বোধোদয় : বুড়ো মানুষের কদর

ছোটো গল্প

0
590

মাহাবুব আলম

তোমার মাকে নিয়ে আর পারছিনা। প্লিজ কিছু একটা করো। শুধু খায় দায় আর ঘুমায়। কোন কাজে আসে না। প্রডাক্টিভ কোন কাজে না আসলে সে মানুষের দরকার কি? 

আজিব কি বলো মিলি! মা কে কি করবো?

-আমি বলিকি তার নিঃসঙ্গতা দুর করার জন্য তার সমবয়সিদের সাথে একত্রে থাকা উচিত। এতে সে মন খুলে কথা বলার, গল্প বলার সুযোগ পাবে।এখানে তার সমবয়সী কোন বন্ধু বান্ধবী না থাকায় তার বড্ড খারাপ লাগে এজন্য এর একটা বিহিত করা দরকার। 

দিপু সাহেব জানতে চায় মিলির কাছে “আসলে কি বলতে চাও ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে সোজাসাপটা বলো”।

মিলি উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষা নেয়া মেয়ে।সদ্য এডভোকেট হয়েছে। তার স্বামী মফিদুল ইসলাম দিপু। মেহের আফরোজ মিলি ও মফিদুল ইসলাম দিপু দম্পতির একমাত্র সন্তান ইফতেখার আহমেদ সিয়াম।

এডভোকেট বউয়ের ইনিয়ে বিনিয়ে বলা কথাটার মর্মার্থ ধরার বাকি রইলোনা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মফিদুল ইসলাম দিপুর।দিপু তবুও জানতে চায় মায়ের কি বিহিত করতে পারি? কি করার কথা বলছো?

  • আমি বরং তার ভালোর জন্যই বলছি 
  • সেটাই বলো।কি করতে চাচ্ছো। ডিরেক্টলি বলো।
  • আমি বলছি কি তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসো। মুলত তার একাকিত্ব দুর করাই উদ্দেশ্য। সে সমবয়সী মানুষ পাবে, গল্প করবে সময় কাটবে যেটা সে বাসায় পায়না।

দিপু চিন্তা করে দেখলো তাইতো। এতে আমাদের উটকো ঝামেলা কমে গেলো আবার সে নিঃসঙ্গতা দুর করার সমবয়সী লোকও পেল।

পড়ার টেবিলে বসে বাবা মায়ের এ কথোপকথন কানে ভেসে আসলো সিয়ামের। কথাগুলো তীরের মত বিধঁতে লাগলো সিয়ামের ছোট্ট কাঁচা হৃদয়ে।হঠাৎ দাদুর মায়াবী মুখটা ভেসে উঠলো সিয়ামের মানসপটে। আমি কি শুনছি! 

সিয়াম মুর্ছা যায় ভেতরে ভেতরে।

পরদিন সিয়াম আবার পড়তে বসে পড়ারটেবিলে  কিন্তু উদাস মন কিছুতেই আজ স্থির হচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর সিয়ামের কানে ভেসে আসলো দিপু-মিলি দম্পতির কথোপকথন। 

  • মিলি, বৃদ্ধাশ্রমে তাকে নিবো কিভাবে? কেউ দেখলে? 
  • ধুরো দেখবে কেন?একটা ঠুলি কিনে আনবা। ঠুলিতে ভরে রাতে গাড়িতে উঠাবো যাতে কেউ দেখতে না পায়, তাকে বলবো আপনি হেটে গাড়ি অবধি যেতে পারবেননা বলে ঠুলিতে ভরে নিচ্ছি এবং গাড়িতে উঠে  আপনাকে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছি। 
  • তাহলে একটা ঠুলি কিনে আনবো আজ।

সিয়াম এক দৌড়ে দাদুর রুমে যায় দাদুকে এক পলক দেখতে।আহা কাল থেকে দাদুকে আর দেখতে পারবো না!! 

দাদু চোখে ঝাপসা দেখে।এক চোখ অন্ধ হয়ে গেছে দিপু যখন শৈশবে।আরেক চোখে অস্পষ্ট সিয়াম কে দেখে মৃদু স্বরে ডাক দিলো, সিয়াম? 

  • হুম দাদু।
  • হঠাৎ এ সময়ে আসলা যে? 
  • দাদু তোমাকে দেখতে মন চাইলো তাই।
  • যাও দাদু গিয়ে পড়তে বসো। তোমার আব্বু আম্মু দেখলে বকা দিবে।

আজ যেহেতু শেষ দিন তাই দাদুর বিছানা একটু ঝেরে দিয়ে মশারী টানিয়ে দিতে উদ্ধত হলো অমনি সিয়াম লক্ষ্য করে দাদুর বালিশের পাশে একটা পুরাতন ডায়েরি। ঢের পুরাতন। ডায়েরিটা সঙ্গোপনে নিয়ে প্রস্থান করে সিয়াম।

সিয়াম ডায়েরি খুলে পড়তে শুরু করে। সিয়ামের দাদুর ভাঙা ভাঙা হাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আজ ১০_০৬_১৯৯১  আমার ছোট্ট দিপুর জন্ম দিন।

১৭-০৬_১৯৯১ আমার সোনামণি কলিজাটার আজ আকিকা। একটা গরু আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করে আকিকা দিয়ে ছোট্রমনিটার নাম রাখলাম মফিদুল ইসলাম দিপু। দিপুর বাবার স্বপ্ন তার ছেলে একদিন দেশসেরা বিচারক হবে। 

দিপু যেদিন প্রথম স্কুলে যায় সেদিন যে আমার কি আনন্দ। দিপুর বাবা দিপুকে নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুলে দিয়ে ওখান থেকে অফিসে চলে যায় দিপুর বাবা। অফিস শেষে ফিরতি পথে  দিপুকে সাথে নিয়ে ফিরে আসে দিপুর বাবা আর আমি পথপানে তাকিয়ে থাকি আমার দিপু কখন ফিরবে?

 আজ কেন যেন বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো! আমার দিপুর কিছু হলোনা তো? না, দিপুর কিছু হয়নি বটে দিপুকে রোড পারাপারের সময় দিপুর বাবা মর্মান্তিক রোড এক্সিডেন্ট করেন। হসপিটালের বেডে আমার কোলে মাথা রেখে দিপুর বাবা হাতটা ধরে বললো দিপুর মা,  হয়তো তোমাকে আজীবনের জন্য নিঃসঙ্গ করে চলে যাচ্ছি। তুমি দিপুকে দেখে রেখো।জীবনের বিনিময়ে হলেও ছেলে কে আমার স্বপ্ন পূরণ করিও। দেখবা তোমার ছেলে একদিন জজ হবে তুমি হবা বিচারকের মা।তোমার বউমা থাকবে, নাতি থাকবে, তোমার নাতীর সাথে খেলবে, গল্প করবে, তোমাকে কখনো আর নিঃসঙ্গতা ছুঁতে পারবেনা। 

এ পর্যন্ত পড়ে সিয়াম চোখের জলে ডায়েরি ভিজিয়ে ফেললো। আহা আমার বাবা দিপু সাহেব আজ সত্যি জজ হয়েছে আমার দাদার বলা সে নাতি আমি আর আমার দাদুর নিঃসঙ্গতা দুর করার মাধ্যম টি আমি। নাহ। কখনোই বৃদ্ধশ্রমে যেতে দিবো না দাদুকে।

সিয়াম দাদুর ডায়েরি পড়তে থাকে। দিপু জানিস তুই একদিন বড় জজ হবি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমি আর নতুন করে সাংসারিক জীবন শুরু করার প্রয়োজনবোধ করিনি।লক্ষ্মী আমার সোনা আমার, তোর মুখটা দেখলেই আমার সব দুঃখ চলে যায়।তোর নানা অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে আবার  বিয়ে দিতে। তারা বলতো এ দীর্ঘ জীবন একাকী কিভাবে পার করবি? আমার দিপুর মুখটা ভেসে উঠতো যখনি তারা আমার বিয়ের কথা বলতো। 

আমার ছেলে একদিন মানুষ হবে,তার সাজানো একটা সংসার থাকবে,বিচারক ছেলের ঘরে ফুটফুটে  নাতি হবে আমার। আমি আমার নাতীর সাথে গপ্পসপ্প করেই কাটিয়ে দিতে পারবো আর এখন আমার ছোট্ট দিপুর মুখটাই আমার একাকিত্ব দুর করতে যথেষ্ট। 

জানিস দিপু তোর বাবা মারা যাওয়ার পর তোর নানা আমাদের আগলিয়ে রাখতো।তোর নানার মৃত্যুর পর তোর মামা বাড়িতে আমি আর তুই তাদের গলার কাটা হয়ে গেলাম। বড্ড কষ্ট হতো যখন দেখতাম আমার ভাইয়ের ছেলেরা ঈদে নতুন জামা পড়ে আর তোকে নতুন জামা কিনে দিতে পারিনা। এমনিতেই তাদেরটা খাই আবার আবদার করি কোত্থেকে। 

একদিন তুই একটা সাইকেলের জন্য বায়না ধরলি মামার কাছে। স্কুলে যেতে একটা সাইকেল দরকার।এ দাবির পর একদিন হঠাৎ তোর মামা মামির খুব ভালো ব্যবহার!

আমি রীতিমতো অবাক!  তাদেরতো তেলেবেগুনে জ্বেলে ওঠার কথা তা না বলে আজ এত ভালো ব্যবহারের কারণ কি?

বাজার থেকে আনা মাছটার মাথা আমার পাতে দিয়ে বললো বোন আমার একটা কথা বলি।আচ্ছা বলেন।

বলছি কি সিয়ামের তো সাইকেল কেনার ও পড়াশোনার খরচ দিতে হয় আর তুইতো আমাদের সাথেই খাস থাকস তাই তোর ভাগের জমিটুকু আমাকে লিখে দে।

এই ছিলো তার আসল কারণ!  বললাম ভাই আমার এতিম বাচ্চাটার আর কিছু থাকলো না তাহলে। শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিতে হবে?

-কেড়ে  নিচ্ছি কই?  তোর থেকে চেয়েই তো নিচ্ছি। 

ভাবি বললো মুখপোড়া শাকচুন্নি! তুই আমারটা খাস আমারটা পড়স এখন কস আমরা জমি কেড়ে নিচ্ছি!  ডাইনি মাগি তুই এখনি তোর পোলা নিয়ে বের হবি বাসা থেকে।

দিপু বাবা আমার, সেই দিন তোর হাত ধরে বের হয়েছি আর সৃষ্টিকর্তা কে বলেছি “খোদা গো, আমার দিপু থেকে আমাকে কখনো আলাদা করো না।”

সিয়ামের এই লাইনটা পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসলো।

” খোদাগো আমার দিপু থেকে আমাকে কখনো আলাদা করোনা” অথচ আগামীকাল রাতে আমার বাবা মফিদুল ইসলাম দিপু দাদুকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর নীলনকশা চূড়ান্ত করে ফেলছে!!

সিয়াম পড়ছে আর কাঁপছে। সিয়াম ভাবছে তার দাদুর এক চোখ অন্ধ কেন? এর পিছনে কি কোন ঘটনা নিহিত আছে?  সিয়াম পৃষ্ঠা উলটাতে থাকলো।হঠাৎ চোখ আটকিয়ে গেলো একটা পৃষ্ঠায়।। 

” দিপু বাবা আমার, একটু মন দিয়ে পড়াশোনা কর।তোর বাবা জীবীত থাকলে এত কষ্ট আমাদের করতে হতো না। 

আজ আমি মোল্লা বাড়ির কাজের বুয়া। এতে আমার দুঃখ নাই বাপ।তুই একদিন মানুষ হবি,আমি হবো জজের মা, এটা তোর বাপের স্বপ্ন।  

জানোস দিপু  তুই মুরগির গোস্তো বড্ড পছন্দ করতিস। একদিন মোল্লা বাড়িতে  পাক করার পর তুই মুরগির গোস্তো খেতে চাইলি।আমি তাদেরকে না জিগ্যেস করে তোকে এক টুকরা গোস্ত কেন দিলাম এজন্য আমার দিকে খুন্তি ছুড়ে মারে আর ঐ খুন্তির আঘাতে আমার চোখের কর্ণিয়ায় মারাত্মক আঘাত পাই এবং ধিরে ধিরে বাম চোখের আলো হারিয়ে ফেলি।

জানোস দিপু তোর বাবার চাকুরির বয়স ১০ বছর না পেরোনোয় কোন পেনশন আমরা পাইনি, কতকষ্টে বাসাবাড়িতে কাজ করে একটা টিনের ঘরে ভাড়া থাকতাম এই আসায় আমার ছোট্ট দিপু একদিন বড় অফিসার হবে, আমার একটা বিল্ডিং ঘর থাকবে।

দিপু বাবা আমার, আজকেই হয়তো শেষ ডায়েরি লেখা। আমার সময় কাটতে না তাই তোকে ঘিরে সমস্ত স্মৃতি ডায়েরিতে টুকে রাখতাম। চোখের যন্ত্রণা বেড়ে যায় উপর হয়ে লিখলে তাই হয়তো আর লেখা হবেনা। বাবা আমার তোর বাবার স্বপ্ন পূরণ করিস আমি বেঁচে না থাকলেও।”

সিয়াম ডায়েরিটা বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো এই ভেবে যে বাবা যদি জানতো!

বাবার হাতে ডায়েরিটা যদি পড়তো তবে হয়তো সে এই নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত নিতে পারতোনা।

আজ সন্ধ্যায় সিয়াম পড়তে বসছে কিন্তু পড়ায় মন নেই।যে করেই হোক দাদুকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ঠেকাতে হবে।

দিপু- মিলি দম্পতি কথা বলছে তাদের উটকো ঝামেলা ফেলে দিতে।দিপু বলছে শুনছো মিলি আজ আসার সময় ঠুলি কিনে নিয়ে আসছি। ঠুলিতে করে গাড়িতে ভরবো যাতে কেউ দেখতে না পায় আর তুমি তাকে বলবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।

দিপু এবার বেরিয়ে আসলো পড়ার টেবিল থেকে। এসে বললো

  • আব্বু  আমি তোমাদের সাথে যাবো।
  • আজিব তুই কই যাবি?
  • তোমরা দাদুকে যে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাবে সেখানে
  • না তোমাকে রাতের বেলা কোথাও যেতে হবে না (মনে মনে, আমরাতো ডাক্তারখাানর বাহানা করছি ডাক্তার খানায়তো যাবোনা।আর ওকে বললই বা কে!)
  • আচ্ছা আব্বু, আম্মু তাহলে ঠুলিটা কিন্তু সাথে করে নিয়ে এসো!!

দিপু আর মিলি তো রীতিমতো অবাক!  সিয়াম ঠুলির কথা জানলোই বা কি করে আর ঠুলি দিয়ে ও করবেই বা কি! 

  • সিয়াম তুই ঠুলি দিয়ে কি করবি বাপ?
  • বাবা তোমরা যখন বৃদ্ধ হবে তখন তোমাদের একাকিত্ব দুর করার জন্য যখন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে যাবো তখন যেন কিনতে না হয় নতুন করে  এজন্যই নিয়ে আসতে বলছি।

দিপু- মিলি দম্পতির হুশ ফিরলো ছোট্ট সিয়ামের হৃদয়ে দাগ কাটা কথাটিতে। থ বনে গেলো দুজনেই মুহুর্তের জন্য। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে দুজনেই বললো আমাদের বাড়ি থেকে আমাদের বের করে দিবি? 

  • না বের না ঠিক, দাদুর মত তোমাদেরও তো  একাকিত্ম দূর করা লাগবে তাই না বাবা বলো? 
  • এবার দিপু মিলি তাদের ভুল বুঝতে পারলো।জড়িয়ে ধরে বললে সিয়াম তুই আমাদের চোখ খুলে দিলি বাপ। তোর দাদুর একাকিত্ব দূর করবি আজ থেকে তুই। আমরা তোর দাদুর কাছে যেতে বারণ করতাম এটা ভুল ছিলো।একমুহূর্তও যেন তোর দাদু একাকী ফিল না করে। আমরা অফিস থেকে ফিরেই একসাথে তোদের সাথে আড্ডা দিবো।

সিয়ামের আনন্দ আর কে দেখে।আনন্দে আপ্লূত হয়ে গেল সিয়াম। 

সিয়াম এক দৌড়ে ওর পড়ার টেবিলে গিয়ে দাদুর লেখা ডায়েরিটা বের করে বাবা মফিদুল ইসলাম দিপুর হাতে দেয়। মা -বাবা দুজনেই ডায়েরী টা পড়ে আর তাদের অশ্রুতে সিক্ত হচ্ছে ডায়েরির প্রত্যেকটা পাতা।

 আহা কতবড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম আমরা। আল্লাহ সিয়ামের উছিলায় আমাদের এ গর্হিত কাজ থেকে রক্ষা করেছেন আর মা নিজেও যেহেতু জানেনা আমরা কি করতে যাচ্ছিলাম তাই তার কাছে লজ্জাও পেতে হবে না শুধু আল্লাহর কাছে লজ্জায় মাথা পেতে আত্মসমর্পণ করলাম আর এ নিয়তি করলাম আমরা যখন বৃদ্ধ হবো আমরাও যেন আমার সন্তান থেকে আলাদা না হই যেভাবে আমার মা বলেছিলেন 

” খোদা গো আমার দিপু থেকে আমাকে কখনো আলাদা করো না “

আমিও মিনতি করি তোমার দরবারে  ” খোদাগো কখনো আমার সিয়াম হতে আমাকে আলাদা করো না”।

 আল্লাহর মেহেরবাণীতে দিপু মিলি ভুল বুঝতে পেরে যখন নিজেদের শুধরে নেয় তখন তাদের মিনতিও কবুল করেন মহান আল্লাহ। 

সে এক ভিন্ন গল্প, ততদিনে মিলি -দিপু দম্পতি আশাতিপর বৃদ্ধ -বৃদ্ধা । ইফতেখার আহমেদ সিয়াম তখন পূর্ন যৌবনে। মস্তবড় ব্যারিস্টার।নাম ধাম ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। একনামে সবাই চিনে ব্যারিস্টার ইফতেখার আহমেদ সিয়াম। সেই ছোট্র সিয়াম আজ বড় হয়েছে,সংসার হয়েছে। 

সেই ছোট্ট সিয়াম যার কাঁচা হৃদয়ে দাগ কেটে গিয়েছিল দাদুর ডায়েরির গল্প পড়ে। সিয়াম ভাবে আমার বাব মাও আমার দাদুর মত আমাকে নিয়ে হয়তো অনেক স্বপ্ন দেখেছে চাই সে কাগজের ডায়েরিতে লিখুক বা হৃদয়ের মানসপটে লিখুক। 

সিয়াম বাবা মায়ের  খেদমতে আত্মনিয়োগ করা যুবক।হঠাৎ ব্যত্যয় ঘটে সরকারি এক আদেশে। দেশের নতুন রাজা হয়েছেন সাতাশ বছরের তাগড়া যুবক প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসী। সদ্য রাজা উপলব্ধি করলেন বৃদ্ধ -বৃদ্ধা সমাজের বোঝা, রাষ্ট্রের বোঝা। এরা খায় দায় আর প্রডাক্টিভ টাইম নষ্ট করে।সোজা কথায় তাদের বৃদ্ধা শ্রমেও রাখার পক্ষপাতী নয় নতুন রাজা কারণ তাতে রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয় হবে।যেমনটি আজ থেকে সাতাশ বছর আগে ভেবেছিল এডভোকেট মেহের আফরোজ মিলি। 

নতুন রাজা অধ্যাদেশ জারি করলেন আজ থেকে আমার রাজ্যে কোন বৃদ্ধ- বৃদ্ধা থাকতে পারবেনা। আজ থেকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সকল বৃদ্ধ -বৃদ্ধা কে নিজ নিজ সন্তান তাদের আপন আপন পিতা মাতাকে গহীন জঙ্গলে বা সাগরের কোন দ্বীপে রেখে আসতে হবে।  এতে নিজ হাতে হত্যা করা লাগবে না অধিকন্তু আমার রাজ্য আনপ্রডাক্টিভ লোক থেকে মুক্ত হবে। আমার রাজ্যের সকল লোক হবে প্রডাক্টিভ, কর্মঠ।আর এটাই চূড়ান্ত আঈন।কেউ এ আঈন ভঙ্গ করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

এই সংবাদ পৌছে গেল আশাতিপর বৃদ্ধ- বৃদ্ধা দিপু -মিলি দম্পতির কানেও। বিচলিত সকল সন্তান।  এ কেমন আদেশ। কি আর করা! সিয়াম বাদে অন্যানন্য সন্তানেরা তাদের মা কেউ বা তাদের বাবাকে টুকরিতে করে মাথায় নিয়ে গভীর জঙ্গলে রেখে আসে। 

একসন্তান দেখে মাকে টুকরিতে ভরে মাথায় করে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় গাছের পাতা ছিঁড়ছে! 

হঠাৎ হঠাৎ গাছের পাতা টান দেয়ায় টুকরিটা কেঁপে ওঠে।  সন্তান জিগ্যেস করলো মা তুমি এভাবে গাছের পাতা ছিঁড়ছো কেন? 

মা জবাব দেয় “বাবারে, আমাকে রেখে আসার পর তুই যাতে পথ হারিয়ে না ফেলিস এই গভীর জঙ্গলে তাই আমি তোর মাথার উপরে থেকে গাছের পাতা ছিঁড়ে তোর পথে বিছিয়ে যাচ্ছি যেন পথ চিনতে ভুল না করিস।”

মায়ের কথা শুনে বাকরুদ্ধ সন্তান। যে মাকে মৃত্যুমুখে ফেলতে যাচ্ছি সে মা আমার নিরাপদ ফিরতি যাত্রায় উদ্বিগ্ন নিজেকে ভুলে!

আকাশ পানে হাত তুলে জঙ্গলের মাঝে সন্তান চিৎকার করে বলে “খোদা গো আমার মাকে তুমি রক্ষা কইরো, তোমার কাছে রেখে গেলাম “

আদেশ জারির দশম দিন চলে কিন্তু ইফতেখার আহমেদ সিয়াম নির্বিকার। বাবা মফিদুল ইসলাম দিপু আর মা মেহের আফরোজ মিলি তাদের সন্তানের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। 

  • বাবা সিয়াম তুই আমাদের ফেলে আস।নইলে পঞ্চদশতম দিনের পর তোকে এসে সরকারি লোক ধরে নিয়ে যাবে আর ফাঁসির রশিতে ঝুলাবে।ঝুলাক তবু তোমাদের ছাড়া আলাদা থাকা পসিবল না।পাগলামি করিসনা বাবা।

মিলির আজ সাতাশ বছর আগের কথা মনে পড়ে।আমার কোনভাবেই মনে চাচ্ছে না আমার কলিজা ছেড়াধন সিয়াম কে রেখে কোথাও যাই যদিও এটা সরকারি আদেশ। আহা কতবড় জুলুম করতে যাচ্ছিলাম আমরা তখন। নতুন রাজার এই অমানবিক আদেশের পর তাকে যেমন জুলুমবাজ মনে হয় আজ থেকে সাতাশ বছর আগে  আমরাও জুলুমবাজ ছিলাম যদিও আমাদের কোন সরকারি আদেশ ছিলো না বৃদ্ধ -বৃদ্ধা কে বাড়ি ছাড়া করার অথচ তাই করতে গিয়েছিলাম আর এখন সরকারি আদেশ সত্যেও আমাদের কে বাড়ি ছাড়া করতে নারাজ আমার সিয়াম।

 আয় বাবা বুকে আয় এ বলে সিয়ামকে বুকে জড়াইয়া নিলো বৃদ্ধ  মা মেহের আফরোজ মিলি। তার পুত্রবধূর অমায়িক ব্যবহারে সে যেমন আনন্দিত আবার প্রথম জীবনের কথা স্মরণ করে লজ্জিতও হন মেহের আফরোজ মিলি 

ইফতেখার আহমেদ সিয়ামের স্ত্রী সুচনা সিয়াম হাসনাহেনা একজন গুণবতী প্রত্যুতপন্নমতী নারী। 

তিনিও উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তা। পদবিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারি হুকুম তামিল করাই তাদের কাজ তাই সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে তাদের কিছুই করার সুযোগও নেই। এতদসত্ত্বেও সে তার শ্বশুর -শ্বাশুড়িকে বাড়ির বাইরে নির্বাসনে দিতে নারাজ। আবার সরকারি  আদেশ লঙ্ঘনে স্বামীর প্রাণ নাশের আশংকা। পুরো বাড়ির সবাই পেরেশান।

হঠাৎ বুদ্ধি খেলেগেল তার মাথায়। বললো আব্বু আম্মু কে ফেলাতেও হবে না আর তোমাকেও হারাতে হবে না।

সিয়াম ও তার বাবা মা হা করে তাকিয়ে আছে

হাসনাহেনার দিকে। এবার মনের ভিতর থেকে ঢুকরে উঠলো আহা বউ মা যদি কোন উপায় বের করতে পারে যাতে আমাদের সন্তানকেও হারাতে হবে না আর আমাদেরও নির্বাসে থাকতে হবেনা। মফিদুল ইসলাম দিপুর সাতাশ বছর আগে করা একটা দোয়ার কথা মনে পড়ে বউমা হাসনাহেনার আশাবাদী কথা শুনে । 

যখন সিয়ামের দেয়া তার দাদুর ডায়েরিটা দিপু হাতে নিয়ে পড়ছিলো তখন মায়ের একটা দোয়া লিখা দেখে সেও দোয়া করেছিলো ” খোদা গো আমার সিয়াম থেকে আমাকে কখনো আলাদা করো না “

আহা আজকি তাহলে সে দোয়ার ফল পেতে যাচ্ছি বউমার বুদ্ধির বদৌলতে।  মায়ের দোয়া যেভাবে কবুল হয়েছিল সেভাবে কি আমারটাও কবুল হলো তাহলে?

  • বউ মা বলো কি সে উপায়?

-বউ মা  হাসনাহেনা বলতে শুরু করলো।হাসনাহেনা কথা বলতে শুরু করতে না করতেই প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসীর রাজ ফরমান মাইকে ভেসে আসলো। প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক গলিতে গলিতে মাইকিং করে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে রাজ ফরমান ঃ-“আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। এই পাঁচ দিনের মধ্যে কেউ রাজ ফরমান বাস্তবায়ন না করলে, প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসীর আঈন মেনে নিজ নিজ বাবা মাকে নির্বাসনে না পাঠালে তার সাজা মৃত্যুদণ্ড”
সবাই মুহুর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। সাঁ করে রিক্সাটা হাসনাহেনার সরকারি বাংলোর দেয়াল ঘেঁষে অতিক্রম করলো। এতদিন আশাতিপর  দিপু-মিলি দম্পতি রাজ ফরমানের কথা কানাঘুষা করে লোক মুখে শুনেছে মাত্র আর আজ নিজ কানে শুনলো।
মুহুর্তের মধ্যে বাবা মায়ের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। পুত্রবধূ যদি কার্যকর কোন উপায় বের করতে না পারে তাহলে হয় আমাদের নির্বাসনে যেতে হবে নয়তো আমাদের কলিজার টুকরা সিয়ামের মৃত্যুদণ্ড হবে।সূচনা সিয়াম হাসনাহেনা সবাই কে আশ্বস্ত করলেন। আপনারা ঘাবড়ে যাবেননা।মহান স্রষ্টার কৌশল রাজ ফরমানের চেয়ে বেশি কার্যকরি।তিনি তার বান্দাদের উত্তম কৌশল শিক্ষাদেন। সিয়াম, বাবা মফিদুল ইসলাম দিপু ও মা মেহের আফরোজ মিলি কিছুটা আশ্বস্ত হন। 
হাসনাহেনা তার পরিকল্পনা পেশ করতে যাচ্ছেন তার স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ীর সম্মুখে।_আমাদের বাংলোর ঠিক পিছনে কিছুটা খালি জায়গা পড়ে আছে…..। এটুকুন কথা বলতে না বলতেই ক্রিং ক্রিং বেজে উঠলো হাসনাহেনার ফোন। চারদিকে রাজ্যের উৎকন্ঠা। হাসনাহেনার চেহারায়ও কিছুটা বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে ফোনটি পেয়ে। হাসনাহেনাকে উদ্বিগ্ন দেখে শ্বশুর মফিদুল ইসলাম দিপু জিগ্যেস করে– মা,  কে কল দিয়েছে? — বাবা, আমার উর্ধতন কর্মকর্তা কল দিয়েছেন। ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেড। পদবিতে উপসচিব। যাকে সবাই ডিসি বলে জানে। — কল রিসিভ করো। পাছে তোমার সমস্যা হতে পারে। নির্ভয়ে কথা বলো।যদি বাধ্য হও আমাদের নির্বাসনে দিতে আমরা দুজনেই হাসিমুখে মেনে নিয়ে চলে যাবো নির্বাসনে।আমার ছেলে সিয়ামের মৃত্যুদণ্ড আর আমার লক্ষ্মী পুত্রবধূর চাকুরিতে কোন সমস্যা হোক এটা আমরা কখনোই মেনে নিতে পারবোনা।আমরা জীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসছি মা।এখন বিদায়ী ঘন্টা বাজছে।তোমরা আমাদের জন্য বিপদ ডেকে এনোনা।– না বাবা, এমন কথা মুখে আনবেন না।আমরা শিঘ্রই আলোর পথ দেখতে পাবো।কোন একটা বিহিত হবে। আপনি সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখুন।ফোন পূনরায় বেজে উঠলো। ক্রিং ক্রিং……
স্যার আসসালামু আলাইকুম। -ওয়ালাইকুম সালাম হাসনাহেনা।  আপনাকে রাজ ফরমান বাস্তবায়নে আগামীকাল মোবাইল কোর্ট পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আপনি আপনার টিম নিয়ে যথাযথ দায়িত্বপালন করবেন। – ওকে স্যার। হাসনাহেনা কিছুটা চিন্তিত।  হাসনাহেনার উপর দুটি গুরুদায়িত্ব পড়লো । প্রথমমত স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ী কে প্রটেক্ট করা আবার সরকারি আদেশ বাস্তবায়ন করতে মাঠে নামা।দুটোকাজই পরস্পর বিপরীত তবুও তাকে করতেই হবে। 
হাসনাহেনা তার পরিকল্পনা পেশ করেন। যা করার আজকের মধ্যেই শুরু করতে হবে। আমাদের বাংলোর পিছনের খালি জায়গাটাতে রাতের আধারে খুব সতর্কতার সাথে গোপনে একটা বাঙ্কার বানাবো। সেখানে বসবাসের উপযোগী করে আব্বু আম্মুকে রেখে দিবো আর সময় করে আমরা খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে আসবো। এতে আব্বু আম্মুর আমাদের সাথেই থাকা হবে আর সরকারের সেনাবাহিনী খোঁজ করতে আসলেও পাবেনা।আপাতত এই সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করি দেখা যাক কি হয়। 
অগত্যা সবাই মেনে নিল। যেমন কথা তেমন কাজ।বাঙ্কার বানিয়ে শ্বশুর শাশুড়ীকে খাবার সমেত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসমেত বাঙ্কারে রেখে আসে সিয়াম-হাসনাহেনা দম্পতি। নিয়মকরে দুজনেই বাবা মাকে দেখে আসে আর রাজ্যের সমস্ত আপডেট তাদের কে জানায়। দিপু -মিলি দম্পতি সন্তুষ্ট এই ভেবে যে অন্তত বউ -ছেলের সংস্পর্শেই আছি।তারাতো দেখভাল করেই পাশাপাশি আমার সিয়াম ও বউমার কোন ক্ষতি হলোনা আর আমাদেরও নির্বাসনে যেতে হলোনা।
সিয়ামের মা বাঙ্কারে হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে– “খোদা গো,আমার সিয়াম যে ভালোবাসা আমাদের দেখালো আমরা সন্তুষ্ট। তুমিও আমার সিয়ামের পরিবারের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।তুমি আমার সিয়াম কে এ রাজ্যের মন্ত্রী বানিয়ে দিও”
আমিন বলে মোনাজাত শেষ করতেই দিপুও বলে উঠলেন আমিন। দিপু মনে মনে ভাবেন আমার মা যে দোয়া করতো সেগুলো কবুল হতো তাহলে আমার সন্তানের মা যে দোয়া করেছেন তাও নিশ্চয়ই কবুল হবে।দিপু শৈশবে ধর্মীয় বইতে পড়েছিলো মা -বাবা সন্তানের জন্য যে দোয়া করে আবার সন্তান তার মা বাবার জন্য যে দোয়া করে তাও সরাসরি কবুল হয়। সুতরাং দিপু আজ মনে মনে দেখতে চাইলেন দেখি মিলির দোয়া আসলে ফলে কিনা।
প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসীর ফরমান পুঙ্খানুপঙ্খুরূপে বাস্তবায়ন হয়েছে প্রায় এক মাস হতে চললো।রাজ্যে কোন বৃদ্ধ -বৃদ্ধা নাই।সবাই কর্মঠ শুধু শিশুরা ছাড়া। এতদিন যে সমস্ত পরিবার তার বাবা মাকে উটকো ঝামেলা মনে করতে তাদের মন ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে ওঠে মা বাবার স্মরণে। পুরো বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা লাগে।শিশুদেরও কোলাহল নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে তাদের দাদা-দাদুকে হারিয়ে। পুরো রাজ্য জুড়ে কেমন যেন সুনসান নিরবতা। কি এক অজানা শুন্যতা কাজ করছে প্রত্যেক ঘরে।
নতুন বাদশা প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসী হঠাৎ ফের এক ফরমান জারি করলেন।আমি আমার রাজ্যে টেকনোক্রেট মন্ত্রী নিয়োগ দিতে চাই। এই মন্ত্রী পদে নির্বাচিত হতে তাকে দুটি বুদ্ধিমত্তা টেস্টে উত্তীর্ণ হতে হবে। যে এই দুটি পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হবে সেই হবে আমার মন্ত্রীপরিষদের মন্ত্রী। পরীক্ষা দুটো নিম্নরূপ:-১) প্রথম পরীক্ষা তাকে ছাই দিয়ে রশি বানিয়ে দেখাতে হবে।২) জনসম্মুখে তাকে বিনা ঢুলিতে ঢোল বাজিয়ে দেখাতে হবে। অর্থাউ কোন বাদক থাকবেনা কিন্তু ঢোল বাজবে।
রাজ্যের সকল যুবাদের কপালে চিন্তার ভাজ।ছাই ভস্ম দিয়ে রশি!  এও সম্ভব!!এ কি করে সম্ভব। যে ছাই বাতাস উড়ে যায় আর সে ছাই দিয়ে রশি পাকিয়ে দেখাতে হবে!নাহ এ সম্ভব না।একই ব্যক্তিকে দুটো পরীক্ষায় পাশ করতে হবে! ঢোল না হয় বানালাম বাট ঢোল ধরা ছোঁয়া ছাড়া বাজাবো কিভাবে?নাহ এ অসম্ভব কে সম্ভব করা রাজ্যের কারো পক্ষে সম্ভাব না।
সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু সিয়াম আশা ছাড়তে নারাজ।সিয়ামই শুধু ভড়কে যায়নি কারণ সিয়ামের ভরসা বৃদ্ধ বাবা মায়।সিয়ামের ধারণা রাজ্যে কোন বৃদ্ধ মানুষ নাই সুতরাং অভিজ্ঞতার ঝুলি সকলের শুন্য আর আমার বাবা মা রয়েছেন বাঙ্কারে যাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ এবং তাদের অভিজ্ঞতায় কোন একটা বিহিত অবশ্যই হবে।
রাজ ফরমান পাওয়ার সাথে সাথে সিয়াম বাসায় ছুটে যায়।রাতের আধারে বাঙ্কারে প্রবেশ করে সিয়াম। রাজার ফরমান বাবা মাকে জানানোয় সাথে সাথে বৃদ্ধ বাবা মফিদুল ইসলাম দিপু জানান এটা কোন ঘটনাই না। তুই ই হবি এই পরীক্ষার একমাত্র বিজেতা আর তোর মার দোয়াও কবুল হবে।-মায়ের দোয়া? মানে কোন দোয়া? কিসের দোয়া? বাবা মফিদুল ইসলাম দিপু জানান তোর মা হাত তুলে দোয়া করেছে খোদা গো আমার সন্তান কে তুমি মন্ত্রী বানিয়ে দিও আর আমার বউ মা যেন হতে পারে মন্ত্রীর স্ত্রী। আচ্ছা বাবা শোন তোকে বুদ্ধি দিচ্ছি। যেভাবে বলি সে ভাবেই করবি তাহলে দুটো টেস্টেই অতিক্রম করতে পারবি আর তুই মন্ত্রী হয়ে যাবি।
বাবা বলো।আমি এ ভরসাটাই করতেছিলাম তাহলে মন দিয়ে শোন। তুই রাজদরবারে গিয়ে বলবি আমি আপনার দুটো পরীক্ষায় ই অংশ নিতে চাই এবং দুটো পরীক্ষাতেই আমি শতভাগ সফল হবো এ আমার বিশ্বাস। তখন সে দিনক্ষণ ঠিক করে দিবে।দেখ কোনটার পরীক্ষা আগে নিবে? যদি আগে রশি বানাতে বলে তবে বলবি আমি গ্রামের বাড়িতে ছাই দিয়ে রশি বানিয়ে রাখবো আপনি আপনার লোক সমেত পরীক্ষা করে আসবেন।যেহেতু গ্রাম ছাড়া ছাই এই শহরে পাওয়া দুষ্কর তাই ছাই দিয়ে রশি বানানোর পরীক্ষাটা গ্রামে দিতে চাই আর যদি ঢোল বাজাতে বলে তাহলে সমস্যা নেই আগে হোক বা পরে ঢোল রাজদরবারে সমবেত লোকের সামনেই বাজিয়ে দেখাবাে এ কথা বলবে। এরপর আমাকে জানাও।
রাজার  দরবারে গিয়ে সিয়াম জানতে পারে কেউ ই রাজার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তেমন  সাড়া দেননি কারণ প্রত্যেকেই রাজার এই পরীক্ষা পদ্ধতি কে অসম্ভব ধরে নিয়েছেন। যখন কোন ব্যক্তি সম্ভাবনা কে সম্ভব না হিসেবে দেখে তখন তারজন্য সম্ভাবনার দ্বার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
রাজদরবারে সিয়াম জানতে পারে প্রথম  পরীক্ষা হবে ছাই দিয়ে রশি বানানোর পরীক্ষা। তখন সিয়াম তার দাবি পেশ করে রাজদরবারে যেন তাকে গ্রামের বাড়িতে রশি বানানোর অনুমতি দেয়া হয়।রাজা অনুমতি দিলেন। বাবাকে গিয়ে সিয়াম জানালো বাবা আগামী সপ্তাহে আমার ছাই দিয়ে রশি বানানোর দিন ধার্য হয়েছে।এখন আমাকে পদ্ধতি বলে দিন।
বাবা বলতে লাগলেন, গ্রামের বাড়ি গিয়ে একটা মোটা রশি পাকিয়ে নিবে পাট দিয়ে অতঃপর একটা বদ্ধ ঘরের মাটির মেঝেতে টান করে সরল রেখা বরাবর রেখে একপ্রান্তে একটা প্যারাক মারবে মাটির সাথে আরেক প্রান্তে আরেকটি প্যারাক মারবে।অবশেষে একটি ম্যাচকাঠি দিয়ে রশির একপ্রান্তে আগুন ধরিয়ে দিবে।আগুন যথারীতি একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌছে যাবে আর পুরো রশি পুড়ে অবিকল রশির মতোই ছাই হয়ে যাবে। যেহেতু বদ্ধঘর তাই বাতাস প্রবেশ করতে না পারায় সেখানে পড়ে থাকা ছাইকে মনে হবে ছাইদিয়ে পাকানো রশি। 
বাবার বুদ্ধি বেশ মনে ধরেছে সিয়ামের।বাবার কথামতো সে ছাইয়ের রশি বানিয়ে রাজদরবারে খবর দিল।রাজা তার রাজকর্মচারি ও সভাসদদের নিয়ে সিয়ামের গ্রামের বাড়ি গিয়ে যখন দেখলো আজিব এতো ছাইয়ের ই রশি!!চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। তারা হাত দিয়ে চেক করে দেখলো হ্যাঁ এটাতো ছাই ই!বাদশাহ প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসী খুসি হয়ে উপস্থিত সভাসদদের সামনে ঘোষণা দিলেন পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা উপহারের।
পরের পরীক্ষা নেক্সট  উইকে নেয়া হবে রাজদরবারে সকল সভাসদ ও জনসাধারণের উপস্থিতিতে।যদি সিয়াম বিনা ঢুলিতে ঢোল বাজিয়ে দেখাতে পারে তবেই সিয়াম মন্ত্রী হয়ে যাবে। সিয়াম বাদশার দেয়া উপহারের ৫০ হাজার স্বর্ণ মু্দ্রা নিয়ে বাবা-মায়ের হাতে দেয় আর তার পরবর্তী পরীক্ষার কথা জানায় তাদের।
সিয়ামের বাবা দ্বিতীয় পরীক্ষার পদ্ধতি বলে দিচ্ছে আর সিয়াম শুনছে গভীর মনযোগ দিয়ে।সিয়াম তুই একটা ঢোল কিনে নিয়ে আসবি বাজার থেকে। অতঃপর ঢোলের একপ্রান্তে আটকানো থাকবে আর অপর প্রান্ত খুলে সেখান দিয়ে মৌচাক থেকে বহুসংখ্যক মৌমাছি ঢোলের ভিতরে ভরে খোলা প্রান্ত চামড়া দিয়ে আটকিয়ে দিবি। সকল মৌমাছি একযোগে বের হওয়ার জন্য তারা মাথা দিয়ে ঢোলের দু’প্রান্তে গুতা দিবে এতে ঢোলের চামড়ায় কম্পনের সৃষ্টি হয়ে বেজে উঠবে আর মৌমাছির  সমবেত পাখার গুঞ্জরনে মৃদু শব্দ বয়ে যাবে এতে এক সুরেলা ব্যাঞ্জনা তৈরি হবে যা সকলকে মুগ্ধ করবে।
সিয়াম পরের সপ্তাহে যথারীতি বাবার পরামর্শ মত ঢোল বানিয়ে যখন রাজদরবারে সকলের সামনে ঠাস করে নিচে ঢোল ফেলাতেই ঢোলের ভিতরে থাকা সকল মৌমাছি একযোগে বের হওয়ার জন্য গুতাগুতি শুরু করলো ফলে ঢোল আপনাআপনি বেজে উঠলো। মৌমাছির সমবেত গুঞ্জরণ আর ঢোলের চামড়ায় বের হওয়ার জন্য উপর্যপুরি গুতায় ক্রিং ক্রিং ঝিং ঝিং শব্দে সকলে মাতোয়ারা হয়ে গেল।
বাদশা প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বের হয়ে গেল বাহ কি চমৎকার ।কি কারিশমা দেখালো ছেলেটা অথচ ঢোলটা হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখলোনা।আমি যেমনটা চেয়েছি ঠিক তেমনি করে দিখিয়েছে। ঢোলের আভ্যন্তের ঘটা কাহিনি তো বাদশার অজানা।আরো অজানা এ কারিশমার পিছনের ঘটনা।আনন্দের আতিশয্যে তার জন্য বাদশা এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করে তাকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দিলেন।
চারদিকে ইফতেখার আহমেদ সিয়ামের জয়জয়কার। ব্যারিস্টার ইফতেখার আহমেদ সিয়াম থেকে এখন মাননীয় মন্ত্রী জনাব ইফতেখার আহমেদ সিয়াম। সিয়ামের মন্ত্রী হওয়ার সংবাদে বাঙ্কারে থাকা সিয়ামের মা বাবা দিপু ও মিলি দম্পতি শুকরিয়া সেজদায় লুটিয়ে পড়ে।দিপুর আজ মনেপ্রাণে বিশ্বাস হলো সন্তানের জন্য মা যে দোয়াই করেন না কেন সরাসরি তা কবুল হয়ে যায়।
সিয়াম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন দক্ষতার সহিত।একদিন খোদ বাদশা প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসী সিয়ামকে ডেকে পাঠালেন তার কার্যালয়ে। তার কালজয়ী অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পিছনের গল্প শুনতে চান।সিয়াম আমতা আমতা করে পাছে বাবা মায়ের কথা জানলে বাদশা না জানি পূর্বে জারি করা মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের নির্দেশ দেন তার বাবা মাকে নির্বাসে না দেয়ার জন্য। সিয়াম বাদশার কাছে নির্ভয়ে সত্য বলার অনুমতি চান যেন তাকে কোন পানিশমেন্ট দেয়া না হয়।বাদশা অভয় দিলেন। সিয়ামের প্রতি বাদশার একটা সফ্টকর্ণার তৈরি হয়ে গেছে এতদিনে।
সিয়াম জানালো তার সফলতার পিছনে পুরো অবদান তার বৃদ্ধ বাবা মায়ের যাদেরকে বাদশা অকেজো ভাবতেন।  বাদশা যাদের কে ভাবতেন এরা সমাজের বোঝা,প্রডাক্টিভ কোন কাজে না আসায় রাজ্যের সকল বৃদ্ধ -বৃদ্ধাকে যিনি গভীর জঙ্গলে এবং সাগরের কোন দ্বীপে নির্বাসনে ফেলে আসার ফরমান জারি করেছিলেন সে বাদশাকে সিয়াম পুরো ঘটনা খুলে বললেন। অপরিপক্ক বাদশা এবার তার ভুল বুঝতে পারলেন।বড্ড ভুল হয়ে গেছে। বৃদ্ধ মানুষের অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞান ব্যতিত কোন জাতি সামনে আগাতে পারেনা। তিনি বুঝতে পারলেন গাধা আজিবন পরিশ্রম করলেও বনের রাজা হন সিংহই। কর্মঠ জেনারেশনের পাশাপাশি অভিজ্ঞতালব্ধ বয়স্ক মুরুব্বি মানুষের সুপরামর্শ ব্যতিত একটা পঙ্গু প্রজন্মের জন্ম হবে।
তিনি ফের ফরমান জারি করলেন  যেন আপন আপন বাবা মাকে নিজ নিজ সন্তান খুঁজে নিয়ে আসে।তাদেরকে রাজকীয় ভাবে বরণ করা হবে রাষ্ট্রের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে এবং পরিবারের স্বার্থে। যদি মুমূর্ষও হয় তবুও যেন তাদের ফিরিয়ে আনা হয়।রাষ্ট্রিয় খরচে তাদের সর্বচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে।
বাদশাহ প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসীর সংশোধিত ফরমানে রাষ্ট্রে খুশির আমেজ বইতে শুরু করলো। সেই সন্তান যার মা তার ফিরতি পথে গাছের পাতা বিছিয়ে রেখেছিল যেন সন্তান তার পথ হারিয়ে না ফেলে সেই মাকে আনার জন্য দেয় এক ভো দৌড়। মনে মনে আওড়াতে থাকে সৃষ্টিকর্তার নাম মা যেন জীবিত থাকে। “মাকে ফেলে আসার সময় আকাশ পানে তাকিয়ে চিৎকার করে বলেছিলাম, খোদাগো মাকে তোমার কাছে রেখে গেলাম,তুমি দেখে রেখো।খোদা ডাকে সারা দিয়েছেন। মা গাছের পাতা,ফলমূল কুড়িয়ে খেয়ে কোন রকম বেচে আছেন।মুমূর্ষ মায়ের দিকে তাকানো যায়না।মা বলে মৃদু ডাক দিতেই চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো।মা সন্তানের এ মিলন মেলায় একাকার হয়ে গেল আকাশ পাতালের সকল সুখ দুঃখ। “
বোধদয় হলো সাতাশ বছরের তাগড়া যুবক অপরিপক্ক বাদশা প্রিন্স খালিদ ফেরদৌসীর আরো বোধদয় হলো মফিদুল ইসলাম দিপু ও মেহের আফরোজ মিলি দম্পতির।তারা বুঝতে পারলেন বুড়ো মানুষের কদর।

লেখক: শিক্ষাথী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here