প্রতারণা

ছোটগল্প

0
1263

নাহিদ নেওয়াজ

কোনো এক সাধারণ বিকেলে ব্যালকোনিতে বসে দেখছে বিকেলের কাঁচা সোনা রোদে ইট কাঠে ঘেরা প্রকৃতি। চারপাশে শুধু বড় বড় বাড়ি। কোনো কোনো বাড়ির ছাদে নানা রকম অজানা গাছের সমারোহ। দেখতে বেশ সুন্দর। কোনো ছাদ ফুলের টব, কবুতরের নীড়ে সাজানো। একটা ছাদে দুটো খরগোশ ছানা। স্বর্ণ বই নিয়ে খরগোশ ছানা দুটো দেখতে ব্যালকোনিতে আসে। ছানা দুটিকে মনে হয় একে অপরের সঙ্গী। তবে আজ দেখা যাচ্ছে একটি খরগোশ ছানা চুপটি করে ছাদের এককোণে বসে আছে। বাড়িগুলো দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরটা দেখা যায় না। সবগুলো বাড়ি কালো কাঁচে ঘেরা। এটিই হয়তো নিরাপত্তা। আকাশে দুলছে আলো ছায়ার খেলা। কখনও উজ্জ্বল রোদ তো আবার কখনও ছায়া। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেগুলো এলাকার ভেতরের গলিতে খেলা করছে। সারি সারি কাক আর চিল উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো সারি সারি ভাবে সাজানো। দেখে মনে হচ্ছে আকাশের অলংকার যা কিনা আকাশের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুণ। মনে হয় যেন আকাশটা বেশি দূরে না। এইতো হাত বাড়িয়েই মেঘ ছোঁয়া যাবে। ব্যালকোনির আশে পাশে গ্রীলের বাইরে প্রজাপতি, ফড়িং এর মতো কিছু একটা দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে। স্বর্ণ মনে মনে ভাবে প্রকৃতির সব কিছুই যেন দলবদ্ধভাবে থাকতে ভালোবাসে। আজকের বিকেলটা প্রতিদিনের মতো সাধারণ। তবু আজকের বিকেলের সৌন্দর্য স্বর্ণ’র কাছে অপরূপ রূপে ধরা দিয়েছে। প্রকৃতির সব কিছুই অসম্ভব সুন্দর অনুভব হচ্ছে তার। আজ স্বর্ণের বিয়ে ঠিক হয়েছে। স্বর্ণ ভাবছে, শুরু হতে যাচ্ছে তার নতুন জীবন। এই জীবনে সে সর্বোচ্চ সুখটা অর্জন করবে। কল্পনার জগতে স্বর্ণ তার পতিদেবতাকে রাজপুত্রের মতো কল্পনা করেছিল। আজ তাদের দেখা হয়েছে। স্বর্ণের নিলয়কে খুব পছন্দ হয়েছে। অত্যন্ত সুদর্শন এই ছেলেটি যে কোনো মেয়েকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। স্বর্ণ নিলয়ের সাথে কথা বলে। আরো অবাক হলো একটি ছেলে এত সুন্দর। অথচ কি শান্ত, ভদ্র সাধারণ কথার মধ্যেই জাদু আছে। চাহনিতে নেশা আছে। কোনো উপমাই যেন সঠিক মনে হচ্ছে না। আনন্দ চিত্তে বিহ্বল স্বর্ণের কাছে নিলয়ের যোগ্য কোনো উপমাই নেই। নিলয় স্বর্ণকে বলেছে তোমায় আমি মায়াবতী বলে ডাকবো। কথাটা ভাবতেই স্বর্ণর মুখ লাল হয়ে গেল। সে বসে বসে ভাবতে থাকলো। আচ্ছা, ভালো লাগাটা কি এক দেখাতেই এতোটা গাঢ় হতে পারে? নাকি নিলয়কে সে একটু বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। এও কি সম্ভব, এক দেখাইতে এতোটা কল্পনা। যদিও নিলয়-স্বর্ণ’র প্রথম দেখা রাস্তার ধারে স্বর্ণর কলেজের কাছে। নিলয় বলেছিল, আপনার নাম কী? খুব সহজ ভাবে স্বর্ণর উত্তর ছিল স্বর্ণা আহমেদ। নিলয় সরাসরি তার বাড়ির ঠিকানা আর বাবার নাম জিজ্ঞেস করেছিল। স্বর্ণও চোখে চোখ রেখে উত্তর দিয়েছিল। এখন স্বর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। অসম্ভব মায়াবতী দেখতে স্বর্ণ। টলমলে জলে ভেসে থাকা পদ্মের মত। শিল্পীর হাতে নিঁখুত সৃষ্টি যেন স্বর্ণ। হরিণী চোখ দুটোতে যেন পৃথিবীর সকল মায়া এসে ভর করেছে। ঠোঁট দুটো ঠিক যতোটা চিকন আর যতোটা মোটা হলে গোলাপের মতো লাগে ঠিক ততোটাই দেখতে। কথা বলতেই গাল ভরা হাসি যেন সে সৌন্দর্যকে বাড়িতে তুলেছে শতগুণ। মাঝারি গড়নের মেদহীন শরীরের প্রতিটি কোণায় কোণায় যেন সৌন্দর্যের ফোয়ারা। কোমর সমান কেশরাজি খুলে ব্যালকোনিতে বসে বিকেলের শহরটা দেখতে দেখতে স্বর্ণা একজীবনের ছবি এঁকে ফেললো। মেয়েটি কখনোই সুন্দর সাজানো গোছানো সংসারের বাইরে কোনো স্বপ্ন দেখেনি। মনে মনে ভাবতে লাগলো, আনন্দে শিহরিত হলো এই ভেবে যে, এতো দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। তার জীবনসঙ্গীটি যেন স্বপ্নের মতো। বস্তুত নারী বোধ হয় সর্বোচ্চ স্বপ্ন দেখে তার দাম্পত্য জীবনকে ঘিরে। তবে একটি মেয়ে ছাড়া এই স্বপ্নটা কতোটা নিস্পাপ, কতোটা সাদাসিধে হয় বোধ করি পুরুষের পক্ষে তা বোঝা অসম্ভব। বিশ থেকে বাইশ বছরের জীবন, স্মৃতি, মায়ামমতা। শুধুমাত্র এই একটি স্বপ্ন দেখেই সে মায়া কাটিয়ে ওঠে বিয়ের দিন থেকে। কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেলো স্বর্ণ টেরই পেলো না। পাশের ঘর থেকে স্বর্ণ’র বাবা লতিফ আহমেদ ডাকছেন, মা স্বর্ণ, মাথাটা ভীষণ ধরেছে, একটু চা করে আনতো। স্বর্ণ কল্পনা থেকে বাস্তবে এলো। চা করতে উঠে গেল। প্রতিদিনই এ সময় লতিফ সাহেবের ছোট মেয়ের হাতের চা প্রয়োজন। যদি কোনোভাবে এই রুটিন ভঙ্গ হয়, লতিফ সাহেব যতো রাত করেই বাড়ি ফিরুক মেয়ের হাতের চা তার তৃষ্ণা মেটায়। স্বর্ণ’র মা হামিদা বেগম স্বামীকে বলছেন, হ্যাঁ গো দেখেছো মেয়েটাকে কত খুশি খুশি লাগছে? মনে হয় ছেলেটাকে ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। পছন্দ হবেই বা না কেন? নিলয় দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। বিদেশে ব্যবসা থাকা কি মুখের কথা। লতিফ সাহেব নিজেই পছন্দ করেছেন মেয়ের জন্য পাত্র। তবু কোথাও যেন তার এক অজানা আশংকা। মাথা নাড়িয়ে হতাশ চিত্তে স্ত্রীর কথায় সায় দিলেন। এরই মধ্যে চা নিয়ে এসেছে স্বর্ণা। কেমন যেন লজ্জা লাগছে আজ স্বর্ণর। চা দিয়েই নিজের রুমে চলে গেলো। অন্যদিন হলে বাবার পাশে বসতো, গল্প করতো, বাবার মাথার পাকা চুল বেছে দিত। পরদিন সকালে স্বর্ণ ক্যাম্পাসে গেলো। খুব আনন্দে গাল ভরা হাসি নিয়ে বান্ধবীদের সাথে বিয়ের কথা বলছিল। কেউ প্রশ্ন করলো, তোর বরের বাড়ি কোথায়? কেউবা, দেখি তো তোর জামাইয়ের ছবি? হ্যাঁ রে, বিয়ে কবে? আমাদের দাওয়াত দিবিতো? স্বর্ণর কাছের বান্ধবী নিশি জানতে চাইলো, স্বর্ণ, পড়া শেষে ভাইয়া তোকে চাকরি করতে দেবে তো? স্বর্ণ একগাল হেসে বলল, ও চাকরি করতে দিলেও আমিতো করবো না। আমার এসব চাকরি বাকুরী ভালো লাগে না। সুন্দর একটা সাজানো গোছানো সংসার নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই। অনার্সটা পাস করলেই ঝামেলা থেকে মুক্তি। নিশি হা করে তাকিয়ে ছিল স্বর্ণ’র দিকে মুখ শক্ত করে জবাব দিল, তুই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সিট নষ্ট করেছিস। সবাই চুপ করে গেল। সেদিনের মতো আড্ডা শেষ হলো।

স্বর্ণ’র বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ে বলতে আক্দ। প্রবাসী জামাইয়ের ব্যবসায়িক কিছু ব্যস্ততার কারণে বিয়ের অনুষ্ঠান পরে হবে। বিয়ের রাতেই নিলয় স্বর্ণকে বললো, আজকের এই দিনে আমি তোমার কাছে একটা জিনিস চাই। স্বর্ণ খুব নরম গলায় জানতে চাইলো কি? নিলয় বললো, প্রমিস করো, তুমি আমায় ভুল বুঝবে না। আমি তোমাকে সত্যিটা বলতে চাই। স্বর্ণ তাকিয়ে আছে। বুকটা ধক করে উঠলো। নিলয় বললো, আসলে আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তাই তোমাকে পাওয়ার আশায় আমি মিথ্যে বলেছিলাম। আসলে আমি মালয়েশিয়ার একটা কোম্পানিতে চাকরি করি। আমার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সেখানে নেই। কিন্তু যদি বাবা আমায় সহযোগিতা করেন তাহলে আমি সেখানে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে পারি। স্বর্ণ মনে হয় খুব স্বস্তি পেল। একগাল হাসি দিয়ে বলল, আমি সুখী যে, তুমি আমায় সত্যিটা বলেছ। তোমার সম্মান মানে আমার সম্মান। ঠিক আছে বাবা মাকে বলবো না। তবে আমার নামে বেশ কিছু টাকা বাবার জমানো আছে। আমি বাবার কাছ থেকে সেই টাকাটা নিয়ে তোমায় দেব। আক্দের চারদিনের মাথায় নিলয়কে চলে যেতে হবে তার কর্মস্থল মালয়েশিয়ায়। কোনো এক অজানা কারণ দেখিয়েই বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়নি। শুধু আক্্দ হয়েছে আর আজ বাসর, বিষয়টা একটু সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল। লতিফ সাহেব পাত্তা দেননি।

ছয় মাস অতিবাহিত হল জামাইবাবু এখনও তুলে নিল না। স্বর্ণ’র মা ভীষণ চিন্তিত। একদিন সন্ধ্যায় হামিদা বেগম স্বামীকে বললেন, মেয়েটা সারাক্ষণ মন ভার করে বসে থাকে। ভার্সিটিতে যায় না। খুবই একটা কথাও বলে না। লতিফ সাহেব বললেন বরের সাথে কথা বলে কয়েকদিনের জন্য মেয়েটাকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দিই। নিলয় পাশে থাকলে স্বর্ণ’র মনও ভালো হবে। আর ওদের হানিমুনটাও হয়ে গেল। হামিদা বেগমও এমন বুদ্ধিতে খুশি হয়ে গেল। মেয়ে আর জামাই দু’জনেই রাজি হল। ফলাফলস্বরূপ শ্বশুরের টাকায় মেয়ে-জামাইয়ের হানিমুনও হয়ে গেল। নিলয়ের সাথে স্বর্ণ মালয়েশিয়ায় ছিল প্রায় দেড় মাস। এই দেড় মাসে নতুন ব্যবসার কথা বলে স্বর্ণকে দিয়ে প্রায় দশ লাখ টাকা হাতিয়ে নিল। মালয়েশিয়া থেকে চলে আসার আগে স্বর্ণ প্রমিস করে এলো, সে ফেসবুক চালাবে না। কোনো বন্ধুর সাথে কথা বলবে না। মেয়ের বন্ধুদের সাথেও বেশি মিশতে নিষেধ করলো। স্বর্ণ পতিভক্তিকে ভালোবাসা ভেবে এসব কথা মেনে নিল। নিলয়ের কোথায় যেন একটা ভয়। বেশি বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে মিশলে কথা প্রসঙ্গে এসব কথা আলোচনা করলে, যদি সহজ সরল স্বর্ণর মাথা বিগড়ে দেয়।

স্বর্ণ নিলয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বন্ধুদের সাথে দূরত্ব তৈরি হল, খুব একটা ক্লাসেও যায় না। আবার নিলয়ের সাথেও সারাদিন খুব বেশি কথা হয় না নিলয়ের ব্যস্ততার জন্য। কেটে গেল আরো চারটি মাস। দেশে ফিরলো নিলয়। স্বর্ণর বাবা নিলয়কে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে বললেন। এবারও সে রাজি হল না। অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে কৌশলী নিলয় স্বর্ণকে নিয়ে তার বোনের বাড়িতে উঠলো। জীবনটা আস্তে আস্তে ঘুরে যেতে লাগলো স্বর্ণর। কঠিন বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি স্বর্ণ। বেশ রাত করে তারা ঘুমোতে যায়। আবার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয় স্বর্ণকে। প্রতিদিন সকালে সাতটা বাজতে না বাজতেই নিলয়ের বোন রুবি দরজায় টোকা দেয়। নিলয় স্বর্ণকে উঠিয়ে দেয়। চোখ কচলাতে কচলাতে স্বর্ণ রান্নাঘরে যায়। রান্নায় আনাড়ি হওয়ায় নাস্তা বানাতে সময় লাগে। সকালে এক দফা মা-বাবা দু’জনকে নিয়েই বাজে কথা শুনতে হয় ভাইবোন দু’জনের কাছে। নাস্তা করে নিলয় বেরিয়ে পড়ে। সারাদিন কোনো খবর নেই। দুপুরে রুবি রান্না করে। সে সময় স্বর্ণ ক্যাম্পাসে যায়। রাতে আবার স্বর্ণ’র পালা। নিলয় যখন বোনের সাথে সাথে বসে টেলিভিশন দেখে, হাসি ঠাট্টা করে, স্বর্ণ তখন রান্না ঘরে। এমন পরিস্থিতিতে গাধাও শিয়াল হয়ে ওঠে। স্বর্ণ রান্না করে আর ভাবতে থাকে এই বুঝি সংসার জীবন? সংসার মানেই কি রান্না করে খাওয়ানো আর রাতে স্বামীর সান্নিধ্য লাভ? ঘৃণা হতে লাগে সংসারের প্রতি। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে পড়ে তার বাবা মা’র কথা। মনে মনে ভাবে, মা তার চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছে বাবার সাথে হাসতে হাসতে। মনে পড়ে, বাবাতো এখনো মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করেন। পত্রিকা পড়তে বসে চশমা নিতে ভুলে গেলে বাবা চশমা এনে মার চোখে পরিয়ে দেন। চোখ জলে ভরে যায়। ভাবতে থাকে সবাই বাবার মতো না কেন? সে রাতে, নিলয় স্বর্ণর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে টাকা চেয়েছিল। স্বর্ণ বললো কিছুদিন আগেই তো বাবার কাছ থেকে টাকা এনেছি। এখন তুমি অন্যভাবে ব্যবস্থা করো। সে রাতে নিলয় কিছু বলেনি। সাংসারিক অত্যাচার বেড়ে গেল। একদিন নিলয় বাসায় এসে বলল, কাল থেকে তুমি ভার্সিটিতে যাবে না। ভার্সিটিতে গিয়ে ছেলেদের সাথে আড্ডা দাও। চা খাও বেহায়া মেয়ে। স্বর্ণ স্বামীকে বিশ্বাস করাতে বার বার চেষ্টা করলো। সে কোনো ছেলের সাথে কথা বলে না। নিলয় আরও রেগে উঠলো। এই বুঝি জগতের নিয়ম, যে পরাধীন থাকতে চায় প্রকৃতিও তাকে পরাধীন করে রাখে। নিজের স্বাধীনতা অন্য কেউ দেয় না। সমাজ থেকে তা কেড়ে নিতে হয়। পরদিন স্বর্ণর মা বাবা এলেন রুবিদের বাড়িতে। স্বর্ণ খুব খুশি হল বাবা মা’কে দেখে। স্বর্ণর ননদ রুবিও খুব সমাদর করলেন। স্বর্ণর মা বললেন অনেকদিন হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখিনা। খুব মন পুড়ছিল। তাই হঠাৎ করে চলে এলাম। কিছু মনে করোনিতো রুবি? রুবিও খুব গদগদ স্বরে বলল, না না আন্টি, আমরা বেশ খুশি হয়েছি। স্বর্ণ’র মা আবার বললেন, দেখ, আমার মেয়েটা সংসার কি তা বোঝে না। তুমি একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিও। তুমিতো ওর বড় বোনের মতো। রুবি চুপ করে সম্মতি জানিয়ে ভাইয়ের দিয়ে তাকিয়ে রইলো। চোখে চোখে কি যেন কথা হল ভাইবোনের মাঝে। স্বর্ণ দাড়িয়ে নিলয়ের পাশে। আজ নিলয় আবার টাকার জন্য চাপ দিল স্বর্ণকে। স্বর্ণ সরাসরি না বললো। রেগে গিয়ে দাঁত খিটমিট করে বলতে লাগলো। তবেরে, কাল ভার্সিটিতে যেতে নিষেধ করতে না করতেই নালিশ করে মা-বাবাকে এনে হাজির। এই সব বলতে বলতে চুল ধরে চড় মারতে লাগলো স্বর্ণকে। স্বর্ণ নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করতেই এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সকালে যখন ঘুম ভাঙে স্বর্ণ তখন মেঝেতে শুয়ে আছে। নিলয় বিছানায় বেঘোর ঘুম। স্বর্ণ মেঝেতে উঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো তার কল্পনার সেই রাজপুত্রের দিকে। এই প্রথম নিলয়ের চেহারা দেখে ওর ঘৃণা হল। বাড়িতে তখনও সবাই ঘুম। কাউকে কিছু না বলেই স্বর্ণ বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। বেরিয়ে চিন্তা করলো কোথায় যাবে সে এখন। জীবনের প্রথম তার অনুভব হলো, “আমার কোনো ঠিকানা নেই?”এ বাড়ি ও বাড়ি কোনো বাড়িইতো আমার না। ভেসে উঠলো বাবার চেহারা। পথ চলতে চলতে গিয়ে থামলো বাইশ বছরের চিরচেনা সেই বাড়িটির গেটে। দারোয়ান দূর থেকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় স্বর্ণকে দেখে হামিদা বেগমকে ডাকতে থাকলো। খালাম্মা, খালাম্মা, স্বর্ণ আপায় আইতাসে। হামিদা বেগম মেয়েকে দেখে হকচকিত হলেন। তিনিই যেন তার মেয়েকে চিনতে পারছেন না। অঝোরে কাঁদতে লাগল স্বর্ণ। এই দুই মাসে ঘটে যাওয়া সব কথা বলল। হামিদা বেগম তার স্বামীকে বলল। লতিফ সাহেব আহত হলেন। একই সাথে মেয়ের অবস্থা দেখে নিজের নিবুর্দ্ধিতার জন্য নিজেকে অপরাধী করলেন। নিলয়কে ফোন করলেন। তৃতীয়বারে নিলয় কল ধরলো। খুব ভদ্রতার সাথে কথা বলা শুরু করতেই লতিফ সাহেব বলতে লাগলেন, নিলয়, তোমার ভদ্রতার উপর আমার আস্থা নেই। তোমার সাহসতো কম না তুমি আমার মেয়েকে মেরেছো? এই মাসেই আয়োজন করে বিয়ে অনুষ্ঠান করে আলাদা বাসা নিয়ে আমার মেয়েকে রাখো। আর কখনও স্বর্ণকে মারধর করলে আমি আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। এসব বলেই ফোন রেখে দিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় নিলয় স্বর্ণদের বাসায় আসলো। অপরাধীর মতো শ্বশুর মহাশয়ের পা ধরে ক্ষমা চাইলো। শাসনের স্বরে লতিফ সাহেব বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, ক্ষমা চাইতে হবে না। আর যেন কখন এমন না হয়। তবে ঐ বাড়িতে আমার মেয়ে আর যাবে না। নিলয় চুপ করে শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নরম সুরে লতিফ সাহেব আবার বললেন। আপাতত আমার বাড়িতেই তুমি স্বর্ণকে নিয়ে থাকো। নিলয় মনে মনে বেশ খুশিই হল। আড়াল থেকে স্বর্ণ সব শুনছিল। একবার মনে হল যে সে বাবাকে কিছু বলবে। পরক্ষণে থেমে গেল। পরাধীনতা মানুষকে বারবার শিকলে বাঁধে। দৈহিক পরাধীনতা ভাঙতে পারলেও মানসিক পরাধীনতার শিকল ভাঙা খুব কঠিন। হয়তো সেখানেই আটকে গেল স্বর্ণ। শ্বশুরকে মানিয়ে নিলয় স্বর্ণ’র কাছে এলো। নিজেকে এমনভাবে প্রকাশ করলো, এমনভাবে ক্ষমা চাইলো, স্বর্ণ’র হৃদয়ের পাথর সরে গেল। বরফের মতো গলতে শুরু করলো অশ্রুধারা। এভাবেই পরাজিত হয় স্বর্ণরা। পুরুষের আকুতির কাছে বারবার হেরে যায় নিজ পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি। স্বর্ণকে জড়িয়ে ধরলো নিলয়। আলিঙ্গনের আগুনে পেছনের সব গ্লানি ভুলে গেল স্বর্ণ। আবার মনে হতে লাগলো এই বুঝি তার রাজপুত্র। রাতে ঘুমাতে গিয়ে দু’জনে খুব গল্প করছিল। নিলয় বললো, স্বর্ণ কাল তুমি ক্লাস করতে যাবে, আমি তোমাকে পৌঁছে দেব। চাপা অভিমানের স্বরে স্বর্ণ বলল, না ক্লাস করবো না। নিলয় দুঃখিত স্বরে বললো, ভার্সিটির মেয়েরা খারাপ হয় আমি ভুল বলেছিলাম। ঠিক এমন কথা ক’জন পুরুষ বলতে পারে। আর কেন জানি তাদের মানসিকতা মায়াবতী সরল স্বর্ণরা বুঝতে পারে না। আর তাই বারবার হোঁচট খায়। বারবার স্বপ্নগুলো ভেঙে যায়। সংসার করতে চাওয়া আর সংসারের সাথে স্বাধীন জীবন যাপনে বিশ্বাসী সব মেয়ের গল্পই যেন এক হয়। নিলয়রা জিতে যায়। একটি সপ্তাহ কেটে গেল। একদিন খুব সকালে স্বর্ণ ঘুমিয়ে আছে। নিলয় তড়িঘড়ি করে এসে স্বর্ণকে বলতে লাগলো, স্বর্ণ ওঠো ওঠো। এই পেপারে একটা সাইন দিয়ে দাও। চোখ মুছতে মুছতে স্বর্ণ জিজ্ঞেস করলো কিসের সাইন? কিসের কাগজ? আরে তাড়াতাড়ি করো। আমার ব্যবসার শেয়ারটা তোমার নামে করবো। তাই এখানে তোমার সাইন লাগবে। স্বর্ণ এক গাল হাসি দিয়ে নিলয়কে জড়িয়ে ধরলো। নিলয় বলল, এই শুরু হল দুষ্টুমী, তাড়াতাড়ি কর। আজ আমার অনেক কাজ আছে। স্বর্ণ না পড়েই সাইন করে দিল। নিলয় তাকিয়ে ছিল স্বর্ণ’র চোখের দিকে। হয়তো ভয় পাচ্ছিল। তবু বিশ্বাস ছিল স্বর্ণ পড়বে না। সে যাই হোক, নিলয়ের যে উদ্দেশ্য ছিল তা সফল হলো। চার দিনের মাথায় নিলয় জরুরি কাজের কথা বলে চলে গেল মালয়েশিয়া।

অনেক বেশি জেদ ধরেছিল স্বর্ণ আর কিছুদিন পরে যাওয়ার জন্য। তারা নতুন বাসা নিয়েছে লতিফ সাহেবের বাড়ির পাশেই। স্বর্ণকে বোঝানো খুব সহজ। স্বর্ণ মেনে নিল। তারপর রাগ করে বললোÑ ঠিক আছে, তুমি যাও, নতুন বাসায় আমি একাই উঠবো। নিলয় চলে গেল তার গন্তব্যে। এদিকে স্বর্ণের স্বপ্ন তার সাজানো গোছানো সংসার। আজ থেকে তার শুরু। সেখানে সে একাই থাকবে আপাতত। স্বর্ণ’র পছন্দ করা সব ডিজাইনের আসবাবপত্র কিনে দিয়েছে লতিফ সাহেব। লতিফ সাহেবও বেশ খুশি। নতুন নতুন ফার্ণিচার ঢুকছে স্বর্ণের ফ্ল্যাটে। সব কিছু সেট হয়ে গেছে। পাঁচ ছয়টা লাগেজ ভরা কাপড় স্বর্ণ গুছিয়ে আলমিরাতে ঢোকাচ্ছে। নিলয়ের ফোন এলো। ফোনে কথা বলতে বলতে স্বর্ণ একটি লাগেজ খুললো। চোখ আটকে রইলো সেখানে। হাত থেকে সেল ফোনটি পড়ে গেল। লাগেজটি নিলয়ের কাপড়ের। একটি ছবির ফ্রেম, নিজের চোখকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এ সে বিয়ের ছবি, কিন্তু মেয়েটি কে? স্বর্ণ অপলক চেয়ে আছে ছবিটির দিকে। না তার ভুল হচ্ছে না, এটাতো সে না। কে এই মেয়েটি? স্বর্ণ’র পৃথিবী অমাবস্যা রাতে ঢেকে গেল। আচমকা এক ঝড় তার কোমল হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল। পৃথিবীটা বড় স্বার্থপর মনে হল। স্বপ্নের সংসার স্বপ্নেই রয়ে গেল। কি এমন চেয়েছিল স্বর্ণ, কোনোভাবেই হিসেব মিলছে না। ছোট্ট একটা স্বপ্ন ছিল। ছোট্ট একটা সংসার। আরতো কিছু নয়। এতোটুকুন একটি স্বপ্নে এত বড় একটি ঝড় মুহূর্তে মিশে গেল মাটির সাথে। ছোট্ট এই হৃদয়টা কিভাবে সামাল দেবে সে ধ্বংস। এত বড় প্রতারণা! কি অপরাধ ছিল তার? একটি সংসার বাঁধার স্বপ্ন একটি মানুষের ভালোবাসা, এসব চিন্তা করতে করতে দুদিন কেটে গেল স্বর্ণর। একদিন দুপুরে শরীর থেকে সব ক্লান্তি দূর করে উঠে বসলো। মনে মনে বলতে লাগলো, আমি হার মানিনি। আমি পরাজিত নই। নয় লক্ষ কাবিনে আমার জীবন বাধা না। এই টাকা আমি তাকে ভিক্ষা দিয়েছি। ফোন করলো তার কাছের বান্ধবী নিশি কে। নিশি অপ্রস্তুত ছিল স্বর্ণ’র ফোনের জন্য। কল রিসিভ করতেই স্বর্ণ বলল, আগামীকাল ক্লাস কয়টায়? নিশি বলল, নয়টা পঁয়তাল্লিশে। স্বর্ণ বলল, আমার জন্য অপেক্ষা করিস তোরা। এক সাথে ক্লাসে যাব। কতদিন ক্যাম্পাসের মামার হাতের ফুচকা খাইনা, এসব বলেই স্বর্ণ ফোন রেখে দিল। নিশি কিছুটা অবাক হল। স্বর্ণর এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটির মধ্যেই যেন স্বর্ণর এখন তার অনেক ব্যস্ততা।

লেখক: গল্পকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here