বুড়িমার গুপ্তধন

ছোট গল্প

0
1197

বুড়িমার গুপ্তধন

নাজনীন তৌহিদ

শহর ছেড়ে একটু দূরে গ্রামের শেষ সীমানায় নদীর কোল ঘেষে একটি গাঁও ছিল। সে গাঁয়ের মানুষ খুব লোভী ছিল। আর অলস ছিল। সে গাঁয়ের শেষ মাথায় কেবল একটিই বাড়ি ছিল। বাড়িটি যে কত সুন্দর তা আর কী বলি!

সে বাড়িতে দু’জন মানুষ থাকতেন। একজন বৃদ্ধ বাবা অন্যজন বৃদ্ধ মা। তারা কিন্তু গাঁয়ের অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল। তাদের অবশ্য বেশ ক’জন ছেলে মেয়ে ছিল। তারাও গাঁয়ের অন্য সবার মতোই ছিল। গাঁয়ের নদীটির ওপারে ছিল মায়ামোহের রাজ্য, মানে সবাই মনে করত ওই রাজ্যে কেবল সুখ  আর সুখ, আরাম আয়েসের জীবন। তাই ছেলে মেয়ে গুলো সেই সুখী জীবন পেতে নদীর ওপারে মায়া মোহের দেশে চলে গেল। কিন্তু সে দেশে গেলে কেউ আর ফিরে আসেনা।

বাবা মা মনে করলেন তাদের মায়র চেয়ে বড় কোনো মায়া থাকতেই  পারেনা, নিশ্চয় একদিন তার ছেলে মেয়েগুলো ফিরে আসবে। কিন্তু দিন যায় মাস যায় বছর যায় তারা আর ফিরে আসেনা। বাবা তার ছেলে মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে বিছানায় পড়ে গেলেন মানে ভীষন অসুস্থ হয়ে গেলেন। তিনি আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। মাও ছেলে মেয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেলেন। নদীতে নৌকার কোনো শব্দ হলে বাবা ভাবতো ওই বুঝি তার ছেলে মেয়ে কেউ এসেছে। বাড়ির মধ্যে কোনো পাতা পড়ার শব্দ হলেও মা কান পেতে থাকতেন, তারপর ছেলে মেয়ের নাম ধরে বলতেন কে? কে? বড় খোকা? মেজ খোকা? না কোনো উত্তর পাওয়া যেতনা!

বাড়িটাতে অনেক ধরনের ফুলের গাছ ছিল। মা তো ফুল দেখতে পেতেন না কেবল গন্ধ পেতেন আর বাবা তো দেখতে পেতেন কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতেন না। কখনো বেলি ফুল ফুটলে বাবা বলতেন আজ আমার মেয়ের জন্মদিন। কখনো গন্ধরাজ ফুটলে গন্ধ শুঁকেই মা বলতেন আজ আমার বড় খোকার জন্ম দিন। আসলে তাদের কাছে তো ক্যালেন্ডার ছিল না, ঘড়ি ছিল না, তাই তারা ফুল ফোটার সময় হিসেব করেই ছেলে মেয়েদের জন্মদিন পালন করতেন। এভাবে দিন যেতেই থাকলো, না তাদের ছেলে মেয়েগুলো ফিরেই আসে না। অপেক্ষায় থেকে থেকে বুড়ো বাবা একদিন না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তবে যাবার আগে মায়ের হাতে একটি জিনিস দিয়ে বললেন, এটি আগলে রাখো, যে এর উপযুক্ত কেবল তাকেই এই সম্পদ দিবে, আর কাউকে নয়।

বাবা তো না ফেরার দেশে চলে গেলেন কিন্তু একবুক কষ্ট নিয়ে বুড়ো মা বেঁচে থাকলেন। তবে তার কাছে কি আছে কেউ তা জানেন না। কিন্তু একজন দু’জন করে করে অনেকে বুঝে গেছে যে বুড়ি মায়ের কাছে কিছু সম্পদ আছে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে ছল করে জানতে চায় যে বুড়িমার কাছে কি সম্পদ লুকানো আছে।

বুড়ি মা বলেন, আছে, আছে। এমন এমন গুপ্তধন আছে যার সন্ধান সবাই পাবেনা। যে নির্মোহ মানে যার লোভ লালসা নেই সেই পাবে।

অনেক চেষ্টা করেও গ্রামের কেউ যখন জানতে পারল না তার গুপ্তধনের কথা তখন হতাস হয়ে অনেকে ওই নদীর ওপারে মায়ার রাজ্যে পারি জমালো। আসলে গ্রামে তখন খুব কষ্ট ছিল তা নয়। নদীতে মাছ ছিল, জমিতে ফসল ছিল, গাছে ফল ছিল কেবল পরিশ্রম করেই তা আনতে হতো। পরিশ্রম ছাড়া তো কিছুই হয়না, তাই না? কিন্তু সেই গ্রামের অলস মানুষগুলো তা বুঝতেই চাইতনা। তারা কেবল নদীর ওপারেই কলকারখানা আর ইট পাথরের মাঝে সুখ খুঁজতে যেত।

     একদিন হঠাৎ করে নদীর ওপারের মায়ারাজ্য থেকে একটি ছেলে পথ ভুল করে এই গ্রামে চলে এল। গ্রামটি শহরের মানে নদীর ওপারের মতো আলোক উজ্জ্বল নয়, বাড়িঘরও কেমন যেন মাটির তৈরি, খড়ের তৈরি। তবে নদী , খাল, পুকুর, গাছপালা, সবুজ ঘাস, লতাপাতা, পশুপাখি, শস্যমাঠ এসব দেখে ওর ভীষন ভালো লাগলো। এসব ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে গাঁয়ের শেষ মাথায় জঙ্গলে ঘেরা, শেওলা আঁটা পাঁচিলের ভেতর একটি ঘর দেখে ভেতরে গেল।

তখন সন্ধ্যাা হয়ে এসেছে। চারিদিকে কেমন অন্ধকারে ডুবে গেছে। জঙ্গল থেকে ঝি ঝি পোকার মিটমিটে আলো দেখা যাচ্ছে। তবে ঘরের ভেতর অন্ধকার, কোনো লোকজন আছে বলে তার মনে হলো না।

ছেলেটি তবু ডেকে ডেকে বলল, বাড়িতে কেউ আছেন?

বুড়ি মা অন্ধকার ঘরে একা একা শুয়ে ছিলেন। তার তো চোখ নেই, তাই ঘরে আলো জ্বালিয়ে কোনো লাভ নেই বলে আলো জ্বালান না। তাছাড়া তিনি খুবই অসুস্থ, তাই আলো জ্বালাতে পারেন না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন রাত পার করেন। গাঁয়ের কেউ খোঁজ নেয়না, কাছে আসেনা। কারো যেন সময় নেই।

হঠাৎ মানুষের কণ্ঠ শুনে ধরফর করে বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে বললেন কে? কে? আমার ছোট খোকা?

ছেলেটি ভ‚তুড়ে বাড়ি দেখে কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়েছিল, কিন্তু আজ রাতটি তার কাটানো দরকার তাই বুড়ি মাকে দেখে তার একটু সাহস হলো, ভাবলো যাক তবে রাতটি এ বাড়িতেই কাটানো যাবে। ছেলেটি বুড়িমাকে পরিচয় দিয়ে বলল সে রাতটি তার বাড়িতে থাকতে এসেছে।

বুড়িমার ছেলেটির কথা শুনে এ গাঁয়ের ছেলে বলে মনে হলোনা এবং কোন লোভী ছেলে বলেও মনে হলো না। যারা এতদিন বুড়িমার বাড়িতে এসছে তারা কেউ ভালোবেসে আসে নি, কেবল গুপ্তধনের খোঁজেই এসেছে, তারপর গুপ্তধন না পেয়ে তারা চলে গেছে। কিন্তু এই ছেলেটিকে বুড়িমার নির্মোহ এবং খুব মায়াবী ও দয়ালু বলে মনে হয়েছে। কেন না ছেলেটি বুড়ি মাকে একা একা থাকতে দেখে তার একা থাকার কষ্ট বুঝতে পেরেছে। নিজে নিজেই খড়কুটো, পাতা জ্বালিয়ে খাবার বানিয়ে খাইয়েছে। অসুস্থ বুড়ি মার সেবা করেছে।

তাকে এমন একা থাকতে দেখে ছেলেটি তার কোনো সন্তান আছে কিনা বা তারা কোথায় থাকে তা জানতে চাইলে বুড়ি মা সবকিছু খুলে বললেন। বুড়ি মার জন্য ছেলেটির তখন খুব মায়া হলো।

একদিন দু’দিন করে বেশ ক’দিন হয়ে গেলেও ছেলেটি বুড়িমাকে এমন অসুস্থভাবে ফেলে রেখে যেতে চাইলো না। বুড়ি মাও বুঝতে পারল এই সেই উপযুক্ত ছেলে যাকে তার গুপ্তধনের সন্ধান দেওয়া যায় আর তাছাড়া যদি উনি হঠাৎ করে মরে যান তবে তো সেই গুপ্তধন কেউ খুঁজে পাবেনা। কারো কোনো উপকারেও আসবে না।

তিনি ছেলেটিকে নিয়ে বুড়ো বাবার কবরের কাছে গিয়ে বললেন, ওগো শুনছো! এই যে আমি সেই উপযুক্ত ছেলে পেয়েছি। আমাদের ছেলে মেয়েরা তো আর ফিরে এলোনা তাই এই ছেলেটিকেই আমি সেই গুপ্তধনের সন্ধান দিতে চাই।

     বুড়ি মা বিড় বিড়িয়ে বুড়ো বাবার কবরের কাছে গিয়ে কি বলল ও তেমন কিছুই শুনতে পেলনা, তবে এদের জন্য তার মন খুব কাঁদলো। তারও শহরে ফেরার সময় হয়েছে। কিন্তু একা এই বৃদ্ধাকে ফেলে যেতে মন চাইছে না।

এমন সময় বুড়ি মা ছেলেটিকে বলল, আমি তোমাকে একটি জিনিস দিব, কিন্তু তা মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা আছে।

ছেলেটি শুনে অবাক হলো।

বুড়ি মার নির্দেশে বুড়ো বাবার কবরের পাশের মাটি খুঁড়ে বেশ গভীর গর্ত করল। কিন্তু তেমন কিছুই খুঁজে পেলনা। পরদিন খুঁড়ে একটি সোনার হাড়ি পেল, তবে তাতে কিছুই রাখা নেই, ফাঁকা।

বুড়ি মা বললেন, এই হাড়ির মধ্যে কী জমানো আছে তা সবাই বুঝবেনা। ছেলেটি বুড়ি মার কথা শুনে মৃদু হসাল।

বুড়ি মা আবার বললেন, কাল সকালে আমার স্বামীর পাশে এই গর্তে আমাকে শুইয়ে রাখবে।

ছেলেটা এবার একটু চিন্তিত হলো।

পরের দিন বুড়ি মা মারা গেলেন। সেই গুপ্তধনের খোঁড়া মাটির ভিতর তাকে শুইয়ে রাখা হলো। ছেলেটি বাড়িটি ছেড়ে গেল না।

 চারেিদক সবার মুখে মুখে গুপ্তধনের কথা ছড়িয়ে গেছে। ছেলেটির কাছে সেই গুপ্তধন আছে তাই সবাই তার কাছে ভিড় জমাচ্ছিল। ছেলেটিও তখন তাদেরকে বলল, হ্যাঁ তার কাছে বুড়ি মার গুপ্তধন আছে। তবে তা সে সবার মাঝে বিতরণ করে দিবে। কিন্তু সে জন্য তার কথা শুনতে হবে, কাজ করতে হবে এবং পরিশ্রমি হতে হবে।

সবাই রাজি হলো।

তখন বুড়ি মার বাড়ি থেকে শুরু করে গাঁয়ের সব আগাছা কেটে পরিস্কার করে সেখানে ফলের বাগান করা হলো, পুকুর কেটে মাছের চাষ করা হলো। জমি চাষ করে ফসল ফলানো হলো। ক’দিনের মধ্যেই সেই গাঁওটি একটি আদর্শ ও সুন্দর গাঁও হয়ে গেল। বুড়ি মার বাড়িতে একটি মসজিদ করা হলো, গ্রামে হাসপাতাল তৈরি করা হলো, স্কুল কলেজও বানানো হলো। কিছুদিনের মধ্যে ওপারের মায়ারাজ্য থেকেও লোকজন এখানে আসা শুরু করল। গ্রামটিও সেই মায়াবী শহরের মতো আলো ঝলমলে হয়ে উঠল, তখন এই গাঁয়ের কোনো ছেলে মেয়েরা আর বাবা মাকে ফেলে দূর দেশে যায়না। সবার ভিতর মায়া আর ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হলো। ছেলেটি সবাইকে তখন বুড়ি মায়োর গুপ্তধনের রহস্য  খুলে বলল।

 আসলে বুড়ি মার কোনো লুকানো টাকার সম্পদ ছিল না। ছিল মায়া, ভালোবাসা আর প্রাণঢালা দোয়া যা তার ছেলে মেয়ের জন্য লুকানো ছিল। কিন্তু ছেলে মেয়েরাও গাঁয়ের অন্য সবার মতো লোভী ছিল, তারা সত্যিকারের সম্পদ খুঁজে দেখেনি। কিন্তু এই ছেলেটি অনেক বুদ্ধিমান বলেই তা খুঁজে পেয়েছে এবং সে মায়া ভালোবাসা গাঁয়ের সবার মাঝে বিতরণ করে দিয়েছে। তাই সে গ্রাম মানে দেশটিই একদিন সবার সেরা দেশ হয়ে উঠল। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here