রসিক আলি : বই এবং বউ সমাচার

গল্প

0
1162

আহমেদ ফরিদ

বই এবং বউ শব্দ দুটো কতই না কাছাকাছি। শুধু দুটি স্বরবর্ণের এদিক ওদিক। এ দুটির মধ্যে কতই না মিল আর অমিলই না কত! ভাবতে ভাবতে চান্দিতে ফোটা ফোটা ঘাম দেখা দেয় রসিক আলির। মুক্তোর মতই সে ঘাম ঝিকিমিকি করে রসিক আলির চান্দিতে। চান্দির চুলগুলো অনেকাংশেই ঝরে গেছে, বউ নাকি বইয়ের কারণে সেটি নিয়ে একখানা অভিসন্দর্ভ রচনার ইচ্ছা আছে তার। কিন্তু সময় করে উঠে পারছেন না রসিক। আর পাবেই বা কীভাবে? বউ এবং বই এ দুই নিয়ে তিনি মহাব্যস্ত। বই যেমন তাকে পড়তে হচ্ছে বউকেও তেমনি কিন্তু কোন কুলকিনারা করতে পারছেন না। রসিক বই পড়ছে আড়াই তিন বছর বয়স থেকে। অ-তে অজগর টি আসছে তেড়ে দিয়ে শুরু। বইয়ের অজগরটি এখনও তাকে জীবনের বাঁকে বাঁকে তাড়া করে আসছে। মৃত্যুর পর ওটি কবর পর্যন্ত তাড়া না করলেই হলো। অবশ্য ইদানীং শোনা যাচ্ছে ঐসব অজগর টজগর বাদ। বাদ দেয়াই ভালো। রসিক আলি যতটুকু জেনেছে অজগর সম্পর্কে তাতে মনে হয় প্রাণীটি যথেষ্ট নিরীহ। কাউকে সে তাড়া করেছে এমন কোন নজির নেই। অবশ্য খিদে লাগলে সে তার চেয়েও বড় বড় প্রাণী গিলে ফেলে। খিদে লাগলে কে না খায়? মানুষ তো বিনে খিদেতেও কত কিছু খায়! আর অজগর তো একটা ইতর প্রাণী।

অজগরের পরিবর্তে আসছে এখন অ-তে ‘অজু’ ও-তে ‘ওড়না’। ওলের পরিবর্তে ওড়না। এগুলো টিকবে কিনা কে জানে! অজু, ওল এবং ওড়না নিয়ে শুরু হয়ে গেছে টানাটানি, টাগ অব ওয়ার। এ টানাটানিতে কে যে বেআব্রু হয় বুঝা মুশকিল! দেখা যাক।

রসিক আলি তিন বছর বয়স থেকে বই পড়া শুরু করলেও বইয়ের বিষয় বস্তু তার মাথায় কিছুতেই ঢুকে না। বাপ বিষয়টা বাল্যকালেই টের পেয়ে যান, ছেলের মাথায় পড়াশোনা শেখার মতো ঢের বুদ্ধি নেই। তাই বাড়িতে লজিং রেখে দেয় মতি মাস্টারকে। মতি স্যার জীবনে বহু গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানিয়ে ছেড়েছেন। সে সমস্ত ঘোড়া জীবনের দৌঁড়ে ফার্স্ট সেকেন্ড পর্যন্ত হয়েছে, আর রসিক আলি তো মনুষ্য সন্তান। কিন্তু মনুষ্য শাবককে পেটালে কী হয় তা বোধ হয় মতি স্যারও জানেন না। মতি স্যারের যতিহীন মারামারিতে রসিক আলি মনুষ্য শাবক হতে গর্দভ শাবকে ডিমোশন পেলো। না হলে প্রতি ক্লাস ডিঙ্গাতে কীভাবে তার দুবছর লাগবে! কোন প্রশ্ন করলেই মতি স্যার ক্ষেপে গিয়ে সপাং সপাং বেত চালাতেন। মতি স্যার একবার তাকে নলেজ বানান লিখতে দিলেন। রসিক লিখল Noleg.

তোরা দেখ, দেখ তোরা! লম্ব কর্ণটার কাণ্ড দেখ। ওকে বললাম knowledge লিখতে আর ও লিখল noleg  মানে পা নেই। আরে গাধা, তোর তো আমাদের চেয়েও দুটো পা বেশি। নাকি তোর নাম রসিক বলে মতি ওস্তাদের সাথে রসিকতা করছিস? আজকে তোর রসিকতা ছুটিয়ে দিব। বলে সপাং সপাং জালিবেতের মার।

স্যার বানানটা তা হলে কী হবে? মার খেয়েও রসিক জিঙ্গেস করে।

knowledge, কে এন ও ডাব্লিউ এল ই ডি জি ই। স্যার টেনে টেনে বানান করে পড়েন।

স্যার, ওটাতো তাহলে কেনোলেডজি হবে। নোলেজে তো কে আর ডি’র উচ্ছারণ নেই।

কিছু কিছু উচ্ছারণ উহ্য থাকে গাধা। যেমন তুই হলি চারপা ওয়ালা লম্বকর্ণ। তোকে কি আমরা সবসময় গাধা বলে ডাকি? ওস্তাদের বেত আবার নাদুস নুদুস রসিকের গায়ে এসে পড়ে।

সূত্রটা মনে রাখ গাধা। সূত্রটা হলো- লিখতা হ্যায় কে নোলেজ পড়তা হ্যায় নোলেজ।

কে নোলেজ না হয় সে লিখল কিন্তু ‘ডি’ টা কেনো নলেজের ভিতর দন্ত বিকশিত করে হাসছে সে বুঝতে পারছে না। লক্ষী বানান নিয়েও তার একই সমস্যা। সে লিখল লক্কী, ওস্তাদ কেটে করে দিল লক্ষী। যা ভাঙলে দাঁড়ায় লকষমী। রসিক লক্ষী বানানটাই জানে না, তার জীবনে কীভাবে লক্ষী ধরা দেবে!

স্কুল কলেজে তার চারিদিকে সুবর্ণ কংকণ পরিহীতা বহু বালিকা রমনী ছিল। সাহস করে রসিক আলি কারও সাথে মোহববতের কথা বলতে পারেনি অথচ তার মনটা তখন ইশ্কের আগুনে পুড়ে পুড়ে অঙার হওয়ার মতো অবস্থা। কারণ একটাই, সে ঠিক মতো না পড়তে জানে, না বানান করতে জানে। ওখানেও নোলেজ, লক্ষ¥ীর মতো অনেক প্যাচালো জিনিস নাকি আছে! অথচ তার বন্ধু কোববাত আলির কত বান্ধবী, প্রেমিকা!

দিলরুবা মেয়েটা আমার প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছে, এক বিকালে খেলার মাঠে বসে কচি ঘাসের ডগা চিবুতে চিবুতে কোববাত ঘোষণা দিল।

কীভাবে বুঝলি তুই?

আমি তো ওদের চোখের ভাষা বুঝতে পারি এমন কি মনের ভাষাও।

রসিক আলি অবাক হয়ে যায়, চোখেরও ভাষা আছে! আচ্ছা না হয় মানুষের চোখের ভাষা আছে, কারণ মানুষ ‘চোখ মারে’ ‘নয়নে বান হানে,’ ‘চোখ রাঙায়’ কিন্তু মনের ভাষা! ওটাতো দেখাও যায় না, বুঝাও যায় না।

আচ্ছা তুই কীভাবে দিলরুবার চোখের ভাষা বুঝতে পারলি দোস্ত?

অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি রে গাধা। দেখিস না দিলরুবা কীভাবে সারাক্ষণ আমার দিকে গরুর মত ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে?

আমাদের কাজলী গাইটাও আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। তাহলে কি….

ও কথা শোনার পর কোববাত রসিককে মারতে আসে।

সে থেকে রসিক চোখ আর মনের ভাষা পড়া বাদ দিয়েছে। কারণ এ চেষ্টা বৃথা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেখানে বলেছেন ‘তোমার ভাষা বুঝার আশা দিয়াছি জলাঞ্জলি।’

চোখ এবং মনের ভাষা বুঝতে না পারলে কী হবে পিতামাতার পিড়াপীড়িতে এক  মহিলার পাণি তাকে পীড়ন করতেই হলো। প্রথম কয়েদিন রসিক দেখল জীবনের এ পাঠগুলা খুব সহজ। ফরফর করে জীবন নামক বইটির পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে সে। কিছুদিন পর যতই পৃষ্ঠা উল্টায় জীবন ততই জটিল হয়। জটিলতা বাড়তে বাড়তে একসময় দেখা গেল রসিক একেবারে বুদ্ধু বনে গেছে। কিছুই আর পড়তে পারছে না। না সে নিজে, না তার বউ। এর মধ্যে বউ রসিকের একটা বই নিজের দখলে নিয়ে গেছে, সেটি চেক বই। পরম যত্নে ওটা তুলে রাখা হয়েছে, কোন পাতা এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। আগাম সইও নেয়া হয়ে গেছে, রসিক অক্কা পেলে যাতে কোন সমস্যা না হয়।

শুধু চেক বই নাড়াচাড়া করছ, দু একটা আউট বই নাড়াচাড়া করতে পারো না, মনটা তাতে প্রশস্থ হয়। রসিক একদিন তার বউকে বলল।

কী বললে! আমার মন প্রশস্থ নয়, আমার মন চিপা গলি, পুরান ঢাকার শাখারী পট্টি! এতে তোমার জায়গা হয় না! বই পড়ে পড়ে আমার মন বড় করতে হবে!

রসিক জানে বইয়ের সাথে বউয়ের একটা দ্বাদ্বিক সম্পর্ক আছে। রসিক বই পড়ে বুঝতে পারুক আর না পারুক তার চতুর্দিকে বই পত্র ছাড়নো ছিটানো থাকে। রসিকের বউ আবার এলোমেলো কোন কিছু দেখতে পারে না। মাঝে মধ্যে বইগুলো  জানালা দিয়ে ছটুড়ে ফেলার হুমকি দেয় ।

রসিক হয়তো কোন বইয়ের গভীরে ডুবে আছে। তখন হয়তো গুলবদনের ভিতর রোমান্টিকতা জেগে উঠেছে।

এই শুনছ, গুলবদন বলছে।

হু,

হু কী? আমি বকে যাচ্ছি আর তুমি হু হু করছ। কী পাইছ, প্যাচার মতো মুখ গুজে আছো বইয়ের পাতায়। বউয়ের চেয়ে বই তোমার প্রিয়। থাক তোমার বই নিয়ে।

রসিক আলিকে তার এক বন্ধু লায়েক জানিয়েছে সম্প্রতি একটা নূতন ধাতু নাকি আবিস্কৃত হয়েছে যার নাম WIFE. এর রাসায়নিক প্রতীক হচ্ছে BV । প্রথম যখন এটা পাওয়া যায় তখন নাকি এ ধাতুটি ওজনে হালকা থাকে,  পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে ওজন বাড়তে থাকে। ধাতুটির অন্যান্য ধর্ম হলো এটি যখন তখন ফস করে জ্বলে উঠতে পারে, আবার জমে বরফ হয়ে যেতে পারে,  ধাতুটি খুবই প্রতিক্রিয়াশীল বিশেষ করে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে। অন্যান্য জিনিস যেমন সোনারূপা, ডায়মন্ড, ক্রেডিট কার্ড, চেক বইয়ের প্রতি ধাতুটির প্রবল আকর্ষণ রয়েছে। আর একে বেশিরভাগ সময়  ড্রেসিং টেবিলের আশেপাশে পাওয়া যায়।

ধাতুটি যখন ফুটতে থাকে তখন চুপচাপ থাকাই শ্রেয়, আবার যখন জমে যায় তখন ভালবাসা নামক রি-এজেন্ট দিলে চমৎকার ভাবে গলে যায়।

বেটা লায়েক আলি বলেছে ধাতুটা নাকি নতুন আবিস্কার। এ ধাতুটা তো সৃষ্টির আদিতে বাবা আদমের সময়  থেকেই ছিল। তাহলে এটি হবে ডিসকভারি, ইনভেনশন নয়। হয়তো  বৈজ্ঞানিকেরা এর ধর্মগুলো নতুন করে আবিস্কার করেছেন। থাকগে, গুলবদনকে একটু ভালবাসা দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।  এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই।

শুনছ, আমি একটা নভেল লেখার চিন্তা করছি।

এক শুভ মুহূর্তে রসিক গুলবদনের অনুমতি চায় উপন্যাস লেখার।

 কী বললে তুমি?

উপন্যাস লিখবে? কেন লিখবে? বাজারে কি নাটক, নভেলের অভাব পড়েছে যে তুমি নভেল লিখবে? ধর টাকা। মেলা থেকে নভেল কিনে নিয়ে আস।

 গুলবদনের ঔদার্যে খুশি হয় রসিক । আসলে গুলবদন মেয়ে হিসেবে খুবই ভালো। কোন ধাতুই নিষ্ক্রিয় নয়, তার নিজস্ব ধর্ম থাকবেই, গুলবদনেরও আছে। বইয়ের শখ তো তার ছিল এখনও আছে। তবে বই দেখার। উত্তম সূচিত্রার কত বই সে দেখেছে, কত চোখের জল ফেলেছে! হালের শাহরুখ, সালমানরা বাদ যায় না। নূতন উপসর্গ হিসেবে এসেছে ভারতীয় সিরিয়াল। সারাদিন ওটাতে মুখ গুজে রাখে সে।

ঐ সমস্ত ছাইপাশ দেখা বাদ দিয়ে দুয়েকটা বই পড়তে পার না। বিরক্ত হয়ে রাগত স্বরে রসিক একদিন বউকে উপদেশ দেয়।

পারি! সংসারের সমস্ত কাজ বাদ দিয়ে বই পড়ি, সংসার চুলোয় যাক আর কি!

সারাদিন যে টিভি দেখ, মিন মিন করে বউয়ের কথার উত্তর দেয় রসিক।

টিভি দেখলে কাজ করা যায়, বই পড়লে কাজ করা যায় না। দেখ না আমি ‘দিলতো পাগল হ্যায়’ দেখছি আবার বোনের সাথে আমেরিকায় কথাও বলছি। বই পড়লে আরো একটি কাজ করতে পারতাম? বলো! যুক্তি দাও। চুপ করে থেকো না।

এ মোক্ষম যুক্তির পর আর কোন যুক্তি চলে না। রসিক আলি মন বেজার করে ছুটল বইমেলার দিকে। ওখানে গিয়েতো রসিক অবাক। ভেলেন্টাইন না কী যেন একটা দিন! জোড়া বাঁধা নরনারীই বেশি। এটাকে বইমেলা বলবে নাকি বউমেলা বলবে। ফাগুনের সাজে সবাই সজ্জিত। প্রায় মহিলার মাথায় ফুলেল মাথাল। মালা কবে মাথাল হয়ে গেল। কীভাবে মালা কণ্ঠ থেকে শিরে উঠে গেল ভেবে পায় না রসিক। হাতের দিকে তাকায় সে। তাদের বিপরীত হাত দুটি জুটি বাঁধা। অন্য দুটি হাত খালি। বই কেনার জন্যই ও দুটো হাত খালি রেখেছে ওরা নিশ্চয়! বই এবং বউ পাশাপাশি চলুক না!

লেখক: গল্পকার, কথাসাহিত্যিক

ও যুগ্মসচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here