মাসউদুল হক
বাবার মৃত্যুর অনেক বছর পর গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ইতোপূর্বে যতবার গ্রামের বাড়ি গেছি ততবারই বাবা থাকতেন আমার সাথে। তিনি হতেন পথপ্রদর্শক আর আমি অনুসারী। এবার প্রথমবারের মতো বাবা নেই। আমি জানি, স্মৃতিকে বাগানের বৃক্ষের মতই যত্ন করতে হয়। যত্ন না করলে স্মৃতি আগাছা হয়ে যায়। আমার কাছে গ্রামের স্মৃতিও আগাছায় আগাছা হয়ে যাওয়া প্রায় অচিন কোনো বৃক্ষ। তবুও ঝাপসা স্মৃতি এবং গ্রামের আত্মীয়-স্বজনদের উপর ভরসা করে গ্রামে চলছি। বাবার অবর্তমানে আমি পথপ্রদর্শক আর আমার আমার আট বছর বয়সী পুত্র বিভোর অনুসারী। যার কাছে এই কিছুদিন আগেও ঠিকানা মানে ছিল ঢাকার কংক্রীট নির্মিত একখানা দালান। তবে ইদানীং গ্রাম থেকে নির্দিষ্ট বিরতিতে আত্মীয়-স্বজন, নকশা করা পিঠা এবং নানাবিধ ফল-ফলারির আগমনের মধ্য দিয়ে সে অনুভব করতে সক্ষম হয়েছে যে ঢাকা শহরের বাইরেও আমাদের পরিবারের আরেকটি ঠিকানা আছে এবং শুধু জন্মসূত্রেই সেই ঠিকানার একটি অংশ সে।
আজন্ম শহরে লালিত বিভোর ইতঃপূর্বে ক্যালেন্ডারের পাতা, ছবি আকার বই আর টেলিভিশনে টুকরো টুকরো দৃশ্য দেখে গ্রাম সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়েছে। ছবির বই আর ক্যালেন্ডারের পাতার মতো সুন্দর একটা গ্রামে যে তাঁরও অংশীদারিত্ব আছে। এ ভাবনা তাকে সবসময় বেশ পুলকিত করত। সে প্রায়শ অবসর সময়ে অদেখা সেই গ্রাম নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করত। আমি বিশ বছর আগে দেখা গ্রামের স্মৃতি হাতড়ে তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতাম। মলিন স্মৃতির জোড়াতালি দেওয়া জবাব তাকে তৃপ্ত না করে বরং নতুন নতুন প্রশ্নের দিকে ঠেলে দিত। তার এই নতুন ইতিহাস অনুধাবন এবং কৌতূহল চরম আকার ধারণ করে যখন একদিন গ্রাম থেকে আমার ফুপাতো ভাই অনেকগুলো আম আর পিঠার সাথে একটা ময়না পাখি নিয়ে আমাদের ঢাকার বাসায় হাজির হয়। এতদিন বিভোর জানত শুধু গল্পেই পাখিরা কথা বলে। কিন্তু ময়না পাখিটি সম্ভবত শৈশবেই ধরা পড়ে যাওয়ায় এবং পালকের একান্ত চেষ্টায় কথা বলা শিখে নিয়েছিল। ময়না পাখিটি যখন প্রথম দেখায় আমার শিশু পুত্রকে জিজ্ঞেস করল ’ভালো আছো’ তখন গল্পের পাখি আর বাস্তবের পাখির মধ্যে থাকা সীমারেখাটি বিলীন হয়ে গেল।
আমাদের বাসার ছাদে আরও কিছু পাখি আছে। সেসব পাখিদের সবই দোকান থেকে কেনা। ঐ পাখিদের কোনেটিই কোনোদিন বিভোরকে জিজ্ঞেস করেনি । সে কেমন আছে? গ্রাম থেকে আসা ময়না পাখিটির এই প্রশ্নে আমার শিশুপুত্রের বোধ করি মন-প্রাণ সব জুড়িয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট একটা প্রশ্ন ’ভালো আছো’র মধ্য দিয়ে ময়না পাখি এবং বিভোরের মধ্যে একটি নিবিঢ় বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল। ফলত পাখিটির জায়গা ছাদে হলো না। হলো আমাদের বাসার বারান্দায়। আমার পুত্র প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে এবং রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজ হাতে পাখিটিকে দুধ-কলা খাওয়াত। দুপুর বেলা যেদিন স্কুল থাকত না সেদিন একটা বাটিতে করে পানি এনে দিত। ময়নাটি সেই পানি নিজের শরীরে ছিটিয়ে গোসল সারতো। রাতে বাসায় ফিরলে আমাকে প্রতিদিন সেই পাখির গল্প শুনতে হতো। ঐ পাখির সূত্র ধরেই আমাদের না- দেখা গ্রামটি এক অপার্থিব জগত হয়ে বিভোরের সামনে ধরা দিতে শুরু করে। যে গ্রামের আম এত মিষ্টি, যে গ্রামের পিঠা এত মধুর, যে গ্রামের পাখি অচেনা মানুষদের দেখে জানতে চায় ।সে কেমন আছে- সে গ্রামকে অপার্থিব এক জগত ভাবলে দোষই-বা দিই কি করে!আমার সাথে গ্রামের সম্পর্কে যে একটা বড় ফাঁক আছে। তা বিভোর ধরতে পারে না। সে ভাবে, আমিও ঐ গ্রাম থেকেই এসেছি। পাখিটি আসার পর সে ঘন ঘন জানতে চাইতো , ‘বাবা, আমাকে ক’বে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবা?’
আমি পুরোপুরি শহুরে মানুষ। বাবার একান্ত ইচ্ছায় গ্রামের সাথে আমার সম্পর্ক রচিত হয়েছিল। দু’তিন বছর পর পর কয়েকদিনের জন্য স্থাপন করা ঐসব সম্পর্ক আমাকে বাবার মতো করে গ্রামের সাথে বাঁধতে পারেনি। আমার বাবার কাছে গ্রামের বাড়ি ছিল নিজ গৃহে ফেরা আর আমার কাছে ছিল একটা ভ্রমণ। আমার ঐসব ভ্রমনের স্মৃতির সাথে কেবল ইবনে বতুতা বা হিউয়েন সাংয়ের মতো পরিব্রাজকদের স্মৃতিরোমন্থনেরই তুলনা চলে। কোন পরিব্রাজক বহুদূরের কোন জনপদ ভ্রমন শেষে ফিরে গিয়ে আপনজনদের কাছে যেভাবে বর্ণনা করতেন সেভাবেই আমি শিশুপুত্রের কাছে গ্রামের গল্প বলতাম। আমাদের সময়ের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। রাস্তা-ঘাট ছিল না। পাছে তেলের খরচ বেশি হয় এই ভয়ে সবাই সন্ধ্যা নামতে না-নামতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে মালপত্র নিয়ে কয়েকদিনের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের গ্রামের বাড়ি যেতে হতো। ভৈরব বা নরসিংদি থেকে ভোরে ভোরে লঞ্চে চড়ে আমরা বাড়ির পথে রওয়ানা দিতাম। ঘন্টা পাঁচকের সেই লঞ্চ যাত্রায় আমাদের একমাত্র বিনোদন ছিল খানিক পর পরসিদ্ধ ডিম আর ঝালমুড়ি খাওয়া। এভাবে ডিম আর ঝালমুড়ি খেতে খেতে আমরা একসময় নবীনগরের লঞ্চ ঘাটে গিয়ে হাজির হতাম। আমাদের গ্রামটি খুব প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় নবীনগর নামার পর শুরু হতো নতুন ঝঞ্ঝাট। বর্ষাকালে তিতাস নদী বেয়ে নৌকা পৌঁছে যেতো বাড়ির ঘাটে। আর শীতকালে তিতাসের সাথে যুক্ত খাল-বিলগুলি শুকিয়ে গেলে আমাদের নদীর এক প্রান্তে নেমে যেতে হতো। তারপর শুরু হতো সরিষা ক্ষেতের আল ধরে লম্বা পথ হাঁটা। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়তাম। একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করতাম হাঁটা। খুব কম দিনই সন্ধ্যার আগে গ্রামের বাড়ি পৌঁছুতে পারতাম। আমার ভ্রমনের গল্প এতই দীর্ঘ হতো যে ভ্রমণ কাহিনী শেষ হওয়ার আগেই ছেলে ঘুমিয়ে পড়তো।
আমি ভাবতাম এইসব গ্রামের বাড়ি যাওয়ার গল্প হয়তো আর সব ভ’তের গল্পের মতই সকালে ওঠে সে ভুলে যাবে। কিন্তু কি এক অদ্ভুত কারনে আমার পুত্র এইসব গল্প ভুলতো না। কোন কোনদিন পিৎজা হাটসে পিৎজা খেতে খেতে কিংবা নভো থিয়েটারে মহাকাশ দেখে ফিরতে ফিরতে আচমকাই রঙ্গমঞ্চ থেকে পোষাক খুলে বের হয়ে আসা কোন অভিনেতার মতো বলতো, ‘বাবা, আমাকে কিন্তু তুমি এখনও গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওনি?’
আমি খুব অবাক হতাম তাঁর এই অতৃপ্তি দেখে। যে শিশুটি জীবনে একবারের জন্যও গ্রাম দেখেনি, যার গ্রামকে নিয়ে কোন স্মৃতি নেই। সে কেন ইতালীয়ান পিৎজার গন্ধ মুখে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার জন্য বায়না ধরে-তা আমার ভাবনায় কুলোতো না। এই অতৃপ্তি আমি বাবার মধ্যেও দেখতাম। বাবার অতৃপ্তির একটা যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল। গ্রামের বাড়িতে তাঁর জন্ম হয়েছিল। গ্রামের মাটিতেই তিনি বেড়ে ওঠেছিলেন। আর সব নাগরিকদের পূর্বপুরুষের মতোই একদিন চোখের জল মুছতে মুছতে পেটের টানে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে এসেছিলেন। সংগে ছিল অনেক স্বপ্ন। ছিল আবার গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রত্যয়। কিন্তু নাগরিক জীবন মানেই চোরাবালিতে আটকে পড়া জীবন। এই চোরাবালিতে আটকে গিয়ে তাঁর আর গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়া হয়নি।
ঢাকা শহরে যেদিন আমার বাবা ছোট্ট এক খন্ড মাটি কিনলেন সেদিনও বলেছিলেন, ‘তোদের জন্য কিনলাম। চাকরী শেষ কইরা আমিতো বাড়িত ফিরা যামু।’
নিজের সীমাবদ্ধতা জানার পরও বাবার কেমন যেন একটা নেশা পেয়ে বসলো। ঢাকার নীচু জমিতে মাটি ফেললেন। তাঁরপর একদিন লোন নিয়ে শুরু করলেন দালান তোলা। সেই দালান এমনই দালান যে একবার তাতে হাত লাগালে সেই হাত আর সরিয়ে নেওয়া যায় না। মায়ের গয়না গেল। ব্যাংকের আপদকালীন মজুদ শেষ হলো। আমার প্রথম জীবনের ইনকাম। যা দিয়ে মানুষ একটু ফুটানি মারে তাও তিনি নির্দয়ভাবে কেড়ে নিলেন। তাঁর অসংখ্য কেড়ে নেওয়ার কাহিনী যোগ করে আমাদের একদিন একটা বাড়ি তৈরি হয়ে গেল। জৌলুসহীন সেই বাড়িতে আমাদের একটা নতুন স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করে দিয়ে তিনি আবার বললেন,’ দালানে সুখ নাইরে। আলো নাই, বাতাস নাই। আমরার বাড়ির পুষ্কুনীর পাড়ে এই সময় কি উতরাইল বাতাস থাহে। গাছ থাইকা টপ টপ কইরা আম পড়ে। যখন ইচ্ছা পুকুরে বুর পারতাম পারি। এইহানে তোরাই থাক। আমি বাড়িত যামুগা।’
ঢাকায় বসেই তিনি গ্রামের জমি বিক্রি করলেন। সেই জমি বিক্রির টাকা দিয়ে নবীনগরের প্রত্যন্ত গ্রাম জুলাইপাড়াতে পাকা ঘর উঠতে লাগলো। মাঝে মাঝে টেলিফোনে শুনতাম আমাদের গ্রাম সম্পর্কীত এক চাচার সাথে বাবার মান অভিমান। ’ তোরে কইলাম মুরগী মার্কা ঢেউটিন দিতে আর তুই দিলি পান মার্কা টিন!’
গ্রামের সেই চাচা হয়তো ঐপাশ থেকে বলতেন, ’ পান মার্কা টিন ভালো।’ কিন্তু বাবা মানতেন না। টেলিফোন নামিয়ে রেখে হতাশ গলায় বলতেন, ’ নিজে থাইকা কাম না করাইলে এমনই হয়। যাইতে হইবো, যাইতে হইবো একদিন।’
এই ’যাইতে হইবো একদিন’টা আর আসেনি। পুকুর পাড়ে বসে উতরাইল বাতাস খাওয়া হয়নি। এক রাতের জন্যেও পান মার্কা সেই টিনের বাড়িতে তাঁর থাকার সৌভাগ্য হয়নি। ’পান মার্কা’ ঢেউ টিনের বাড়িতে যাওয়ার যে শক্তি দরকার তা তিনি অসুখে আক্রান্ত হয়ে হারিয়ে ফেললেন। ডাক্তার চুপিচুপি বললেন, বড়জোর আর তিন মাস বাঁচবেন।
পিতার সাথে তখনও আমার মিথ্যার সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। সম্ভবত প্রথমবারের মতো আমি সজ্ঞানে মিথ্যা বললাম। ’ডাক্তার বলছেন, আপনার সুস্থ হইতে মাস তিনেক লাগবে। তিনমাস পর আপনারে গ্রামে নিয়া যামু।’
আমাকে তিনি বিশ্বাস করতেন। অবিশ্বাস করার মতো কোন স্মৃতিই তাঁর ছিল না। নামী-দামী হাসপাতালের পরিপাটি কেবিন। কেতাদুরস্থ ডাক্তার। হিন্দি বলা নার্সদের নগ্ন আচরন দেখে সুস্থ হওয়ার বিষয়ে বিন্দু পরিমান সন্দেহ না রেখেই তিনি আবার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। আমার বলা মিথ্যার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তিনি টেলিফোনে গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের সাথে তিন মাস পরের কোন একদিন বাড়ি যাওয়ার তারিখ-সময় ধার্য্য করা শুরু করলেন। মাঝে মাঝে বিছানায় শুয়ে শুয়েই আমাকে ডাকতেন আর বলতেন, ’ সাহজাহানের সাথে কথা হইছে, তুই আমারে শুধু নবীনগর নিয়া যা। বাকি পথ আমার গুষ্ঠীর লোকজন কান্ধে কইরা নিয়া যাইবো।’
সুফিবাদি দর্শনের দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে আমি হয়তো ঠিকই বলেছিলাম। তিন মাস পর দেহত্যাগ করলে শারীরিক যাতনা থেকে তাঁর মুক্তি ঘটবে। তাঁর পরমাত্মা ঘুরে বেড়াতে পারবে শৈশবের স্মৃতির ধূলোতে। কিন্তু এ বিশ্লেষণ আমাকে মিথ্যা বলার অপরাধ থেকে আজ পর্যন্ত মুক্তি দিতে পারেনি। তবে নিজের ব্যস্ততা এবং শেষ দিকে বাবার শরীরের দ্রুত অবনমনের কারণে তাকে আর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অপরাধবোধ লাঘবের জন্যইআমি পণ করেছিলাম যেভাবে হোক পুত্রের শখ আমি পূরণ করবোই। সে কারনেই এবার শীতে বাড়ি যাচ্ছি.. .
নবীনগর পর্যন্ত এখন সড়কপথে যাওয়া যায় তা আগেই জানতাম। কিন্তু নবীনগর এসে ডাক বাংলোয় ওঠার পর জানতে পারলাম এখন আমাদের গ্রামের বাড়ি যেতে নৌকা লাগে না। দশ কদম পথও পায়ে হাঁটতে হয় না। সিএনজি’তে চড়েই গ্রামের বাড়ি পৌঁছানো সম্ভব। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই অগ্রগতি আমাকে পুলকিত না করে বরং বিমর্ষ করে দেয়। বিভোর জানে, আমাদের গ্রামের বাড়ি যেতে তিতাস নামের একটা নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা ভাসাতে হয়। তারপর কখনো পাঁয়ে হেঁটে, কখনো কয়েকগুচ্ছ বাঁশ দিয়ে বানানো সাকোতে এ্যাক্রোব্যাটদের মতো দোল খেতে খেতে লম্বা পথ পারিদিয়ে গ্রামের বাড়ি পৌঁছুতে হয়। আমার পুত্র আমারই বলা গল্প শুনে শুনে মনের গহীন কোণে গ্রামের যে ছবি এঁকেছে, সিএনজি চড়ে বাড়ি গেলে তার আর অস্তিত্ব থাকবে না।
তাই, আমি ফুপাতো ভাইয়ের সাথে পরিকল্পনা করে বাড়ি যাওয়ার একটা নতুন পথ বানালাম। ডাক বাংলোর পেছনের ঘাট থেকে একটা নৌকা ভাড়া করে মরা তিতাসের বুকে অনেকক্ষণ ঘুরলাম। তারপর বাড়ির অনেক দূরের এক জনমানবশূন্য পরিত্যাক্ত ঘাটে নৌকা থামালাম। সেখান থেকে সরিষা ক্ষেতের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম। আমার নবসৃষ্ট এই অলৌকিক পথ পারি দিতে গিয়ে আমার পুত্র কখনোই অনুধাবন করতে পারলো না যে, আমি তাঁকে আনন্দ দিতে গিয়ে একধরনের বিভ্রমের দিকে ঠেলে দিয়েছি। যেই আমি শিশুদের জন্য বড়দের লেখা গল্প এক ধরনের বিভ্রম সৃষ্টি করে ভেবে কোনদিন শিশুতোষ গল্প লিখিনি সেই আমি সজ্ঞানে নিজের পুত্রকেই এক ধরনের বিভ্রমের দিকে ঠেলে দিলাম। আমার বিশ্বাসী পুত্র সেই নবসৃষ্ট পথকে সত্য-পথ ভেবে ক্ষেতের আল ধরে অবিরাম দৌঁড়াতে থাকে। আমাকে রেখে দৌড়ে অনেক দূরে চলে যায় তারপর আবার দাঁড়িয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে আমি আবার যখন তাঁর কাছাকাছি আসি তখন সে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার দৌঁড়াতে শুরু করে। এভাবেচলতে চলতে সে একসময় ঠিকই গ্রামের বাড়ি পৌঁছে গেল। ভুল পথে বা নতুন পথে বাড়ি এসে সে তেমনই আনন্দিত হয় যেমন আনন্দিত আমি হতাম একদিন সঠিক পথে যেয়ে।
বাড়িতে গিয়েও তাঁর উদ্যমে ভাটা পড়ে না। ঢাকায় ছোট্ট একটা গলির এমাথা-ওমাথা সাইকেল চালানো বালক বিশাল উঠান আর বড় বড় দুই পুকুরের পার ধরে সমবয়সী বালকদের সাথে অবিরাম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একসময় আমাকেই ভুলে যেতে থাকে। তাঁর এই ক্ষুদ্র জীবনে এর চেয়ে বড় বিস্ময় হয়ে পূর্বে আর কিছু ধরা দেয়নি । তাঁর আনন্দ দেখে মনে হয়, কোন জাদুকর ক্যালেন্ডারের পাতায় ঝুলতে থাকা গ্রামে তাঁকে জাদু বলে প্রবেশ করিয়েছে। কখনো উঠানে, মুহূর্ত পরেই পুকুর ঘাটে আবার কখনো বাড়ির শেষ সীমানার গাছ-গাছালিতে ঘেরা বাগানের বনজ পরিবেশে তাঁর ক্রমাগত স্থানান্তর দেখে মনে হয়, সে যেন ঝাঁপ দিয়ে ক্যালেন্ডারের এক পাতা থেকে আরেক পাতায় ঢুকে পড়ছে। বারো পাতা নয়, হাজার পাতার ক্যালেন্ডারের ছবির ভেতর দিয়ে যাত্রা করছে সে। আর আমি পান মার্কা টিনের ঘরে বসে বাবার কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হতে থাকি। অনেকটা সময় আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর দুপুরের দিকে সে আমাকে খুঁজতে শুরু করে। হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে জানায়, ’বাবা, আমি সেই পাখিটা দেখেছি।’
আমি হঠাৎ করে ধরতে পারি না, সে কোন পাখিটির কথা বলছে। বেশ বিস্ময় নিয়ে জানতে চাই ’কোন পাখিটি দেখেছো?’
এ প্রশ্নের উত্তরে সে খুব বিস্মিত হয়। আমার ওপর খানিকটা অভিমানও করে। আঙুলটা আকাশের দিকে তুলে বলে, ‘ঐ যে ময়না পাখিটা। যেটা কথা বলতো?’
আমার এবার মনে পড়ে সেই ময়না পাখিটির কথা। বিভোর ভেবেছিল, ময়না পাখিটির চলে যাওয়া আমাদের সবার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ; যেমন গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাছে। যে পাখিটি আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকার বাসায় আনা হয়েছিল। যে পাখিটিকে সে দুধ-কলা খাওয়াতো। দুপুরে গোসলের জন্য বাটিতে ভরে পানি দিত। সেই পাখিটিকে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। একবার বিভোর যখন কিছুদিনের জন্য তাঁর নানার বাড়ি বেড়াতে গেল, তখন পাখিটার খুব অসুখ করলো। অন্য পাখিদের নিয়ে আমার কোন বিশেষ আবেগ ছিল না কিন্তু ঐ ময়নাটিকে নিয়ে আমাদের বাসার সবারই একটা বিশেষ দুর্বলতা ছিল। পাখিটা মরে গেলে ছেলে কষ্ট পাবে ভেবে, আমি খাঁচা সুদ্ধ পাখিটিকে নিয়ে অফিস কামাই দিয়ে, বঙ্গবাজারের পশু-পাখির হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ডাক্তারের পরামার্শে এক গাদা ঔষধ কিনে খাওয়ানোও হয়েছিল। কিন্তু তারপরও পাখিটিকে বাঁচাতে পারিনি। বিভোর নানার বাড়ি থাকতে থাকতেই পাখিটি মরে গিয়েছিল। পাখিটির মৃত্যু যে, বিভোরের চোখের সামনে হয়নি তা ভেবে স্বস্থি পেয়েছিলাম। আবার পাখির মৃত্যু সংবাদটি কি করে দিবো -তা ভেবে একটু বিচলিতও ছিলাম। আমাদের এক আত্মীয় যিনি পাখিবিশারদ হিসেবে পরিচিত তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন,’বিভোরকে বলো নাÑ পাখিটি মরে গেছে। সে মনে কষ্ট পাবে। তাঁকে বলো, পাখিটি উড়ে গেছে।’
এরকম একটা মোক্ষম জবাব পেয়ে আমরা অনেকটা নির্ভার হয়েছিলাম। বিভোর নানা বাড়ি থেকে ফিরলে আমরা বাসার সবাই একযোগে জানালাম, ‘পাখিটা খুব দুষ্ট। খাবার দেওয়ার সময় খাঁচার দরজা ফাঁক হয়েছে আর ওমনি সে ওড়ে গেছে।’ সে খুব অবিশ^াস নিয়ে শূণ্য খাঁচার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল। এত সযতেœ রাখা পাখিটি যে তাঁকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারে তা বিশ্বাস করতে বিভোরের খুব কষ্ট হয়েছিল। সে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বারবার বলেছিল, ’ আমি যদি থাকতাম, তবে পাখিটি যেত না।’
এতদিন পর সেই পাখির প্রসঙ্গ ফিরে আসায় আমি খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ি। ভুল পথে বাড়ি এনে একবার অন্যায় করেছি। এখন আবার একটা মৃত পাখি নিয়ে সন্তানের সাথে মিথ্যে বলতে হবে বলে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আস্তে করে বলি, ’ এই পাখিটা আমাদের ময়নাটা না। এটা অন্য কোন ময়না।’
সে এবার খুব বিরক্ত হয় যেন। নাছোরবান্দার মতো আমার মুখটা নিজের মুখের দিকে ফিরিয়ে আনে। খুব আত্মপ্রত্যয়ী ভাব নিয়ে বলে, ‘ময়না পাখিটার বাড়ি আমাদের গ্রামে না? পালিয়েতো তার এখানেই আসার কথা।’
এবার আমি তাঁর যুক্তির কাছে হার মানি। পাখিদের যে কোন দেশ নেই। কোন ভৌগলিক সীমানা নেই। তাদের যে মানুষের মতো কোন গ্রাম নেই – তা বুঝার মতো বয়স বিভোরের হয়নি। সুতরাং এই পাখিটি যে ঐ পাখিটি নাস্তা বিভোরকে আমার পক্ষে বুঝানো অসম্ভব। নিজের মিথ্যার ফাঁদে যে নিজেই একদিন আটকে পরবো তা আগে কখনো ভাবিনি। তবু আস্তে করে বলি,’এরকম অনেক ময়নাইতো আছে..’
সে আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে ’ কিন্তু এই ময়নাটাতো আমাকে জিজ্ঞেস করেছে-ভালো আছো?’
আমি খুব বিষন্ন হয়ে পড়ি। আমি অনুধাবন করি, শুধু একটা ময়না পাখির মৃত্যু সংবাদ না-জানার কারনে অনেক বছর পরও আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার বিভ্রান্ত পুত্র পাখিটিকে খুঁজতে থাকবে। একবার ভাবি সত্য কথাটি জানিয়ে দেই। বিভ্রান্তি থেকে পুত্রকে মুক্তি দেই। আবার ভাবি, মিথ্যাতো মানব জীবনেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মিথ্যা যদি খানিকটা স্বস্তি বা আনন্দ দেয় তবে তাতে দোষের কিছু থাকে না।আমি পুত্রের হাত ধরে উত্তেজিত ভাব নিয়ে বলি, ’ চলোতো, পাখিটা দেখে আসি?’
আমিও বাড়ির পেছনের গাছ-গাছালিতে পূর্ন বাগানটিতে হাজির হই এবং পুত্রের হাত ধরে পাখিটিকে খুঁজতে থাকি। পাখিটিকে খোঁজার অভিনয় করতে গিয়ে আমার মনে হয়, এভাবেই হাজার কিংবা লক্ষ বছর আগে শত্রুর দেওয়া আগুনে হয়তো পুড়ে গিয়েছিল খাচাসুদ্ধ কোন পোষা পাখি। কোন গ্রীক পিতা হয়তো তার প্রিয় পুত্রকে সান্তনা দিতে গিয়ে আরেকটা জীবন্ত পাখি ধরে এনে বলেছিল, ’এই দ্যাখ তোর সেই পাখি, ছাই থেকে আবার জন্ম নিয়েছে।’ পৃথিবীর নিয়মে সেই গ্রীক পিতা-পুত্র হারিয়ে গেছে কিন্তু টিকে আছে সেই ফিনিক্স পাখি।
মাসউদুল হক
লেখক : কথাসাহিত্যিক