উন্নয়নের পথে শত্রুমিত্র

গোলাম কিবরিয়া

0
1096

মহাজোট সরকারের যারা শত্রু তারাও এখন বলছে দেশের নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু দিক আছে দৃশ্যমান; কিছু আছে অদৃশ্য। আমরা জানি,উন্নয়ন অর্থ বিদ্যমান অবস্থার ধীরে ধীরে ইতিবাচক পরিবর্তন। এই অর্থে দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীগণ ক্রমাগত ভারসাম্যহীন মূল্যায়ন করার প্রবণতা লালন করেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে এড়িয়ে যান। 
বিগত এক দশকে দৃশ্যমান উন্নয়নের ধারায় সড়ক যোগাযোগ সর্বসাধারণের মনোযোগ কেড়েছে। এখন সড়ক যোগাযোগ মানুষের বিরক্তির কারণ হচ্ছে না। কিন্তু মানুষের অসন্তোষের কারণ হচ্ছে গাড়িভাড়া আদায় এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনাগত বিদ্যমান অনিয়ম। অধিক মুনাফালোভী বাসমালিকেরা এর জন্য দায়ী। তারা সুযোগ পেলেই যাত্রী সাধারণের পকেট কাটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কারা এই হয়রানি বন্ধে এগিয়ে আসবে? নিশ্চয় এরজন্য সরকারি বিভাগ রয়েছে, যারা এই দিকটি মনিটরিং করার কথা। আমরা মনে করি, এই ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল সরকারি বিভাগই সরকার ও জনগণের শত্রু। এরা বাস মালিকদের থেকে অবৈধ সুবিধা নিচ্ছে ; ফলে উন্নত অবস্থার সুফল পাওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 
সরকার নির্মাণ খাতে ঈর্ষণীয় বরাদ্ধ দিচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠিকাদার, প্রকৌশলী এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে প্রত্যাশিত কাজ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে মূলতঃ আওয়ামী লীগের ছাতায় আশ্রয় নেয়া গোষ্ঠীই সরকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়েছে। তারা নির্ভয়ে তাদের কুকর্ম করে যাচ্ছে। এমন শোনা যায়, কাজ না করে ঠিকাদার সরকারি টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছে। এরা উন্নয়নের শত্রু এবং দেশের শত্রু। এদেরকে চিহ্নিত করতে হবে এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। 
বর্তমানে জিডিপির প্রায় অর্ধেক সেবাখাত যোগান দিচ্ছে। সেবাখাত গতিশীল এবং যৌক্তিক আচরণ করতে সমর্থ হলে শিল্প ও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষাসহ বাদবাকি খাতে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। অথচ সেবাখাতে যুক্ত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের এক বিশাল অংশ সেবা গ্রহণকারীদের সাথে অসহযোগিতা করেন, ঘুষ নিয়ে থাকেন এবং উন্নয়নের সাথে স্পষ্টতঃ সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। ফলে, মানুষ আর্থিক ও মানসিক ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন।অন্যদিক, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়নের অভিযাত্রায় এসকল দুর্নীতিবাজ বাঁধা সৃষ্টি করছে। এদের কারণে কৃষি ও শিল্পখাতে প্রত্যাশিত জিডিপি আহরিত হচ্ছে না।
সরকার কৃষিখাতে বিভিন্নধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে।সরকার কৃষকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে, সার,বীজ এবং নগদ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। উল্লেখ্য যে, সরকার এই সিদ্ধান্তের অধিকাংশই বিশ্বের মোড়ল এবং ঋণদাতা গোষ্ঠীর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বাস্তবায়ন করছে। এতে দেখা যাচ্ছে, কৃষিতে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এই সেবাখাতের কর্তাদের মন্দমানসিকতার কারণে কৃষক তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। আমরা চলতি বছরে কৃষকের ধান বিক্রিতে সরকারি কর্তাদের অসহযোগিতার চরম প্রমাণ পেয়েছি। চাল ব্যবসায়ীরা কম দামে(৮০০ টাকা মন) কৃষকের ধান কিনে সরকারের কাছে বিক্রি করেছে ১০০০ টাকা। এতে কৃষক তাদের পুঁজি হারাচ্ছে, ঋণগ্রস্ত হচ্ছে এবং আরো গরীব হচ্ছে – যা সরকারের লক্ষ্য পূরণের(এলডিজি এবং এমডিজি) পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। তাহলে, নিঃসন্দেহে উন্নয়নের পথে বাঁধা সৃষ্টিকারী শত্রুদের চিহ্নিত করা যায়। (চলমান)

শিক্ষাখাতের উন্নয়নঃপ্রাথমিক ও মাধ্যমিক

একটা জাতির স্থায়ী এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা পূর্বশর্ত।স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুদরাত-ই-খুদা কমিশন গঠন করেন যা যুগের চাহিদা পুরন করতে সমর্থ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষাক্ষেত্রে বিশৃংখলার সূচনা হয়, যে ধারা অদ্যাবধি চলমান আছে। শিক্ষাক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরেই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অশুভ কর্ম চলমান আছে। একই দেশে বসবাস করে, একই দেশের জনগণের জন্য স্বীকৃত সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করার দাবিদার হয়েও জনগণ বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার শিকার হচ্ছে। একই দেশে একই পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাস্তরে ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।মাঝেমধ্যে সর্বশেষ শিক্ষানীতির সুপারিশ বাস্তবায়নের আওয়াজ তোলা হয় ;কিন্তু সময় চলে যায় তার আর বাস্তবায়ন হয় না। কারণ,শিক্ষাখাতে বরাদ্ধ অযৌক্তিকভাবে নিম্নগামী। বৈশ্বিক বিচারে বাজেটে যতটুকু অর্থ বরাদ্ধ রাখা উচিত, তা রাখা হয় না। ফলে, বিদ্যমান বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের ব্যবস্থাপনা সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা স্তরের অবস্থা হতশাজনক অবস্থায় আছে। 
শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রশাসন এবং ব্যবস্থাপনা সম্মানজনক পর্যায়ে যাবার কোন লক্ষ্মণই দেখা যাচ্ছে না। প্রথমতঃ এখানে সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, বেতন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম শক্ত ভীতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ভালো শিক্ষা প্রশাসন আছ কিন্তু ব্যবস্থাপনা নেই। কারণ, দীর্ঘদিনের অবহেলা আর দুর্নীতিবাজ নীতিনির্ধারকদের লোভের ফাঁদে পড়ে এখানে প্রচুর পরিমানে ভুল মানুষ জমায়েত হয়েছে। এরা কী করা উচিত, কেন করা উচিত, কাদের জন্য করা উচিত তা হয়তো ভালো বুঝেন না ; কিন্তু কিভাবে অবৈধ অর্থ হস্তগত করা যায় তা ভালো বুঝেন। এই গোষ্ঠির বেহায়াপনার কারণে শিক্ষাবিভাগ দুর্নীতির অন্যতম শীর্ষস্থানে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে দুর্নীতি তীব্রমাত্রায় বিদ্যমান, সেখানে সেবাপ্রাপ্তির হার নিম্নগামী হবে – এটাই স্বাভাবিক। তাহলে, আমরা শিক্ষায় উন্নয়নের পথে শত্রু কারা তা সহজেই অনুমান করতে পারি। 
এখন সজ্জন ব্যক্তিবর্গ অভিযোগ করতে পারেন, জনগণের জন্য তাদের প্রতিনিধি সাংসদবৃন্দ আছেন, যারা প্রত্যাশিত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রনয়ণ করতে পারেন। হ্যাঁ, এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের বলতে হয়, সর্বশেষ শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী একটা শিক্ষা আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত প্রায় একদশক ঝুলে আছে।যেহেতু আইন সার্বজনীন, তাতে অন্ততঃ লিখিতভাবে বৈষম্যহীনতার স্বরুপ প্রকাশিত থাকবে। কিন্তু আইনের খসড়া রূপই আজ পর্যন্ত ফাইল বন্দী আছে।অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে নিরিহ আম জনতার সাথে জন প্রতিনিধিদের মিত্রতা কিভাবে রক্ষিত হবে? এমন অবস্থায় আমরা কি বলতে পারি নাঃদেশে সার্বজনিক উন্নয়নের ধারায় মিত্রজনের সংখ্যা অতি নগন্য। 
দ্বিতীয়তঃ সবজান্তা ইনোভেটিব সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত একটা গোষ্ঠী আছে। এরা নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে আসেন। যদিও এদের অধিকাংশই কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পূর্বে কোন স্বীকৃত গবেষণা করার সুযোগ পাননা। নতুন প্রকল্প মানেই নতুন অর্থ, নতুন সুযোগ। এক্ষেত্রে যে কোন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে গবেষণা আবশ্যিক। এই গবেষক সম্প্রদায় হবেন দেশ, জনগণ এবং উন্নয়নের মিত্র। যদি নীতি নির্ধারকগণ এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন, তাহলে তারাও উন্নয়নের পথে মিত্র বলে বিবেচিত হবেন। 
তৃতীয়তঃ দরদী সরকার মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দিচ্ছে। সারা দেশের অভিভাবকগণ খুশি। কিন্তু যারা তাদের সন্তানদের নিয়ে ভাবেন, তারা বিপদ অনুভব করেন। কারণ,তারা জানেন শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে দুইহাজার টাকার বই পেলেও প্রতিমাসে তাদের সন্তান পিছু আরও চার পাঁচ হাজার ব্যয় করতে হবে।কয়েক হাজার টাকার গাইড বই কিনতে হবে। এটিই হলো বাস্তবতা। যার বিত্ত আছে, তিনি তার সন্তানের জন্য চিত্ত উজাড় করে দিবেন – এটাই সঙ্গত।সাথে সাথে, একজন সচেতন অভিভাবক তার সন্তানকে অধিকতর যোগ্য শিক্ষকের কাছে নিয়ে যাবেন, তাদের সহযোগিতা চাইবেন।কিন্তু বিচার বিভাগ সরকারি বেতনভোগী শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সাথে সাথে এও বলেছে যে, যারা শিক্ষকতায় যুক্ত নেই শুধুমাত্র তারাই প্রাইভেট টিউশনি করতে পারবেন। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শিক্ষাদান এবং গ্রহণকে ফলপ্রসূ করতে হলে শিক্ষকের যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকা পূর্বশর্ত।অতএব, প্রশিক্ষণহীন ব্যক্তিবর্গের শিক্ষাদান শিক্ষাদান শিক্ষার্থীদের ভার বাড়ালেও ধার বাড়াতে সক্ষম হবে না। উন্নত বিশ্বে শিক্ষায় ডিগ্রি থাকা ব্যতীত শিক্ষকতা (প্রাইভেট টিউশনিও) করা অসম্ভব। এই বিষয়ে আদালতের নির্দেশ-নির্দেশনার পরে আমার এক বন্ধুকে সরকারি জনৈক পদস্থ কর্মকর্তা তার ছেলেকে প্রাইভেট পড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন।আমার বন্ধু বলেছিলেন, স্যার আমি আইন মানি। পড়াতে পারবো না। তখন বিব্রত কর্মকর্তার মুখশ্রী মলিন হয়ে গেল। 
চতুর্থতঃ সরকার বৈদেশিক ঋণের আওতায় শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, ICT প্রশিক্ষণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবস্থাপনাসহ কর্মকর্তাদের জন্যও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পরিচালনা। প্রায় সারা বছরব্যাপি এধরণের প্রশিক্ষণ চলছে।এতকিছুর পরেও প্রত্যাশিত অর্জন হচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কিংবা প্রশাসনিক পর্যায়ে পুরুস্কার বা তিরস্কারের ব্যবস্থা নেই। বরং এখানে অর্থহীন তেলের কদর আছে। ফলে যোগ্যরাই প্রতারিত হচ্ছে। আমরা মনে করি, শিক্ষা প্রশাসকের মূল্যায়নে শিক্ষকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত ; অন্যদিক, শিক্ষকের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।শিক্ষক মূল্যায়নে সেরারাই পরবর্তীতে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।যদিও এই প্রক্রিয়া নিকট ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা নেই। যদি তা করা সম্ভব হয় তাহলে শিক্ষাখাতের উন্নয়নে প্রত্যাশিত গতি সঞ্চার হবে।
পঞ্চমতঃ শিক্ষার্থী মূল্যায়নে পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকএবং শিক্ষাক্রম নির্ধারণ করে NCTB. এখানে নিযুক্ত কর্তাদের নিয়োগে অনিয়ম হলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই ধ্বংস হতে বাধ্য। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ পাঠ্যপুস্তকের বিষয়ে মাঝেমধ্যে তাদের হতাশার কথা প্রকাশ করেন। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, NCTB তে সমস্যা আছে। বিশ্বমানের শিক্ষার জন্য বিশ্বমানের শিক্ষক- কর্মকর্তার অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। 
যুগের চাহিদা বিবেচনা করে শিক্ষার্থী মূল্যায়নে সংস্কার করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর এক বা দুটি বিষয়ের দূর্বলতাকে তার সামষ্টিক সাফল্যের কাছে তুচ্ছ যেন না করা হয়।

উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গ

জম্মের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে ডাকা হতো। এর প্রথম ভিসি ছিলেন স্যার পি জে হার্টগ,যিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং দক্ষ প্রশাসক ছিলেন । তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ ভারতের সেরা পণ্ডিতদের সমাবেশ ঘটান। অধ্যাপক সত্যেন বোস এখানে বসেই তার যুগান্তকারী গবেষণা শুরু করেন। অধাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার, কবি মোহিতলাল মজুমদার এবং ডঃ মুহাম্মদ শহীদ উল্যাহর মতো প্রতিভাবানদের পবিত্র পদচিহ্ণে এই বিশ্ববিদ্যালয় মুখরিত হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষকদের জন্যই তাবৎ বিশ্বের সমীহ আদায় করেছিলো। এখন প্রশ্ন হলো, এতো এতো নামী অধ্যাপকগণ কেন এই নবীন বিদ্যালয়ে এসেছিলেন? মূলতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন শিক্ষকদেরকে বিশ্বের সর্বোচ্চ বেতন এবং সুযোগ সুবিধা প্রদান করতো। 
বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাতিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় মূলতঃ চাকুরী বাজারের কর্মী তৈরি করে। ফলে তাদের শিক্ষার্থীরা জ্ঞানসাধক হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে জীবনাচারে ব্রতী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না বা সে সুযোগও পায়না। সরকারি বাধ্যবাধকতা না থাকলে তারা মানবিক বিষয়সমূহ বাদই দিয়ে দিতো। অন্যদিকে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের অধিকাংশই মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে জুলুমের শিকার হচ্ছে। 
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা আশিভাগ শিক্ষক বিশ্বমানের।তাদের বিষয়ের জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা যেকারো শ্রদ্ধা কেড়ে নিতে সক্ষম। দেশে এখনও তাদেরই একটা অংশ মানুষের অনুকূলে সাহসী শব্দ উচ্চারণ করে। তবু্ও আজ আমরা সেরাদের তালিকায় নেই। কিন্তু কেন? তথ্য খুঁজে খুঁজে যা উপলব্দি করা যায়, তা হলঃআমাদের জুনিয়র পণ্ডিতগণ এদেশে তাদের স্বপ্নের গবেষণা করার সুযোগ পাননা। ফলে, অনিবার্যভাবে উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমান। সিনিয়র পণ্ডিতগণের অধিকাংশই দেশের প্রেমে বন্দী হয়ে গোপনে অশ্রুপাত করেন। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কথা আমরা কে না জানি? ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী গণিতজ্ঞ এদেশে নির্ভৃতচারী হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।

পৃথিবীর সম্ভবতঃ একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে ভেদামাছ আর শিংমাছের একই দাম। স্ব স্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের বেতন ভাতা মোটেই সম্মানজনক নয়। ফলে অনেকে দেশান্তরি হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের সাথে সংগতিপূর্ণ হলেও বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি অধ্যাপক নিয়োগ নিষিদ্ধ। অথচ আমাদের মেধাবী সন্তানেরা সম্মানের সাথে বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে। মানুষ নিবে আর দিবে ; এভাবে নিজকে সমৃদ্ধ করবে – এটাই সময়ের দাবি। এদিকটায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আছে। তারা স্বল্পসংখ্যক হলেও বিদেশি অধ্যাপকদের নিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে। তারা তার ফলও পাচ্ছে। 
আমরা কথা বলছিলাম উন্নয়নের পথে শত্রু মিত্র নিয়ে। এককথায় বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ আজ মিত্রহীন। এখানে বিদ্যার ভার অতুলনীয় ; কিন্তু ধার বাড়ানোর জন্য প্রায়োগিক সুযোগ সীমাবদ্ধ। এর প্রধান কারণ, এখানে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্ধ অন্যায্যভাবে স্বল্প। বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের গবেষক উপহার দিবে ; এটাই প্রত্যাশা এবং দাবি। কিন্তু রাষ্ট্র তার ভিত্তি মজবুত করার জন্য জ্ঞান সাধনার পথ রচনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেকে মনে করেন, সুবিধাবাদী গোষ্ঠী যারা শিক্ষকের পদ হাতিয়ে নিয়েছে, তারাই এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। কারণ, তারা যতটুকুনা শিক্ষক তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক জীব। তাদের অনেকে ভূয়া পিএইচডি নিয়ে প্রশাসনে উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত হন। এরাই যাদের চাপিয়ে রাখা যাবে তাদেরকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পেতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় অর্থ বরাদ্ধে দৈন্যতা সম্পর্কে বললে বলতে হয়ঃপ্রতিবেশী দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গবেষণায় বরাদ্ধকৃত অর্থ আমাদের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গবেষণায় বরাদ্ধকৃত অর্থের চেয়ে বেশি। এই বিষয়টি ডঃজাফর ইকবাল স্যার তাঁর একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন। 
তবে গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়। মহাজোট সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পাটের জিনোম আবিস্কারসহ বেশকিছুক্ষেত্রে সফল গবেষণা পরিচালিত হয়। 
এখন প্রশ্ন হলোঃসরকার অর্থ বরাদ্ধে ব্যর্থ হলে কারা এগিয়ে আসবেন। বর্তমানে দেশে অর্ধলক্ষের অধিক কোটিপতি আছেন। বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিত্তবানদের উদার সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। তারা সেরকম ব্যক্তিত্বও ধারণ করেন। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চাইলেই বিত্তশালীরা চিত্তের উদারতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন।বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে তাদের সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে।। 
বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করতে হলে মেরুদণ্ডধারী প্রশাসকের সাথে সাথে শিক্ষক নিয়োগে, পদোন্নতিতে, শিক্ষার্থী ভর্তিতে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে হবে। এসব বাস্তবায়নের মধ্যদিয়েই আমারা আমাদের মিত্রদের সন্ধান পাবো,পাবো স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় । 

প্রসঙ্গঃউচ্চশিক্ষায় পেশাদার শ্রেণি

উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর যারা নিজেদেরকে সুনির্দিষ্ট পেশাদার শ্রেণি হিসেবে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তারা হলেন ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং কৃষিবিদ। এরাই একমাত্র পেশাদার গোষ্ঠী যারা তাদের উত্তর কৈশোরের সূচনায় ভবিষ্যতের বীজ বপন করেন। অপরাপর পেশাদার সম্প্রদায় অগত্যা নিজেদের পেশায় নিজেদের আবিষ্কার করে। প্রতিটি দেশের সেবাখাতের গতিশীলতা, সফলতা এবং ব্যর্থতা এই পেশাদার শ্রেণির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। দেশসেরা বালক বালিকারা মাতাপিতার স্বপ্ন পুরনে জীবনযুদ্ধে অগ্রসর হয়। উল্লেখ্য যে, উন্নত বিশ্বে শিক্ষাখাতের কর্মী, কর্মকর্তাও উচ্চশিক্ষার শুরুতেই নিজেদেরকে প্রস্তুত করে।

উল্লিখিত তিনটি পেশাদার শ্রেণির পেশাদার হওয়ার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়। অতিরিক্ত পড়ার চাপে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। পড়াশোনার কারণে এদের অধিকাংশই একটি সুনির্দিষ্ট গণ্ডিতে বন্দী হয়ে পড়ে।

এখন এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাদার শ্রেণি নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথমে কৃষিবিদ নিয়ে আলোচনা করি। কৃষিবিদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। তাদের সক্রিয় সহযোগিতা এবং গবেষণার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি মনে করি বাংলাদেশের কৃষিখাতের উন্নয়ন তার প্রত্যাশাকেও অতিক্রম করেছে। কৃষিখাতের অনেক মাঠকর্মী খুবই নিবেদিতপ্রাণ। এরা বিশাল ক্ষুধার্ত মানুষের আত্মার আত্মীয়।এঁদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীদের একটি অংশ চাকুরী এবং নাগরিকত্ব নিয়ে বিশ্বের উন্নত অংশে পাড়ি জমান। এরা কখনোই দেশের জন্য স্বপ্ন লালন করেনি, দেশের ঋণও শোধ করেনি। এরা অকৃতজ্ঞ গোষ্ঠী বলেই বিবেচিত হবে।

আমি চিকিৎসক সম্প্রদায়কে ঈশ্বরের কাছাকাছি বলে বিবেচনা করি। একজন আগত রোগী একান্ত গোপন কথা নির্ভয়ে ডাক্তারকে বলেই নিজকে নির্ভার অনুভব করে। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসক সম্প্রদায় সবচেয়ে নন্দিত এবং নিন্দিত। এমন রোগী কমই পাওয়া যায় যারা চিকিৎসা নেওয়ার পরে উচ্ছ্বাস আর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তার মানে এই নয় যে, চিকিৎসক যথাযথ চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন। আসলে মানুষ সমস্যা সমাধান যতটুকু না চায় তারচেয়ে বেশি চায় সহানুভূতিশীল আচরণ। বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারষ্পরিক যোগাযোগ দক্ষতা উন্নয়নের উপর খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়না। বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবার উন্নয়নে ব্যক্তিগত দক্ষতার সাথে সাথে পারষ্পরিক সক্রিয় সহযোগিতার উদাহরণও অল্প।কারণ,এখানে অধিকাংশ চিকিৎসক পরষ্পরের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে  প্রতিশ্রুতিশীল পেশাদার চিকিৎসকগণই একঘরে হয়ে পড়েন। শৈশব-কৈশরের স্বপ্ন লালন করা যুবকগণই কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর নিন্দাসূচক বাক্যে বিব্রত হন। সাধারণ জনগোষ্ঠী যারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সেবা নিতে আসেন, তারা প্রতিনিয়ত হতাশ হচ্ছেন। এখানে অধিকাংশ চিকিৎসক চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন দায়ে পড়ে,দয়ায় নয় ; অথচ একজন রোগী ডাক্তারের দয়াদ্র হাতের স্পর্শই অনুভব করতে চায়। মূলতঃ সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা সেবা আজও জনমানসের অন্তর জয়ে ব্যর্থ। অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের ঔষধ বাইরে বিক্রি হয় বলে অভিযোগ আছে । এখানে সংঘটিত আর্থিক অনিয়ম যেন নিয়মে পরিনত হয়েছে। তবে, এসকল সরকারি হাসপাতালে মাঝেমধ্যে কিছু দরদী চিকিৎসক নিয়োগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের অধিকতর সেবার মানসিকতার কারণে তারা দ্রুততম সময়ে উপরে বদলী হতে বাধ্য হন। উপরে আলোচনা থেকে চিকিৎসা সেবায় শত্রুমিত্র চিনতে কারো ভুল হওয়ার কথা নয়। 
আমরা চিকিৎসা সেবার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাই মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। এ স্তরে ব্যবস্থাপনাগত শৃংখলাহীনতার কারণে অনেক অভিজ্ঞ এবং সিনিয়র চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতালে চাকুরি নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন। এদের অনেকেই দলবাজিকে ঘৃণা করেন এবং রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে অস্বস্তি বোধ করেন। এটিই তাদের পেশাগতজীবনে অবমূল্যায়িত হওয়ার কারণ হিসেবে উপস্থিত হয়। এঁদের উচ্চতর দক্ষতা এবং ভেতরের সৌন্দর্য অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়। মিডিয়াও এঁদের অন্তর্ধানের সত্য প্রকাশের প্রয়োজন অনুভব করে না। ফলে জাতি তাঁদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

এঁদের যোগ্যতা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এরা সুদূরপ্রসারী সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভবত তাদের পেশাগত জীবনের নিদারুণ ব্যস্ততা এর জন্য দায়ী। হয়তো বিত্তবান হওয়ার তীব্র বাসনা তাদেরকে সমাজের মতো পরিবারেও একা করে রাখে। 
বর্তমানে বাংলাদেশের যোগাযোগ, নগরায়ন এবং শিক্ষাপ্রকৌশলে যে ব্যপক উন্নয়ন ঘটেছে তা এদেশের প্রকৌশলীদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। এঁদের শ্রম আর দক্ষতার ফল আজকের বাংলাদেশ। এরাই আবার সর্বোচ্চ সমালোচিত পেশাদার শ্রেণি। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, এঁদের সাথে রাজনীতিবিদ এবং ঠিকাদারের যোগসাজশ নির্মান কাজে ত্রুটির জন্য দায়ী। নির্মান কাজে অনিয়মের সংবাদ প্রায়ই সংবাদ দেখা যায়। যারা এসব কাজে যুক্ত তারা নিঃসন্দেহে দেশ ও জাতির শত্রু। এঁদের মধ্যে একটি শ্রেণি আছে যারা শিক্ষাজীবন শেষে বিদেশে পাড়ি জমান । আর ফিরে আসেন না।

উল্লিখিত তিনটি পেশাদার শ্রেণির জন্য রাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে থাকে। অতএব তারাও রাষ্ট্রের ঋণশোধের বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। অন্যথায়, তারা তৃপ্তকর জীবনের স্বাদ পেতে ব্যর্থ হবে। (চলমান)

উন্নয়নে ভারসাম্যহীনতা

সাধারণ জনগোষ্ঠী উন্নয়ন মানে মনে করে রাস্তাঘাট নির্মান বা মেরামত করা, বড় বড় বিল্ডিং নির্মান করা,অফিস ঘর নির্মান করা, স্কুল ঘর নির্মান, সেতু নির্মান ইত্যাদি। তারা দৃশ্যমান পরিবর্তনকেই উন্নয়নের জন্য বিচার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে ; বস্তুগত উন্নয়নের সাথে সাথে অবস্তুগত উন্নয়নের দিকটি স্পষ্টভাবে জড়িত। 
বস্তুগত উন্নয়নের সাফল্য নির্ভর করে অবস্তুগতদিকের উন্নয়নের মাত্রার উপর। অবকাঠামো নির্মানে এর সন্নিহিত এলাকায় এর প্রভাব, রক্ষণাবেক্ষণ, এর গ্রহণযগ্যতা, এর যৌক্তিকতাসহ অন্যান্য যে সকল বিষয়াদি বিবেচনা করা হয় সেগুলোর মাধ্যমে অবস্তুগত উন্নয়নে দেশের অবস্থান নির্ধারণ করা যায়। মানুষের সে সকল গুণাবলি মানুষকে মানুষ হসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেগুলো হল অবস্তুগতউন্নয়নের মাপকাঠি। মানুষের উন্নয়নের অবস্তুগত দিকের নিম্নগামীতা বস্তুগত উন্নয়নকে অর্থহীন করে দেয় ; এবং এমতাবস্থায় দৃশ্যমান উন্নয়ন সর্বত্র নিন্দিত হয় ;কারণ তা জনমানসের প্রত্যাশা পুরনে ব্যর্থ হয়। সাথে সাথে তা সমাজে অসম পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। 
এ মুহূর্তে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের কোথাও তীব্র অভাবী লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিগত চার দশকের পরিবর্তন মাঝে মাঝে আমাকে বিষ্মিত করে। স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও মানুষের মধ্যে বাজে রকমের ভাগ ছিলনা। গ্রামের মানুষের মধ্যে হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল, একের বিপদে অন্যে এগিয়ে যেতো। বর্তমানে সেসব সুন্দর সম্পর্কের অস্তিত্ব নেই।অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচয় দিয়ে স্বস্তি বোধ করে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের অভিমূখে থাকার মধ্যে সুখকর অনেক কিছু আছে। 


রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবস্থাঃ


পৃথিবীর প্রতিটি দেশে মানবিক জীবনবোধের পরিচালক হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা ; অবশ্যই এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রত্যাশিত ভূমিকায় বিরাজিত হবে । বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক পরিবেশে প্রত্যাশিত সংস্কৃতি চর্চার সাথে পুরোপুরিই অসংগতিপূর্ণ। এর ফলে দেশের সর্বদিকে উন্নয়নের অবস্তুগত দিকের অধঃপতন ঘটেছে এবং ক্রমশ মানবিক অনুভূতি বিলুপ্ত হচ্ছে। এর ফলে দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রায় সকল পর্যায়েই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। লুটপাটকারীরা একরকম নির্ভয়ে তাদের অসৎ কর্ম সমাপন করছে। যার ফলে ভবন উদ্ভোদনের আগেই ভেঙ্গে যাচ্ছে, চেইন অফ কমান্ডের মত ঘুষ লেন দেন হচ্ছে, নিরিহ জনমানুষ নিপিড়নের শিকার হচ্ছে, নারী ও শিশু নির্মম জুলুমের শিকার হচ্ছে, সামাজিক বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে গিয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত অভিরুচিতে পরিচালিত হচ্ছে,আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অব্যবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। 
দেশের উন্নয়ন কাজে অর্থ বরাদ্ধে অগ্রাধিকার নির্বাচনে অদক্ষতা বিদ্যমান। ফলে দশতলা ভবনের পাশে হাঁটার রাস্তা পাওয়া যায়না, উন্নয়ন কাজের পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করা হয় না। অন্যদিক, সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রিতার আশ্রয় নিচ্ছেন। 
এজন্য যোগ্যদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করতে হবে।অদ্যাবধি, অভ্র সফটওয়্যারের উদ্ভাবক রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত হননি। অথচ তিনি কোটি কোটি বাঙালির কাছে নন্দিত জন। এরকম অসংখ্য নির্ভৃতচারী রয়েছেন, যারা হার মানেন না, অবনতও হন না ;তাদের যত্ন নিতে হবে। তা না হলে যৌবনের তাড়নায় তারা বিশ্বময় নিজস্ব স্থান আবিষ্কার করে নিবে।

ভারসাম্যহীন আচরণ, ভারসাম্যহীন উন্নয়ন বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে। অতএব,সুশৃংখল আর ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নয়নের মানবিক দিকে সুদৃষ্টি দেয়া সময়ের দাবি। 

টেকসই উন্নয়ন 

অর্থবছর সমাপ্তের শেষলগ্নে এসে আমরা দেখলাম দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় “টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট ” এই শিরোনামে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হল। এর আয়োজক ছিল উপজেলা প্রশাসন। উন্নয়ন সম্পর্কে তৃণমূলে সচেতনতা সৃষ্টিতে এরকম আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

টেকসই শব্দের সাথে আমরা প্রায় সকলে পরিচিত। পারিভাষিক অর্থে এর দ্বারা সম্পাদিত কাজের স্থায়িত্ব নির্দেশ করে। খোলাসা করে বললে বলতে হয়, কাজটি ঠিক যেভাবে হওয়া উচিত সেভাবে হলেই কাজটি টেকসই হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। যেমন ধরুন, খালের উপর কাটভার্ট নির্মিত হল কিন্তু রাস্তা নির্মিত হয়নি ; এমনতর উন্নয়ন হলে বলতে হবে তা টেকসই হয়নি। খাল,নদী ভরাট করে, অবৈধ দখল করে যদি শহর উন্নয়ন করা হয়,বড় বড় দালান নির্মিত হয়- তাহলে তাও টেকসই হয়নি। বর্তমানে, উন্নয়নের জোয়ারে এই সকল প্রাকৃতিক উপাদানই সর্বাগ্রে আক্রান্ত হচ্ছে।কারণ, এগুলো হলো সরকারি সম্পদ। যার ক্ষমতা বেশি, যিনি সরকারি অফিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম তিনিই এসব দখলে নিচ্ছেন। শহরের সৌন্দর্য হচ্ছে মানুষ, জলাশয়, নদী, বাগান আর হাঁটার জায়গা। উত্তর প্রজন্ম আর গবেষকগোষ্ঠী শাসকশ্রেণির যে কাজের জন্য তাদেরকে সমীহ করে তার মধ্যে অন্যতম হল পরিকল্পিত নগরায়ন সৃজনের যোগ্যতা। এই একটা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন সরকার নগরপিতা রেংকিংএ ন্যূনতম স্কোর অর্জন করতে ব্যর্থ হবেন। 

টেকসই উন্নয়ন নিয়ে বৈশ্বিক ভাবনাঃ

২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ১৯৩টি দেশ নিম্নোক্ত ১৭ লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ে একমত হয়েছে:

১)দারিদ্র্য বিমোচন… সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্য নির্মূল করা।

২)ক্ষুধা মুক্তি… ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টির লক্ষ্য অর্জন ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা চালু।

৩)সু স্বাস্থ্য … স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করা।

৪)মানসম্মত শিক্ষা … অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতা-ভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা।

৫)লিঙ্গ সমতা … লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়ের ক্ষমতায়ন করা।

৬)সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা … সবার জন্য পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সহজপ্রাপ্যতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

৭)নবায়নযোগ্য ও ব্যয়সাধ্য জ্বালানী … সবার জন্য ব্যয়সাধ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানী সুবিধা নিশ্চিত করা।

৮)কর্মসংস্হান ও অর্থনীতি… সবার জন্য দীর্ঘমেয়াদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল ও উপযুক্ত কাজের সুবিধা নিশ্চিত করা।

৯)উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো … দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়ন করা এবং উদ্ভাবন উৎসাহিত করা।

১০)বৈষম্য হ্রাস … দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্য হ্রাস করা।

১১)টেকসই নগর ও সম্প্রদায় … নগর ও মানব বসতিগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করে তোলা।

১২)সম্পদের দায়ীত্বপূর্ণ ব্যবহার… টেকসই ভোগ ও উৎপাদন রীতি নিশ্চিত করা।

১৩)জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপ … জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

১৪)টেকসই মহাসাগর … টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও সেগুলোর টেকসই ব্যবহার করা।

১৫)ভূমির টেকসই ব্যবহার … পৃথিবীর ইকোসিস্টেমের সুরক্ষা, পুনর্বহাল ও টেকসই ব্যবহার করা, টেকসইভাবে বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণ রোধ, ভূমিক্ষয় রোধ ও বন্ধ করা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি রোধ করা।

১৬)শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান … টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভু্ক্তিমূলক সমাজ তৈরি করা, সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ প্রদান করা, এবং সর্বস্তরে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

১৭)টেকসই উন্নয়নের জন্য অংশীদারিত্ব … বাস্তবায়নের উপায়গুলো জোরদার করা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব পুনর্জীবিত করা।

টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থাঃ

টেকসই উন্নয়নের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা দরকার। আর গৃহীত পরিকল্পনাকে যদি দরদী হাতে বাস্তবায়ন করা হয় – তাহলে তা হয়ে ওঠে শিল্প। মানব সমাজও যদি যুক্তির বিচারে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা হলে তাদের কাজও হয়ে উঠবে শৈল্পিক সৌন্দর্যে বিভূষিত। শিল্প মানে এবং গুণে কালকে জয় করতে সমর্থ হয়।বাংলাদেশে উন্নয়ন আজ পর্যন্ত শিল্পের পর্যায়ে যেতে সক্ষম হয়নি।

টেকসই উন্নয়ন এবং ভোটের বাজারের সম্পর্কঃ

টেকসই উন্নয়নের সাথে ভোটের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে ভোটারের মন জয় করার বিষয়টি জড়িত থাকে।উন্নয়ন যদি টেকসই হয় তা ভোটারের মন জয় করবেই। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকারই ভোট এলেই ভয়ার্ত হয়। সকলেই নতুন নতুন অন্যায় কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। কারণ, তারা জানে তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা আর গৃহীত কৌশল জনবান্ধব ছিলনা। উপরে উল্লিখিত সতেরোটি উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের প্রতিটি দিক সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে উন্নয়নের অধিকাংশ দিকই টেকসই হয়নি। এমনটি হলে জনগনের মন জয়ে যে ব্যর্থ হবে তা তো আর বলার অপেক্ষা করে না। 

জনগণের সরকারকে যেহেতু জনগণের কাছে যেতেই হবে, সেহেতু সত্যিকার অর্থেই উন্নয়ন জনগণের অভিমূখী হতে হবে। এজন্য সর্বপ্রকার উন্নয়ন কাজ দলবাজির উর্ধ্বে উঠে সমাপন করতে হবে। সাথে সাথে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সর্বপ্রকার বৈষম্যের বিলোপ সাধন করতে হবে। এরকম কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যাবে না যাতে জনগণ উন্নয়নের অংশীদার হয়েও অন্তরজগতে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বিব্রত আর অসহায় হয়ে পড়ে ;এই সত্য ক্ষমতাসীন সরকার যত দ্রুত অনুধাবন করবে ততই মঙ্গল। (সমাপ্ত)

গোলাম কিবরিয়া

লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here