কুমার অরবিন্দ
আমার রুনুদি,
কেমন আছ? কতদিন হলো তোমার সঙ্গে কথা হয় না! হবেই-বা কেমন করে? আমিই তো কণ্ঠকে রুদ্ধ করে রেখেছি। আমার কান দুটোও আর কাউকে শুনতে চায় না। নিজেকে খোলসবন্দি করে নিক্ষিপ্ত করেছি পরিচিত বলয়ের বাইরে। জানো, এখন আর আমাকে জীবিত মনে হয় না, মৃত মনবাহী শকট মনে হয়। মানুষের সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে বড্ড ভয় হয় আজকাল।
চোখের পলকে চেনা মুখগুলোকে বদলে যেতে দেখেছি। ক্ষুধার্ত পশুর মতো হিংস্র হতে দেখেছি। হিতাহিত ভুলে কোনোরকম বিবেচনা না করেই মানুষ কেমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হতে পারে তুমিও তা দেখেছ। সেদিন তুমি যদি না থাকতে…!
রুনুদি, আমার অনেক না পাওয়া জীবনে কেমন করে যেন ভগবান তোমাকে দিয়েছিলেন! নিরবিচ্ছিন্ন আঁধারের মাঝে তুমি ছিলে আমার আলোকবিন্দু, আমার অভয়া। আমার সবকিছুতেই তুমি জড়িয়ে ছিলে। তোমার আদর- স্নেহ, তোমার কপট অভিমান, প্রচ্ছন্ন শাসন আমার খুব ভালো লাগত।
তুমি যখন সাজতে বসতে আমি তখন মুগ্ধ বালক। খুঁটির সাথে আট ইঞ্চির আয়নাটা হেলান দিয়ে রেখে চুলে চিরুনি চালাতে। ফিতার এক পাশ দাঁতে কামড়ে ধরে অন্য পাশ দিয়ে বিনুনি বাঁধতে। মুখে তোমাকে তেমন কিছুই মাখতে দেখিনি। তারপরও তুমি অনিন্দ্য। বিশেষ দিনে মাঝেমধ্যে টিপ পরতে শুধু।
তোমার টিপপরা দেখেই আমি বুঝতাম। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলে তুমিও ধরে ফেলতে আমি বুঝে গিয়েছি। তারপর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেড়িয়ে পড়তে। রুনুদি, তোমার সবকিছুই আমার কেমন যেন লাগত, মুগ্ধ হতাম। ঘোর তৈরি হতো মাঝেমধ্যে।
আমার মনে হয় তোমার মতো রুনুদিরা প্রতি পাড়ায় একজন করে থাকে। সব আবদার, সব আহøাদ তারা হাসিমুখে মেনে নেয়। তবে সব রুনুদির মধ্যে তুমিই ছিলে সেরা। তুমি ছিলে আমার আশ্রয়স্থল, আমার কল্পতরু। তুমি এত ভালো ছিলে কেন গো!
বাবা যখন মারা গেলেন তখন আমার বয়স চার বছর। বাবার শ্রাদ্ধের দিন তোমাদের বাড়িতে ছবি তোলার লোক এসেছিল। তোমার ছোটদাদা এনেছিল। তোমাদের সবার ছবি তুলল। তোমার আবদারে আমারও একটা ছবি তোলা হলো। ন্যাড়া মাথা। আলগা গায়ে কোমরে শুধু সাদা থান জড়ানো। চোখ দুটি গর্তে ঠাসা, চোখের নিচে কালশিটে। গলার হাড় দুখান উঁচু হয়ে নির্মম দীনতার সাক্ষী দিচ্ছে। ক্যামেরাম্যান বোধহয় আমাকে হাসতে বলেছিল। কিন্তু সে জানত না, পিতৃহারা ক্ষুধায় কাতর শিশুর ঠোঁট বেয়ে হাসি বেরোয় না ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হয় মাত্র।
ছবিটা এখনও আমি যতœ করে রেখেছি। মাঝেমধ্যে দেখি। সমস্ত পৃথিবীর দুঃখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক নিঃসঙ্গ শিশু। ওই ছবিটাই আমার সারাজীবনের প্রতীকী ছবি হয়ে থাকবে কে জানত। চারপাশে আপন কেউ নেই। চারদিকে সময়ের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। আমি শুধু নিঃস্ব এক দ্বীপ, ডুবতে ডুবতে জেগে আছি।
বাবা মারা যাবার পর যা কিছু জমি ছিল বর্গাচাষের জন্য দেয়া হলো। বাড়ির পাশের জমিতে আমি আর মা মিলে সবজি চাষ করতাম। তাতে মায়ে-পুতে কোনো রকমে চলে যেত। তোমরা সবাই কেমন পুতুল সেজে স্কুলে যেতে। আমিও বায়না ধরলাম স্কুলে যাব। কিন্তু তোমাদের মতো বড় না হওয়ায় স্কুল আমাকে ভর্তি নিল না। আমি সারাদিন বড় হবার প্রতীক্ষায় থাকতাম।
বয়স বাড়লে মা কিছুটা নিমরাজি হয়ে আমাকে স্কুলে ভর্তি করালেন। তুমিই আমাকে অ, আ, ক, খ পড়তে, লিখতে শেখাতে। গোপনে তোমার দেয়া খাতা কলমে আমি প্রাইমারির পাঠ শেষ করি।
হাই স্কুলে উঠে পাড়ার পাঠাগার থেকে বই নিয়ে আসতাম। বড় বড় লেখকের বই। আমি একচালার নিচে বসে, শুয়ে সে সব বই পড়তাম। তুমিও কখনো-সখনো এসে বইগুলোর গল্প শুনতে। তুমি পড়তে চাইতে না। আমাকে পড়তে বাধ্য করে শুধু কাহিনীটা শুনতে চাইতে। আমি ওই বয়সেই তোমার জন্য বঙ্কিম, রবীন্দ্র, শরৎ পড়েছি। কি বুঝতাম তা জানি না। তবে আমার মতো করে বানানো গল্প শুনে তুমিও মুগ্ধ হতে।
মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে মা মারা গেলেন। অধিক শোকে পাথর বলতে যা বোঝায় আমার অবস্থা তখন তাই হলো। মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আর শ্রাদ্ধাদি শেষ করে ভাবলাম এবার আমার ছুটি। এতদিন পরের জমিতে মজুরি খেটেছি; অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা আর দুটি পেটের জন্য। এখন আর কোনো পিছুটান নেই। ঘর থেকে বের হতে পারলেই সমস্ত পৃথিবীটাই আমার। বাঁধ সাধলে তুমি, আমার রুনুদি। বললে, তোর পরীক্ষা দিতে হবে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে।
আমি কাঁদি আর পড়ি। কালো কালো অক্ষরে আমার মায়ের শীর্ণ মুখ ভেসে ওঠে। মা বলেন, বাবা, পড়। মানুষ হ, সুখী হ।
নিজের চাল নিজে ফুটিয়ে খাই। আলু সিদ্ধ, ভাত। অন্য মানুষ কতদিন আর আমাকে রেধে খাওয়াবে? মাঝেমধ্যে তুমি আসতে। আলু সিদ্ধর পরিবর্তে তখন আলু ভাজি হতো। তুমি লুকিয়ে আমার জন্য তরকারি নিয়ে আসতে। তুমি একদিন বললে, শোল মাছ আমার খেতে ইচ্ছে করে না, জানিস? তাই তোর জন্য নিয়ে এলাম।
সেদিন বুঝলাম, তুমি তোমার ভাগের তরকারিটুকু না খেয়ে আমার জন্য গোপনে নিয়ে আসো। কতদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখেছি আমার টেবিলের ওপর খাবার রাখা। সারাজীবন অনাদরে, অবহেলায় বেড়ে ওঠা কারোর পক্ষে এমন ¯েœহ সহ্য করা কঠিন। আমিও সহ্য করত পারিনি, রুনুদি। নীরবে কেঁদেছি।
তোমার মা-বাবা, দাদাদের চোখ এড়িয়ে আরও অনেক কিছুই আমাকে দিতে। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে পুজোয় আমার জন্য নতুন জামা কিনতে। তোমাদের বাড়িতে ভালো কোনো খাবার তৈরি হলে আমার জন্য নিয়ে আসতে। মাছ কাটতে পারতাম না বলে মাছই খাওয়া হতো না। তুমি এসে কেটে-ধুয়ে দিয়ে যেতে। কতদিন আমার জন্য তুমি রান্না করেছ! তুমি এমন কেন ছিলে গো, রুনুদি? এত ভালো কেন ছিলে? তোমার আমার তো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তবু যে স¤পর্ক ছিল সেটা রক্তের স¤পর্কের চেয়েও অধিক গাঢ়, অধিক পবিত্র ছিল।
তুমি যখন আমাকে কিছু করতে বলতে আমি ছুটে যেতাম তা করার জন্য। তোমার জন্য কিছু করতে পারলে আমারও আনন্দ লাগত। মনে হতো যে দেবীর করুণায় বেঁচে আছি তাকে অন্তত কিছু অর্ঘ্য দিতে পেরেছি।
তোমাকে কেউ খারাপ কিছু বললে আমার গায়ে জ্বালা ধরত। একবার তো বিজনদাকে মারতে গিয়েছিলাম। বিজনদারও বই পড়ার অভ্যাস ছিল। পাঠাগারে গেলেই দেখা হতো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করত। তুমি গল্প-উপন্যাস পছন্দ কর নাকি কবিতা? তোমার কথা বলতেই বিজনদার মুখ কেমন লালচে হয়ে যেত। বইয়ের মধ্যে বিজনদা কাগজে কি সব লিখে তোমাকে দিতে বলত। আমি নিতাম না। বিজনদার সঙ্গে ঝগড়া করতাম। আমি রেগে কথা বললেও সে শান্ত হয়ে আমাকে বোঝাত। বলত, তোর রুনুদিকে এটা দিস, যদি না নেয় তাহলে আমাকে যা ইচ্ছে হয় বলিস।
আমি বললাম, দিদিকে আগে জিজ্ঞেস করি। যদি সে নিতে বলে তারপর দিয়ো। বাড়িতে এসে তোমাকে বললাম। তুমি প্রথমে আমাকে ধমক দিলে। বললে, খবরদার ওদেরকে পাত্তা দিবি না। আমি তোমার কথাকেই শিরোধার্য মানলাম।
পরের দিন বিকেলে আমার ঘরে এলে। বিছানাটা ঠিক করতে করতে বললে, তোকে এত করে বলি একটু গুছিয়ে রাখ সবকিছু। তা না। সব ছড়ায়ে ছিটিয়ে রাখিস। আমি কি প্রতিদিন এটা করতে পারব? আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, আমার জীবনই তো ছড়ানো ছিটানো, দিদি।
তুমি ধমক দিয়ে বললে, চুপ কর। খালি বড় বড় কথা। …আজ লাইব্রেরিতে যাবি?
-না। তবে তোমার কোনো বই লাগলে যেতে পারি।
তুমি আমতা আমতা করে নিচের ঠোঁট কামড়ে বললে, বিজনদা কি লিখেছিল রে?
-আমি দেখেছি নাকি? তবে কি আর লিখবে। ওই সব হবে হয়তো…।
-ওই সব মানে কি?
আমি একটু হেসে তোমার কানের কাছে মুখ এনে বললাম, প্রেম নিবেদন করতে চায় মনে হয়।
তুমি আমার মাথা সজোরে সরিয়ে দিয়ে বললে, ধ্যাত।
তবে ঘর থেকে বের হতে হতে বললে, বিজনদার হাতের লেখা নাকি সুন্দর। এবার দিলে নিয়ে আসিস তো। দেখব কেমন লেখা…।
তোমার মনের খবর পড়তে পেরে আমার একটু হাসি পেল। তোমার পাশে বিজনদাকে কল্পনা করে আমার পছন্দও হলো।
বিজনদার চিঠির উত্তর তুমি সাথে সাথেই দিতে না কিছুদিন ঘুড়িয়ে উত্তর দিতে। বিজনদা আমাকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করত, কি রে, কিছু দিয়েছে? আমি মাথা নাড়তাম। বেচারা মাথা চুলকাতে চুলকাতে চলে যেত।
পরে যখন তোমাদের স্থায়ী পিয়ন হয়ে গেলাম তখন মাঝেমধ্যে চিঠি খুলে পড়তাম। এতদিন পরে কথাটা স্বীকার করছি, রুনুদি। তবে তোমরা কেউ তা জানতে না। তোমার চিঠির ভাষা ছিল সাদামাঠা। বই পড়া বিজনদার ভাষার কাছে তা কিছু না। বিজনদা চিঠিতে কত লেখক, কবির উক্তি ব্যবহার করত। বিজনদা একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে লিখেছিল-
‘তবে পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে
রূপ না দিলে যদি বিধি হে!
পূজার তরে হিয়া ওঠে যে ব্যাকুলিয়া
পূজিব তারে গিয়া কি দিয়ে।’
তুমি আমার কাছে এসে বললে, তোর কাছে কবিতার কোনো বই আছে?
বিজনদার চিঠি পড়ার জন্য বিষয়টা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। চিঠির জবাব দেবার জন্য তুমি কবিতা খুঁজছ।
আমি বললাম, কবিতার বই তো এখন নেই। তবে সামনের সপ্তাহে এনে দিতে পারব।
তুমি অস্থির হয়ে বললে, না না, এখনই দরকার।
-আমি এখন বই কোথায় পাব?
-তুই তো অনেক বই পড়িস, দুই একটা কবিতা মুখস্থ নেই?
আমি তোমার দিকে তাকিয়ে বললাম, আছে তো। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে…।’
তুমি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললে, আরে এগুলো না। রোমান্টিক কবিতা পারিস নে?
আমি বাঁকা হাসি হেসে বললাম, বিজনদাকে লিখবা?
তুমি মাথা নিচু করে চোখের কোনা দিয়ে কিছুটা হাসি ছড়িয়ে দিলে। লাজুক মুখে বললে, ও খুব খারাপ নাকি রে দেখতে?
-কই না তো। বিজনদা কি সুন্দর দেখতে। তবে গায়ের রং একটু কালো। কৃষ্ণ ঠাকুরের মতো…।
-আচ্ছা বুঝছি…। এখন তুই আমাকে উদ্ধার কর। কবিতা বল।
- কেমন কবিতা বলব।
তুমি একটু চিন্তা করে বললে, এই মনে কর, সে যেমনই দেখতে হোক না কেন তবু তাকে যুগ যুগ ধরে ভালোবাসব…।
তোমার কথা শুনে আমার আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। আমি বললাম, স্বর্গের ঠিকানা জানো? তুমি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলে। আমি বললাম, আমার দাদু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটা চিঠি লিখে দিই। তোমার জন্য একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দেবেন।
তুমি আমার মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে বললে, ধ্যাত।
তোমার থাপ্পড়ে আমার মাথা খুলল। আমি খাতা নিয়ে লিখলাম,
‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।’
এটুকু তোমাকে পড়ে শোনালে তোমার চোখে খুশির ঝিলিক দেখতে পেলাম। বললে, তুই লিখেছিস?
-হ্যাঁ, তোমার সামনেই তো লিখলাম। তবে স্বর্গ থেকে রবি দাদু তাঁর জিনিসখান মনে করিয়ে দিয়েছেন।
রুনুদি, বিজনদার সঙ্গে এখন কি আর যোগাযোগ হয়? তার এখন কি খবর গো? বেচারা!
তোমার বিয়ের দিন তাকে দেবার জন্য একটা চিঠি দিয়েছিলে। তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে নদীর তীরে যাই। গিয়ে দেখি বিজনদার চোখ ফোলা। কান্না করছিল। আমাকে দেখে তার দুচোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়ল। আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি তাকে কি বলব বুঝতে পারছি না। আমারও দুচোখ ঝাপসা হয়ে এলো। চিঠিটা সে খুলল না। হয়তো খুলে দেখার সাহস পেল না। এমন অসহায় মানুষ আমি জীবনে আর দেখিনি। আমাকে জিজ্ঞেস করল তোমার কথা। বললাম, তোমার জন্য দিদিও খুব কান্না করছে।
তোমাদের সেই সব চিঠি পড়ে এত ভালো লাগত। এত প্রেম, এত আবেগ, একে অপরের প্রতি এত টান! মনে হতো আহা, আমি যদি কাউকে লিখতে পারতাম! আমার যদি এমন কেউ একজন থাকত!
আমার জীবনে তেমন একজন এসেছিল। তুমিই তো এনে দিয়েছিলে। তোমার মামতো বোন অনু, অনুরাধা ঘোষ। তোমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসত। ছোটকাল থেকেই তো তাকে চিনি। কিন্তু তাকে নতুন করে চিনলাম। আমি তখন কলেজে পড়ি।
বিকাল বেলা শুয়ে আছি। আকাশ-পাতাল চিন্তা করছি। অন্যদের মতো আমার জীবনটা কেন হলো না। এমন নিঃসঙ্গ নিঃস্ব জীবন, এমন হতচ্ছাড়া জীবন, এমন কাঙালপনা জীবন কেন আমার। হঠাৎ অনুকে আমার ঘরে এনে বললে, দ্যাখ, বাঁদরটা এখনো ঘুমোচ্ছে। একে আর মানুষ করা গেলো না! আমি অনুকে দেখে কিছুটা বিব্রত হলাম, অনেকটাই মুগ্ধ হলাম। তুমি বললে, দ্যাখ তো, বাঁদরটাকে মানুষ বানানো যায় কিনা।
অনু লজ্জায় মাথা নিচু করল। তুমি বললে, চল ঘুরে আসি। আমি বললাম, কোথায়?
-অনুকে নিয়ে নদীর তীরে যাব।
আমরা মধুমতির তীর ঘেষে হাঁটছি। কিছুদূর গিয়েই দেখি বিজনদা। বুঝলাম, বিজনদার সঙ্গে আগেই তোমার কথা হয়েছে। তুমি বললে, আমি ওর সাথে একটু কথা বলে আসি। তোরা দাঁড়া।
তোমরা একটু দূরে গেলে। আমরা এদিক ওদিক তাকিয়ে দুএকটা আটপৌরে কথা বলছি। কেউ কারোর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারছি না। অনুর সঙ্গে আগেও তো কথা বলেছি। এমন লজ্জা এসে কখনো দুজনার মাঝে ব্যবধান বাড়ায়নি। আমরা দাঁড়িয়ে থেকে থেকে বসলাম। ধীরে ধীরে সংকোচের বাঁধা দূর হলো। অনুর প্রতি অপার মুগ্ধতা নিয়ে আমার কুঁড়েঘরে ফিরলাম। তখন মনে হলো রুনুদির মতো আমার পাশে সত্যিকারের আরেকজন তুমি আছে।
রুনুদি, তোমার কাছ থেকে আমি পেয়েছিলাম মায়ের মমতা, বোনের আদর। অনু আমাকে দিয়েছিল টিকে থাকার দীক্ষা, বেঁচে থাকার প্রেম।
তোমাদের মতো আমরাও লিখতাম। তবে আমাদের বাহক কেউ ছিল না। আমি মাঝেমধ্যে সাইকেল চালিয়ে ওদের কলেজে যেতাম। সে সব তুমি জানতে। আমার দিন তখন কষ্টের মধ্যেও অনুর কথা ভেবে ভালোই যাচ্ছিল। ততদিনে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। বিজনদার সঙ্গে দেখা হলে তোমার কথা জিজ্ঞেস করে, তোমার বর কি করে তা জানতে চায়। আমি বলি, রুনুদি ভালো আছে। বিজনদা আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ লুকায়।
বাবা মারা যাবার পর জীবনটাকে অনেক জটিল মনে হয়েছিল। তবু মনে হয়েছিল, মা আছেন। মা চলে যাবার পর জটিল জীবন শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল। বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষাই ছিল না। তখন তুমি ছিলে, রুনুদি। তোমার বিয়ের পর যে কি খারাপ লেগেছিল তা কি করে বোঝাব। কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছি। বিজনদার সঙ্গে বিয়ে হলেও তো গ্রামেই থাকতে। ইচ্ছে করলে প্রতিদিনই তোমাকে দেখে আসতে পারতাম।
তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবার পর আমি আমার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হারালাম। তখন অনুর কথা ভেবে কিছুটা শক্তি পেতাম, সাহস পেতাম, আশা পেতাম।
দুর্গা পূজায় তুমি বেড়াতে এলে। আমার হাতে অনেকগুলো টাকা গুঁজে দিয়ে বললে কছু কিনে নিস। আমি সেবার এইচএসসি পরীক্ষা দেব। কিছুটা তো বড় হয়েছি। তোমার কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নিতে লজ্জা লাগে। আমি বললাম, এত টাকা দিয়ে কি করব? জামা-প্যান্ট কিনতে এত টাকা লাগবে না।
তুমি বললে, অনু আসবে। ওকে কিছু কিনে দিস, খুশি হবে মেয়েটা।
তোমার কথা শুনে আমার চোখে জল এলো। আমি বললাম, ওকে দেবার জন্য আমিই কিছু টাকা জমিয়েছি। সেই টাকায় কিনে দিলে ও আরও বেশি খুশি হবে, আমিও খুশি হবো।
তুমি তবুও বললে, ঠিক আছে তুই টাকাগুলো রাখ। অন্য কাজে লাগবে।
অনু পূজায় এলো।
তোমাদের আর আমাদের ঘর পাশাপাশি, মাঝে শুধু উঠোন। পুজোর সময় আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভরা। অনুর সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারি না। নবমীর দিন অঞ্জলি দিয়ে, সবাইকে প্রসাদ খাইয়ে বিকালে বাড়ি এসেছি। ভেবেছি কিছুক্ষণ ঘুমাবো। তখন কেউ আমার ঘরে এলো। ভাবলাম তুমি। তাকিয়ে দেখি স্মিতহাস্যে দাঁড়িয়ে আছে দেবী অনুরাধা, আমার অনু।
অনু বলল, এখন ঘুমাবে নাকি?
-কেন?
-চলো পূজা দেখে আসি।
-রুনুদি যাবে?
-না, দিদির মাথা ধরেছে। শুয়ে আছে।
আমি একা অনুকে নিয়ে বের হতে ভয় পাচ্ছিলাম। বললাম, সন্ধ্যায় দিদিকে নিয়ে একসাথে যাব।
অনু কিছুটা অভিমান নিয়ে বলল, ঠিক আছে।
দুজন কতক্ষণ চুপ থাকলাম। আমি তো অনেক কথা জমিয়ে রেখেছি ওর জন্য। ভেবেছি দেখা হলে সব বলব। কিন্তু কিছুই বলা হচ্ছে না। তবু আমি বললাম, অনু, তুমি আমার মতো এমন নিঃস্ব, সহায় সম্বলহীন একজনকে কেমন করে ভালোবাস?
অনু ধীরে ধীরে তার স্বভাবসুলভ ভাষায় বলল, তুমি নিজে যা আমি সেটাকে ভালোবেসেছি। তোমার কি বা কে তা দেখে তো ভালোবাসিনি।
-পৃথিবীতে কেউ কেউ একা থাকে। তবে আমার মতো এমন নিঃসঙ্গ আর কি কেউ আছে?
-রুনুদি আছে, আমি আছি। তুমি একা কোথায়?
-তোমরা কেউ তো আমার কাছে থাক না। আমার যন্ত্রণার কথা, বেদনার কথা, আনন্দের ক্ষণ, সুখের মুহূর্ত কারোর সঙ্গেই শেয়ার করতে পারি না। এটা কত বড় একাকিত্ব তুমি অনুধাবন করতে পার?
মেয়েরা যে বয়সের চেয়ে অনেক বড় হয় তা তোমাকে দেখে বুঝেছিলাম, রুনুদি। সেদিন অনুর কথায় আবারও তার প্রমাণ পেলাম। অনু আমার পড়ার ভাঙা চেয়ারটাতে বসে বই গোছাতে গোছাতে বলল, পৃথিবীর মহামানবদের দিকে যদি তাকাও দেখবে তাঁরা হয় নিঃসঙ্গ ছিলেন নয়তো নিঃসঙ্গ হয়ে সমস্ত পৃথিবীর কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন, সকলের ভালোবাসা পেয়েছেন, সঙ্গ পেয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল কংসের কারাগারে। পালিত পিতা-মাতার কাছে তিনি মানুষ হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের সব ছিল। রাজত্ব ছিল, সুন্দরী স্ত্রী ছিল, ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান ছিল। সবাইকে ছেড়ে তিনি পথে বের হয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন। কুমারী মাতার গর্ভে যীশুর জন্ম হয়েছিল। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এতিম ছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেব মা ও স্ত্রীকে ছেড়ে একা হয়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। এঁরা সকলেই মানবকল্যাণের জন্য, মানব-মুক্তির পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। এঁদের মতো তুমি মহামানব নও, হতেও বলছি না। তবে এঁদের থেকে এই শিক্ষা তো নিতে পার রিক্ত-নিঃস্ব হলেও কাজের দ্বারা পৃথিবীর সবার হওয়া যায়। সবার সঙ্গ পাওয়া যায়।
অনুর কথা আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আমি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনুর জন্য কেনা শাড়িটা দেয়া তখনো হয়নি। আমি সেটা বের করে তাকে দিলাম। বললাম, কাল বিজয়ার দিনে এটা পরবে।
অনু বিস্মিত হলো। বলল, আমার জন্য এত টাকা খরচ করার দরকার ছিল না। আর এটা আমি নিতেও পারব না। সবাই দেখলে আমি কি বলব?
-বলবে তুমি কিনেছ?
অনু মুখ ভেংচিয়ে বলল, হু, বললেই হলো আমি কিনেছি! আমি এত টাকা পেলাম কোথায়?
-কিছু একটা বলে দিয়ো।
-তোমার যা বুদ্ধি!
আমি বললাম, তুমি পরবে বলেই তো কিনেছি। এটা কেনার জন্য কত কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে জানো! অন্যের জমিতে কামলা খাটতে হয়েছে।
ভেবেছিলাম ইমোশনাল কিছু কথা বললে অনু শাড়িটা নেবে, পরবে। আমার কথা শুনে অনুর চোখ ছলছল করল। তুমি এটা যত্ন করে রেখে দাও। তোমার বউ হয়ে এলে তখন পরব।
-তখন তোমাকে আরও কিনে দেব। এখন এটা নাও।
অনু নিল না। আমি একটু জোরে ধমক দিলাম, না নিলে যাও। আমি গরীব বলে আমার কিছু নিতে চাও না…।
আমার কথায় অনু খুব আঘাত পেয়েছিল। সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তোমার ছোট দাদা, রনেশদা ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে বলল, ঘরের মধ্যে কে রে?
অনু ভয়ে জলভরা চোখ নিয়ে বের হয়েই রনেশদার সামনে পড়ল। অনুকে কাঁদতে দেখে সে কি ভাবল জানি না। ঘরের মধ্যে এসে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পেটাতে শুরু করল। আরও কয়েকজন এলো। তারা আমার কাছে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। আমার ঘর থেকে অনু কাঁদতে কাঁদতে বের হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি এমন কিছু করেছি…। তারাও আমাকে মারতে লাগল। মারতে মারতে আমাকে উঠোনে এনে ফেলল।
অনুকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি তাকে কী করেছি। অনু মৌন ছিল। সেটা থেকেই তারা প্রমাণ করলো আমি এমন কিছু করেছি যা অনু বলতে পারছে না। তারা মনের সুখ মিটিয়ে আমাকে মারল। সেই বীরপুরুষদের দলে তোমার বরও ছিল।
তুমি এসে না ঠেকালে ওরা আমাকে মেরেই ফেলত। রনেশদা তোমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল, তোর জন্যই ও এতটা বাড় বেড়েছে। কুত্তার বাচ্চাটাকে আজ মেরেই ফেলব। দেখি তোর কোন বাপ এসে বাঁচায়
তখনই অনুর মা ওকে নিয়ে বাড়ি চলে গেলো। অন্যরা যা বিশ্বাস করেছিল তুমিও তাই বিশ্বাস করলে! তুমিও আমার কাছে এসে একবারের জন্যও কিছু জিজ্ঞেস করলে না, রুনুদি!
মরার মতো উঠোনে পড়ে ছিলাম কতক্ষণ জানি না। আমাকে ধরার কেউ ছিল না। পাড়ার যে বাচ্চাদের পড়াতাম তারা ধরে আমাকে ঘরে নিয়ে আসে। সারারাত আমি কাঁদলাম। ব্যথায় না, বিশ্বাসহীনতার যন্ত্রণায়। আমার রুনুদি আমাকে ভুল বুঝেছে, আমাকে অবিশ্বাস করেছে এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। রাতে তুমি আর তোমরা মিলে যাত্রাগান শুনতে গেলে আমি বিছানায় পড়ে পড়ে কাতরালাম। সেদিন মনে হয়েছিল মরে যাই।
পরের দিন সকাল হবার আগেই আমি ঘর থেকে বের হই। আমার অপমানিত মুখ তোমাদের দেখাতে চাইনি। শাড়িখানা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম যদি…। না তা আর হয়নি।
একটা সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম জানো, রুনুদি। আমি আর সে। সে সংসার আমার আজও হয়নি। আমার সাথে আমার, আমার সাথে তার সংসার করা হলো না, আর হবেও না। একাকিত্বই এখন জীবনের ব্রত করে নিয়েছি।
আমি এখন যে ঘরে ঘুমাই সে ঘরে ঠাণ্ডা করার মেশিন লাগানো। অফিসে যাবার জন্য গাড়ি আছে। তবু আমার দমবন্ধ লাগে, গা জ্বালা করে, ঘুমাতে পারি না। আমার চুপসে যাওয়া মায়ের মুখটা মনে পড়ে খুব। আহা, মা আমার, জন্মদাত্রী! চিরটাকাল একটু একটু করে দুঃখ জমিয়ে রেখেছিল। যাবার আগে উত্তরাধিকার সূত্রে তার সম্পূর্ণটুকু আমাকে দিয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করিস মা। এই চল্লিশ পার করা জীবনে তোর মতো আমিও সুখ কি জিনিস বুঝিনি।
শুনেছি তুমি স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো আছ। এই সংবাদের চেয়ে বড় আনন্দের আমার কাছে আর কিছু নেই। অনুরাধার খবরটা কয়েকবছর পর জানতে পারি। নবমীর দিন বাড়িতে গেলে সবাই ওকে বকাঝকা করে। বিজয়ার দিন সবার সাথে অনুও সিঁদুর খেলেছিল। সে অন্যদের চেয়ে একটু আগেই বাড়ি চলে আসে। মায়ের সিঁদুরের কৌটা থেকে সিঁথিতে সিঁদুর নেয়, মায়ের একটা শাড়িও পরে। ও একদিন আমাকে বলেছিল, জানো, আমাকে শাড়ি আর সিঁদুর পড়লে দারুন লাগে, ঠিক লক্ষী ঠাকুরের মতো! শাঁখা-সিঁদুর পরে যখন তোমার কাছে আসব না তুমিও চমকে যাবে!
শাঁখা-সিঁদুরে সংসারী হবার খুব ইচ্ছে ছিল মেয়েটার। বিজয়ার দিনেই বুকের মধ্যে লালন করা ইচ্ছেটাকে ওড়নার ফাঁসে ঝুলিয়ে দিলো।
তুমি বলতে পার, রুনুদি, অনুর আত্মহত্যার খবর শোনার পরও কি আমার বেঁচে থাকা উচিত ছিল? আমি কেন মরতে পারছি না?
…একদিন তোমার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসব, রুনুদি। তারপর আমার আর তার না হওয়া সংসারটাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ব।
ইতি
তোমার ভাই অমলেশ।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অমলেশের। এসির তাপমাত্রা আরও কমিয়ে দেয়। চিঠিটা লেখা শেষ করে আবার পড়ে। ইতির পরে ‘তোমার ভাই’ শব্দ দুইটা কেটে দেয়।
অনু তার জন্য মিথ্যে কলঙ্কের দায় নিয়ে চলে গিয়েছে। এই চিঠি রুনুদিকে পাঠিয়ে এখন নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো মানে হয় না। আত্মপক্ষ সমর্থন সে আগে করার সুযোগ পায়নি। এখন করেও লাভ নেই। অনেকদিন ধরে না বলা কথাগুলো রুনুদিকে লিখে একটু হালকা হতে চেয়েছিল। কিন্তু কি মনে করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অমলেশ চিঠির পাতাগুলো কুচিকুচি করে ছিড়তে থাকে।
লেখক : গল্পকার