কে এ বিপ্লব
রূপা,
জানতে চাইবো না কেমন আছো! শুধু একটা বিনীত অনুরোধ করতে চাই। কী হলো শুনে অবাক হলে, তাইতো ? না অবাক হবার কিছুই নেই। অনুরোধ তাকেই করা যায় যার ফিরে দেখার মতো দুর্দান্ত কৌতুহল আর অঢেল ইচ্ছে আছে। বাকিটা না হয় বোঝাপড়ার উপর ছেড়ে দিলাম, মানুষ নিজেও জানে না একান্ত স্বপ্নগুলো কখন যেন নিজের কাছ থেকে চুরি হয়ে যায়। আ-মরন পাশে থাকবো বলে একটা নিঃশব্দ চেতনাও কখনো জীবন চলার গতিশক্তিকে রোধ করে দেয়। তবুও পথচলা, ভালো লাগা, আর জানার ব্যাকুলতায় আপন স্বপ্নগুলো চোরাস্রোতে গা ভাসায়। আজ তার বাস্তবতা আমাকে চেপে বসেছে। চলমান জীবন কখনো কখনো থমকে দাঁড়ায় যদি সেটা ঠুনকো একটা আঘাতও হয়।
তুমি নিশ্চয়ই ভালো করে জানো অহেতুক অজুহাত আর ক্ষনিকের তারতম্যের ফারাক-টা কতখানি। এটাই চরম সত্যি যে ভাঙতে ভাঙতে গড়ার নিয়মটা শিখে নিতে হয়। ভাঙা আর গড়ার দু’য়ের সামঞ্জস্যের ছাঁচে যে পূর্ণ অবয়বের জন্ম হয়, তা অত্যন্ত নিখুঁত,যা স্বচ্ছ আয়নার মতো কখনো মিথ্যা বলেনা। জীবনের এই সময়ে সহজ কিংবা কঠিন এই কথা গুলো শুনে যদি বলো, আমি কী পেয়েছি?
আমি বলবো তিরস্কারটাই বা কম কিসের, পুরস্কারে হয়তো বাহবা আছে, অর্থ কিংবা খ্যাতি,আর তিরস্কারে আছে নিজেকে চেনার সত্য কৌশল। বলিষ্ঠ স্বপ্ন বন্ধনীগুলো যখন উল্কাপিণ্ডের মতো খসে পড়ে, আকাশ কি মনে রাখে তার গতিবিধি বা পেছনের গল্প.! না। কিন্তু নির্মম সত্য হলো নিয়মনীতির কথা না ভেবে চ্যুতি-বিচ্যুতির আড়ালে আবার সে স্বপ্ন দেখে কোনো এক মহাকাশ গড়বে বলে। এই কথা আমার কেন মনে হলো সেটা জানতে চাচ্ছ কী ? ধরো আচমকা আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে, আমি কেমন আছি? তুমি ভালো করেই জানো সাধারণত এরকম প্রশ্নে আমি বধির ও অন্ধ হয়ে থাকি। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা, অন্যরকম, সম্পূর্ন অবর্ননীয় অনুভূতি। যদি কিনা সেই প্রশ্নকর্তা হও স্বয়ং তুমি নিজে। তুমি জানো হয়তো,কিছু মানুষের জীবনে কিছু অদ্ভুত খেয়াল থাকে, যার কোন জিজ্ঞাসা নেই। নেই কোন মীমাংসা, থাকে না কোন উত্তরও,ঠিক এমন জায়গা থেকেই ভাবনা শুধু তোমার জন্য।
অহেতুক পাগলামি কিনা তাও বুঝতে সংশয় হচ্ছে, তবুও বলি, রাত যখন গভীর হয়, নির্মল জোৎস্নার আলো ঘরের বাইরে সুস্পষ্ট ঠিক তখনই আমার ছোট্ট ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে একবার বাইরে যাই, আবার ভেতরে ঢুকি। যেন আমি আমার নিজের ঘরেই একজন অচেনা অজানা অপরিচিত আগন্তুক। কখনো মনের অজান্তে কালো চঞ্চল বিড়ালের মতো পা তুলে নরম বিছানায় শুয়ে পড়ি,আবার কখনো বাইরে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা বিষণ্ন গাছ বর্ষায় অবিরাম ভিজছে। আমি তখন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠি কিন্তু আশ্চর্য হলেও ধ্রুব সত্যি যে তখন আমার আর্তচিৎকারে কোনো প্রতিধ্বনিও ওঠে না। দন্ডায়মান গাছগুলো পাতা নেড়ে অভিবাদন জানায় আর নিজের বাকল খুলে আমাকে বুকের পাঁজর দেখায়। আমি অবাক নয়নে দেখি আমার নিজেরই কোষ দিয়ে তৈরি গাছগুলোর বাদামি অর্ধবৃত্ত শরীর।
কখনো ভরদুপুরে আমাকে দেখে সভ্যজন মিটমিট করে দুর থেকে হাসে আবার কেউ কেউ ভাবে লোকটা ঠিক উন্মাদ হয়ে গেছে, নইলে মেইন রাস্তা রেখে রাস্তার পাশ দিয়ে কর্দমাক্ত জায়গায় হাঁটছে। আবার কখনো অনিচ্ছায় প্যান্টের জিপার খোলা, আনমনে চলছি চোখ বন্ধ, এলোমেলো চুলগুলো দখিনা হাওয়ায় উড়ছে ।
কিন্তু কেউ কী সত্যটা জানে, তুমি ই বলো ? কেবল তুমি ফিরে এসে আমায় বলতে পারো আমি কেমন আছি! তুমিই একমাত্র পারো বিশ্বাস নিয়ে অন্ধকারের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখতে ভেতরে কতটা আলো নাকি প্রগাঢ় অন্ধকার। কেউ না জানুক তুমি দিব্যি বোঝো, সে বিশ্বাস আমার অনেক আগেই ছিলো। পদতলে চোরা বালি কি করবো বলো, ঐ দুরে আষাঢ়ে বৃষ্টি বৃক্ষের ছায়ার কোন পাসওয়ার্ড ছিলনা যে সেই অবৈধ তালা খুলে আমি মেঘ- নীলিমার প্রাণ ও প্রেম দেখবো। অলৌকিক নৈঃশব্দ্যে মেঘ বালিকার ভেজা চুল আর বিস্তৃত সিঁথি বেয়ে ওষ্ঠ থেকে চিবুকে গড়িয়ে পড়ছে জল কনা। যৌবনের দোলায় বালিকার চক্ষু তীর ও শিহরণে সুচিত হয়েছে ভাব ও লীলা । কিন্তু তাতে কী, কে না জানে নন্দন ব্যতীত কুন্জ্ হয়না।
আমায় দেখো এই তো আমি একটা নামহীন পাখি, বাতাসে ডানা ভাসিয়ে দিয়ে উড়ছি আর ঠিক তখনই একটা ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে চোখ পিটপিট করে আমাকে দেখছে। হঠাৎ আমি বন্দিত্বে নাম লেখালাম।
তোমার পাশেই চেয়ে দেখ কী বিশাল একটা মরিচা ধরা খাঁচা পড়ে আছে, শিকারী খাঁচার দরজাটা ভুলোমনে আজ উম্মুক্ত করে চলে গেছে । আমাকে চুমু খেয়ে এই খাঁচা থেকে তুমিই পারো যত্নে বের করে নিতে। কতদিন দেখিনা তোমার নগ্ন পায়ের কারুকাজ যা আমার দৃষ্টি কেড়ে নিতো । আচ্ছা এখনও তোমার আবেগী মন অভিমানের গন্ধ ছড়ায় ? তোমার বাঁকা চোখের চাহনিতে অতৃপ্ত বাসনা লুকায়িত থাকতো যা দেখে আমার জমানো কষ্টের মিছিল স্তব্ধ করে ছুটে আসতাম গল্প,আড্ডা আর চায়ের কাপের সান্নিধ্যে ।
মনে করো, তোমাকে ছেড়ে খুব অভিমান থেকে দূরে কোথাও চলে গেলাম। বেঁচে যাবে হয়তো কিন্তু তুমি ভেবে পেলে না কিসের এতো অভিমান ! আমি ও তেমন না ভেবেই চলে গেলাম। আমাকে যেমন সাদা কাগজ ডাকলে আমি লিখতে বসে যাই । ঠিক তেমনি অভিমানের ভান করে তোমার থেকে দূরে ঐ দূর পাহাড়ের দেশে চলে গেলাম। ঝর্ণার সাথে খুব করে কাঁদলাম,পাহাড়ের চূড়ায় উঠে অস্ত যাওয়া দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় নিজের ফুরিয়ে যাওয়াও দেখলাম। আমার আত্মার নিঃশেষের আকুতির কাছে মৌনতার বোঝাপড়া করলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বা দুইটা দলছুট লাল পিঁপড়ের কর্মব্যস্ততা আমাকে মনে করিয়ে দিবে তোমাকে আর ফেলে আসা তোমার শহরকে। তবে শোনো,এবার কিন্তু পাহাড়টাকে আমি পাড়ি দেবোই ! যে পাহাড়ের গায়ে আঘাত খেয়ে বার বার ফিরে আসে আমার দীর্ঘশ্বাস ! মনে হয় পাহাড়ের ভ্রূকুটি আর নিছক হাসির ছলে আমাকে ছোট করে দেখাটা তোমার থেকে শিখেছে ! তাই তো তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কোন মানেই নেই! এই ভ্রূকুটি করা আহাম্মক পাহাড় যেন তোমারই নামান্তর মাত্র!
বিশ্বাস করো এখনো নীল রঙের জুতো জোড়া নিঃশব্দে মেঝেতে পড়ে আছে, আজ একটিরও ফিতে নেই।
সাইকেলের চেইনটা বিচ্ছিন্ন সেই থেকেই। আর লাল ফ্রেমের সেই স্মৃতি বিজড়িত চশমাটাও ধুলোয় আচ্ছন্ন। টেবিলের উপর তাকালে দেখতে পাবে ধুলোবালির আঁচলে ঢেকে আছে তোমার দেয়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ” সোনালী দুঃখ ” বইটি । আর তোমার দেয়া সেই হলুদ পাঞ্জাবিটাও অনাদরে আহত হৃদয় নিয়ে বুকশেলফের কিছুটা ওপরে হ্যাঙারে ঝুলছে, সবকটা বোতাম ছেঁড়া, বহু কাল ধরে অপেক্ষায়। শুধু শেষ বারের মতো জানতে চাই, বোতামগুলো লাগিয়ে দিতে কবে আসছো তুমি?
ইতি
তোমার অবহেলিত সেই
অচেনা পথিক।
লেখক : গল্পকার, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।