আত্মোউপলব্ধিতে “এক টুকরো কাগজ”

প্রবন্ধ

0
1361

খোরশেদ আলম বিপ্লব

কোন এক পড়ন্ত বিকেলে সদা হাস্যজ্জোল প্রিয় মানুষ কথা সাহিত্যিক মনি হায়দার ভাইয়ের ডাকে তার অফিসে স্বাক্ষাত করতে যাই, রম্য রস আর ছোট ছোট আনন্দের খুনসুটির মাঝে কিছুটা হলেও আনন্দের জোয়ারে ভাসছিলাম তার অট্রহাসির মাঝে। হাসি দিয়ে জগতকে জয় করা যায় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ তিনি।  কিছুক্ষন পর মনি ভাই খাওয়ালেন‌ও বটে। অফিস থেকে বেড়িয়ে পুরো বাংলা একাডেমি চত্তর ঘুরিয়ে দেখালেন, ফেরার পথে উপহার পেলাম তার হাতের লেখা উপন্যাস ” এক টুকরো কাগজ”। অনেক দিন পর পুরো বইটি পড়লাম। সময় স্বল্পতা আর  যান্ত্রিক কর্ময়ম জীবনে অনেক কিছু চাইলেও তার জন্য ফুসরত মিলে না। তারপরও একটু একটু করে পুরো বইটির পড়া শেষ করলাম। মনি হায়দার ভাইয়ের লেখার পুনঃমূল্যায়ন করার দুঃসাহস আমার নেই, তবুও ভীমরতি কাঁধে চেপে বসেছে তাই  “এক টুকরো কাগজ”র  পূনঃমূল্যায়ন করার দুঃসাহস দেখাচ্ছি।

অপূর্ব সুন্দরী তাবাচ্ছুম কলি শিল্পপতির কন্যা হওয়া সত্যেও ছোট একটা হাউজিং কোম্পানীতে কাজ করার পেছনের গল্পটা কথা সাহিত্যিক মনি হায়দার তার লেখা উপন্যাস “এক টুকরো কাগজ” এ  খুব নিখুঁত ভাবে উপস্থাপ করেছেন।

উচ্চবিলাসী মানুষরা সব সময়  ভাগ্যের বরপুত্র হয়ে থাকেন, তেমনি জৌলুস জীবনের চাকচিক্য দু’হাতে লুটে সুযোগ সন্ধানী সোলায়মান জীবনের কার্নিশে লোভের রেল গাড়ি চালিয়ে দেয় শামীমার উপড়। তারপর অন্তসত্তা হওয়া সত্তেও দাম্বিকতার মোহে নিমিষেই সোলায়মান ভুলে যায় ঢাকা শহরে পড়তে আসা তাদের বাড়িতে আশ্রিত আত্বীয় শামীমার সাথে যৌন লীলার কথা। আমাদের চারপাশে এ ধরনের শত অন্যায়ের মাঝেও কিছু মুখ প্রতিবাদের ঝান্ডা হাতে অন্যায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়, যেমনি করে বাবা সোহরাব কিবরিয়া অসহায় শামিমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজ সন্তানের পাপের প্রাশ্চচিত্ত ঘুচাবার জন্য ছেলে সোলায়মানের সাথে শামীমার বিয়ে দেন ধুমধাম করে।

আমাদের সমাজে কিংবা কর্মস্থলে ভদ্র বেশী কিছু মানুষ সব সময় ওত পেতে থাকে হায়েনার মত গ্রাস করার জন্য। যেমনি করে আহসান ও জয়নাল চাকলাদার তাবাসসুম কলির পেছনে জোকের মত লেগে ছিল। ষড়যন্ত্র আর নাগরিক কোলাহলের মধ্যে ইসরাত জাকিয়ার ভালবাসা উপেক্ষা করে ভীতু আবদুল মতিন সব সময় ছিলেন বিবেকের কাছে আপোষহীন। মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে  আহসান আর চাকলাদারের ব্যবহার ও কুটিলতায় তার চিত্র সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। তাবাচ্ছুম কলি নিজেকে সমাজের বুকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিছুটা অভিনয়ের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে সত্যের জায়গায় রাখার চেষ্টা করেছেন সবসময়, তা সত্তেও কলির  কিছু চাল চলনে অফিসের পিওন হরলাল দুষ্কৃতিকারীদের কাছ থেকে মেয়েটাকে বাঁচাবার জন্য সতর্ক ভাবে আবদুল মতিনের সামনে অনুরোধের বায়নাটা তুলে ধরেন। ছোট পদবী  আর দারিদ্র্যতার মাঝে বসবাস হলেও হরলালরা  মানুষ, সুন্দরের স্বপ্ন দেখেন সবসময়। তাইতো নিজ কন্যা যোগিতাবালী’র  মেট্রিক পাশের আনন্দে অফিসের সবাইকে মিষ্টি মুখে করিয়ে সন্তানের আর্শিবাদ চেয়েছেন।

ব্যথিত মনে আবদুল মতিন অন্যের কাঁধে জামেলা তুলে দিয়ে  কিংবা কারো বিড়াম্বনায় কখনো সামিল হতে চায়নি । আপন ধ্যানে  কাজের মধ্যে ডুবে থাকা মানুষ গুলো সহজ সরল কিংবা ভীতু হতে পারে কিন্তু অস্থিত্বহীন নয়, তারই প্রতিচ্ছবি আবদুল মতিন এবং সৎ মানুষী কর্ম গল্পের চরিত্রে লেখক তা তুলে ধরেছেন। সমাজের বুকে এরকম অনেক আবদুল মতিনরা পারেন ভুল পথে পা বাড়ানো হুমায়ুন কবির দেরকে দুই সন্তান আর স্ত্রীর বুকে ফিরিয়ে দিতে। ক্ষনীকের মোহে আবিষ্ট হয়ে মানুষ কখনো অন্যায় আর লালসায় প্রলোপব্দ   হয়ে ভুল পথে পা বাড়ায়। কিন্তু যখন সত্য আর সঠিক পথের দিশা বিবেক প্রান্তে কড়া নাড়ে তখনই হুমায়ূন কবীর’রা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসে আপন ঠিকানায়। সবসময় নিজের একান্ত ভালবাসা স্বপ্নের মধ্যে পুঞ্জিভূত রেখে আবদুল মতিন পাশে দাড়ায় অসহাত্বের। যেমনটি আব্দুল মতিন করেন জাকিয়া ও সামান্থার জন্য।
ভালো কাজের প্রাপ্তি মূল্যায়ন  বা সন্মান একটু দেরিতে হলেও পাওয়া যায়, যা কোম্পানীর এম ডি এবং সেক্রেটারি জীনাত রহমানের সঠিক সিদ্ধান্তে তাবাসসুম ও  আবদুল মতিনকে কোম্পানির বিশেষ কাজে  কক্সবাজার পাঠান যা তাদের প্রতি অনুপ্রেরণার সামিল। এখানে ভালো মন্দের তারতম্যটা লেখক খুব সুন্দর করে এই গল্পে মতিন চরিত্রে তুলে ধরেছেন। সমাজে একদল মানুষ আছে যারা নিজ সংসার ভুলে নোংরা অসুস্থ বাসনার বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে নেয়় অনায়াসে। যা আহসান ও চাকলাদারের চরিত্রে তাবাচ্ছুমদেরকে খাবলে খাওয়া লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে পিছু তাড়া করে প্রতিনিয়ত। অসহায় ও বঞ্চিত  তাবাচ্ছুমরা নিজেকে আত্মরক্ষা কিংবা টিকিয়ে রাখার জন্য কখনও বক্ষ উন্মোচন করে দুষ্কৃতি চাকলাদারকে বলে আমার যা আছে ঠিক তা তোমার মায়েরও রয়েছে নাও ভোগ করো ।  ঠিক এভাবেই তাবাসসুম কলিরা নিজেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

জাকিয়া আর সুদর্শন ডাক্তারের প্রেম নিষ্কলংকের বার্তা হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে এক টুকরো কাগজ গল্পে। কিছু মানুষের বেখেয়ালী মনোভাবের কারণে সাধারণ মানুষের অনিয়মের সম্মুখীন  হতে হয়। যেমনটি হয়েছিল হুমায়ূন কবীর সাহেব হাসপাতালে স্ত্রীর চিকিৎসা বিল দুইগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তাতে হুমায়ূন কবীর এর সন্দেহ হয় পরবর্তীতে তদন্ত করে দেখা যায় হিসাব বিভাগ ভুল করেছেন। আমাদের চারপাশে এমন বহু হাসপাতালে এই ধরনের অনিয়ম দুর্নীতি হয়ে থাকে যা লেখক দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন।
মূর্ত বিবেকবান তাবাচ্ছুম কর্ম ব্যস্ত সহজ সরল মানুষ আবদুল মতিনের অন্তরের প্রেম আর মানবিক মূল্যবোধ নিজের মনে ধরেছেন আপন ধ্যানে। আর তাই তো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নিজের অতীত ও তার মায়ের প্রতি সোলায়মানের অন্যায়ের প্রতিচ্ছবি অকপটে তুলে ধরেছেন আবদুল মতিনের কাছে। অন্যায় আর অসহায়েত্বের মাঝে তাবাসসুম কলির বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় সকল অনাচার ‌ঋতিক ঘটকের চির অমলিন “কোমলগান্ধা”  ছবির সুরের ফোয়ারা নেমে আসে। সেই কান্নার জলে আবদুল মতিন ভেসে চলে নিরবতায় আর সুমধুর অনাকাঙ্ক্ষিত ভালবাসা নেমে আসে তাবাসসুম কলি ও মতিনের জীবনে।

মোটা অঙ্কের কাবিনের টাকা আর অঙ্গীকারেও যে সুখ মেলে না এমনকি সংসার টিকে না, তার বাস্তব উদাহরণ তাবাসসুম কলির বাবা ও মা।  তাই ঐ অর্থ আর কাবিন নামক ‘এক টুকরো কাগজ’কে উপেক্ষা করে অলৌকিক গ্রহ থেকে আসা কূল কিনারাহীন সৌন্দর্য্যের দেবী হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় তাবাসসুম কলির। বিশ্বাস ভালোবাসা আর দ্বায়িত্ববোধ থেকে আব্দুল মতিন বাস্তবতায় তাবাচ্ছুমকে জড়িয়ে নেয় বিবাহ বন্ধনে। দু’জনে মিশে যায় আলোর অসীম সরল রেখায়, নতুন সম্ভবনায়, নগ্নতায়, জীবনের আদিম অকৃত্রিম সুরঙ্গে গভীর থেকে গভীরতম তৃষ্ণায়।

দুর্বল ও অসহায় মানুষরা চিরদিন মার খায় তার স্বরূপ প্রতিচ্ছবি তাবাচ্ছুমের মা শামীমা । শশুর মারা যাবার পর থেকে দুঃখের খড়্গ নেমে আসে জীবনে। কিন্তু এখানে লেখক চাইলে মা শামীমা বেগমের প্রাশ্চচিত্ত দীর্ঘায়িত না করে সোলায়মান কবিরকে প্রতিদানের প্রাপ্তি দিয়ে অভাগী মায়ের মুখে হাসির দৃশ্য তুলে ধরতে পারতেন। অন্যদিকে এক রাতে সুযোগে থাকা আহসানের সামনে নারীদেহকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন সেটাকেও একটু ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করা যেত। এছাড়াও পুরো বইটিতে কিছু শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে যা অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাঠকদের মনে কিছুটা হলেও সমালোচনার ঝড় তুলবে। সেই ধরনের শব্দ গুলো লেখক ব্যবহার না করলেও পারতেন।

পরিশেষে তার সহজ সরল ভাষায় উপস্থাপিত এক টুকরো কাগজ উপন্যাসের অসাধারণ গল্প পাঠক মহলে সমাদৃত হবে বলে আমি আশা পোষন করছি। সাহিত্যাঙ্গনের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়ুক ” এক টুকরো কাগজ” এর প্রতিধ্বনি, আর তার অকৃত্রিম মমতা ও ভালোবাসায় যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুন কথা সাহিত্যিক মনি হায়দার এই কামনা চিরকালের।



লেখক ও মানবাধিকার কর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here