হাওরাঞ্চলের ইতিকথা (প্রথম খণ্ড) এ এস এম ইউনুছ
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাওরাঞ্চল। এটি দেশের উত্তর-পশ্চিম গারো পাহাড় থেকে শুরু করে ভৈরব পর্যন্ত ৭টি জেলা সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, মৌলভীবাজার, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপরোক্ত জেলাসমূহের ৫২ উপজেলায় বিস্তৃত হাওরাঞ্চল। তবে ৫২টি উপজেলার সব কয়টি উপজেলা পুরোটাই হাওর এলাকা নয়।
বর্তমানে হাওর বলতে আমরা বন্যা প্রতিরোধের জন্য নদীর তীরে নির্মিত মাটির বাঁধের মধ্যে প্রায় গোলাকৃতি নিচুভূমি বা জলাভূমিকে বুঝি। মূলত হাওর শব্দটির ভূৎপত্তি ‘সাগর’ থেকে। হাওরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো হাওর প্রতি বছরই মৌসুমী বর্ষা বা স্বাভাবিক বন্যায় প্লাবিত হয়। বছরের বেশ ক’মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং বর্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওরের গভীরে কিছু স্থায়ী বিল পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ভৌগোলিক অবস্থান বা এলাকার বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিবেচনা করে বাংলাদেশের হাওরকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়Ñ যথা পাহাড়ের পাদদেশে বা কাছাকাছি অবস্থিত হাওর, প্লাবিত এলাকার হাওর এবং গভীর পানিতে প্লাবিত এলাকার হাওর। সিলেট এবং মৌলভীবাজার জেলার হাওরসমূহ পাহাড়ের পাদদেশে বা কাছাকাছি অবস্থিত হাওর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্লাবিত এলাকার হাওর, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, গভীর পানিতে প্লাবিত এলাকার হাওর।১ এ সাত জেলার মধ্যে হাওরাঞ্চলের মা বলা যেতে পারে সুনামগঞ্জ জেলাকে।
এ জেলার শাল্লা, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, দিরাই, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জামালগঞ্জ প্রায় সম্পূর্ণ হাওরাঞ্চল। তাছাড়া সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, জগন্নাথপুরের বড় অংশ হাওর, কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলি পুরোটাই হাওর এবং তাড়াইল, করিমগঞ্জ, বাজিতপুরের একটি বড় অংশ হাওর, কুলিয়ার চরেরও কিছু অংশ হাওর, ভৈরব হাওর অধ্যুষিত না হলেও হাওরাঞ্চলের সব পানি মেঘনা নদী হয়ে নামার সময় এ অঞ্চলের নিম্ন এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়। নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুরীর পুরোটাই হাওর এবং মদন, মোহনগঞ্জ, আটপাড়া ও কলমাকান্দার বড় অংশ হাওর। তাছাড়া কেন্দুয়ার একটি অংশও হাওর। হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গের প্রায় সবটাই হাওর এবং লাখাই, নবীগঞ্জ, বাহুবলের বড় অংশ হাওর। তাছাড়া মাধবপুরের একটি অংশও হাওর। সিলেটের জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ ও বালাগঞ্জের আংশিক এলাকা হাওর। তবে এসব উপজেলাগুলোতে উঁচু এলাকা বিদ্যমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরের বৃহদাংশ হাওর, তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর ও সরাইলের কিছু এলাকা হাওর। মৌলভীবাজারের সদর, শ্রীমঙ্গল, রাজনগর, কুলাউড়া, বড়লেখা, জুরি উপজেলার অংশ বিশেষও হাওর। উপরোক্ত অঞ্চলসমূহের সম্মিলিতভাবে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে হাওরাঞ্চল। যেখানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের সরাসরি আবাসস্থল। তবে এর আশেপাশের বিপুল জনগোষ্ঠীর সাথে এ অঞ্চলের ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। ধরে নেয়া যায়, প্রায় অর্ধ কোটি লোকের সাথে হাওরের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। হাওরের মোট জমির পরিমাণ ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ১৩৩ একর। এ অঞ্চলে মোট হাওরের সংখ্যা ৪২১টি। এসব হাওরের মধ্যে হবিগঞ্জে ৩৯টি, মৌলভীবাজারে ৩টি, সিলেটে ৪৫টি, নেত্রকোণায় ৭০টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬টি, কিশোরগঞ্জে ১২১টি এবং সুনামগঞ্জে ১৩৭টি অবস্থিত।
দেশের এ সম্ভাবনাময় জনপদের সাথে প্রকৃতির এক অপরূপ মিলন রয়েছে। শীতকালে যে এলাকা শুকনো কিংবা বালুচর, বর্ষাকালে সেখানে দিগন্ত বিস্তৃত জলধারা থৈ থৈ করে যা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শুধু পানির প্রবাহই নয় প্রচণ্ড ঢেউ আছড়ে পড়ে দ্বীপ সদৃশ্য ভূ-খণ্ডে আর দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি সাগরের বিশালত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দ্বীপের মতো গুচ্ছ গ্রামগুলো যেন ভেসে থাকে জলের বুকে। বর্ষাকালে যে হাওরের পাগল করা ঢেউয়ের দোলায় হাওরের শুষ্ক প্রান্তরগুলো উত্তাল হয়ে উঠে, শুকনো মৌসুমে সেখানে পানি থাকে না এক ফোঁটাও। যতদূর চোখ যায় শুধু বোরো ধানের সবুজ শীষ বা সোনারাঙা ধানের সুউচ্চ শস্যময় শীষ প্রাণকে উদ্বেলিত করে। কোনো বছর অকাল বন্যা হলে কৃষকেরা ফসল হারিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে আর্তনাদ করে। শীতকালে হাওরাঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখিদের আগমন হাওরাঞ্চলে নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করে। এ রহস্যময়ী সাগরকন্যা খ্যাত অঞ্চলটির মূল নাম সাগর। অপভ্রংশ ও উচ্চারণ বিচ্যুতি ঘটতে ঘটতে সাগর শব্দটি সায়র, আঁওর এবং হাওর শব্দে পরিণত হয়েছে।
তুলনাহীন রূপ বৈচিত্র্যময় সমৃদ্ধ এ জনপদ সৃষ্টির ইতিহাস জানতে হলে বাংলাদেশের ভূ-ভাগ সৃষ্টির ইতিহাস জানা দরকার। অতিপুরাকালে ভূমধ্যসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত টেতিস নামে এক সাগর ছিল। পৃথিবীর আটটি প্রাচীন শিলার মধ্যে ভারতের বৃন্দাবন ও তিব্বত অন্যতম। এ দু’পাহাড়ের মধ্যে সাগর প্রবাহিত হতো। বায়ুমণ্ডলের চাপে সাগর থেকে হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি এবং সে জন্য হিমালয়ে অনেক জীবাশ্ম পাওয়া যায়।
প্ল¬াইস্টোসিন যুগের প্রারম্ভে জলবায়ু খুব ঠাণ্ডা ছিল। ফলে ভূ-ভাগের অনেকাংশ ছিল বরফাচ্ছন্ন। তখন বঙ্গোপসাগর অনেক নিচে নেমে যায়। সাগরের অনেকাংশ ছিল শুষ্ক। কালক্রমে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। জলবায়ু শীতল ও শুষ্ক হয়ে ক্রমে উষ্ণ ও আর্দ্র হয়। আর অধিক বৃষ্টিপাত ও বরফ গলার ফলে বঙ্গোপসাগরের পানি ক্রমে ক্রমে উপরে উঠতে থাকে। হিমালয়ের পাদদেশ পানিতে নিমজ্জিত ছিল। আজও প্লাইস্টোসিন যুগের লাল পলি অঞ্চল বরেন্দ্র, মধুপুর ও কুমিল্লার লালমাইতে দেখা যায়। প্লাইস্টোসিন যুগ যদি দশ লক্ষ বছর ব্যাপ্ত থাকে তাহলে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ বছর আগে হয়ত এ ঘটনা ঘটে। তারপর নদী দ্বারা বাহিত পলি-বালি প্রভৃতি জমে জমে বাংলাদেশের ভূ-ভাগ সৃষ্টি হয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্ম দু’লাখ বছর ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু দক্ষিণভাগের ভূগঠন ৫০ হাজার বছরের বেশি হবে না।২ সেক্ষেত্রে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল কবে কোন অমানিশার অন্ধকার থেকে বের হয়ে প্রথম আলোর মুখ দেখেছিল তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে হাওরাঞ্চলটি একসময় সাগরগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। এ বিষয়ে দু’একটি উদাহরণ রয়েছে যেমন- তাহিরপুর উপজেলার টেকেরহাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পটি। এ খনিতে মজুদ চুনাপাথর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে একটি ইতিহাস জানা যায়। আর তা হলো এ চুনাপাথরে এক ধরনের ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। সামুদ্রিক ঝিনুক জাতীয় জীবাশ্ম জমাট বেঁধে মাটির ঢিবি গড়ে তোলে। আর এর নিচে সঞ্চিত জীবাশ্ম প্রাকৃতিক কারণে এর ভূগর্ভস্থ উত্তাপে জমাট বেঁধেই বিশাল চুনাপাথর স্তরের সৃষ্টি হয়। ফলে এটাও অত্যন্ত পরিষ্কার, এ অঞ্চলটি আগে নিশ্চয়ই সমুদ্রগর্ভ বা তার অংশ ছিল যা কালীদহ সাগর/লোহিত্য সাগর নামে পরিচয় করা সম্ভব হয়েছে। যার বুক চিরে এককালে সপ্তডিংগা মধুকর বাণিজ্য করে বেড়াত। আজ ডিনামাইট ফাটিয়ে সে জমাট চাই ভেঙ্গে উত্তোলন করা হচ্ছে তা একটি বড় উদাহরণ। এ থেকে সত্য প্রমাণিত হয় এ অঞ্চলটি এক সময়ে সাগরের গর্ভে ছিল। তখন এটি কালীদহ সাগর বা লোহিত্য সাগর নামে অভিহিত ছিল।
তবে নামের বিষয়ে বৃহত্তর সিলেটের গবেষকদের মতে, এলাকাটি কালীদহ সাগরে নিমজ্জিত ছিল। দেশবরেণ্য গবেষক শ্রীযুক্ত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত¡নীতি তার ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে হাওরাঞ্চলকে কালিদহ সাগর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং নেত্রকোণা মুখাশ্রী গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
আড্ডা দিলা গঙ্গা মাও কালীদহ
বাদুরার ডিঙ্গা ডুবাইতে
ব্রহ্মপুত্র যায় আগে সংগে নিয়া পূর্বভাগে
ষোলশত নদ-নদীর সহিতে।
অন্যদিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গবেষকদের মধ্যে ড. গোলাম ছামদানী কোরায়েশী ময়মনসিংহের সাহিত্য সংস্কৃতি নামক গবেষণা পত্রিকায় লিখেছেন সম্ভবত ব্রক্ষপুত্রের পূর্বনাম লোহিত্য নদ, তিনি লিখেছেন-
“জনমি কায়স্থকুলে লৌহিত্য নদের কুলে,
রাঢ় বরেন্দ্রভূমি ছাড়ি কৈনু আগমন।
বোরোগ্রাম পুণ্যভূমি বসতি করিনু
আমি দশদিক শোভা অতুলন।”
কালীদহ সাগর নাকি লোহিত্য সাগর এ বিষয় দুটি ভিন্নমত থাকলেও দুটির নামের সঠিকতা রয়েছে। কেননা জনবসতি শুরু হওয়ার পর থেকে হাওরাঞ্চল দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রাচীন আমলে বৃহত্তর ময়মনসিংহের হাওরাঞ্চল কোচদের স্বাধীন রাজ্য ছিল। অন্যদিকে বৃহত্তর সিলেট হাওরাঞ্চলে খাসিয়াদের দখলে ছিল। তাদের এ অঞ্চলে রাজত্ব করার ইতিহাস রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় যখন থেকে সভ্য মানুষের জনবসতি শুরু হয়েছে তার পর হতে সর্বশেষ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দুটি অঞ্চল দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির আগ পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলা এবং সিলেট আসাম প্রদেশের একটি জেলা ছিল যার ফলে দুই অঞ্চলের মানুষের কাছে এ সাগরের দু’ধরনের পরিচিতি ছিল।
কিশোগঞ্জের ইতিহাস ‘সম্মেলন স্মারক ২০০৪’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এলাকাটি সাগরের গর্ভে নিমজ্জিত ছিল। হয়তো তখন ব্রহ্মপুত্র নদের স্বতন্ত্র প্রবাহধারা শুরু হয়নি। বৃহত্তর সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত এ বৃহৎ হাওরাঞ্চলের বিশাল জলধারার তরঙ্গমালা আছড়ে পড়তো খাসিয়া এবং গারো পাহাড়ের পাষাণ গাত্রে। এটাই ছিল কালীদহ/লৌহিত্য সাগর। এ এলাকার “হাওর” শব্দটি “সাগর” শব্দটির পরিবর্তিত রূপ। এ সাগর পাড়ি দেয়া সম্ভব ছিল না। মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব এখানে ভ্রমণ করতে পারেনি বলে এলাকাটিকে পাণ্ডববর্জিত অঞ্চল বলে উপহাস করেছে।
যা হোক সপ্তম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত যেসব ভূ-পর্যটক বাংলাদেশ সফর করেছেন তাদের কারো সফরনামায় ভাটি এলাকার উলেখ পাওয়া যায়নি। বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন-সাং এর লেখা থেকে জানা যায়, একটি বিশাল জলধারার পশ্চিম উপকুল ধরে তিনি উত্তরে কামরূপ তথা প্রাগজ্যোতিষপুর হয়ে চীনে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
কালের আবর্তনে এ সাগরের বুকে জমে চরা। নবগঠিত এ চরার স্যাঁতস্যাতে জমিতে গজিয়ে উঠে নিবিড় নলখাগড়া আর ইকরার বন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে এ বন চাপা পড়তে থাকে নতুন পলিমাটির নিচে। বহুকাল যাবত বিরান পড়ে থাকার পর পর্বতচারী অষ্ট্রোমঙ্গোলীয়ান জাতি গোষ্ঠীর কোচ, হাজং গারো এবং খাসিয়ারা সমতলে নেমে আসে এবং বসবাস শুরু করে।৫ এদের মধ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহ কোচদের সংখ্যাধিক্য থাকায় তারা সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং বৃহত্তর সিলেট অংশে খাসিয়াদের উপদ্রব ছিল বেশি। তাদের এ অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল যার নাম । মালনিয়াং মাধুর মাস্কুট রাজ্য। মালনিয়াং রাজ্যটির উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি কিংবদন্তি বিদ্যমান। একটির মতে বলা হয়েছে যে, এ রাজ্যের রাজাগণ জৈন্তিয়া বংশোদ্ভুত লোক ছিলেন। এ রাজ্য সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা দরকার কারণ বৃহত্তর সিলেটের অধিকাংশ এলাকা প্রাচীনকালে এর রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। মধ্যযুগ পর্যন্ত দুটি স্থানে এ রাজাদের রাজধানী ছিল। একটি হলো খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের সীমান্ত এলাকায় মাধুর মাস্কুট নামক স্থানে এবং অন্যটি সিলেট জেলার জাফলং এর বল্লাপুঞ্জি নামক স্থানে অবস্থিত। দুটি জায়গায় আজও রাজবাড়ীর ধ্বংস¯তূপ দেখতে পাওয়া যায়। কিংবদন্তির মতে, এ রাজ্যের পূর্বদিকে মণিপুর রাজ্য উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদী, পশ্চিমে ময়মনসিংহ এবং দক্ষিণে ঢাকা ত্রিপুরা অবস্থিত। জৈন্তিয়াসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহ এ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। এ রাজ্যটি এককালে সিলেট সদর শহর এলাকা কোম্পানীগঞ্জ থানা, গোয়াইন ঘাট থানা ও সুনামগঞ্জ জেলার বৃহৎ অংশ জৈন্তিয়া পাহাড়ের কিয়দংশ এবং আসামের একটি অংশ নিয়ে গঠিত ছিল।
ধীরে ধীরে এ ভূ-ভাগ কামরূপ রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এভাবে চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী। ইতোমধ্যে ব্রহ্মপুত্রের স্বতন্ত্র প্রবাহধারা শুরু হয়েছে।
একে তো পাণ্ডববর্জিত অঞ্চল, তার উপর উত্তাল তরঙ্গমালা তাই বহুকাল নির্বিবাদে বসবাস করেছে উপজাতি স¤প্রদায়ের মানুষেরা। এখনো হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পরিত্যক্ত কান্দা এবং পুতায় তাদের বসতির চিহ্ন আজও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন ছাতকের কোচ বাড়ি এবং ইটনা সদরে কোচ সামন্তরাজার বাড়ি, যেখানে ছিল সেটি এখনও কোচরাজার হাটি নামে বিদ্যমান। ইটনা থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে চিলনি গ্রামে ১২ একর পরিমাণ একটি দিঘী এবং একটি আয়তাকার বেলে পাথর কোচ সামন্তযুগের একটি নিদর্শন। পাথরটি ছিল কোচদের আরাধ্য দেবতা। এটিকে তারা পূজা করতো।
যা হোক বিভিন্ন স্থান থেকে নিরাপদ বসতির জন্য এ অঞ্চলে তীরে মানুষ আসতে থাকে। তখন উপজাতিরা তাদেরকে কোনো প্রকার বাধা প্রদান করেনি। তাদের এ উদারতার ফলে পরবর্তীকালে দলে দলে ভাগ্যান্বেষী মানুষ এ এলাকায় ছুটে আসতে থাকে। এখানে এসে তারা এক অরাজনৈতিক নিশ্চিন্ত জীবন খুঁজে পায়। সাথে সাথে লাভ করে বিস্তর উর্বর জমির মালিকানা স্বত্ব। সাধারণত কৃষিজীবী এবং মৎস্যজীবী হিসাবেই তারা জীবন নির্বাহ করতে থাকে। উপজাতি লোকদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের ফলে এক মিশ্র সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ধর্মীয় চিন্তা চেতনার সাথে কিছু কিছু বিষয় এক হয়ে যায়। লৌকিক আচার অনুষ্ঠান কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিন্ন রূপ লাভ করে। দেও-দানব-ভুত- পেত্নী, ঝাঁড়-ফুক, তুক্, তাক্, মন্ত্র-তন্ত্র, যাদুটোনা এবং বিভিন্ন অপদেবতা- যেমন ডাকিনী, যোগিনী, হাকিনী ইত্যাদির বিশ্বাস প্রসার লাভ করে। যার প্রভাব অদ্যাবধি এখানে লক্ষ্য করা যায়।
তথ্যসূত্র: হাওরবাসীর জীবনকথা, লেখক এ এস এম ইউনুছ, প্রকাশকাল ২০০৯