শামছুল আরেফিন খান
দৈনিক সংবাদে ৬১ সালে ব্যক্তিগত পরিচর্যায় আমাকে প্রতি রাতে নির্দেশনা দিয়ে রিপোর্টার হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন জহুর ভাই। শেরেবাংলার জীবনের শেষ সাক্ষাতকার নিলাম তাঁর নির্দেশে। পিআইডিসির ঝোলাগুড় কেলেঙ্কারির কোটি কোটি টাকার দূর্ণীীতর তথ্য পাতাল থেকে তুলে অনলাম তারই দেয়া সূত্রধরে। আইয়ুব খানের জাতীয় সংসদে ফাটাফাটি আলোচনা সমালোচনা হ’ল ।আমার রিপোটের ভিত্তিতে পরিচালক জামান সহ ৮ জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার চাকরি গেলো। পতিতা পল্লীঘুরে যখন রিপোর্ট করতে লাগলাম তাদের জীবনকথা জহুর ভাইর নির্দেশনায় ঢাকার সিটি এসপি মুস্তাফিজুর রহমান আমাকে পূর্ন নিরাপত্তা দিলেন। সে সময় সড়ক দুর্ঘটনার খবরের বিবরণে বলা হ’ত অমুক জায়গায় ‘এতজন লোক’ হতাহত হয়েছে। জহুর ভাই বললেন , ফলোআপ কর। ভিকটিমদের বাড়িতে চলে যাও। আহত নিহতদের রক্তাক্ত ছবি নিয়ে রিপোর্ট কর। একটা দুর্ঘটনায় পরিবারের উপর কী দুর্ভাগ্য কী দুর্যোগ নেমে এসেছে সেটা তুলে ধর। দুর্ঘটনার কারণ কী? সে কথা বল? পুলিশ কী ঘোড়ার ঘাস কাটে? শিক্ষামন্ত্রী বগুড়ার হাবিবুর রহমান আসলেন । জহুরভাই আমাকে ১০০টা প্রশ্ন তৈরি করে দিলেন। আমাকে বললেন, “একবারে নাস্তানাবুদ কইরা ফালাইবা। কান্দাইয়া ছাড়বা”। তাই হ’ ল মন্ত্রীর বিমানবন্দর সাক্ষাতকারে। পিআইডির উপপরিচালক সোবহান সাহেব মন্ত্রীকে বিড়ম্বনা থেকে বাচাতে আমাকে পাজাকোলা করে তুলে সাংবাদিক সাক্ষাতকারের ইতি টানলেন। সংবাদপত্র পাড়ায় তার প্রভাব পড়লো। আমার নাম ফাটলো।হামিদুর রহমান কমিশন কী শাল দিচ্ছে , সংবাদের রিপোর্ট পড়ে সেটা বুঝতে পেরে ছাত্রসমাজ গর্জে উঠলো। ’৬২ ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হ’ল।সংবাদ সেদিন ২য় সংষ্করণ প্রকাশ করেছিল। ইত্তেফাকে প্রথম ওয়েজ বের্ডের চলনসই বেতন পেলাম। বিয়ের বাজারে ইত্তেফাকের চাকরির তবুও একটা কদর ছিল। একজন পেশাদার সাংবাদিকের কাছে চাকরির শর্তটাই সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ। আমি সিরাজভাইর ডাকে সাড়া দিয়ে বিনা দরখাস্ত বিনা ইন্টারভিউ ১ জানয়ারি ৬২ ইত্তেফাকের বার্তাবিভাগে সহসম্পাদক পদে যোগদান করলাম। বিয়ের কপাল খুলে গেলো। ২৮ জানুয়ারি বিয়ে করলাম। জহুরভাই ছাত্র জীবনে কলকাতায় ছাত্র ফেডারেশন করতেন। শেখ মুজিবেুর রহমানের সথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জহুর ভাই একদিন তাঁর নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে আমাকে মুজিব ভাইর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই থেকে সংবাদে মুজিব ভাইর অনেক এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট ছাপা হতে লাগলো।সেই নৈকট্য আরও নিবিড় হয়েছিল উত্তরকালে। তারই ফলশ্রুতিতে ২৩ মার্চ ৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুের রহমান পাশ্চাত্যের সাংবাদিক প্রতিনিধিদের কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দশ বছরের তথ্য সমন্বয়কারি / MIDIA COORDINATOR বলে। ৭৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আমাকে অনেকের ঈর্ষার শিকার হতে হ’ল সরকারের মুখপত্র ও দেশের প্রধান কাগজ দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা CEO এবং পদাধিকারে প্রধান সম্পাদক ও সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে। আমি সজ্ঞানে অব্যাহতি চেয়ে কাকুতি মিনতি করায় মুজিব ভাই বললেন , “তুই বুঝলি না আমি তোকে ‘প্রাভদার’ চীফ এডিটার বানিয়েছি।” সেটা বুঝলাম খ.মুশতাকের প্রধান এজেন্ট তাহের উদ্দিন ঠাকুর যখন ষড়যন্ত্র মাথায় নিয়ে মুজিব ভাইকে পটিযে তথ্য প্রতিমন্ত্রী হ’ল এবং প্রথমেই আমার আমার মুন্ডুপাত করলো তখন। বুঝলাম হাড়ে হাড়ে। সে গল্প অনেক বড়। কখনও বলা হয়নি। সময় পাবো কিনা জানিনা। আজকের এই পর্বে জহুর ভাইর একটা রসের স্মৃতি চারণ করে শেষ করতে চাই। আইয়ুব খান বড় মাপের স্বৈরাচার হলেও প্রতি মাসে একবার দেশের সব কটি পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দীর্ঘ বৈঠক করে দেশের কথা আলোচনা করতেন। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (ইত্তেফাক),আব্দুস সালাম ( পাকিস্তান অবজারভার ), আবুল কালাম শামসুদ্দিন (দেনিক পাকিস্তান), বদরুদ্দিন আহমেদ (মর্ণিং নিউজ) সহ অন্যান্যের নেতা ও মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন। সেদিন ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধান মন্ত্রী হয়ে শপথ নিলেন। সেই খবরের তারবার্তা সম্পাদকদের সাথে বৈঠক চলাকালে পেয়ে প্রেসিডেন্ট সবাইকে জানালেন। জহুর ভাই উঠে দাড়ালেন। সবাই মনে করলেন তিনি বোধ হয় খুব জ্ঞানগর্ভ পর্যবেক্ষণ জানাবেন। কিন্তু রসিক জহুর ভাই শুধু একটা বাক্যই উচ্চারণ করে হাসির বোমা ফাটালেন : “NO MORE CLOSE DOOR MEETING WITH INDIAN PRIME MINISTER , MR PRESIDENT.” আমি ঋদ্ধ জহুর ভাইর কাছে। জন্মদিনে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
লেখক: কলাম লেখক ও সাংবাদিক