শামছুল আরেফিন খান
কেতাবমতে যুদ্ধ ও প্রেমে নৈতিকতা মেনে চলার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্রয়োজনের তাগিদে ‘মিথ্যা’ না বললেও কিঞ্চিত “অসত্য” বলা চলে। কৌরবদের সাথে যুদ্ধে পান্ডব প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ বীর অভিমন্যুর প্রাণ বিপন্ন হয়েছিল। তাকে বাচাতে চেয়ে এক চিলতে মিথ্যে বলেছিলেন ন্যায়ের অবতার যুধিষ্ঠির। সে কারণ মহাভারতের নায়ক ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে সশরীরে স্বর্গ যাওয়ার পথে একটুখানি নরক দর্শন করতে হয়েছিল। “রণে ও প্রেমে জয়ের জন্যে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াটা জায়েজ”। এই কথাটার উৎপত্তি মনে হয় সেই কাল্পনিক কাহিনী থেকেই ঘটেছে। রণক্ষেত্র থেকে প্রেরিত আমার প্রতিবেদনে সত্যমিথ্যার মিশেল ছিল।কিন্তু মিথ্যা এমন প্রবল ছিল না । তবে পাকিস্তানীদের দম্ভ অহঙ্কার গ্রেনেড মেরে গুড়িয়ে দিতে ও তাদের দর্পচূর্ণ করতে সেটা খুব একটা অপ্রতুল হয়নি। চারটে প্রধান আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার নেটওয়ার্কে ভর করে খবরটা সারা পৃথিবীতে চাউর হয়েছিল। কোথায় সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ পাওয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আর কোথায় একদল চাষাভূষা অদক্ষ বন্দুকধারি। অস্ত্র বলতে পুলিশের ব্যবহার করা ক’টা পুরণো মডেলের থ্রি নটথ্রি রাইফেল আর ইপিআর এর ক’টা চকচকে চাইনিজ । স্টেনগান এর সংখ্যাও তেমন বেশি ছিল না।মর্টার এলএমজি ছিল প্রয়োজনের তূলনায় খুবই অপ্রতুল । তাই নিয়ে মুক্তিবাহিনী প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছিল। ইউনিফর্ম তো ছিলই না কারও তেমন একটা। যেমন খুশি সাজোর মত অবস্থা।লুঙ্গিপরা সেই বাঙালি যোদ্ধাদেরকে পাকিস্তানীরা এতকাল যাবত “কতিপয় বন্দুকধারি দুষ্কৃতি “ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এসেছে। “সেই হঠাৎ গজানো” মুক্তিবাহিনীর দ্বারা পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীর নাস্তানাবুদ হওয়াটাই ছিল অনেক বড় ব্যাপার। ক্ষয়ক্ষতি যাই হোক না কেন।তারউপর মিথ্যার ওপর সত্যের রঙ চড়ানোআমার পেশাদার প্রতিবেদনে তিনশতাধিক টাইটফিট সৈন্য হতাহত হওয়ার খবর তাদের বুকে বল্লমের আঘাত হেনেছিল। সত্য বলতে তো আমরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলাম অনেক বেশি সংখ্যায়। প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার দশা। পাকিস্তানিরা সমর বিজ্ঞানের খুব পুরাণো কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল।শত্রুকে ভিতরে ঢুকতে দিয়ে বেকায়দায় ফেলার কৌশল নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া হিটলারের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিল। সে গল্প প্রায় সবাই জানে। পাকিস্তানিরাও সেই কায়দায় পিছনে হটতে শুরু করলো । মুক্তিবাহিনী এগিয়ে গেলো বীর বিক্রমে। যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে একটা টিলার উপর সেক্টর কমান্ডারের পাশে আমি বসেছিলাম।আমাদের অদূরে মিত্রশক্তির আর্টিলারি ব্যাটারি। মেজর বিক্রম সিং আমাদের পাশে বসেই ক্যাপটেন রবের চাহিদামত টার্গেট নির্দেশ করছিলেন । এক পর্যায়ে চাহিদা ও সরবরাহের সমন্বয় আর রক্ষা করা গেলো না। তখনই আমাদের যোদ্ধারা বিপদের ঝুকিতে পড়ে গেলো।মিত্রদের কয়েকটা গাড়ি ধার করে আমি ছুটলাম রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে।সেন্ট্রি ডিউটি করারও কেউ থাকলো না। অস্ত্র গোলাবারুদের মজুদ নিঃশেষ হয়ে গেলো। এই হতাশার কথা চেপে রেখেই আমি এক টুকরো আশা জাগানিয়া কাহিনী প্রচারের প্রয়াস করেছিলাম। আর তারই চড়া দাম দিতে হয়েছিল আমাকে।ঠিক তিনদিনের মাথায় শত্রুপক্ষের জিঘাংশার প্রথম আলামত ফুটে উঠলো। সীমান্তের নো ম্যান’স ল্যান্ডে ছিল আমাদের আর একটা ঘাটি। কতকগুলা টিলার মাঝখানে। কাছেই ছিল বিএসএফ চৌকি।হঠাৎ সন্ধারাতেই জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে সাদা পোষাকে শত্রু সৈন্য সেই ঘাটিতে ঢুকে বিশ্রামরত মুক্তিসেনাদের নিশ্চিহ্ন করে দিলো। জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে নিরাপদে প্রস্থান করতেও সক্ষম হ’ল।“লালপতাকা দিয়ে লালপতাকা খতমের কৌশল নিয়েছিল তারা। এই ঘটনায় আমরা যথেষ্ট বিচলিত হয়েছিলাম।আমি ফিরে গেলাম রণক্ষেত্রে। মিত্রশক্তির নিকটবর্তী এক সেনা সদরে অফিসার্স ক্লাব সংলগ্ন টিলার উপর একটা ডেরায় আমার অবস্থান নির্দিস্ট ছিল। একই টেন্টে পাশপাশি দুটো খাটিয়ার একটাতে আমি , অন্যটাতে সেকটার কমান্ডার মেজর সিআর দত্ত থাকতেন। পাশের অন্য একটা টেন্টে থাকতেন স্টাফ অফিসার (একাউনটস) ফ্লাইট লেফটেনান্ট আতাউর রহমান।উত্তরকারে এয়ার কমোডর , অবঃ। সাতদিন গেলোনা। তার মধ্যে গোয়েন্দা সূত্রে দুঃসংবাদ আসলো। শত্রুপক্ষের এবারের টার্গেট আমি। আরটিলারি হামলাটা আসবে সুতাকান্দি সীমান্ত থেকে।পরবর্তী বুধবার । আমি রবিবার গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। গ্রামবাসীকে নির্দেশ দেওয়া হ’ল নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার জন্যে। আমার বাড়ির কাছেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসএসবি এবং বিএসএফ গোয়েন্দা পোস্ট ছিল। একটার দায়িত্বে ছিলেন ইনেসপেক্টার দেব বাবু্ । অন্যটাতে বিএসএফ এর একজন সহকারি পরিচালক ।তারাই গ্রামবাসীকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু আমার বাড়ির এক উঠোনে যে ৫/৭ পরিবার ছিল তারা অনড় রইলো।কেউ আমার মত করে বাঙ্কারও খুড়লো না। চলবে
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক