শামসুল আরেফিন খান
ইতিহাস সত্য ও সুন্দরের অবিকৃত প্রতিচ্ছবি হয়ে প্রতিভাত হ’ত যদি চলমান সময়ের ধারাপুঞ্জের স্ব-লিখনে প্রাসঙ্গিক দাপুটে মানুষের হস্তক্ষেপ না ঘটতো । তবে ইতিহাসের আছে একটা অমর আত্মা । আছে একটা অমর প্রাণ। আছে একটা অবিনাশি চাক্ষুশ স্মৃতি। স্বার্থান্বেষী মানুষ সত্যের অপলাপ করে। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায়।। ইতিহাসকে পাথর চাপা দেয়। তবুও সময়ের তাড়নায় সত্য সুন্দর আবার মহেঞ্জোদারোর পুরাকীর্তীর মত মাটি ফুড়ে বেরিয়ে আসে। “সভ্যতার শহর মাটির নিচে//ধূলার নিচে ভাষা-কথা মালা //মানুষ তাকে বলে মৃত টিলা//এখানে কোন মহামারীর একদা আগমন ঘটেছিল”।নিজের অতীতকে সম্যক না জানলে মানুষ সামনের দিকে পা ফেলতে শঙ্কিত ও দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে।বিভ্রান্ত হতে পারে। ভুল পথে পা ফেলে চোরাবালিতে নিমজ্জিত হতে পারে। অবলীলায় অগ্রগতি অবাধ রাখতে তাই মুক্তিকামী জাতিকে নিজস্ব সংষ্কৃতি সংরক্ষন করতে হবে। ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে হবে। ইতিহাসকে অমলিন ও নির্ভেজাল রাখতে হবে । এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।কোন জাতি যখন দৃঢ় প্রতীতী নিয়ে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায় তখনই পশ্চাদমুখীন অপশক্তি নানা কৌশলে তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে। আমাদের সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল কয়েকশ’ বছরের অসাম্প্রদায়িক মিলনমেলায়।তারই সুফল ও ফলশ্রুতি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৫৭ সালের আকাশস্পর্ষী গণজাগরণ।তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি হারালো তার অখন্ড ভৌগলিক অস্তিত্ব ও জেগে ওঠার শক্তি।ব্রিটিশ চলে গেলো্। পূর্ব বাংলায় আমরা আবার আটকা পড়লাম নয়াউপনিবেশবাদী দুঃশাসন ও রক্তচোষা শোষণের নিশ্ছিদ্র জালে। প্রথম আঘাত আসলো ভাষার ওপর।বাঙালি মাথা তুললো । সেখান থেকে শুরু নবঅভিযান ও নবজাগরণের ইতিহাস। দুরন্ত দুর্বার অবিরাম সংগ্রামের ইতিহাস। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম কখনও অবাধ হয়না। বাধা আসে ।বাধা ভাঙতে হয়।বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আইনী আগ্রাসন আসতে দেখে রুখে দাড়ালেন কুমিল্লার সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।সংসদে দাড়িয়ে বললেন বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ । বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে পাাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকথ আলী খান জন্ম গ্রহন করেছিলেন পাঞ্জাবের হরিয়াণায়।কিন্তু মুসলিম লীগের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন পূর্ব বাংলার কোটায়। বাঙালি না হয়েও বাংলার মানুষের প্রতিনিধি হলেন। প্রতারণার শুরু সেটাই। তিনি ধীরেন্দ্রনাথকে বললেন, তুমি বিচ্ছিন্নতাবাদী।মুসলমানরা কেউ উর্দুর বিরুদ্ধে নেই।তোমরা ভারতের দালাল। তোমরা পাকিস্তান ভাঙতে চাও।দেশত্যাগের হিড়িকের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ মাতৃভূমির মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকার এমন নির্মম পুরষ্কার পাবেন সেটা কখনও ভাবেননি আগে।ভগ্ন হৃদয় নিয়ে তিনি করাচি ছেড়ে কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে এসে নামলেন । সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা দৃশ্যমান ছিল না। অদূরে দেখতে পেলেন জন পঞ্চাশেক মানুষের জটলা। বয়সে সবাই তরুণ। সবার গায়ে চাদর । একটু ভয় পেলেন ধীরেন্দ্র নাথ । ওরা হয়ত এসেছে তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে। তিনি সসঙ্কোচে এগিয়ে গেলেন। ওরাও সবাই সামনে এসে দাড়ালো। ভয় আতঙ্কে তিনি তখন ঘর্মাক্ত হচ্ছিলেন বিদায়ী শীতের শির শিরে পরশের মধ্যে। কিন্তু জানতেন না যে এখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল একটা মধুর চমক। ওরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সবাই এবার চাদরের ভিতর থেকে হাত বের করলো। অস্ত্রশস্ত্র না। সবার হাতেই দেখা গেলো ফুলের মালা। তাঁর ভালোবাসার পরিবর্তে ভালোবাসা এনেছে ওরা। এটা তাঁর বীরোচিত সম্বর্ধনা।এটাই ভাষা বাঁচাবার তরে বাঙালির সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সূচনা লগ্ন । ভাষাযুদ্ধের ধ্রুবতারা ধীরেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজৈবনিক স্মৃতচারণে এভাবেই উপস্থাপন করেছেন বিষয়টা।সময়টা ১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারি। ধীরেন্দ্রনাথের রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব পাকিস্তানের গণপরিষদে খারিজ হওয়ার সাথে সাথেই বলতে গেলে ঢাকার শিক্ষাঙ্গনে প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঊর্মিমালা উথলে উঠেছিল। সংগঠন ছিলনা। বাঙালি হৃদয়ে আবেগ ছিল। সেই আবেগ নিয়ে গোপালগঞ্জের শেখ মুজিবুর রহমান নতুন সংগঠন গড়েছিলেন। নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিবাদী ছাত্রদের নিয়ে।সাম্প্রদায়িক অভিঘাতে একদা শক্তিশালী বাম সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন তখন প্রায় নিশ্চিহ্ণ হওয়ার দশায়। যারা আত্মগোপনে সপ্রাণ ছিল, মুজিবের হাত ধরে তারাও এসেছিল সেই সন্ধ্যায় চমকে দেয়া ফুলেল সংবর্ধনায়। ভাষার হাত ধরে বাঙালির অবদমিত সংগ্রামী সত্বা আবার জেগে উঠলো।ভাষা যেমন সংগ্রামের হাতিয়ার । ভাষা তেমনি শোষনেরও অস্ত্র।উর্দু ভাষাকে ধর্মের মোড়কে পুরে সেই শোষণের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকরা। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪ প্রদেশের ছিল প্রত্যেকের ভিন্ন ভাষা।তার আলাদা সংস্কৃতি। পৃথক ঐতিহ্য্।প্রত্যেকের ছিল জাতীয় মুক্তির আকাঙ্খা।সম্পদের বৈষম্য এবং দারিদ্র্যই ছিল দুটো অভিন্ন বিষয়। এ ব্যাপারে পাঞ্জাবের গরীব আর সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং পাঠান মুল্লুকের দরিদ্র মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না।এতদাঞ্চলের মানুষের শ্রেণী ছিল মাত্র দুটো। ধনীদরিদ্রের মাঝখানে হাইপেন হিসেবে কোন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। পাঞ্জাবিদের একটা আলাদা শক্তি ছিল। সেটা তাদের যুদ্ধ বিদ্যা।ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে পাঞ্জাবিদের সংখ্যাধিক্য সেই শক্তির যোগান দিয়েছে।তার মধ্যেও বেচেছিল অসাম্প্রদায়িক পাঞ্জাব।দেশভাগের সময় পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী সেকেন্দার হায়াত খান সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করেই জিন্নার পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধিতায় দ্ব্যর্থহীন হতে পেরেছিলেন।তাঁর দৃঢ়তা বাংলার ফজলুল হক ও সোহরাওর্দীকে হার মানিয়েছিল।অবিভক্ত বাংলার তিন প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক , খাজা নাজিমুদ্দিন, হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী বুকে বুক মিলিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যে বাংলার মাঠঘাট চষে বেড়িয়েছিলেন।তারা বাংলার মুসলমানদের হুজুগে ঠেলে দিতে সফল হয়েছিলেন।কিন্তু বাঙালির আত্মার ক্রন্দনকে থামাতে পারেননি।ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বাঙালি ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন , বাঘা জতীন যেমন লড়েছিলেন জানপ্রাণদিয়ে । তেমনি পাঞ্জাবের মহেন্দ্রপ্রতাপ সিং, ভগৎ সিং ও উধাম সিংরাও অখন্ড সমাজতান্ত্রিক ভারত পওয়ার সাধনায় অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।বিদ্রোহী বাংলা ও বিপ্লবী পাঞ্জাবকে সাম্প্রদায়িকতার খড়্গ দিয়ে দ্বিখন্ডিত করে ব্রিটিশ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছিল বলেই আমার মনে হয়। ।সংগ্রামী সিন্ধু“সিন্ধু কোন প্রাচীন সভ্যতার নাম নয়//এক নবীন প্রত্যয় আর আবেগের নাম সিন্ধু”। কবি বিকাশ দাশের ভাষায় আরও বলা যায় ,“ মহেঞ্জোদড়ো নয় হরপ্পা নয় -এ দেশ এখন সিন্ধুর দেশ //দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে//এ লড়াই নারীত্বের লাঞ্ছনা আর অপমানের বিরুদ্ধে লড়াই//এ সংগ্রাম ত্যাগ ও তিতিক্ষার সংগ্রাম”।সংগ্রামী সিন্ধুর বিপ্লবী নেতাদের দেখা পেয়েছিলাম ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে রুপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে। কথা হয়েছিল জিয়ে সিন্ধ দলের নেতা আব্দুল মজিদ সিন্ধির সাথে।তিনি বলেছিলেন ,“ স্বাধীনতাই আমাদের শেষ কথা”।সীমান্ত গান্ধী১২ মার্চ ১৯৩১ মাত্র ৭৮ জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে মহাত্মা গান্ধী তাঁর ঐতিহাসিক ‘ডান্ডি অভিযান’ শুরু করেন। ২৪ দিনে ২৪১ মাইল পথ হেটে গুজরাটের সবরমতি আশ্রম থেকে আরব সাগরের তীরে ডান্ডিতে উপনীত হন।৬ এপ্রিল সেখানে আরব সাগরের জল থেকে লবন উৎপাদন করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলেন। উত্তর পম্চিম সীমান্ত প্রদেশের গান্ধীবাদী নেতা সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গাফফার খান এর নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে ।তিনি ছিলেন খোদাই খেদমতগার বা ঈশ্বর সেবক দলের প্রতিষ্ঠাতা। এই দলের সদস্যরা সীমান্ত অঞ্চলের প্রাচীন পোষাক পরিধান করতেন বলে এই দল লালকোর্তা পার্টি বা রেড শার্ট পার্টি নামে পরিচিত ছিল। তাদের আকঙ্খায় ছিল পাখতুনিস্তান। পশতু ভাষা ভাষীদের জন্যে স্বাধীন রাষ্ট্র। বেলুচিস্তান বালুচরা বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি হিসাবে পরিচিত ছিল। তারা কখনোই অন্যের বশ্যতা স্বীকার করেনি। যেকারণে ব্রিটিশ কালাতকে একটি স্বাধীণ স্বার্ভভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়। আজ যে ভূখন্ডটি বেলুচিস্তান নামে পরিচিত , দেশ বিভাগের আগে তার নাম ছিল কালাত। তারা কথনোই ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ ছিলনা। ১৮৭৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী কালাত একধরণের স্বাধীণ ও স্বার্বভৌম রাষ্ট্রে মর্যাদা ভোগ করতো।বালুচ ও বাঙালির জাতিগত সংগ্রামের মধ্যে মিল অমিল দুটোই আছে। বাংলাও ধর্মের ভিত্তিতে একাধিকবার ভাগ হয়েছে। ।কিন্তু বালুচরা ধর্মের চেয়ে জাতিসত্বাকে তাদের সংগ্রামের হাতিয়ার করেছে। বালুচ নেতারা মনে করেন , একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্যে ধর্মই মূল উপাদান হতে পারেনা।তাদের মধ্যে ভাষিক সাংষ্কৃতিক ও নৃতাত্বিক মিল থাকতেই হবে। বালুচরা কখনোই পাকিস্তানকে মনে প্রানে মেনে নিতে পারেনি। শীর্ষ স্থানীয় সব বালুচ নেতার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কারাগারে। যখন উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকার ছিল, কালাতের শাসকদের পক্ষে মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন তাদের বেতনভুক আইনি উপদেষ্টা। তিনি তখন কালাতের স্বাধীনতার পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহ কালাতের স্বাধীনতা খর্ব করতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেন; এমনকি সেনা অভিযান চালাতেও দ্বিধা করেননি।পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পরদিন ১৫ আগস্ট কালাতের শাসক মির আহমেদ ইয়ার খান, যিনি খান সাহেব নামে অধিক পরিচিত ছিলেন, বেলুচিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যে কোয়েটা ও লাসবেলার শাসক নিজ নিজ রাজ্যকে কালাতের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে ৫ আগস্ট ১৯৪৭ কালাতের ভবিষ্যত্ নিয়ে দিল্লিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন, কালাতের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ রীতি অনুযায়ী, কালাতেও দারুল আওয়াম ও দারুল উমরাহ নামে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষ ছিল। দুই কক্ষেই সর্বসম্মত প্রস্তাব নেওয়া হয়, কালাত স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে।পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে না। এতে সমতার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি চুক্তি করার কথা বলা হয়। কিন্তু সেই চুক্তি কখনোই হয়নি। তার আগেই পাকিস্তান সরকার কালাতকে গ্রাস করতে নানা ফন্দিফিকির আঁটে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তানে প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু করে বালুচরা, ১৯৪৮ সালে। বাঙালির সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয় ১৯৭১ সালে এবং নয় মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। বালুচদের সংগ্রাম আজও পরিণতি পায়নি।১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব বঙ্গের মানুষ ভাষার জন্যে জীবন দিলো। সেই ৫২ সালের মার্চ মাসেই কালাত ,মাকরান , খামান ও লাসবেলাকে নিয়ে স্বাধীণ বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নেন বালুচ নেতারা। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব ব্রিটিশের সহায়তায় জোর করে বেলুচিস্তানকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করলেন। ১৯৩৯ সালে ভাইসেরয় মার্কুইস লিংলিথগোকে জিন্নাহ বলেছিলেন ,হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। ভারতর মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষ্যে কথা বলার অধিকার রাখে কেবলমাত্র মুসলিম লীগ।তাঁর এই দাবি ছিল ভিত্তিহীন। কারণ তিনি বা তার মুসলিম লীগ ভারতের মুসলমানদের ম্যান্ডেট পাননি কখনো। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুসলিমদের জন্যে ৪৮৪টি আসন সংরক্ষিত ছিল। তার মধ্যে মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ১০৮টি আসন। অন্যান্য মুসলিম সংগঠন ও কংগ্রেস অর্জন করেছিল ৩৭৬টি আসন। এই মাপকাঠিতে তিনি ভারতের মুসলমানদের অবিসম্বাদিত নেতাতো ছিলেনই না বরং মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারও তার ছিলো না। ।তিনি ছিলেন ব্রিটিশের টপ এজেন্ট। ১৯৪০ সালে বিশ্ব সমরে অংশ নেয়ার প্রশ্নে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও খেলাফাত আন্দোলন, লালকোর্তা পার্টি ও খান আব্দুল গাফফার খান , জামায়াতে ওলামায়ে হিন্দ এবং কংগ্রেস সহ সমস্ত দেশপ্রেমিক স্বধিীনতাকামী দল যখন স্রেফ ‘না’ বললো। আগে আজাদী ও গণতন্ত্র । পরে যুদ্ধ। এই বলে প্রত্যাখ্যান করলো ব্রিটিশ প্রস্তাব । তখন চোগাচাপকান টুপি পরে ক্লিন শেভ্ড জিন্নাহ ব্রিটিশের ভাড়াখাটার জন্যে ভারতের মুসলমানদের ২য় মহা যুদ্ধের গন গনে আগুনের মধ্যে ঠেলে দিলেন । তার নির্লজ্জ দালালির এটাই সবচেয়ে বড় প্রমান। দেশভাগের পর জিন্নাহ সাহেব দেখলেন শুধু ধর্মের দড়ি-রশি দিয়ে বাঙালি -পাঞ্জাবী -সিন্ধী-বালুচ -পাঠান এই“ চির উন্নতমম শির” গোছের বিদ্রোহী পঞ্চপান্ডবকে বেঁধে রাখা যাবেনা । তাছাড়া লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সতর্কবানীতো ডেমোকলস এর তরবারির মত তার মাথার উপর ঝুলছিলো।‘বাঙালিকে ২৫ বছরের বেশি লোহার শিকল দিয়েও বেঁধে রাখা যাবেনা’।তাই তিনি পবিত্র কোরাণের হরফ তথা আরবী বর্ণমালায় ভর করা উর্দু ভাষাকে হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিলেন। কিছু কিছু জায়গায় যে ওষুধ ধরেনি তা বলবো না। কারণমোস্তফা চরিতের লেখক বাঙালি কবি গোলাম মোস্তফা অবলীলায় গিলে ফললেন সেই ট্যাবলেট। বাধ সাধলেন মহান শিক্ষক জ্ঞান তাপস ইসলামী চিন্তাবীদ ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।আলেম সমাজের উপর তাঁর ব্যাপক প্রভাব ছিল।তিনি জিন্নার অগ্নিবানে বুড়িগঙ্গা -শীতলক্ষার শীতল জল ঢেলে দিলেন।বললেন, আমাদের দাড়ি টুপি চোগা চাপকান, লুঙ্গি লেবাজ দেখে মালুম করা যায় যে আমরা মুসলমান। পৈতা , টিকি ,ধুতি চাদর পোষাক পরিচ্ছদ থেকে প্রতীয়মান হয় আমরা হিন্দু। কিন্তু দুজনেই আমরা বাংলায় কথা বলি। তাই আমরা আগে বাঙালি । তার পরে হিন্দু মুসলমান। রাজধানী ঢাকার আদিবাসীরা ‘কুট্টি’ নামে পরিচিত ছিল। তাদের উপরও ‘ডাক্তর সহীদুল্লার’ অনেক প্রভাব ছিল।কথিত আছে যে, ঢাকাবাসী বলতো “আমাগো সহরের মদ্যে দুইটা জিনিস দেখোনের আছে। একটা অইলো গিয়া নবাব সলিমুল্লার আহসান মঞ্জিল্ । আর একটা ডাক্তার সহীদুল্লার বেগম বাজারের পেয়ারা হাউজ”।এ রকম একটা গল্পও একসময় চালু ছিল: দুজন কুট্টি , একজন স্বল্প শিক্ষিত আর একজন ‘ক-অক্ষর গো মাংস’ ।মূর্খজন তার প্রতিবেশি স্বল্পজ্ঞানীকে বলছে, “ডাকতোর সহীদুল্লা রুগী ভি দ্যাখেনা। ওসুদ ভি দেতা নেই।”উনি আবার কেমন ডাকতোর?” স্বল্প জ্ঞানী : উনি হইলেন গিয়া বড় মাস্টোর।মূর্খজন: কেত্তা বড়া মাস্টর? জ্ঞানীজন: আমাগো তারু মিঞা আছেনা? তার যে মাস্টর , তারও যে মাস্টর , তার যে মাস্টর,তারও যে মাস্টর – এমনে কইরা তুই পঞ্চাস তালায় উইঠা পড়; সেইখানে তুই যে মাস্টররে পাইবি? হেই ওইলো গিয়া ডাক্তর সীদুল্লাহ।”ঢাকার আদিবাসীরা উর্দু বাংলা মিশেল দেয়া একটা জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলতো। উর্দুর প্রতি একটা বিশেষ টানও ছিল তাদের। উর্দুকে তারা খানদানী ভাষা বিবেচনা করতো। কিন্তু ড.শহীদুল্লাহ বাংলার পক্ষ্যে শক্ত অবস্থান নেয়ায় তাদেরও মন ঘুরে গেলো।তারাও ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’স্লোগান তুলে পাড়া মহল্লা মুখর করে তুললো। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা উদীয়মান জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে তাদের একজন মনের মত নেতাকে খুজে পেলো। ১১ মার্চের তুলকালামে ঢাকাবাসীও স্পন্দিত হ’ল। হালে পানি পেলেন না জিন্নাহ সাহেব। তাকে গলা পানিতে নেমে অনেক ঘাটের জল খেতে হ’ল।জিন্নার হাতের পাচ একে ফজলুল হক এডভোকেট জেনারেল এর চাকুরি পেয়েই যেন বরতে গেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে গড়ে তুললেন তার বলয়। ডাকসু ভিপি ফরিদ আহমদ , জিএস গোলাম আযম , সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি আব্দুর রহমান চৌধুরী ও মুসলিম ব্রাদারহডের ছাত্র ফ্রন্ট এবং শাহ আজিুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুসলিম ছাত্র লীগ তাঁর দ্বিতীয় পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামলেন। ‘বাংলা ভাষা মরবে না। প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা নিয়ে বহাল থাকবে সরকারি দফতরে’।কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে কঠোর অবস্থান নিলেন্ । এবার তাকে লম্বা মেয়াদে কারারুদ্ধ করা হ’ল।এদিকে জিন্নার নেক নজরে আসার জন্যে সোহরাওয়ার্দী সাহেবও উর্দু রাষ্ট্রভাষা সমর্থন করে করাচীতে বিবৃতি দিলেন। তাতেও বাংলা রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল। ১১ সেপ্টেম্বার ৪৮ জিন্নাহ বিদায় নিলেন ধরাধাম থেকে। ‘৪৯ সালে আওয়ামি মুসলিম লীগের আবির্ভাব ঘটায় আন্দোলনকারী শক্তি বুকে বল পেলো। মুসলিম লীগ সরকার ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙা বাধিয়ে দিয়ে আন্দোলন দমনে আরও নির্মম হ’ল।জল্লাদের বেশে মাঠে নামলেন চট্রগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরি, খুলনার খান এ সবুর, কুষ্টিয়ার শাহ আজিজুর রহমান। ঢাকা বরিশালের পুরণো কসাইরাতো সক্রিয় ছিলই। ঢাকায় ৫০ এর দাঙ্গার নির্মমতা ১০ বছর বয়সে আমি নিজ চোখে দেখেছি। ৪৬ এর দাঙ্গার সময় কলকাতায় ছিলাম। সেই হিংস্রতায় ৬ বছর বয়সে আমি যারপরনাই আতঙ্কিত হয়েছিলাম। দুটোতেই দৃশ্যমান ছিল একই রকম দানবীয় উন্মত্ত্বতা।যা এখনও আমার রাতের দুঃস্বপ্ন। ৫০ এর দমন পীড়ন ছিল ঘুমন্ত জনপদে বন্যহাতির আগ্রাসনের মত বর্বর ও নির্দয় । অত্যাচারের সেই স্টিম রোলারে পিষ্ট হয়ে ভাষা আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে পড়লো। শেখ মুজিবুর রহমান যাতে তৃণমূলে ও মাঠপরযায়ে সক্রিয় হয়ে আন্দোলনকে আবার জাগিয়ে তুলতে না পারেন সে জন্য বার বার তাকে কারাগারে আটক করা হ’ল। ফজলুলহক সাহেব সরকারের সাথে হাত মিলালেন নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার আশায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব কেন উর্দু রাষ্ট্রভাষা সমর্থন করলেন জানিনা্ । তবে তারও লক্ষ্য ছিল নির্বাচন। সবাই আশা করছিল যে মুসলিম লীগ তার পাপের ভারেই ডুবে যাবে । শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫০ ও ১৯৫১ সালের পুরো ২৪ মাস জেলে আটক থাকলেন। নবগঠিত আওয়ামি মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দীভক্ত নেতারা আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নির্বাচনমুখী হলেন্ । নির্বাচনে জিততে পারলেই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্বাসন শেষ হবে। এই তাদের আশা ।নতুন দলে এডভোকেট সালাম খান ও আলী আমজাদ খানের মত রক্ষণশীল লোক ছিলেন্। সহ সভাপতি আতাউর রহমান খান , সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক , যুগ্ম সাদারণ সম্পাদক খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও রফিকুল ইসলাম এবং মশিউর রহমান , শেখ আব্দুল আজীজ , আব্দুল জব্বার খদ্দরের মত প্রভাবশালী মধ্যপন্থীরাও ছিলেন। এরা কেউই রাজপথের আন্দোলনের লোক ছিলেননা্। সাংগঠনিক সম্পাদক ওলি আহাদ ছিলেন একটু বাম ঘেঁষা্ । পুরো বামপন্থী ছিলেন সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ তোহা, অধ্যাপক মোজাফফফর আহমদ, আব্দুল হক , আব্দুস সামাদ আজাদপ্রমুখ। আওয়ামি লীগের মধ্যে ডানবামের দ্বন্দ্ব তখন থেকেই ঘুষঘুষে জ্বরের মত সার্বক্ষণিক বিড়াম্বনা হয়ে বিরাজমান ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয় অবস্থানে আসার আগে পর্যন্ত মওলানা ভাসানী ভারসাম্য রাখতেই হিমশিম খেয়েছেন। ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানই উদগ্রীব ছিলেন । নবগঠিত ছাত্রলীগও তখন প্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারেনি। ১৬ অক্টোবর ৫১ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আতোতায়ীর গুলিতে নিহত হলেন। খাজা নাজিমুদ্দীন নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন্ । নুরুল আমীন হলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। তিনিও ভাষা আন্দোলনকে মেরে ফেলার জন্যে নতুন নির্বাচনের হাতছানি দেওয়া শুরু করলেন। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর কাছে ভাষা আন্দোলন ছিল রাষ্ট্রের অখন্ডতা ও সংহতি বিনাশের মত একটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। এমতাবস্থায় বরফের আচ্ছাদন সরিয়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বিস্ময়করভাবে আবার টগবগে হয়ে উঠলো। এই অসাধ্য সাধন হ’ল আওয়ামি মুসলিম লীগের বামপন্থী অংশ এবং তৎকালীন যুবলীগের নেতা ইমাদুল্লাহ ও মোহামম্মদ সুলতানের অক্লান্ত পরিশ্রমে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে অনলধারা বইয়ে দিলেন ভাষা সংগ্রামের ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটক ইমাদুল্লাহ , মোহাম্মদ সুলতান ,গাজীউল হক, এম আর অখতার মিুকুল , হাসান হাফিজুর রহমান ,হাবিবুর রহমান শেলী , কেজি মুস্তফা প্রমুখ জেদী ও সংগ্রামী মানুষগুলো। আওয়ামি লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবায়ক প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেন ১৪৪ ধারা ভাঙার । কিন্তু বাঙালির ভাষা বিপ্লবের রূপকার কারারুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী অবস্থায় আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে সংগ্রামী ছাত্রনেতাদের উদ্দীপ্ত করলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, কেলিফরণিয়া
লেখক: কলাম লেখক ও সাংবাদিক