খোরশেদ আলম বিপ্লব
ভাষা যেকোনো সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ।এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা শ্রেণীর পার্থক্যকেও ছাড়িয়ে যায়।জন্মের পর একটি মানুষের নিজের বা নিজেকে প্রকাশ করার জন্য এটি প্রথম ‘মাধ্যম’।জাতীয়তাবাদ বা জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তি নির্ধারণে ভাষা প্রভাবশালী বৈশিষ্ট্য,কারণ এটি একটি জাতির পরিচয় উপস্থাপন করে। মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা একজন ব্যক্তির জীবনকে চিত্রিত করার জন্য প্রয়োজনীয়।একজন ব্যক্তির সমস্ত উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম।জীবনে যথাযথ পরিচয় ব্যতীত একজন ব্যক্তি ডানা বিহীন পাখির মত।মাতৃভাষার ডানাগুলি বহমান বাতাসের মতো।এটি সেই মাধ্যম যার দ্বারা স্বীয় প্রকাশটি তার সর্বোচ্চ আকারে ঘটে।ভাষা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বা জাতি গোষ্ঠী, শক্তি এবং সংস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।মাতৃভাষা জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা এবং এর বিশেষ সামাজিক রাজনৈতিক তাৎপর্যের কারণে মাতৃভাষার অধিকার বিষয়ক দাবি সার্বজনীন হয়ে থাকে। পূর্ববঙ্গে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবি ও একই ধরনের ।আর সে কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়ে যায় ছাত্রদের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে।মুসলিম লীগ সরকারের জন্য এই ঘটনা ছিল অনভিপ্রেত ও বিস্ময়কর।
বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন প্রথম গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন।এ আন্দোলনের তাত্ত্বিক সূচনা বিভাগপূর্ব কাল থেকে। এর সাংগঠনিক প্রকাশ পায় ১৯৪৮ সালের ১১ ই মার্চ, ১৯৫০ এ কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাবিত মূলনীতির বিরুদ্ধে এবং অবশেষে ১৯৫২ র ফেব্রুয়ারীতে বিস্ফোরিত ছাত্র-যুব আন্দোলনে।এ আন্দোলনের ব্যাপ্তি শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত গোটা পূর্ববঙ্গে। যার পেছনে ছিল কৃষক শ্রমিক এবং জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে মতবিরোধ শুরু হয় ১৯৪৭ সালের পূর্ব থেকেই।১৮, মে ১৯৪৭ সালে মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন এর উদ্যোগে হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত “উর্দূ সম্মেলনে” উত্তর প্রদেশের মুসলিম লীগ নেতারা ঘোষণা করেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দূ।১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট “তমদ্দুন মজলিস” ভাষা-আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে। তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম সদস্য ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ( ১৯৭১ সালের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) । অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাশেমের তিনটি প্রবন্ধ নিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু শীর্ষক একটি পুস্তিকা বের করে এই পুস্তিকায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আহ্বান জানানো হয়।এ সময়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমূখ জোরালো দাবি নিয়ে সুনিশ্চিত প্রবন্ধ রচনা করেন।
২৫ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে গণপরিষদের অধিবেশন বসে।এই অধিবেশনে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর সাথে বাংলাকে ও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় তা অগ্রাহ্য হয়ে যায়।১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য এক সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।এই সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন শামসুল হক।গণপরিষদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকা শহরে ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করে । যার ফলশ্রুতিতে তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকার শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ সহ অনেক ছাত্রনেতা ও বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার করে।
পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পূর্ববাংলা সফরে আসেন এবং ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় তিনি বলেন যে, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু অপর কোন ভাষা নয়।উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।” পরবর্তীতে ২৬ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশন এবং পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন যে,” উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষণার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়।আলোচনায় স্থির হয় যে একুশে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে। নুরুল আমিনের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেন, এবং সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করেন।১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ছোট ছোট আকারে শোভাযাত্রা সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো কলা ভবন প্রাঙ্গণে মিলিত হয়।বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের আম তলায় যে ঐতিহাসিক সভা শুরু হয় সেখানে ছাত্র নেতা আব্দুল মতিনের প্রস্তাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাইরে সশস্ত্র পুলিশ পাহারা ভেদ করে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্রছাত্রীরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলতে থাকে, মুখে ছিল তাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান। পুলিশি বেষ্টনি ভেদ করে ছাত্রদের দশজনের খণ্ড মিছিল পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।শান্তিপূর্ণ এই মিছিলটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এলে পুলিশ ও ই পি আর নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ মিছিলে লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ এবং গুলি চালায়।তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের গুলিতে নিহত হন এমএ ক্লাসের ছাত্র বরকত,তেজোদীপ্ত তরুণ সালাম ও আবদুল জব্বার এবং বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেস এর মালিকের ছেলে রফিক।২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠে।২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারন জনতা শোভাযাত্রা সহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে।২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন শফিউর রহমান, রিকশাচালক আউয়াল এবং নাম না জানা এক কিশোর। পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদ সদস্য মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এবং আজাদ পত্রিকার সম্পাদক ও ব্যবস্থাপক পরিষদ সদস্য আবুল কালাম শামসুদ্দীন এই নির্লজ্জ পাশবিক পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ভাষা আন্দোলনে প্রেরনা যোগায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের স্লোগান “শহীদ স্মৃতি অমর হোক”।কে এই স্লোগান এর পরামর্শক, কার মুখে এটি প্রথম উচ্চারিত হয় ,আমরা জানি না কারণ এই তথ্য সংরক্ষিত হয়নি। ঢাকায় প্রথম শহীদ মিনার অর্থাৎ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কৃতিত্ব এককভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের রাজনীতিমনস্ক ছাত্রদের যা দলমত নির্বিশেষে হয়।২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ মেডিকেল ছাত্রদের নেতৃত্বে এক আলোচনায় একজনের মুখে হঠাৎ প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হয় শহীদ বরকতের রক্তে ভেজা স্থানটিতে মেডিকেল ছাত্র বদরুল আলমের নকশা মাফিক শহীদ মিনার নির্মাণের কিন্তু কে শহীদ স্মৃতি রক্ষার প্রস্তাবক তা কোনোদিনও জানা যাবে না। কেউ সেই ছাত্রবন্ধুটিকে শনাক্ত করে রাখেনি,তাই নির্বাকই রয়ে যাবে।ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য সেখানে ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা ।২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন আজাদ পত্রিকা সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। শহীদ মিনার হয়ে ওঠে বাঙালির তীর্থকেন্দ্র ।প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ সরকার ওইদিনই বিকালে শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলেছিলো কিন্তু বাঙালির হৃদয়ে যে স্মৃতির মিনার গাঁথা হয়েছিল তা মুছে যায়নি। রাঙা হৃদয়ের বর্ণমালায় তা আজও সমুজ্জ্বল রয়েছে।
১৯৫২ সালের মহান একুশের রক্ত দানের ফলে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশিত হয় সেই চেতনা থেকে একুশের প্রতীক ২১ দফা প্রণয়ন করে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাঙালি নেতৃবৃন্দ।১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাংলার মাটিতে খাজা নাজিমুদ্দিন ও নুরুল আমীনের মুসলিম লীগের কবর রচিত হয়।অতঃপর নুরুল আমীনের বাসভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি।বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অর্জিত একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হয় এবং শহীদ মিনার নির্মিত হয় অবশেষে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এখন বাংলাদেশে ভাষার মাস চলছে।কিন্তু চারদিকে মহাসমারোহে চলছে ফাগুন এর আয়োজন। শিক্ষাঙ্গন,মিডিয়া, টেলিভিশন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এ যেন ব্যস্ততার মাস, এতে আমাদের জাতীয় হীনমন্যতার পরিচয় ও মেলে।এ মাসে বাড়তি আকর্ষণ শুধু বাংলা একাডেমী ও বই প্রকাশকদের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত একুশে বইমেলা।
একুশে শুধু সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না,এর অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল যথেষ্ট।একুশ আমাদের সংস্কৃতি চর্চা কে রাজনৈতিক,গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ধারায় চলতে উদ্দীপ্ত করেছিল।১৯৫২ র আন্দোলন যা মহান একুশে নামে পরিচিত তা জাতীয় জীবনে গভীর প্রভাব ও ভূমিকা রেখেছিল।বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্মেলন গুলো তার প্রমাণ।একুশের চেতনার প্রভাবে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ধারণ করেছে আদর্শিক নান্দনিকতা।সে তুলনায় রাজনীতিতে একুশের প্রভাব চড়াই-উৎরাই পার করে ইতি ও নেতিতে পরিপুষ্ট।তবুও সবাইকে মানতে হবে যে, একুশের প্রভাব ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ যা শেষ পর্যন্ত ৬৯ এর গণ জাগরণ ও একাত্তরের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। সঙ্গত কারণেই বলা যায় অমর একুশে মানে” মাটি ও শিকড়-ঘেঁষা গণতান্ত্রিক চেতনা”।
খোরশেদ আলম বিপ্লব।
লেখক ও সাহিত্যিক
ঢাকা বাংলাদেশ
১২, ফেব্রুয়ারি ২০২১
তথ্যসূত্র:
– বাংলাদেশ স্টাডিজ
– বিচিত্র একুশে বিচিত্র তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।