মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি- (১ম খণ্ড)

কলাম

0
1452

আমেরিকা থেকে

শামসুল আরেফিন খান

একসময় নিজেকে খুব অসহায় ভাবতে শুরু করেছিলাম।ষাট সালের এপ্রিলে বয়স ২০ বছর শেষ হয়েছে। মে মাসে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। টায়টোয় বিএটা কোনরকম পাশ করেছি।আইয়ুবের সামরিক শাসনের খড়্গ ছিল মাথার ওপর।টেষ্ট পরীক্ষা দিতে পারিনি। তবুও সেন্ট আপ হলাম ঢাকা কলেজ থেকেই। ইউনিয়নের ভি-পি বলে কথা।হুলিয়া মাথায় নিয়ে জগন্নাথ কলেজ সেন্টারে পরীক্ষা দিলাম। গেরিলা কায়দায়।সে সব লম্বা গল্পে যাব না।কপাল ভালো যে আইয়ুব সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লে. জে. কে এম শেখ ঢাকায় এসে সামরিক আইনে সাজা পাওয়া কেসগুলো রিভিউ করে ক্রিমিনাল অফেন্স নেই এমন সবাইকে রেহাই দিলেন। তবে কালাকানুনে সবাই ফেঁসে থাকলো।লেখাপড়া চাকররিবাকরি সোনার হরিণ হয়ে গেলো।সরকারের কাছে নাক খত না দিলে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হবে।আব্বা বললেন, আমার তো চাকরি শেষ হয়ে আসলো।তোর জন্যে আমার ডিপার্টমেন্টে ইউডি পোস্টে একটা চাকরি ঠিক করেছি।মাথার থেকে সব বাজে চিন্তা বাদ দে।আমার অপিসের চাকরিতে শুধু খাতা সইকরে অনেকে 
ইউনিভারসিটির লেখাপড়া শেষ করেছে। আমার বড়ভাইর এক বন্ধুর উদাহরণ টেনে বললেন সে এমকম এলএলবি পাশকরে এখন বড় একটা চাকরি করছে। সেই ভাবে এমএ-ল টা পাশ করে ওকালতি করে সুখে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবি। এজি বি অপিসের দৃষ্টান্ত টেনে বললেন, সেখানে শুধু দশটা পাঁচটা চেয়ারে কোট ঝুলিয়ে কত লোক উচ্চ শিক্ষা শেষ করেছে। 
কত লোকে এভাবে লেখাপড়া করে মন্ত্রি মিনিস্টার হয়েছে। সে দরজা তো খোলাই থাকবে। বুকে অনেক কষ্ট নিয়ে সততায় সাক্ষাত যুধিষ্ঠির আমার আব্বা আমাকে সততার দেয়াল টপকে গলিপথে হেটে বড় রাস্তায় ওঠার পথ দেখালেন। 
 অনেক ভেবে চিন্তে বিজ্ঞাপন পড়ে বিসিক এবং ওয়াপদায় আ-ইও পোস্টে দরখাস্ত করলাম।এক বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থাকা চাই।তারও একটা সুরাহা হ’ল। ড. শহীদুল্লাহ সাহেবের ৮ ছেলের একজন কমরেড তকিউল্লাহ ৯ বছর পর ১৯৫৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। ‘৫৫ সালে ঢাকা জেল হাসপাতালে আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। মামাভাগনে সম্পর্কটা তখন থেকেই। তবে সেটা একেবারেই পাতানো সম্পর্ক না।

আমার আব্বা আসলেই তাঁর দুলাভাই। আব্বার দ্বিতীয় তরফের ফুফাতো শালা।সেদিক থেকে সম্পর্কটা বেশ মজবুত।ওঁদের বেগম বাজারের পেয়ারা হাউজে ছোটবেলা থেকেই 
আমার যাতায়াত ছিল।আপন না। সৎ সম্পর্ক । তবুও নানা নানী দুজনেই খুব আদর করতেন।জেল ফেরত হওয়ায় ব্যাপারটা একটু ঘনো হয়েছিল।প্রথম দিকে অতিথি সেবায় মুড়িমুড়কি এবং কদাচিৎ রসগোল্লা জুটতো। জেলফেরত হওয়ার পর থেকে দই সন্দেশ নিশ্চিত হয়েছিল।চক বাজারের বড় মিষ্টির দোকানগুলো ছিল বাড়ির আসপাশেই। ওই বাড়িতে লাল ঝান্ডার আবার একটা প্রচন্ড প্রতাপ ছিল।বাড়ির এক ছেলে ৪৮ সাল থেকে রাজবন্দী। অন্য আর একজন মস্ত আঁকিয়ে মূর্তজা বশির। ৫২ সালে আমার গুরু মোহাম্মদ সুলতান প্রকাশ করেছিলেন অমর সংকলন “একুশে ফেব্রুয়ারি”। সম্পাদনা করেছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান। আর রেখাচিত্র একেছিলেন তাতে শিল্পি মূর্তজা বশির।তাতেই তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ঘটেছিল। জ্ঞানতাপস ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সেই ‘৪৮ সালে শুধু বলেছিলেন , “আমরা বাংলায় কথা বলি। আমরা আগে বাঙালি । পরে হিন্দু মুসলমান” । বাংলা ভাষার এতবড় পন্ডিত।তায় আবার কোরাণ তফসির করা একজন মস্ত আলেম। তাঁর এই এক কথায় মুসলিম লীগ সরকারের মুখে আমড়া ঢুকে গিয়েছিল।

আব্বা বললেন তুই বরং তোর ঐ কম্যুনিস্ট মামার কাছে যা। নিশ্চই একটা উপায় হয়ে যাবে।টুকটাক কাজ তো করেছিস।কথাটা তো একেবারে মিথ্যে না। জেলখানায় দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক হওয়াতো যেমন তেমন কথা না তাছাড়া জেল হাসপাতালে যাওয়া যে কারণ তার সাথেও আমার সেই বিখ্যাত দেয়াল পত্রিকার একটা সম্পর্ক ছিল। সেটাও দেখলাম মনে রেখেছেন।

নগন্য হলেও সে গল্পে জিরা মরিচের সুবাস ছিল।যাকে বলে স্পাইসি। সে কথা কমরেড তকিউল্লাহ জেনেছিলেন।কমরেড মামা আমাকে সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরির কাছে নিয়ে গেলেন। জহুরভাই ঠোটকাটা মানুষ। রাখঢাক না করেই বললেন, জেলখানার ওসব ‘ঠুসঠাস’ দেয়াল পত্রিকার 
কানাকড়ি কোন মূল্য নেই চাকরির বাজারে। অন্য কিছু ? কোন ছাপানো কাগজে লেখালিখি? সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা মানে তো কাগজের সাথে কাজ করা। আমি বললাম , জি না। তবে কলেজে থাকতে ইস্ট পাকিস্তান ইন্টার কলেজ কালচারাল কমপিটিশনে “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও দায়িত্ব কর্তব্য” বিষয়ে বিক্তৃতা দিয়ে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিলাম । তার সার্টিফিকেট আছে।ফাইল থেকে সেটা বের করতেই জহুরভাই আবারও নিজস্ব ভঙ্গিতে ঠেস দিয়ে বললেন, ও সব চোথা দেখিয়ে কোন কাজ হবে না। এরমধ্যে কাকতালিয় ভাবে জেলখানায় দেখা পাওয়া আমার আর এক শুভাকাঙ্খী সিনিয়ার সাংবাদিক ভাষা সৈনিক শ্রী রণেশ দাশ গুপ্ত এসে পৌছালেন। তিনি তখন বামপন্থী দৈনিক সংবাদ এর সম্পাদকীয় বিভাগের ১৬ আনা ভার সামলাতেন । সম্পাদক জহুর হোসেন ছিলেনওজনদার স্বাক্ষী গোপাল। ধারে না কাটলেও এবার ভারে কাটলো। জহুর ভাই চাপে পড়ে গাঁইগুই করে অবশেষে ঢেকি গিললেন। একটা ফাড়া কাটলো।
ওয়াপদার চাকরিটাতেই ইন্টারভিউতে টিকে গেলাম। সেটাও বোধ হয় মামার জোরেই।বিসিক( ক্ষুদ্র শিল্প কর্পোরেশন) এও টিকলাম। কিন্তু পুলিশ রিপোর্টে সবটারই বারোটা বেজে গেলো আধা সরকারি চাকরিই যখন হ’ল না, তখন সরকারিটাও যে হবে না সেটা আর বুঝতেতো কারও বাকি রইলো না। গরীব বাপকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার শেষ আশাটাও এবার গেলো। বেশএকটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। আব্বা রিটায়ের করলে মাথা গোজার বাসাটাও থাকবে না। তখন থাকবো কোথায় ?

অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।আমার কপালটাও যেন তেমনি উষরে ভরা । হয়ে যাওয়া চাকরি। একটা নয় দুটো। তাও হ’ল না। পুলিশ রিপোর্ট আমার পাকাধানে মই দিয়ে সব কেচিয়ে দিলো। কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিঙের গোরা সাহেবদের অপিসের বড়বাবু আমার আব্বা হামিদ খান সাহেবঅবসর নেয়ার আগে কারণীক থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকারিক হয়েছেন । এবার তিনি মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে লাগলেন আমাকে দিয়ে বন্ড সই করিয়ে সরকারি চাকরির খোয়াড়ে আটকাবার জন্যে।পারলে একটা বিয়ে করিয়ে দিয়ে ছাপোষা বানিয়ে ফেলেন। তাঁর ভক্ত বস পিডাব্লিউডির চীফ ইন্জিনিয়ার আফসার উদ্দীন সাহেব ও সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জহুরুল হক সাহেব হুকোয় বাতাস দিচ্ছিলেন।
আমার মনে পড়লো সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরির শিক্ষিকা পত্নীর আজিমপুর এস্টেটের বাসায় বসে ড. শহীদুল্লাহ সাহেবের কমরেড ছেলে তকিউল্লাহ , সাংবাদিক রণেশ দাশ গুপ্ত ও আমি কথা বলছিলাম। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বলেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। “আমি তো সারাদিনই সংবাদ অপিসে থাকি। পারলে একবার আমার সঙ্গে দেখা কোরো”। আমার কমরেড মামা তকিউল্লাহ সাহেবও মাথা নেড়ে তাতে সায় দিয়েছিলেন।তবে তাঁদের সেই মৌন সহমতে চিকন বুদ্ধি বা আকালমন্দের জন্যে যে সুপ্ত ইশারা ছিল মোটা মাথায় আমি সেটা বুঝিনি।সে কথা অকপটে স্বীকার না করে উপায় নেই।

ভাষা সৈনিক রণেশ দাশগুপ্ত ১১ মার্চ ১৯৪৮ সাধারণ ধর্মঘট সফল করতে তোপখানা রোডের সচিবালয় গেটে পিকেটিং করার সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন । একই সময় ভাষা সংগ্রামের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও পথিকৃতের ভূমিকা রেখে গ্রেফতার হয়েছিলেন ।রণেশ গুপ্ত ছিলেন বামপন্থী সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের প্রভাবশালী নেতা।মোহাম্মদ তোহা,শহীদুল্লাহ কায়সার অলি আহাদ, মোহাম্মদ ইমাদুল্লা, আব্দুস সামাদ আজাদ, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, শিল্পি কামরুল হাসান ও কাইয়ুম চৌধুরি প্রমুখ সমদর্শীদের নিয়ে তিনি ভাষা সংগ্রাম উৎক্ষেপনের লক্ষ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সোহরাওয়ার্দীপন্থী ছাত্রলীগের পাশে দাড়িয়েছিলেন।একই স্রোতধারা থেকে এসেছিলেন উত্তরকালে শেখ মুজিবের দুর্দিনের সাথী তাজুদ্দিন আহমদ সাহেবও।

সে সময় সরকার সমর্থক বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কুষ্টিয়ার শাহ আজিজুর রহমান। তার ঘনিষ্ঠ সহচর চট্রগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরি ও খুলনার খান এ সবুর ছিলেন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা এবং নাজিমুদ্দিন সরকারের লাঠিয়াল। তারাই শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পূর্ব পাকিস্তানে থাকতে দেননি।সেই সাথে তারা উটপাখির মত বালুর ঢিবিতে মাথা ঢুকিয়ে রেখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার ঝড় রুখে দেয়ার চেষ্টায় গলদঘর্ম হয়েছিলেন। চলতি মৌসুমের ডাকসু ভিপি মৌলভি ফরিদ আহমদ ও জিএস, উত্তরকালের জামাতে ইসলামের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম এবং এস এম হলের ভিপি উত্তরকালে হাইকোর্টের বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরি ছিলেন তাদের গোপন সাঙ্গাত। পরবর্তীকালে মৌলবি ফরিদ আহমদ আইয়ুবের এমএনএ হয়েছিলেন। একাত্তরে একজন শীর্ষ রাজাকার।কক্সবাজারের বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ‘অতি বাড় ’ বাড়তে দেখে জান্নাতবাসী করেছিল সঠিক পন্থায়।

জিন্নার গোপন ইচ্ছায় ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ঢাকার নবাবদের উত্তরসূরি ব্রিটিশের তাবেদার স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন। জিন্নার কূট ইশারায় তিনি সাহরাওয়ার্দী সাহেবের পূর্ব পাকিস্তানে আসার উপর ‘টাবু’ দিয়েছিলেন। ৪৮ সালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাঁকে কলকাতায় ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।(অসমাপ্ত আত্মজীবনী , পৃ-১০৮ দ্র:) ; “গণপরিষদে একটা নতুন আইন পাশ করে শহীদ সাহেবকে গণপরিষদ থেকে বের করে দেওয়া হ’ল।(অসমাপ্ত আত্মজীবনী ,পৃ:১০৯ দ্র)।
দূরদর্শী নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব ধৈ্র্য ধারণ করলেন।কোনরকম ধস্তাধস্তিতে গেলেন না।

দেশভাগের আগে তিনি অখন্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।তার আগে ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার সদস্য। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় রিলিফ মন্ত্রী।তখনই সাধারণ মানুষের সেবায় প্রাণপাত করে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।উত্তরোত্তর সেটা ফুলে ফেপে উঠেছিল। তাতেই মজে গিয়ে জিন্না সাহেব তাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানাবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ২৩ মার্চ, ১৯৪০ বিতর্কিত লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে জিন্নাহ সাহেবকে টেনশনে রেখেছিলেন। হক সাহেব ইংরেজি ব্যাকারণের একবচন ও বহুবচনের গোলকধাঁধায় আটকে ফেলেছিলেন সমকালীন ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। ভাবি পাকিস্তান রাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামোতে একবচনে একটি মাত্র ‘স্টেট’ থাকবে না বহুবচনে ‘স্টেটস‘ হবে?হক সাহেবও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। তাঁর সে খায়েশ যদি জিন্না সাহেব পূরণ করতে রাজি হতেন তাহলে হক সাহেব নিজেই হয়ত ‘স্টেটস’ শব্দ থেকে ‘এস’(s) অক্ষরটা মুছে ফেলতেন টাইপ মিসটেক হয়েছে বলে। কিন্তু সে কাজটা জিন্নাহ সাহেব নিজেই করেছিলৈন হক সাহবকে পাশকাটিয়ে । 
মরার আগে দৈনিক সংবাদকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে হক সাহেব কায়েতটুলির বাসার চিলে কোঠায় শুয়ে চৌকির উপর একটা চাপড় মেরে দাবি করেছিলেন , “ মুই স্টেট লেখিনাই। ‘এস্টেটস’ লেখছেলাম। জিন্নাহ সাহেব ‘এস’ অক্ষর মুইছা ফেলাইয়া বেঙ্গল এবং পাঞ্জাবের গলায় ছুরি চালাইছেলেন। পাকিস্তানের ফেডারেল কাঠামোতে বাংলা ও পাঞ্জাবকে স্বাধীন রাষ্ট্র হইতে দেলেননা”।

২৭ এপ্রিল ১৯৬২ হক সাহেব মৃত্যু বরণ করেন। ২৬ অক্টোবর ১৯৬১ ছিল তাঁর ৮৮তম জন্মদিন। দৈনিক সংবাদের জন্যে ২৫ অক্টোবর, ১৯৬১ বিকেলে হক সাহেবের জীবনের সেই শেষ সাংবাদিক সাক্ষাতকারটি নিয়েছিলাম আমি নিজে । তখন আমি সংবাদের স্টাফ রিপোরটার । সেটা আমার এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট হয়েছিল।তাতেই সম্ভবতঃ আমি ইত্তেফাকের প্রাণপুরুষ সিরাজউদ্দিন হোসেনের নজরে পড়েছিলাম।তার হাতে গড়া সেকালের সেরা কাগজ ইত্তেফাক বোধহয় সেইদিনই প্রথম বামপন্থী সহযোগী সংবাদ এর কাছে একটা গুরুত্বপূর্ন নিউজে মার খেয়েছিল।তাঁর বড় বড় রিপোরটারদের তিনি বেশ কশেই ঝাড়ি দিয়েছিলেন । হক সাহেবের দেশের লোক ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক বদরাগি মানিক মিয়াও রিপোর্টারদের উপর মহা ক্ষেপেছিলেন। প্রেসক্লাবে বড় বড় সাংবাদিকরা আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে ছাড়েননি।

১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের দিল্লী সম্মেলনে জিন্নাহ সাহেব সেই গোলমেলে লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০) নিখুত করে কেটে ছেটে নতুন বোতলে পুরে “পাকিস্তান প্রস্তাব”(১৯৪৬) উত্থাপন করালেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে।১৯৪৬ সালে মুসলমান আইন প্রণয়নকারীদের দিল্লী সম্মেলনে যে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হয় তাতে নিম্নোক্ত মূলনীতিটি অন্তর্ভুক্ত ছিল:

“ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলা ও আসাম সমবায়ে এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্থান সমবায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নিয়ে যে অঞ্চলসমূহ গঠিত, সে অঞ্চলসমূহকে নিয়ে *** একটি সার্বভৌম স্বাধীন ‘রাষ্ট্র’ ***গঠন করা হোক এবং কোন রকম বিলম্ব ছাড়াই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার প্রদান করা হোক”। 
শহীদ সাহেবের অখন্ড স্বাধীন বাংলা অর্জনের স্বপ্নে বরফজল ঢেলে দিতে ধূর্ত জিন্না ওয়াদা করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানাবেন।তিনি নিজেও তখন গান্ধীর হাতের তালু চেটে স্বাধীন অখন্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটনও তাঁকে মুলো দিয়ে রেখেছিলেন। বাগড়া দিচ্ছিলেন তখনকার অন্তর্বর্তীকালীন ভারত সরকারেরর অর্থমন্ত্রী মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খান। গান্ধীর খায়েশ ছিল সারা ভারতবর্ষের সকল জাতিধর্মের মানুষ করজোড়ে অনুরোধ জানালে তিনি অখন্ড স্বাধীন ভারতের রাষ্টপতির আসন অলঙ্কৃত করবেন। সেই লক্ষ্যে তিনি কংগ্রেস ভেঙে দিয়ে সবদলকে মিলিয়ে একটি নতুন জাতীয় দল গঠন করতে বলেছিলেন।কিন্তু তার কথা কেউ শোনেনি। 
গান্ধী ও জিন্নাহ দুজনেই মার্কিণ পৃষ্ঠপোষকতার আগাম আশ্বাস পেয়েছিলেন। রুশ ঘেঁষা পন্ডিত নেহেরুকে নেতাজীর অন্তর্ধানের ইসূতে চাপে ফেলা হয়েছিল।পন্ডিত নেহেরু লর্ড মাউনট ব্যাটেনকে গভর্ণর জেনারেল মেনে গোপনে মার্কিন আশীর্বাদ নিয়ে পাল্টা চালে গান্ধী জিন্নাহ দুজনকেই কুপোকাত করলেন। 
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পাঞ্জাব লবির লিয়াকত আলী খান, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান , আব্দুর রব নিশতার, গুরমানী প্রমুখ রাঘব বোয়াল লাহোর প্রস্তাব ইস্যূতে জিন্নাহ সাহেবকে চাপের মধ্যে রেখেছিলেন। নিজের স্বার্থে সেই চাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্যেই বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সর্বোচ্চ মূল্য ধার্য করে ব্যবহার করেছিলেন জিন্নাহ সাহেব। ।কিন্তু উত্তরকালে লিয়াকত আলী খানের সাথে সমঝোতায় এসে তিনি ওয়াদা খেলাপ করলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দূরের কথা সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীও হতে দিলেন না।

দূরদর্শী নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব ধৈর‌্য হারালেননা। তিনিও নাজিমুদ্দিনকে সুযাগ দিতে চাইলেন। তাছাড়া কলকাতার দাঙ্গাপীড়িত হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনাটাও দরকার ছিল। তিনি গান্ধীর পাশে দাড়াবার জন্যে কলকাতায় গান্ধী আশ্রমে থেকে গেলেন।পূর্ব বঙ্গ আইনপরিষদে সোহরাওয়ার্দীভক্ত এম.এল.এ ‍বৃন্দের নেতা হিসাবে সক্রিয় ছিলেন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তুখোড় বাগ্মী আবুল হাশিম।বিশিষ্ঠ বামপন্থী তাত্বিক বদরুদ্দিন ওমরের পিতা।নারায়নগঞ্জের সোহরাওয়ার্দীভক্ত মুসলিম লীগ নেতা হাজি ওসমান আলীর বেয়াই। মানে তাঁর বড়ছেলে ,উত্তরকালে আওয়ামি লীগের এমএনএ শামসুজ্জোহা সাহেবের শ্বশুর। আর একালের জবরদস্ত সাংসদ শামিম ওসমান এর নানা।

সোহরাওয়ার্দীভক্ত ছাত্রনেতা গোপালগঞ্জের শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ উপদলীয় নেতা ছিলেন।তিনি সংগঠন ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবেন বলে। মোগলটুলি অপিসে বসে ৭/৮জন সমদর্শী সঙ্গী সাথী নিয়ে পৃথক ছাত্র সংগঠন গড়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিলেন। সরকার সমর্থক সংগঠন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের নাম বদলিয়ে তখন “নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ” করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,“ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।তারা কেউ এই সংগঠনের সদস্য না।আমি ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম। আজিজ আহমদ , মোহাম্মদ তোয়াহা, ওলি আহাদ, আব্দুল জামিদ চৌধুরি , দবিরুল ইসলাম,নঈমউদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন,আব্দুর রহমান চৌধুরি, আব্দুল মতিন চৌধুরি .সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেক ছাত্রনেতা একমত হলেন আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান করা দরকার। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেমবিলি হলে এক সভা ডাকা হ’ল, সেখানে স্থির হ’ল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। তার নাম হবে,পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নঈমউদ্দিনকে কনভেনার করা হ’ল”।নামের সঙ্গে মুসলিম থাকায় ওলি আহাদসহ অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পেয়ে সরে গেলেন । নবীন সেই মুসলিম ছাত্রলীগ সারা পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছিল ১১ মার্চ ১৯৪৮। সরকার বিরোধী সংগ্রাম বেগবান করতে প্রগতিশীল ছাত্রনেতা রণেশ দাসগুপ্ত সেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে শেখ মুজিবের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আত্মগোপনে থাকা বাম সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের অদৃশ্য সমস্ত শক্তি সাথে নিয়ে।কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মী মোহাম্মদ তকিউল্লাহ ছিলেন নিবিড়ভাবে তার পাশে।গোলাম আজম বিরোধী ইসলামী ঘরাণার তমুদ্দুন মজলিশ সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক অধ্যক্ষ আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তাদের দিকে ঐক্যের হাত বাড়িয়ে দিলো। তৈরি হ’ল দেশের প্রথম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি। সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন তখন দৈনিক আজাদে। তিনি সমদর্শী সাংবাদিকদের নিয়ে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সহপাঠী শেখ মুজিবের পাশে দাড়ালেন। কলমের শক্তি দিয়ে বিরূপ পরিবেশে তাঁকে আলোকিত রাখতে পাদপ্রদীপের তলে ধরে রাখার প্রয়াস পেলেন। সরকার ঘেঁষা দৈনিক আজাদ তখনও সর্বাধিক পঠিত সবচেয়ে প্রভাবশালী কাগজ ছিল।প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আক্রাম খান তার মালিক সম্পাদক। ইসলামকে ”এছলাম” না লিখে কেউ ইসলাম লিখলে তার চাকরি চলে যেত। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here