মাওলানা ইব্রাহিম খলিল মাহমুদী
কোরবানির হাকীকত বা তথ্য :- কোরবানী শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে কোরবানুন।কোরবান,বলা হয় এমন বস্তুকে যা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের মাধ্যম বা উছিলা হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক নেক আমল যা আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও রহমত অর্জন করে, সেটা জন্তু জবাই করার মাধ্যমে হোক বা দান সদকা দ্বারা হোক। কিন্তু সাধারণের মধ্যে কোরবান শব্দটি জবেহের জন্যই অধিক ব্যবহৃত হয়। এছাড়া পবিত্র কোরআন মাজিদে প্রায়ই এই শব্দ দ্বারা জন্তুর জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অর্জন কে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি হলো একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট ব্যক্তির জানোয়ার বা পশু জবাই করা। কোরবানি আমাদের জন্য নতুন কোন জিনিস নয়, দুনিয়ার আদিকাল থেকেই কোরবানির প্রচলন রয়েছে। এখনো সৃষ্টি জগতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যায়,এ ধরাপৃষ্টের প্রতিটি জীবনই একে অন্যের জন্য নিবেদিত প্রাণ। তরুলতা নিবেদিত জীবজন্তুর জন্য আর জীবজন্তু হচ্ছে মানুষের জন্য কোরবান। বিষয়টা আরও গভীর ভাবে দৃষ্টি পাত করলে স্পষ্টত প্রতিয়মান হয়ে উঠে যে, মানুষ ও সর্বদা একে অপরের জন্য কোরবান হচ্ছে। মা বাপ সন্তানের জন্য বিলীন করছে নিজেদের জীবন। নিম্ন স্তরের লোক করে উচ্চ স্তুরের জন্য উৎসর্গ করছে আপন সত্তা,রক্ত মাংস এবং তার মূল্যবান সময়। একজন সাধারণ সৈনিক থেকে নিয়ে কমান্ডার ইন চীফ পর্যন্ত সকলেই নিজেদের মাতৃভূমি ও বাদশাহর জন্য কোরবান হচ্ছে।মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলা। কেননা সৃষ্টি জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই ক্রমোন্নতির সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।আর মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত, সুতরাং মানুষের একান্ত কর্তব্য আধ্যাতিক উন্নতি তা সকল উন্নতির চেয়ে মহান তার প্রতি ধাবিত হওয়া। মহান আল্লাহ তায়ালার জাত পাক ও পবিত্র । মানুষের প্রকৃতিগত আকাংখা হলো মহান মালিকের নৈকট্য লাভ করে তার পবিত্র সত্তার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, যেমন সৃষ্টিজীবের প্রতিটি জিনিষই একে অপরের জন্য অস্তিত্ব মিটিয়ে দেয়। তৃনলতা জন্তুর জন্য কোরবানি হচ্ছে আর জন্তুগুলো মানুষের সেবা করে যাচ্ছে এবং গোশতের টুকরা হয়ে আমাদের শরীরের অংশ পরিনত হচ্ছে। প্রকৃতির আত্নোৎস্বর্গের এ নীতি আমাদের কে শিক্ষা প্রদান করছে যেন আমরা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করার জন্য মহান আল্লাহর মাঝে নিজেদের কে বিলীন করে দেই। কোরবানি তারই একটি জ্বলন্ত নিদর্শন। সুতরাং কোরবানির গভীর তত্ত্ব খুবই সূক্ষ। অতএব কোরবানি জন্তু যেমন আল্লাহর হুকুম পূর্ণাঙ্গরুপে মেনে নিয়ে আপন অস্তিত্ব কে ফানা করে মানুষের শরীরের টুকরা হচ্ছে, তেমন আমরা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অবনত মস্তকে তার পূর্ণ আনুগত্য করি। কবির ভাষায় : ইসমাইলের মত রেখে দাও শির তীক্ষ্ণ তরবারী তলে,তবে আনন্দ চিত্তে কোরবান কর দান আল্লাহর তরে। কোরবানির ইতিহাস :- ইতিহাস ও জীবনীমূলক কিতাবাদি থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীতে এমন কোন জাতি ছিলনা যারা স্বীয় ধর্মনুসারে কোরবানি করত না। কোরবানির এ ধারা হযরত আদম (আঃ)এর সন্তান হাবিল-কাবিলের মধ্যে বিবাহ নিয়ে দ্বন্ধ দেখা দিলে হযরত আদম আঃ তাদেরকে এখলাছের সঙ্গে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়ে বললেন, তোমাদের যার কোরবানি কবুল হবে তার সঙ্গে ই বিবাহ হবে। তখনকার যুগে কোরবানি কবুল হবার আলামত ছিল,যে কোরবানি টি কবুল হয় তাকে আসমান থেকে একটি আগুন এসে জ্বালিয়ে দিত। উক্ত ভ্রাতৃদ্বয় কোরবানির আদেশ প্রাপ্ত হয়ে দুটি দুম্বা কোরবানি করল আল্লাহ তায়ালা হাবিলের কোরবানীকে কবুল করলেন আর কাবিলের দুম্বাটি এ রুপই পড়ে রইল এতে সে অত্যধিক ক্রদ্ধ হয়ে হাবিল কে হত্যা করল।ইসলাম ধর্মে কোরবানি :- যদিও প্রাচীন কাল থেকেই হিন্দু, ইয়াহুদী ও নাসারাদের ধর্মে মিসর, ইউনান রোম প্রভৃতি দেশে কোরবানির প্রচলন ছিল কিন্তু ইসলাম ধর্মে কোরবানির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কোরবানি ইসলামে একটি অন্যতম ইবাদাত এবং নিদর্শন। এজন্যই ইসলাম ধর্মে কোরবানি শুধু রূছম বা প্রথা নয় বরং আল্লাহ তায়ালার জন্য একটি বিশেষ ইবাদাত। হযরত ইব্রাহীম আঃ এর মত উৎসাহ উদ্দীপনা এবং আবেগ ও মহব্বত নিয়ে আমাদের কে কোরবানি করতে হবে কেননা আল্লাহর দরবারে গোশত ও রক্তের প্রবাহ কিছুই পৌছেনা। শুধু পৌঁছে খালেছ নিয়ত এবং আনুগত্যের আবেগ ও জজবা।কোরবানির উদ্যেশ্য :- আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তার ইবাদত করার জন্য। তাই তার বিধানাবলী তার নির্দেশিত পথে পালন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা পক্ষ থেকে কোরবানির বিধান আমাদের উপর আসার বেশ কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে যথা :-
১| শর্তহীন আনুগত্য :- মানুষ হলো বান্দা আর আল্লাহ হলেন মাবুদ। তিনি তার বান্দাকে যে কোন আদেশ ও নিষেধ করতে পারেন, বান্দা হিসেবে তা অবশ্যই শর্তহীন ভাবে পালন করতে হবে যেমনটি করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম আঃ।
২| তাকওয়া অর্জন :- তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন। আর পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কোরবানি দাতা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করে।
৩|আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনা করা :- প্রত্যেক ইবাদাত আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমান বহন করে। তাই কোরবানির মাধ্যমে ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনা করা হয়।
৪| ত্যাগ করার মহান পরিক্ষা :- কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ত্যাগ করার মানসিকতা তৈরি করা। আল্লাহর বিধান পালনে জান মালের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কোরবানির ঈদকে গোশত খাওয়ার অনুষ্ঠানে পরিনত না করে বরং নিজেদের মধ্যকার পশু সুলভ আচরণ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নফসের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়াই কোরবানির উদ্দেশ্য। কোরবানির পশুর ধরন ও বয়স :- আট প্রকার পশু দ্বারা কোরবানি সর্বসম্মতিক্রমে জায়েজ তা হিসাবে ধরা হয়:- ভেড়া বা দুম্বা, ছাগল, গরু, উট, এগুলোর প্রত্যেকটির নর ও নারী। বয়সভেদে কোরবানির জন্য উপযুক্ত পশুর তালিকা :-
১|উট পাঁচ বছর বা তদূর্ধ্ব।
২| গরু দুই বছর বা তদূর্ধ্ব।
৩| ছাগল এক বছর বা তদূর্ধ্ব।
৪| ভেড়া বা দুম্বা ছয়মাস বা তদূর্ধ্ব।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সর্ব অবস্থা সঠিক সহি জ্ঞান দান করুন এবং কোরবানীর মত নিজেকে উৎসর্গ করে নেক কাজ ও আমল করার তৌফিক দান করুন আমিন।