সৈয়দ এ এইচ আশিক
নেতৃত্বের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণ বিদ্যমান। কিন্তু ইচ্ছে করলেই রাতারাতি বড় নেতা হওয়া যায় না। ব্যক্তিজীবনে অথবা কর্মক্ষেত্রে যদি কেউ নিজেকে নেতার আসনে দেখতে চান, তাহলে সেই ব্যক্তিকে বেশকিছু প্রতিভার অধিকারী হতে হবে। একদিনে কেউ নেতা আর দুদিনে কেউ জনপ্রিয় হতে পারেন না। তিলে তিলে আগ্রহী ব্যক্তি নিজেকে শাণিত করেন, প্রস্তুত করেন, বিপ্লব করেন, বিনির্মাণ করেন; পরিচিত করেন নিজেকে দেশের কাছে, দশের কাছে, এমনকি নিজের কাছেও। এজন্য তাকে কঠিন সাধনা করতে হয়। এ কাজের শুরু যেদিন থেকেই হোক না কেন, এর শেষ কবে হবে, কীভাবে হবে, আর কবেই-বা এই দীক্ষা পরিপূর্ণ হবে। এ বিষয়ে সর্বজনস্বীকৃত কোনো নির্ধারিত সিলেবাস, ব্যাকরণ কিংবা নিশ্চয়তা নেই।
দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত যেমনি মানুষের শিক্ষাজীবন, তেমনি রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক যে কোনো সংগঠনে বা দলে নেতৃত্ব অর্জনের জন্য ওই ব্যক্তিকে সমর্থক থেকে কর্মী, কর্মী থেকে নেতা হওয়ার প্রক্রিয়ায় দোলনার মতো করেই দোল খেতে খেতে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে এবং আমৃত্যু তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। এই দীর্ঘ, জটিল এবং অনেকটাই অস্বাভাবিক জীবনের পথচলায় ব্যক্তি হিসেবে কর্মক্ষেত্রে কিংবা সংগঠনে যদি কেউ নিজেকে নেতার আসনে দেখতে চান, তাহলে প্রতি মুহূর্ত তাঁকে যেমনি সংগ্রাম করতে হবে, শিখতে হবে, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে; সে সঙ্গে প্রয়োজনীয় কতগুলো কৌশল রপ্ত করতে হবে।
এসব তত্ত¡ খুব যে বেশি কঠিন, এমন নয় কিন্তু এই তত্ত রপ্ত করা এবং স্বার্থকভাবে প্রয়োগ করে কাক্সিক্ষত ফল অর্জন করা সুকঠিন বিষয়। যে কোনো সফল নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য ঘাঁটলে কিংবা তাঁদের জীবন ধারণের পদ্ধতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সে জীবন কতগুলো গুণের সংমিশ্রণে তৈরি। সেসব গুণাবলির প্রতি আমাদের যেমনি ক্ষোভ রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভালোবাসাও। রয়েছে আকর্ষণ অথবা চরম বিদ্বেষও। কারণ সবাই সেই গুণ অর্জনে সমর্থ হন না। আবার সবাই তা সব সময় ধরেও রাখতে পারেন না। অনেকেই সেসব তত্ত রপ্ত করে কোনো জানা-অজানা কারণে তার যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়ে পরাজয়ও মেনে নিয়েছেন।
এসব গুণ কেউ পারিবারিকভাবে, কেউ উত্তরাধিকার সূত্রে, কেউ শ্রম ও সাধনায়, আবার কেউ দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে অর্জন করেন। নেতৃত্ব একটি প্রতিভাগত বিষয়। খুব সহজে অনেকেই জন্মগতভাবে প্রতিভার অধিকারী হন। আবার কেউ কেউ লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, প্রতারিত কিংবা ঘাত-প্রতিঘাতে সঞ্চিত বিদ্রোহ থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তার কল্যাণে বিশাল রাজনৈতিক অঙ্কশাস্ত্রে যোগ-বিয়োগের হিসাবে দক্ষ হয়ে ওঠেন। ফলে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ফল অনুধাবনে তিনি একজন অভিজ্ঞ জ্যোতিষ হয়ে ওঠেন। এমন পাণ্ডিত্য তাকে ইতিহাসের পাতায় আলাদা স্থান দিতে বাধ্য।
নেতৃত্ব আর কর্তৃত্ব এক নয়। অত্যাচারী আর জনপ্রিয় শাসকও এক নন। একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্রও এক নয়। শাসন ও শোষণও এক কথা নয়। ব্যক্তিকে আগে চিন্তাভাবনা করতে হবে সে কী হতে চায়। কী তার পছন্দÑ ক্ষমতা, না-কি দায়িত্ব? ভোগবিলাসিতার রাজনীতি তাকে আকর্ষণ করে, না-কি মানুষের দৈনন্দিন দুঃখ-কষ্ট বিচলিত করে? ব্যক্তিস্বার্থ, জনস্বার্থ, আদর্শ, সততা-সংগ্রামে ব্রতী; নাকি স্বীয় স্বার্থে উত্তরোত্তর সাফল্যের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনে অস্থির! এ আলোচনায় আমরা জনগণের কাম্য, জনগণের সেবায় ব্রত, আদর্শিক এবং যোগ্যতাসম্পন্ন, দূরদৃষ্টির অধিকারী, ভিশনারি এবং কার্যকর গণতান্ত্রিকভাবে শক্তিশালী শাসক কিংবা নেতৃত্বের আলোচনা কিংবা অনুসন্ধান করবো।
আমরা সেই নেতৃত্বকে প্রত্যাশা করি যে নেতৃত্ব মানব কল্যাণের জন্য হিতকর, যা প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়, প্রয়োজনেই আস্তে আস্তে পথ চলে কিন্তু খুব সহজে হারিয়ে যায় না বা অস্থির রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মঞ্চে আত্মসমর্পণ করে না। আমরা সেই নেতৃত্ব চাই না, যা সময় কিংবা ভাগ্য সহায়তার বিশেষ অনুকম্পায় হঠাৎ ঝরে বক মরার মতো উদয় হয়; আবার নির্ধারিত সময়ের আগেই আচমকা পরাজিত হয় বা ফুরিয়ে যায়। ওপর থেকে ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজনে, বিশেষ সময়ে তৈরি সুবিধাবাদী কৃত্রিম ধারার চাপিয়ে দেয়া নেতৃত্ব সময়ের পটপরিবর্তনে হারিয়ে যেতে বাধ্য। কৃত্রিম নেতৃত্ব সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতরে যতক্ষণ ক্রিয়াশীল থাকে, ততক্ষণই তা মানবতার বিরুদ্ধে গিয়ে মনবসত্তাকে কলঙ্কিত করার সুযোগ খোঁজে। আমরা সৎ, আদর্শিক, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, কল্যাণকর, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও ভিশনারি নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছি। সে সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী অজনপ্রিয় এবং শেয়ারবাজারের মতো হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে ওঠা নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁদের বিরোধিতা করছি।
লেখক : সংগঠক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব