অধ্যক্ষ আবুল বাশার হাওলাদার
বিশ্বব্যাপী মহাদুর্যোগে যখন মানুষ মহাআতঙ্কে গৃহে অবস্থান করছে, মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, আরও লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, অনিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে মানবজাতি, ঠিক এই মুহূর্তে আর্থিক বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। এই মহাসংকটেও থেমে থাকবে না মানুষের পথচলা। তাই আমি বিশেষ করে বাজেটে শিক্ষাখাত নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
এখানে শিক্ষা একটি ব্যাপক বিষয়। দেশের শতকরা ৯৭ ভাগেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা এই তিন স্তরে বিন্যস্ত সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা। তাছাড়া মাদরাসা, ইংলিশ মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্শন-সহ নানা ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদ্যমান রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৫ লাখেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি করছেন এবং ৫ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন। শিক্ষার সাথে মূলত সম্পৃক্ত আছেন দেশের সকল মানুষ। সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যে ব্যয় করেন তা জাতিগড়ার কাজে বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, বইমুদ্রণ,শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, অবকাঠামো নির্মাণ, আসবাবপত্র, বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি-সহ আরো অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় করা হয় শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে।
জাতীয় বাজেটের শতকরা ১২ থেকে ১৩ ভাগ বরাদ্দ করা হয় শিক্ষাখাতে। গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১২.৩ ভাগ বরাদ্দ ছিল শিক্ষাখাতে। পক্ষান্তরে পার্শবর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকায় শতকরা ১৬-২০ ভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষাখাতে। ইউনেস্কো-আইএলও যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষার মান্নোনয়নে একটি নীতিমালা ঘোষণা দেন এবং সেই রেজুলেশনে বাংলাদেশ একমত পোষণ করে স্বাক্ষর করেছিলেন। সেখানে বলা আছে, জিডিপির ৬ শতাংশ বা জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে শিক্ষাখাতে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষাখাত অনেকটাই দুর্বল। এখানে লক্ষ্য করা যায়, শতকরা ৯৭ ভাগ শিক্ষক-কর্মচারী বেসরকারি চাকরি করেন। তাদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ এমপিও ব্যবস্থার মাধ্যমে বেতনভাতার একটি অংশ সরকার থেকে পান, বাকিরা কোনো বেতনভাতা পান না। যার ফলে বৈষম্যে জর্জরিত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা ১০০০ টাকা বাড়িভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসাভাতা, ২৫ শতাংশ উৎসবভাতা পেয়ে থাকেন। উচ্চতর স্কেল, পদোন্নতি, বদলী-সহ নানা বৈষম্যের শিকার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা।
তাছাড়া অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা আছেন আরও কষ্টে। অবসরের ৩-৪ বছর পর তারা টাকা পেয়ে থাকেন। এমনকি নানা রোগে ভুগতে ভুগতে টাকা পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। শুধু শিক্ষক-কর্মচারীরাই নন, শিক্ষার্থীরা যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি টিউশন ফি দিয়ে থাকে। বাজেটে শিক্ষাখাত অবহেলিত থাকার জন্যই এ বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে।
জাতির দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সকল বৈষম্য নিরসন হবে বলে সবাই আশা করছিলেন। অপ্রিয় হলেও সত্য, শিক্ষানীতির মূলকথা ছিল শিক্ষায় সকল বৈষম্য দূর করা এবং বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা; তা আদৌ হয়নি।
এজন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও যথেষ্ট অর্থ বিনিয়োগ করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে বেশ আন্তরিক। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাঠামো সঠিকভাবে এগোতে পারেননি। ফলে শিক্ষায় বৈষম্য নিরসন অধরাই রয়ে গেল।
এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কোভিড-১৯ সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। সাজানো বাগান এলোমেলো হয়ে গেছে।এর মধ্যেও বাঁচতে হবে। নতুন করে সবকিছু সাজাতে হবে। আসছে জাতীয় বাজেট ২০২০-২০২১।
“শিক্ষাবাজেট কেমন চাই ” প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটকালেও শিক্ষায় বৈষম্য নিরসনে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। মাধ্যমিক শিক্ষাও পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করেছেন। এই মর্মে বলব, এখন সময় হয়েছে একযোগে সকল স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা এবং বৈষম্যে জর্জরিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। পরিশেষে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের লক্ষ্যে ইউনেস্কো-আইএলও ঘোষিত জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করার জোর দাবি জানাই।
অধ্যক্ষ আবুল বাশার হাওলাদার
সভাপতি
বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন
কেন্দ্রিয় কমিটি