কোলকাতা থেকে
রাজর্ষি বিশ্বাস
সারা রাত জেগে বসে থাকে মনসিজ। ঘুম আসে না কিছুতেই। এমনিতেই কদিন ধরে ঠিক মত ঘুম হচ্ছে না। সিগারেট খাওয়াটাও বেড়েছে এই উদ্বাসিত জীবনে। বন্দীদশা যেন কাটতেই চায় না। এই ক’টা দিন যেন তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। বিকালে হসপিটালের ড: রায় জানিয়ে গেছেন, আগামীকাল সকালে টেস্টের রিপোর্ট আসবে। রিপোর্ট নেগেটিভ না এলে যে কি হবে … টেনশন যতটা তার নিজের জন্যে, তার থেকেও বেশী বাকিদের জন্যে। একজনের ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত। জনবিচ্ছিন্নকারী সরকারী ঘেরাটোপে এই কদিনে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। নিয়ম ভেঙেই সিগারেট ধরায় একটার পর একটা। রাত প্রায় আড়াইটা। স্তব্ধতায় ডুবে আছে চারপাশ। নিয়ন আলোয় এক মায়াবী পরিবেশ। কে বলবে, চারপাশে সব কিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। চলছে মৃত্যু মিছিল। তবু এই বিপন্ন বৈশাখ ঐশ্বর্যশালী। ধ্যান গম্ভীর। স্নিগ্ধ । রাজ আমলের নিদ্রামগ্ন বৃদ্ধ ইমারতটিও সভ্যতার সংকটের নীরব সাক্ষী হয়ে গেল। তবু লম্বাটে বারান্দায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে মুখোশহীন সারমেয়রা। এরাই এখানকার প্রকৃত রাজা। অর্থাৎ শাসক। অধিকার বোধটাও তাই বেশী। মনসিজ দু’একবার এদের তাড়িয়ে দিতে চাইলেও, লাভ হয় নি। পরে ভেবেছে, এখানে তো তারাই পরিযায়ী। তাদেরকে ওরা আশ্রয় দিয়েছে। যেদিন গভীর রাতে অপরাধীর মত করে সরকারী বাস সবাইকে নিয়ে আসে, সেদিন মানুষ নয়, ওরাই স্বাগত জানিয়েছিল। মনসিজ ভাবে, মানুষ সত্যিই অদ্ভূত। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে হিরক রাজা। যেখানেই যায় মনে করে সব জায়গাই তার। শুধুমাত্র তারই সম্পত্তি। সব কিছুর মালিক। তা বাসের সিটই হোক, পার্কের চেয়ার বা ভাড়া করা ফ্ল্যাট। আসলে প্রতিটা মানুষের মনের গভীরে বসে থাকে এক একজন আস্ত গভর্নর জেনারেল। সে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে কারণে অকারণে। আর তখন কুকুর-মানুষ সবাই একাকার হয়ে যায়। পার্থক্য খুঁজে পায় না। অস্থায়ী শিবিরের দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিটিও হাবেভাবে যেন একজন ছোট লাট। সবার সাথে দাঁত খিঁচিয়ে কথা বলাই যেন দস্তুর। ওই গভীর রাতে বাস থেকে নামার পর সবাইকে যেন নিয়ে যাওয়া হয় এক বদ্ধভূমিতে। মনে করা হয়েছিল, এরা সবাই সারমেয়র দল। সবাই ভেবেছিল, একদল অচ্ছুৎ মানুষ এসেছে ভিন রাজ্য থেকে অথবা ভিন গ্রহ থেকে। অতঃপর শুরু হয় বন্দী দশা। সময় কাটতেই চায় না কিছুতেই। তবুও চোদ্দ দিন থাকতে হবে। সরকারি নিয়ম। মনসিজ দিনের বেলায় সবার সাথে ফোন করে সময় কাটায়। কিন্তু বিপ্লবের সাথে দুদিন ধরে কোন কথাই হয় নি। ওর ফোনটাও বন্ধ।
পেটের দায়ে সে পড়ে আছে দূরবর্তী ভিনরাজ্যের ঊষর ভূমে। চলে আসার সময় বাসে ব্যাগপত্র তুলে দিতে এসে বলেছিল, স্যার মনে হয় আর বাড়ি ফেরা হবে না… মনসিজ ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, চিন্তা করো না। তোমাদেরও ফেরানোর ব্যাবস্থা হবে। আলোচনা তো চলছে। বিপ্লব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ওর বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারেনি। রাজ্যে ফেরার বাসে দ্রুত উঠে জানলার পাশে একটি সিটে বসে পড়ে সে। আর বিপ্লব রাস্তার ওপারে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই বিদেশ বিভুইয়ে এসে বয়সের ব্যাবধান থাকলেও বিপ্লবের সাথে এক অদ্ভূত সখ্যতা গড়ে ওঠে মনসিজের। যে কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটে সে এসে ওঠে, সেখানেই কেয়ারটেকারের কাজ করে । প্রথম দিকে বিপ্লবকে দেখলেও কথা হয় নি। যেদিন প্রথম অচলায়তনের কথা ঘোষিত হলো সেদিন সন্ধ্যায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে মনসিজ কিছুটা অবাক হয়েছিল। এই কমপ্লেক্সে দুশোর বেশী ফ্ল্যাট থাকলেও, কেউ কারোর খোঁজ রাখে না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজনের বাস। সবার দরজাই সবসময় ভেতর থেকে বন্ধ। এমনিতেই সবাই বন্দী। নতুন করে আর কি হবে…
দরজা খুলে মনসিজ অবাকই হয়। একটি বছর তিরিশের যুবক হাতে কিছু বিস্কুট, চকোলেটের একটি প্যাকেট হাতে তুলে দিয়ে বলল, চারদিকে সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাই নিয়ে এলাম। ওর মুখে বাংলায় কথা শুনে মনসিজ অবাক হয়ে বলেই ফেলে, তুমি বাঙালি… আরে ঘরে এসো। বাইরে দাড়িয়ে কেন ? খানিকটা সংকোচ নিয়েই ভেতরে ঢোকে। কমপ্লেক্সের একুশে আইন – ইমারজেন্সি ছাড়া ফ্ল্যাটে স্টাফদের প্রবেশ নিষেধ। মনসিজ ওকে বসিয়ে রেখে দুকাপ কফি নিয়ে আসে। এই দূর দেশে কথা বলার লোক পেয়ে সে বেজায় খুশি। এরপর প্রতি সন্ধ্যায় মুখে রুমাল বেঁধে নিয়ম করেই এসেছে সে। কত গল্প। ওর জীবনের নানা কথা। বাবার মৃত্যু। প্রেম। বিয়ে। সংসারের চাপ। অতঃপর খড়কুটোর মত ভাসতে ভাসতে এখানে চলে আসার রোমহর্ষক গল্প। নানা গল্পে সন্ধ্যাটা কেটে যায়। তখনও কেউ জানেনা সামনে কি দিন আসছে…
এই বন্ধ্যা সময়ে বিপ্লব যেন মনসিজের কাছে হয়ে ওঠে মুক্ত বাতাস। ক’টা টাকাই বা বেতন পায় ! তবু সদাহাস্য মুখ। মুর্শিদাবাদে বাড়ি। বাড়িতে বিধবা মা, ভাই , স্ত্রী ও দু বছরের সন্তান। প্রাণোচ্ছল । আশাবাদী। কুছ পরোয়া নেই – হাবভাব। কিন্তু …
সময় যত এগোয় সে ক্রমশ চুপচাপ হতে থাকে।
সিগারেটের শেষ টান দিয়ে আরও খানিকক্ষণ দাড়িয়ে থাকে সে। চারপাশে একটা গুমোট ভাব। ভোর রাতে হয়ত ঢালবে। মনসিজ তাকিয়ে থাকে আলো অন্ধকারে লুকোচুরি খেলতে থাকা প্রাচীন ইমারতের দিকে। আবার তাকে এই কূহকের মধ্যে ঢুকে যেতে হবে…
এই গভীর রাতেও সে বিপ্লবের উপস্থিতি টের পায়। মনে হয় যেন অভ্যাসবশত প্রতি দিনের সান্ধ্যকালীন আড্ডা চলছে। আর সে বলছে, স্যার বাড়ি ফিরতে পারবো তো… কতদিন ছেলেটাকে দেখিনি! একের পর এক রাজ্য থেকে বাস আসে। সবাই ফিরে যায় বাড়িতে। আপনিও চলে যাবেন।
প্রতিদিন বিকালের দিকে সে কমপ্লেক্সের গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। আর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চলে যেতে থাকা গাড়িগুলোর দিকে…
এক সন্ধ্যায় বিষন্ন মুখে এসে বলে, স্যার আমাদের আর চাকরি থাকবে না। কমপ্লেক্সের মালিক জানিয়ে দিয়েছে। সবাইকে বলেছে বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু কিভাবে ফিরবো … এখানে আর বেশিদিন থাকাও যাবে না। এখন রোগ ছড়াচ্ছে চারপাশে। দেখছেন তো সবাই পালাচ্ছে। সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। মাও ফোন করলে একটাই কথা বলে, কবে আসবি ? বাড়িতেও খাবার জুটছে না। স্যার কি যে করি…
মনসিজ কথা খুঁজে পায় না। সরকার তাদের ফিরিয়ে নেবে যে কোন দিন। কিন্তু বিপ্লবরা কিভাবে ফিরবে ? গতদিন খবরে দেখছিল, গুজরাট থেকে একদল নিরন্ন মানুষ তীব্র দাবদাহের মধ্যে পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিল। খাবার নেই। জল নেই। পঞ্চাশোর্ধ ক্লান্ত অবসন্ন এক শরীর লুটিয়ে পরেছে জন শূন্য পথে। প্রাণহীন নিথর দেহ নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। চারপাশে মাছি উড়ছে। কাপড়ের বোঁচকা থেকে দুদিন আগের শুকনো রুটি ছিড়ে খেতে থাকে অভুক্ত কোন এক বৃদ্ধ ভিখারী। সঙ্গীরা এগিয়ে যায় অনেক দূর। তারা জানতেও পারে না হারাধনদা আর কোনদিন বাড়ি ফিরবে না।
মনসিজ সিগারেট ধরায়। এক দেশ। সবাই তো ভোটার। তবু কত বৈষম্য। তারা রাজার হালে না ফিরলেও, নিরাপদে ফিরেছে । বহু অর্থ ব্যয় হয়েছে। কার্পণ্য করেনি কেউ। কাল হয়ত টেস্টের রিপোর্টও আসবে। সব ঠিক থাকলে অতঃপর মুক্তি। এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। বাড়ি ফেরার একটা চাপা উত্তেজনাও টের পায়। এই আধো অন্ধকারে বিপ্লবের বিষন্ন মুখ ভেসে ওঠে। চলে আসার আগের দিন মনসিজ যখন ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে, তখন ও এলো। কোথা থেকে ফল নিয়ে এসেছে। স্যার রাস্তায় কিছু পাবেন না। এটা রাখুন। প্রতিদিনের মত দুকাপ কফি করে নিয়ে আসে মনসিজ। মাথা নীচু করে বসে থাকে বিপ্লব। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে, স্যার আপনারাও চলে যাচ্ছেন। একদম একা হয়ে যাব। এখানে এখন কথা বলার কেউ নেই। পুরো কমপ্লেক্সটা যেন আমাকে গিলে খেতে চায়। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে স্যার। এরপর চাকরিও আর থাকবে না। বাড়ি ফিরেই বা কি করবো… স্যার আমাদের কথা কে আর ভাববে ? কে লড়বে আমাদের জন্যে ? সবাই ঘরে ঢুকে গেছে। শুনছি, মিছিল মিটিং আন্দোলন সব বন্ধ। শুধু ভোট হবে। আমরা খাবো কি ? মনসিজ নিরুত্তর। টি টেবিলে রাখা তার কফিটা ক্রমশ ঠান্ডা হতে থাকে…
রাজস্রী বিশ্বাস
লেখক ও কবি
মাথাভাঙা, ভারত