কলকাতা থেকে
রাজর্ষি বিশ্বাস
সকাল সকাল দিল্লীর টার্মিনাল থ্রি তে ঢুকে বোর্ডিং কাউন্টারে লাগেজ দিয়ে বোর্ডিং পাস নিয়ে নিয়ম মাফিক সিকিউরিটি চেক ইন করে। লাউঞ্জে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে যায় বর্ষা। সে ভুল দেখছে না তো ? এভাবেও দেখা হয় ? বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। বুঝতে পারে না কি করবে ? অত লোকজনের মধ্যেও সাবর্ণকে আলাদা করে চেনা যায়। ওর চেহারার মধ্যে যে কি আছে ? এক অদ্ভূত সম্মোহনী ক্ষমতা ! না দেখার ভান করে বর্ষা কিছুটা এগোলেও থেমে যায়।
আসার সময় ভেবেছিল, লাউঞ্জের দোতলার ফুড পার্কে কিছু একটা খেয়ে নেবে। সকালে শুধু চা খেয়েই বেড়িয়েছে। হাতে অবশ্য এখনও যথেষ্ট সময় আছে। পরেও খাওয়া যাবে । ভাবতেই পারছে না ওকে এতদিন পর দেখতে পাবে ! তাও এত কাছ থেকে। মাত্র তো কয়েক ফুট দূরত্ব। সাবর্ণ কিন্তু তাকে দেখতে পায়নি। চেহারা একই আছে। একটু ভারিক্কি হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখার এই অনুভূতি টা যেন আজও একইরকম।
ও কি এখনও তাকে দেখেনি ! না কি দেখেও দেখছে না। মাঝে মাঝেই কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলছে। মনে হল, যেন একটু উদ্বিগ্ন।
বর্ষাও না দেখার ভান করে মোবাইল ঘাটাঘাটি করছে। সেও বুঝতে দেবে না যে, সে দেখেছে। এত কাছে এসেও যেন কত দূরত্ব। এতবার নানা কাজে দিল্লিতে আসলেও, প্রায় চার বছর পরে এই প্রথম সাবর্ণর দেখা পেল। বুঝতে পারছে না কি করবে … নিজেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে…
সাবর্ণ কি এখনও রেগে আছে তার ওপর ?
নিতান্ত সন্দেহ ও রাগের বশে সম্পর্কটা সে-ই ভেঙ্গে দিয়েছে। শান্ত ভাবেই সাবর্ণ বলেছিল, তুমি ভুল করেছো। এম এন সি তে এসব ভাবলে চলে না। এমন পেশায় আছি সবার সাথে মিলে মিশে থাকতে হয়। আর ও তো আমার অনেক ছোট !
বর্ষা হোয়াটস অ্যাপে সৃজার আপাত নিরীহ ওই মেসেজগুলো দেখেও মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। নয়ডার ফ্ল্যাট থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসে। এখানে থাকার আর কোনও মানেই হয় না। সেদিনই টিকিট বুকিং করে। বাগডোগরার ফ্লাইট ধরে সেই যে শিলিগুড়ি চলে এসেছে ফিরে আর যায়নি। ওর বাবা মা অনেক বুঝিয়েছে। ছোট থেকে জেদি স্বভাবের বর্ষা কারও কোন কথাই শোনেনি। সাবর্ণ অনেক দিন ফোন করেছিল- ধরে নি। মেসেজ করেছিল- উত্তর দেয় নি। এখন মনে হয় এতটা না করলেও হতো। সময়ের সাথে সাথে সব পাল্টায়। আজ সেই রাগও স্থীমিত। বোঝে, ভুল-ই করেছে সে। কখনও কখনও খুব ইচ্ছে হয়েছে সাবর্ণকে ফোন করতে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নামটা সার্চ করেও থেমে গেছে। কোথাও যেন একটা গ্যাপ – একটা গভীর ক্রিভাস ! আসলে যে ব্যবহার সে করেছে তারপর কি ভাবে আর কথা বলে। মাঝে মাঝে মনেও হয়েছে ফিরে যাবে…
এন বি ইউ তে পিএইচডি-র কাজে ডুবে যাওয়ার পর সাবর্ণর স্মৃতি কিছুটা ফিকে হয়ে যায়। তবে তারও অভিমান আছে। নিছক সন্দেহের বশে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া তার ঠিক হয় নি। তাই বলে সাবর্ণ কেন নিজের থেকে একবারও দেখা করতে আসে নি। আদরের চোখে বলেনি , কাছে এসো। ফিরে চলো…
আসলে সবাই শুধু তারই জেদ আর রাগ দেখে… সাবর্ণও ভেতর ভেতর অসম্ভব জেদি। ওর প্রকাশ কম। তাই সাত খুন মাপ। আগে ও অন্য রকম ছিল। হাসি খুশি। প্রাণোচ্ছ্বল। আবেগ প্রবন। ট্রেকিং ও ফটোগ্রাফি করাই ছিল ওর প্যাসান। চাকরিতে ঢোকার পর দ্রুত পাল্টে যায়। সব সময় ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। কোন কথা জিজ্ঞেস করলে হু হ্যাঁ উত্তর দেয়। ওর যাপিত জীবন হয়ে ওঠে যান্ত্রিক। বড্ড বেশি কর্পোরেট। যেখানে আবেগ অনুভূতির কোন জায়গা নেই। ওর এই চেঞ্জটা সে কিছুতেই মানতে পারেনি। হাঁপিয়ে উঠেছিল। এখন ভাবে, সৃজার ওই মেসেজগুলো নয় , তার চলে আসার মূল কারণ হয়ত ছিল সাবর্ণর এই পরিবর্তন।
বর্ষা এসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্কও হয়ে যায়। হঠাৎ দেখে সাবর্ণ যেখানে দাড়িয়েছিল সেখানে নেই। চলে যাচ্ছে রানওয়ের টার্নিং এর দিকে। সাথে খুব পরিচিত কেউ। হ্যাঁ ঠিকই দেখেছে সে। খুব ঘনিষ্টভাবে সৃজাই তো ওর সাথে …
চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে আসে। সব কিছু গুলিয়ে যেতে থাকে। দুচোখ ভারী হয়ে আসে। ঝাপসা হয়ে যায় চারপাশ। তবে আর কেন অপেক্ষায় ? তাকেও তো যেতে হবে। রানওয়ের প্যাসেজ দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কতবার গেছে। আজ যেন প্রথম মনে হচ্ছে ৫৬ নম্বর গেটটা কত হাজার মাইল দূরে ! এতদিন এত ঝড়ঝাপটার পর আজ সত্যিই সে সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। অন্য সময় হলে চারপাশ দেখতে দেখতে হেঁটে যেত। আর আজ তার প্রাণহীন নিথর দেহ ওয়াকিং এসকেলাটর টেনে নিয়ে যাচ্ছে… কোন এক অবিশ্বাসের দেশে…
লেখক : গল্পকার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত