গোধূলি লগ্নে

0
807

তাহমিনা বেগম

ছোটগল্প

ভোর পাঁচটা।করিমসাহেব ফজরের নামাজ শেষ করেন।বাহিরে তখনো আবছা অন্ধকার।রিটায়ার্ড করার পর তিনি এক মুহূর্তের জন্যেও এই শহুরে গণবহুল জীবনে থাকতে রাজী হননি। দুই ছেলে এক মেয়ে ও নাতী নিয়ে
সংসার।তিনি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হতে ইউডি হিসেবে অবসর নেন।অনেক কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের
মানুষ করেছেন।বড় মেয়ে, তারপর দুই ছেলে।মেয়েকে
বিয়ে দিয়েছেন।একটি আট বছরের নাতী রয়েছে মেয়ের ঘরের।জামাই ইঞ্জিনিয়ার।কপাল গুণে পেয়ে গেছেন এমন জামাই।ময়েটির নাম রুবা।রুবাইয়াৎ রুবা।লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিল।ঢাকা ভার্সিটি থেকে
ভুগোল নিয়ে পাশ করেছে।কপাল বলতে হবে।আল্লাহ
হয়তো করিম সাহেবের সততা ও ধৈর্যের পরীক্ষার ফল
দিয়েছেন তাকে।এরপর দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে
আর্মির ক্যাপ্টেন।ছোটটা আই বিএ এর এম বি এ।

বড় ছেলের পোস্টিং হয়েছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে।মেয়ে
থাকে জামাইসহ যশোহরে।একমাত্র ছোট ছেলেটাই
উনাদের সাথে ঢাকার গোড়ানে ভাড়া বাসায় থাকতো।ছেলে সদ্য পাশ করে একটি নামকরা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছে।রিটায়ার্ডের টাকায় করিম
সাহেব গ্রামে বাপ দাদার ভিটাবাড়ীতে থাকবেন বলে
একটি তিনরুমের পাকা বাড়ি করেছেন।ছেলেমেয়েরা
অনেক বুঝিয়েছে ওদের বাবাকে।সারাজীবন এতো কষ্ট
করেছেন আমাদের জন্য।এখন আমরা সবাই প্রতিষ্ঠার পথে।তুমি এই সুখের সময় কেন গ্রামে থাকবে।সহধর্মিনী রাহেলা বেগমের কোনো মতামত নেই।বরাবর
স্বামীর কথার সাথে সহমত পোষণ করেছেন।

করিম সাহেব ছেলেমেয়েদের বলেছেন জীবনের অনেক
সময় পার করেছি শহরের এই রঙচটা জীবনে।আর নয়।এবার গ্রামের নির্মল পরিবেশে বাকী জীবনটা কাটাতে চাই।পৈত্রিক সূত্রে যে একটুকরো জমি পেয়েছি
আর পেনশনের কিছু টাকা আছে ও দিয়েই আমি ও তোমাদের মা নিশ্চিন্তে ওখানেই জীবনের শেষ কটা দিন
পার করবো।তোমরাতো জানো আমি কৃষকের সন্তান।বাবা-মায়ের দোয়ার বরকতে কোনোরকমে এইচ এস সি পাস করে ঢাকা শহরে শূন্য হাতে এসেছিলাম।তখন
প্রথমেই ক্লার্ক হিসেবে এই চাকরীতে ঢুকি।যে টাকা বেতন পেতাম তার থেকে কিছু টাকা বাড়িতে বাবা-মায়ের জন্য পাঠাতাম।বাকীটা দিয়ে কোনোরকমে
কয়েকজন মিলে মেসে থাকতাম।তারপর মা-বাবা বিয়ে
দিলেন।তোমরা আসলে দুনিয়াতে একে একে।তোমাদের মানুষ করতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়েছে।সরকারি চাকরি ছিল বলে রক্ষা।বলতে লজ্জা
নেই চাকরি থেকে ছুটি হলে দুটি প্রাইভেট টিউশনি করতাম।এতে কিছুটা সহায্য হতো সংসারের।আমার সম্পত্তি বলতে তো তোমরাই।তোমরা সবাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেছ।নিজেরা মানুষ হয়েছ।এর চেয়ে শান্তি আর কি হতে পারে? আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া।

ছেলেমেয়েরা আর কিছু বলেনি।শুধু বলেছে তোমার মন যেভাবে ভালো লাগে সেভাবে থাকো।করিম সাহেব
একটি দুধেল গরু কিনেছেন।সকালে নামাজ শেষে একটু বাড়ির সামনে যেয়ে হাঁটাহাটি করেন।তারপর
নিজহাতে গরুর দুধ দোহান।রাহেলা বেগম এর মধ্যে
নিজহাতে দুজনের সকালের নাস্তা রেডি করে ফেলেন।তৃপ্তি সহকারে রাহেলার বানানো নাস্তা খেয়ে একটুখানি
বিছানায় গড়াগড়ি করেন।এরপর ক্ষেতে যান।রবি শষ্যাদি দেখেন।একটু আগাছা দেখলে নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করেন।আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া এজন্য উনারা দুজনে খুব সুস্থ আছেন।রাহেলা বেগমের
বরং প্রেসারটা লো থাকে একটু।

এভাবেই সুখে দুখে দুজনের বেশ সময় কেটে যাচ্ছিল।
করিম সাহেবরা গ্রামে এসেছেন বেশিদিন হয়নি।তাই
কারো সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠেনি।স্বামী, স্ত্রী দুজন
একে অপরের বন্ধু হয়ে সময় কাটান।পুরনো দিনের স্মৃতি মনে করে করিম সাহেব রাহেলাকে বলেন, রাহেলা
শহুরে ব্যস্ত জীবনে চাকরি, সন্তান মানুষ করতে যেয়ে
আমি তোমার প্রতি অনেক সময় খেয়ালই রাখতে পারিনি।তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।রাহেলা আৎকে
উঠে বলেন এসব তুমি কি বলছো? আজ দেখো আমাদের কতো সুখের জীবন।ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়েছে।মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছি।ছেলে দুটোকেও আশা করি বিয়ে দিয়ে লক্ষী দুটি বউমা আনবো।তুমি পরিশ্রম করেছ বলেই তো আজ ওরা মানুষ হতে পেরেছে।এখন আর কিসের দুঃখ? তুমি
আমি এখানে সুখেই আছি।

ছেলেরা ছুটিছাটা পেলেই গ্রামে চলে আসে।মেয়েকে নিয়ে জামাইও সময় পেলে এসে বেড়িয়ে যায়।আসার সময় ওরা মা-বাবার জন্য কত জামাকাপড়,খাবার দাবার নিয়ে আসে।আর কি চাই জীবনে? মানুষ একসময় একটু কষ্ট করে, ধৈর্য ধরে।পরে সুখ ভোগ করে এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম।সেদিন রাতে করিম সাহেব রাহেলার সাথে অনেক সুখ দুখের আলাপ শেষে
রাহেলাকে নিবিড় করে কাছে টেনে নেন।রাহেলা বেগমের মুখটা নবপরিণীতা বধূর মতো লজ্জায় লাল
হয়ে ওঠে।গভীর চুম্বনে ভরিয়ে দেন রাহেলাকে।রাহেলা
বেগম বলেন আজ তোমার কি হলো? করিম সাহেব
বলেন অতীতে যে সময়গুলো তোমাকে দেবার কথা ছিল তখন পারিনি।এখন সেই সময়গুলো তোমাকে দেব
এবং আমার অপ্রাপ্তিগুলোও আদায় করে নেব।

রাহেলা বেগম বলেন এ বয়সে এসে কি পাগলামি করছো? করিম সাহেব বলেন, বয়স কোনো কথা নয় রাহেলা।করিম সাহেব রাহেলাকে আরো নিবিড় আলিঙ্গনে টেনে নেন এবং চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে
মিশে যান প্রকৃতির নিয়মে।একসময় সব শেষ করে
দুজনে পরিশ্রান্ত হয়ে কখন যে সুখনিদ্রায় ডুবে যান।নিজেরাও জানেন না।এভাবেই অতি সুখে সময় পার করছেন।নিজেদের অপ্রাপ্তিগুলো একান্তে মিটিয়ে।


লেখক: কবি ও গল্পকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here