উম্মে কুলসুম মুন্নি
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো । ষ্টেশনের প্লাটফর্ম এ লোক সমাগম কমে এসেছে ।
মধু দার চায়ের দোকানে চায়ের কাপের ঝড় ও অনেক টা কমে গেছে । কর্নারের টেবিলটায় এখনো সাজিয়া বসে আছে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা সামনে নিয়ে যেখানে প্রায়ই তারা দুজন একসাথে বসত,আজ সে একা,বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে, এই বুঝি সে এলো !!
তাকে চিন্তিত দেখে মধু দা বলল,দিদি চিন্তা কর না,সে চলে আসবে ।
রাত দশটা বাজে, ষ্টেশনে সুনসান নীরবতা । শেষ ট্রেন টা ও ছেড়ে গেছে অনেক সময় হয়েছে ।
মধু দা এসে বলল,দিদি, আর কত অপেক্ষা করবে, বাড়ি যাবে না ?
সাজিয়া যেন সম্বিৎ ফিরে পেল ।
ওহ,হ্যা,কিন্তু কিভাবে ফিরে যাব ? কি বলব মাকে ? বাবা মা আর অন্য সবাইকে কিভাবে মুখ দেখাবো ?
মধু দা এসে মাথায় হাত রেখে বলল, চল দিদি, বাড়ি চল ।
মধু দা,আমাকে তোমার সাথে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে, কাল সকালে চলে যাব ।
তুমি যাবে আমার বাড়ি, ঠিক আছে চল ।
সাজিয়া ব্যাগ নিয়ে মধু দার পিছনে হাটতে লাগলো। ষ্টেশন পার হয়ে কিছুদুর গেলেই মধুদার বাড়ি ।
সেখানে মধু দার মা এবং স্ত্রী সাজিয়াকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ।
মধু দা বলল,ইনি সাজিয়া দিদি ।
আজ রাতে এখানে থাকবেন, সকালে চলে যাবেন । শুনে মধু দার মা এবং স্ত্রী তাকে আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো । খাওয়া শেষ করে উঠে মধু দা সাজিয়া কে খাটে শুতে দিয়ে নিজেরা নিচে মাদুর পেতে শুয়ে পড়লো ।
বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায় । দূরে কোথাও শিয়ালগুলো বিরামহীন ভাবে ডেকে যাচ্ছে ।
নির্ঘুম সাজিয়া এপাশ ওপাশ করছে আর ভাবছে যাদের সাথে কোন রক্তের বন্ধন নেই, এমনকি নেই ধর্ম ও জাতের সম্পর্ক তারা তার জন্য কতটা আন্তরিক, অন্য দিকে অপূর্ব, যাকে সে ছোট বেলা থেকে চিনে,ভালোবাসে,যার জন্য আজ সে বাবা মা র মুখে চুনকালি দিয়ে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে, সে তাকে ধোকা দিল,একবার ও ভাবলো না ষ্টেশনে সে একা একা কি করছে,কিভাবে মানুষকে মুখ দেখাবে,,,,,এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত শেষ হয়ে গেল সে বুঝতে পারে নি ।
দূরের কোন মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে,,,,, পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে,,,
বিছানা ছেড়ে মুখ হাত ধুয়ে এসে সাজিয়া যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে তখন মধু দার মা তার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো । খেতে খেতে সে মধু দা কে বলল তাকে ঢাকায় যাওয়ার ট্রেনে তুলে দিতে ।
মধু দা আর তার মা দুই জনই অবাক হয়ে বলল, একা একা কোথায় যাবে তুমি ?
সাজিয়া বলল ঢাকা গিয়ে সে একটা চাকরি খুঁজে নিবে আর তাদের উপকারের কথা সে কখনো ভুলবে না ।
তারপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে নতুন জীবনের সংকল্প নিয়ে সে ঢাকার উদ্দেশ্যে ট্রেনে চড়ে বসল। তার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটাকে পিছনে ফেলে ছুটে চলেছে ট্রেন । সে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল । দুই পাশের গাছপালা, ঘরবাড়ি সবকিছুই ধীরে ধীরে অতীত হয়ে যাচ্ছে ।
টেরই পায় নি কোন এক ষ্টেশন থেকে কেউ একজন উঠে তার পাশের সিটে বসেছে ।
হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে ফেল পাশের সিটে বসা মানুষ টার কথা শুনে,
কোথায় যাবেন আপনি, মানে ঢাকায় কোথায় যাবেন ?
অচেনা মানুষ, কি বলবে বুঝতে পারছে না, তাছাড়া সে নিজে ও জানে না কোথায় যাবে, তাই চুপ করে রইল ।
আমি রায়হান,ঢাকায় ধানমন্ডি তে থাকি, একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আছি,
আপনি ?
এবার সাজিয়া বলল, ঢাকায় আসলে আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই, কোথায় যাব,কি করব এখনো কিছু জানি না ।
রায়হান অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই সে গতকাল সন্ধ্যায় তার স্বপ্ন ভঙ্গের কথা তাকে জানাল,আর ও বলল তার ফিরে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না তাই সে এই অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে ।
রায়হান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না । কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে সাজিয়ার পড়াশোনা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলে পরিবেশ টা হালকা করার চেষ্টা করল । এভাবে কথায় কথায় সময় পার হয়ে গেল ।
একসময় তাদের ট্রেন ঢাকায় পৌছাল।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে । রায়হান সাজিয়াকে বলল,আসুন আমার সাথে । তারপর সে সাজিয়াকে নিয়ে ধানমন্ডি তে একটা কর্মজীবী মহিলা হোষ্টেলে গেল, সেখানে তার এক আত্মীয়া থাকে । সাজিয়াকে সেখানে থাকার সব ব্যবস্হা করে তাকে একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে পরদিন সকালে সেই ঠিকানায় যাওয়ার জন্য বলে সে চলে গেল ।
সাজিয়া সারারাত শুধু রায়হানের কথা ভাবল,যাকে চিনে না,জানে না,তার জন্য ও মানুষ এতটা করতে পারে ।
সাজিয়া ভাবতেই পারে নি পরদিন সকালে তার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল ।
রায়হানের দেয়া ঠিকানায় গিয়ে যখন সে কার্ড দেখালো, ভিতরে জানাতে কিছুক্ষনের মধ্যেই তাকে ভিতরে ডাকল,গিয়ে সে যাকে দেখল,সে আর কেউ নয়,রায়হান,এই অফিসের বস,কিছুক্ষণ কথার পর তার হাতে এপয়েন্টমেন্ট লেটার তুলে দিয়ে বলল কাল থেকে জয়েন করবেন ।
সাজিয়া কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবে বুঝতে পারছে না, তার চোখে পানি চলে আসল ।
তখন রায়হান ম্যানেজারকে ডেকে সাজিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিল এবং পুরা অফিস ঘুরিয়ে দেখাতে বলল ।
পরদিন সকালে সাজিয়া ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য বের হয়ে গেল দেরি হবে ভেবে, বের হয়ে অবাক হল রায়হান গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে দেখে,
কি হলো, আসুন, দেরি হয়ে যাবে ।
সাজিয়া উঠে পাশের সিটে বসল,তারপর একটা দুটো কথা হলো ।
অফিস ছুটির পর ও প্রায় রায়হান সাজিয়াকে হোষ্টেলে পৌঁছে দেয়,
এভাবে কয়েক মাস কেটে গেছে, ওদের বন্ধুত্বটা ধীরে ধীরে বেড়ে এখন অনেক দূর এগিয়েছে । বিশ্বাস আর ভালোবাসার বন্ধনে তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ।
সাজিয়া মাঝে মাঝে ভাবে অপূর্ব কে তো সে অনেক ভালোবাসত,বিশ্বাস করত তাহলে কেন,কিসের মোহে সে সাজিয়াকে ঠকালো ?
এদিকে রায়হান,যাকে সে চিনত না,জানত না,প্রথম বার যার সাথে কথা বলতে ও ইতস্তত বোধ করেছিল,সেই আজ তার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত, ভরসার জায়গা, যে তার নষ্ট হয়ে যাওয়া সেই সন্ধ্যা টা কে ভোরের শুভ্রতায় ঢেকে রাখে ।
আসলে পৃথিবীতে কিছু মানুষকে আমরা কখনো হারাতে চাই না,বিশ্বাস আর ভালোবাসার বন্ধনে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে রাখতে চাই, তবু্ও সে হারিয়ে যায়,কখনো বা নিয়তি র টানে আবার কখনো নিছক ভুল বুঝাবুঝি বা অন্য কিছুর মোহে ।
আবার কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এমন কেউ জীবনে চলে আসে যে, একসময় সেই হয়ে উঠে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত, প্রিয়জন ।
এমনি ভাবেই সাজিয়ার জীবনের গল্পটা নতুন প্রান পেয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে রায়হানের আবির্ভাব এ, যাকে সে হারাতে চায় না কোনকিছুর বিনিময়ে ।
লেখক: কবি ও ছোটগল্পকার