সাইফুল ইসলাম তানভীর
গত ২৫ জুন ২০২০ রাতে টোয়েন্টিফোর নিউজ টি ভি তে সংবাদ দেখছিলাম। উত্তরাঞ্চলে বন্যা চলছে সেটার লাইভ প্রতিবেদন দেখাচ্ছিল। সেখানের একটি দৃশ্য দেখে শৈশবের গ্রামীন কথা মনে পড়ল ! দৃশ্যতে দেখা গেল এক মহিলা পানি থেকে ছাবি টেনে উঠাচ্ছেন। ছাবি কি জিনিস তা অনেকেই জানেনা ! এখন গ্রামে ছাবি তেমন দেখা যায়না। আমাদের বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলে। পানির এলাকা। মাছের এলাকা। বিভিন্নভাবে মানুষ মাছ শিকার করেন। সাধারণত পুরুষ লোকেরাই মাছ শিকার করে থাকে। মশারীর কাপড়ে ভালো ছাবি হত। তবে অন্যান্য পাতলা সুতির কাপড় দিয়েও ছাবি তৈরি হত। সাদা কালো যুগে গ্রামে এই ছাবি দিয়ে অনেক নারীদের মাছ শিকার করতে দেখতাম। হয়ত এটা বি2ওতবে নারীরাও মাছ শিকার করতেন। সেটা ছাবি দিয়ে। সাদা কালো এনালক যুগে গ্রামে মানুষ সুতির কাপড়ের মশারী ব্যবহার করতেন। সেই মশারী পুরোনো হয়ে গেলে সাইজ করে কেটে সেটা দিয়ে ছাবি তৈরি করতেন নারীরা। হয়ত ছাবি এখনো বিলুপ্ত হয়নি। বিলুপ্ত যে পুরোপুরি হয়নি সেটা সেদিন টিভির প্রতিবেদন দেখেই বুঝলাম !বাঁশের চটি দিয়ে চৌকা করে কাপড় সংযোগ করে ছাবি তৈরি হত। সেটা একটা লাঠির সাথে লম্বা রশি দিয়ে বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হত। ছাবি জোয়ারের সময় পাতা হত। ছাবিতে ধানের কুড়া ভাত ইত্যাদি খাবার দিয়ে রাখা হত ! এটা মাছ শিকারের একটা ফাঁদ ! যেখানে স্রোত কম সেখানে ছাবি পাতা হত। কারন স্রোতে ছাবি এলোমেলো করে দেয়। ছাবি পেতে রাখার পর আধাঘন্টা পর ধীরে ধীরে লাঠি দিয়ে টেনে পানি থেকে উঠানো হত। বোকা মাছগুলো ধরা খেত ! এই বোকা মাছদের মধ্য বেশীরভাগ চিংড়িই থাকত ! চিংড়িকে বৈজ্ঞানিক ভাবে মাছ বলা হয় না ! তবে বাংলাদেশে এটা মাছ হিসেবেই পরিচিত। যেমন চা ফ্লুইড খাবার। চা পান করার কথা মানুষ খুব কমই বলে। চা খাওয়াই বেশী বলে ! চিংড়ির দশাটাও সেরকম হয়েছে ! যাইহোক ছাবিতে আরো বিভিন্ন মাছ উঠত। ছোট ছোট মাছ। কোন কোন নারীরা একাধিক ছাবি বিভিন্ন পয়েন্টে পেতে রাখতেন। বিশেষ করে যেখানে মাছ শিকারের সম্ভাবনা থাকে। সাদা কালো যুগে হাইব্রিড মাছ আমাদের এলাকায় ছিল না। ফরমালিন মাখা মাছ ছিল না। তখন অনেক পরিবারের খাবারের প্রোটিনের চাহিদা এভাবেই মিটানো হত। কোন কোন দরিদ্র পরিবারের নারীরা ছাবি দিয়ে মাছ শিকার করে সেটা বিক্রিও করত। সেটা দিয়ে চাউল কিনত। অন্যান্য চাহিদা পূরণ করত। ছাবি দিয়ে মাছ শিকার উঠতি বয়সের ছেলেরাও করে। এতে বেশি মজা পাওয়া যায়। শৈশবে এরকম আমিও করেছি। বড় বড় দেশীয় চিংড়ি, বেলে ইত্যাদি মাছের কথা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় ! আমাদের এলাকায় চিংড়ি মাছকে আঞ্চলিক ভাষায় চিঙগইর মাছ বলে ! নোয়াখালীর মানুষজন বলেন ইছা মাছ ! নারীদের মাছ শিকারের এই ফাঁদ এনালক যন্ত্রটাকে আমাদের এলাকায় ছাবি বলে। অন্যান্য এলাকায় কি বলে সেটা আমার জানা নেই !ছাবিকে পানিতে ডুবাতে হলে ছাবির মাঝখানে (যেখানে মাছের জন্য খাবার দেয়া হয়) সেখানে ইটের ভাঙ্গা টুকরা, পাথর, মাটির তৈরী ব্যাবহারিক জিনিসের টুকরা অংশ ইত্যাদি ওজনওয়ালা কিছু দিতে হয়। ছাবি দিয়ে শিকার করা মাছ তেমন আহত হয় না! অক্ষত থাকে। মাছে আঘাত কম পায়। ছাবি তোলার সময় চিংড়ি মাছের লাফালাফিটা থাকে বেশ চমৎকার। কৈ মাছ, শিং মাছ, বাইন মাছ; কোন কোন ক্ষেত্রে শৈল মাছ ইত্যাদিও মাঝে মাঝে ছাবিতে ধরা পড়ে! তবে সেটা খুব কম। এমন মাছ ছাবিতে ধরা পড়লে আনন্দের হৈচৈ পড়ে যায়! অতীতে ছাবির মাছ দিয়ে মাছের অভাব পূরণ করেছে বহু পরিবার। তখন পানিতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। যেসব মাছ ছিল দেশীয় এবং অর্গানিক। হাওর, বাওড়, খাল পুকুর অন্যান্য ডোবাতে ছাবি পাতা হত। ছাবির মাছ রান্না করে খেলে বেশ মজা লাগে। ছাবির চিংড়ি দিয়ে কচুর লতি রান্না করলে বেশ মজাদার হয়! ছাবির তাজা চিংড়ি মাটির চুলায় ভুনা করলে বা ভাজি করলে অনেক মজাদার হয়। আর সেই সিজনটা বর্ষাতেই। বর্ষা মৌসুমেই ছাবি বেশি পাতা হয়। নতুন প্রজন্ম অনেকেই ছাবি হয়ত চিনবে না। তবে তাদের চেনার দরকার আছে। কোন সময় হয়ত জাতীয় জাদুঘরে ছাবি স্থান পাবে!