মাওলানা ইব্রাহিম খলিল মাহমুদী
হজ্জের মহত্ত্ব ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে ভূমিকা :- ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে ৫ম স্তম্ভ হচ্ছে হজ্জ। হজ্জ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা বা সংকল্প করা আর ইসলামী পরিভাষায় তাকে হজ্জ বলা হয়। হজ্জের মাস সমূহে বিশেষ কিছু কার্যাবলীসহ বিশেষ স্থানের যিয়ারত করা ।(নুরুল ইযাহ, হজ্জের অধ্যায়) আরেকটু বিশ্লেষন করে এভাবে বলা যায় যে,জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে মক্কার প্রান্তরে “আরাফাত” নামক স্থানে অবস্থান করা এবং এর আগে ও পরে কাবাঘর তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা, মিনায় অবস্থান করা, মিনার জামারাতগুলোতে কাকর নিক্ষেপ করা, হজ্জের কুরবানী বা হাদী জবাই করা, মাথা মুন্ডন করা এ সকল কর্মের মধ্যে আল্লাহর যিকির করা, দোয়া করা ইত্যাদি হলো হজ্জের কাজ। হজ্জ ফরজ এর শর্ত :- হজ্জ ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত ৮টি প্রয়োজন। ১। মুসলমান হওয়া। ২। জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া। ৩। প্রাপ্ত বয়স্ক বা বালেগ হওয়া। ৪। আযাদ তথা স্বাধীন হওয়া। ৫। হজ্জ পালনের ওয়াক্ত হওয়া। ৬। মধ্যম ধরনের ব্যয় বহনের সামর্থ থাকা, যদিও সে মক্কায় অবস্থানরত হয়। ৭। যে ব্যক্তি অমুসলিম দেশে ইসলাম গ্রহণ করেছে তার কথা জানা থাকা যে একটি ফরজ কাজ অথবা হজ্জ পালনকারীর মুসলিম দেশের অধিবাসী হওয়া। ৮। যারা মক্কায় অবস্থানকারী নয় তাদের জন্য শর্ত হলো মালিকানা সূত্রে অথবা ভাড়ায় স্বতন্ত্র কোনো সওয়ারী বা সওয়ারীর অংশ বিশেষ ব্যবহারের সামর্থ্য থাকে আর যারা মক্কার আশেপাশে অবস্থানরত তাদের উপর তখন হজ্জ ফরজ হয় যখন তারা শাররিক শক্তি ব্যয় করে এবং পায়ে হেটে বিনা কষ্টে হজ্জ করতে সক্ষম হয় অন্যথায় সওয়ারীর ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। আর উপরোক্ত হজ্জের সফরের সমর্থক ফিরে আসা পর্যন্ত তার নিজের ও পরিবারের এবং নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি থেকে অতিরিক্ত হতে হবে যেমন আবাস গৃহ ঘরের আসবাবপত্র পেশাজীবীদের হাতিয়ার ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি। হজ্জের ওয়াজিব সমূহ :- হজ্জ আদায়ের ওয়াজিব হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে পাঁচটি। ১। শরীর সুস্থ হওয়া। ২। হজ্জে গমনের বাহ্যিক বাধা না থাকা। ৩। পথ নিরাপদ হওয়া। ৪। নারীদের বেলায় ইদ্দত পালন অবস্থায় না হওয়া। ৫। নারীদের বেলায় সফরে তার সঙ্গে কোন প্রাপ্তবয়স্ক বিবেকবান আস্থাভাজন মুসলমান মাহরাম পুরুষ বিদ্যমান থাকা চাই দুগ্ধ সূত্রে মাহরাম হোক অথবা বৈবাহিক সূত্রে।একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য তৈরি প্রথম ইবাদত গৃহ হলো পবিত্র কাবাঘর । তাওহীদ বা একত্ববাদ এর চূড়ান্ত বিজয়ের সূচনা হয় ইব্রাহিম (আঃ) এই ঘরের নির্মাণের মধ্য দিয়ে, আর এর সমাপ্তি ঘটে মহানবী (সঃ) কর্তৃক পবিত্রতা ও তাওহীদি ধর্মের ইসলামের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। হজ্জের মাধ্যমে আমরা এই দুই মহান রাসূলের অগণিত নিদর্শন দেখতে পাই। হজ্জের মাধ্যমে একজন মানুষের ঈমানের পরীক্ষা হয়। হজ্জের মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিকতা প্রশস্ততা লাভ করে মানব কূলের সকল জাতি ও বর্ণের পাশাপাশি সমাবেশ ঘটে। পরস্পরে বর্ণগত, ভাষাগত, জাতিগত, ব্যক্তিগত হিংসা, বিদ্বেষ ও রেষারেষি হজ্জ পালনকারীর হৃদয় থেকে মুছে যায়। সে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে বিশ্ব কত বড় আর সকল মুসলিম কত আপন। মুসলিম জাতির মধ্যে সাম্য ঐক্য ও সহযোগিতার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।হজ্জ কার উপর ও কত বার ফরজ :- মক্কা মুকাররমা পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম এমন প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও মহিলার জন্য জীবনে একবার হজ্জ আদায় করা ফরয, বারবার হজ্জ করা মুস্তাহাব। কেউ হজ্জের ফরজ কে অস্বীকার করলে তাকে মুসলিম বলে গণ্য করা হয় না। আর যদি কোন সক্ষম ব্যক্তি ফরজ সত্ত্বেও তা আদায় না করেন তাহলে তিনি কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত হবেন এবং ঈমান নষ্ট হওয়ার ভয় রয়েছে। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনুল কারীমে বলেন, বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির উপর আল্লাহর জন্য হজ্জ আদায় করা ফরয। (সূরা আল ইমরান আয়াত ৯৭)। আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন:- হজ্জের সময় নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস। অতএব এ মাস গুলিতে যে হজ্জ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো তাকে হজ্জে অশ্লীলতা, পাপ- অন্যায় ও কলহ-বিবাদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে হবে ।আর তোমরা যা ভাল কাজ করো আল্লাহ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয় গ্রহণ করো আর তাকওয়া বা আল্লাহভীতি ও আত্মসংযমী শ্রেষ্ঠ পাথেয় এবং বিবেক সম্পন্নগন তোমরা আমাকে ভয় করো।( সূরা বাকারা আয়াত ১৯৭) হজ্জের শিক্ষা :- হজ্জ আপনাকে কি শেখাল? শেখাল আমিত্ব বা অহমিকা বর্জন করতে । আপনি লাখপতি, কোটিপতি, ধনী, ক্ষমতাবান ইত্যাদি সকল পরিচয় মুছে ফেলতে হবে। আপনি আপনার দেহ থেকে আমিত্ব খুলেছেন। ধনী, গরিব, ফকির, ক্ষমতাবান, দুর্বল, সাদা, কাল সকলেই একই প্রকারের অতিসাধারণ কাফনের কাপড়ের মতো কাপড় পড়ে হজ্জে সমবেত হয়েছেন। কিন্তু আপনি কি আপনার মনের মধ্যে থেকে আমিত্ব কে খুলে ফেলতে পেরেছেন? এটি হলো মূলত এক কঠিন কাজ। গায়ে কি পোশাক আছে খেয়াল থাকেনা। কিন্তু আমি যে, অমুক ধনী ক্ষমতাবান মানুষ তা আমরা ভুলতে পারিনা। কেউ অন্যায় করলে বা আমাদের আমিত্বকে আহত করলে রেগে উঠতে মন চায়। সাবধান ! নিজের আমিত্ব একেবারে ভুলে যান। মনে করুন এ ময়দানে আমিই সবচেয়ে বেশি গুনাহগার অন্য সকলেই আল্লাহর প্রিয় বান্দা । এ অনুভূতি দিয়ে সকলের খেদমতের চেষ্টা করুন এবং সকলের দেওয়া কষ্ট সহ্য করুন।হজ্জের অর্জন :- উপরের আয়াতে আল্লাহ তা’আলা হাজীদের জন্য দ্বিতীয় যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা হল, নিজের হৃদয়কে আল্লাহ ভীতি ও তাকওয়া দিয়ে পরিপূর্ণ ভরে নিতে হবে। হজ্জের সফরে তাকওয়া হলো সবচেয়ে বড় পাথেয়। জীবনে যত গুনাহ করেছেন তা থেকে অন্তর দিয়ে তাওবা করতে থাকুন। সগিরা কবিরা গুনাহ গুলোকে বিষের মতো মনে করুন। হজ্জের পুরো সফরে এবং বিশেষ করে আরাফাতের মাঠে, মুজদালিফায়, মিনায়, তাওয়াফ ও সায়ীর সময় নিজের গুনাহের কথা স্মরণ করে অনবরত অনুশোচনা করতে থাকুন। আর কখনো গুনা করবো না বলে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।হজ্জের আমলে সুন্নাতের গুরুত্ব :- হাজী সাহেবদের জন্য হজ্জের আহকাম গুলো সুন্দর ভাবে জেনে নেওয়া উচিৎ। বিশেষ করে সুন্নত জানার ও মানার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করা। অমুক কাজ জায়েজ, ভালো ইত্যাদি বিষয় দেখবেন না। বরং দেখবেন যে রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণ কোন কাজটি করেছেন। তারা যে কর্ম যেভাবে করেছেন হুবহু সেভাবে তা পালন করা। তারা যে কাজ করেননি তা বর্জন করা । এভাবে হুবহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরিকা অনুসারে ইবাদত পালন করতে পারা সৌভাগ্যের লক্ষণ। এতে রয়েছে কবুলিয়াতের নিশ্চয়তা বিশেষত মদীনা শরীফে ইবাদত-বন্দেগী জিয়ারত দোয়া ইত্যাদি সকল বিষয়ে অবশ্যই হুবহু সুন্নাতের মধ্যে থাকবেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য ইমাম সংকলিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :- আইর থেকে অমুকস্থান পর্যন্ত মদিনার সমস্ত এলাকা মহাসম্মানিত হারাম বা পবিত্র স্থান। এই স্থানের মধ্যে যদি কেউ নব উদ্ভাবিত কোন কর্ম করে, অথবা কোন নব উদ্ভাবক কে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় তাহলে তার উপর আল্লাহর লানত, ফিরিশতাগণের লা’নত এবং সকল মানুষের লা’নত। তার থেকে তাওবা কাফফারা বা ফরজ নফল কোনো ইবাদতই কবুল করা হবে না ( বোখারী, আস-সহীহ ২/৬৬১ ,৬/২৪৮২ মুসলিম,আসা -সহীহ ২/৯৯৫’১১৪৭) বড় ভয়ঙ্কর কথা। এত কষ্ট করে সওয়াব অর্জনের জন্য সেই পবিত্র ভূমিতে যে অভিশাপ অর্জন করে আসা! আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, হাজীরা মদিনায় গেলেই নব উদ্ভাবিত কর্ম করেন। মসজিদে নববীতে, রওজা শরীফে, জান্নাতুল বাকী গোরস্থানে ,ওহুদের শহীদদের গোরস্থানের, খন্দকের মসজিদগুলোতে ও কুবা অন্যান্য মসজিদে ও অন্যান্য জিয়ারত, সালাত ,দোয়া ইত্যাদি ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে হাজীগন আবেগ ও অজ্ঞতার সংমিশ্রণে অনেক ভাবে সুন্নতের ব্যতিক্রম নব উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তাই সাবধান হোন!জিয়ারতের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলতেন কিভাবে দাঁড়াতেন কি করতেন তা সহি হাদিসের আলোকে জেনে নিন। কুবা, খন্দক কিবলাতাইন ও অন্যান্য স্থানে ও সালাত আদায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণের হুবহু পদ্ধতি সহি হাদিসের আলোকে জেনে নিন। তারা যা করেননি তা পরিত্যাগ করুন। চাপ কমাতে গিয়ে অভিশাপে ধ্বংস কামাই করবেন না। হজ্জ করার ফজিলত এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও না করার ভয়াবহ পরিণাম :- ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা,সাম্যের ধর্ম, ইসলাম জোড়পূর্বক কোন বিধান কারো উপর প্রয়োগ করে না। হজ্জ ইসলামের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান যা বান্দাকে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের অন্যতম একটি মাধ্যম। হজ্জ পালনের মাঝে রয়েছে অনেক সওয়াব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিবেদিত ভাবে সর্বপ্রকার পাপ অন্যায় ও অশ্লীলতামুক্ত হয়ে হজ্জ আদায় করল,সে যেন নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরল”(সহি বুখারী ২/ ৫৫৩)। একবার উমরা আদায়ের পড়ে দ্বিতীয়বার যখন ওমরা আদায় করা হয়, তখন দুই উমরার মধ্যবর্তী গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। আর পূণ্যময় পরোপকারময় হজ্জের একমাত্র পুরস্কার হলো জান্নাত (সহিহ বুখারী ২/৬২৯ সহীহ মুসলিম ২/৯৮৩) রাসুল আরও বলেন তোমরা বারবার হজ্জ ও ওমরা আদায় করো কারণ কর্মকার ও স্বর্ণকারের আগুন যেমন লোহা ও সোনার উপর ময়লা মুছে ফেলে তেমনি ভাবে এ দুই ইবাদত দারিদ্র ও পাপ মুছে ফেলে। আর পুণ্যময় পরোপকারময় হজ্জের একমাত্র পুরস্কার হলো জান্নাত। (তিরমিযী আস-সুনান ৩/১৭৫) আর হজ্জ ফরজ হওয়ার পরেও হজ্জ না করে মৃত্যুবরণ করা কে কোন কোন হাদিসে ইহুদি খ্রিস্টান হয় মরা বলে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে বান্দার শরীর আমি সুস্থ রেখেছি এবং তার জীবনযাত্রায় স্বচ্ছলতা দান করেছি এভাবে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সে আমার ঘরে আগমন করল না সে সুনিশ্চিত বঞ্চিত হতভাগা। মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক ও সহি সুন্নত তরিকা মত হজ্জ করার তৌফিক দান করুন, আমিন।