ইমরান খান রাজ
হঠাৎ ফোন কলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো মারুফ সাহেবের। চোখ খুলতেই দেখলো ঘড়ির কাটায় মাত্র সকাল ৭টা বাজে। এত সকালে কে ফোন দিলো ? নিজেকেই নিজের প্রশ্ন ! ঘুম চোখে বিছানায় শুয়েই ফোন রিসিভ করলো সে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করলো মারুফ সাহেব বলছেন ? জ্বি বলছি। আপনি কে বলছেন ? ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আবার বললো, আমি মো. শাকিল। ‘স্বপ্ননীর বৃদ্ধাশ্রম’ থেকে বলছি। আপনার বাবা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে কয়েকদিন পূর্বেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। হাসপাতালে ভর্তির সময় আপনাকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও কোন সাড়া পাইনি আমরা। আপনার বাবার বর্তমান অবস্থা খুব বেশি ভালো নেই। সে আইসিইউ’তে ভর্তি রয়েছেন। নিজ সন্তানকে শেষবারের মতো দেখতে চাইছে। আপনি কি আজ বিকালে হাসপাতালে আসতে পারবেন ? মারুফ সাবেক ক্ষানিকটা সময় চুপ করে থাকার পরে জানালেন, যদি সময় পাই তাহলে একবার যাবো হাসপাতালে বাবাকে দেখতে। তবে কাজের প্রচুর চাপ ! এত বড় বিজনেস একা সামলানো অনেক কষ্টকর। এটা বলেই ফোন রাখলেন মারুফ সাহেব। বাবার অসুস্থতার কথা জানালেন তাঁর স্ত্রীকে। স্ত্রী তাঁর কথায় কর্নপাত না করেই সোজা চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে। আর যেতে যেতে বললো, তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে নাও। মনে আছে আজ ছুটির দিনে আমাদেরকে শপিংয়ে নিয়ে যাবার কথা ছিলো ? এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে ? নাহ নাহ ! মনে আছে ভুলিনি। অবশ্যই নিয়ে যাবো। তুমিও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও আর মেয়েটাকেও ঘুম থেকে ডেকে তুলো। হাসপাতালের আইসিইউ’তে শুয়ে নিজের অন্তিম সময় গণনা করতে করতে চোখের কোনে জল গড়িয়ে এলো মারুফ সাহেবের বাবা লিয়াকত আলীর ! জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই আনন্দময় মুহূর্তের অনুভূতিগুলোর কথা। এইতো কয়েকবছর আগের কথা। বিশাল ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি, ধনসম্পদ কোন কিছুরই কমতি ছিলো না। জীবনে কোন কিছুর অভাব অনুভব করেনি সে ! অথচ আজ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে মৃত্যুর অপেক্ষায় ! এটাই কি তার প্রাপ্য ছিলো ? নিজের একমাত্র ছেলেকে ভালোবেসে, ভরসা করে সকল সম্পত্তি লিখে দেন তিনি। আর হঠাৎ এক এক্সিডেন্টে স্ত্রীকে হাড়িয়ে চিরতরে একলা হয়ে পড়েন তিনি। দুর্ঘটনায় পঙ্গু হবার পর নিজ বাড়িতেই স্থান পায়না সে। নিজের একমাত্র ছেলেই একদিন তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসেন। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ লিয়াকত আলী সাহেব শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। কোন একসময়ের সবচেয়ে সুখী মানুষটি আজ এক পৃথিবী কষ্ট নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় হলেন। বাবার মৃত্যুতে বৃদ্ধাশ্রম থেকে পুনরায় ফোন যায় মারুফ সাহেবের মোবাইলে। তখন সে তাঁর স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে শপিংয়ে ব্যস্ত। বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে এবং জানাযায় উপস্থিত থাকতে বলার পর মারুফ সাহেব জানায়, দেখুন আমার বাসায় ছোট মেয়ে রয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্তান্ত মৃত ব্যক্তিকে দাফন করতে গিয়ে যদি আমিও আক্রান্ত হই তাহলে আমার স্ত্রী সন্তানের কি হবে ! মারুফ সাহেবের এমন উত্তর পেয়ে ফোন রেখে দেন বৃদ্ধাশ্রমের ঐ কর্মকর্তা। লিয়াকত আলী সাহেব’কে বৃদ্ধাশ্রমের পাশেই ‘জান্নাতুল বাকি’ নামক একটি কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।