নূরে জান্নাত
ওনাকে তখন চিনতাম না। অথচ নিয়ম করে সকাল সন্ধ্যে চায়ের দোকানে দেখা হতো। তৃতীয় দিন থেকে খেয়াল করলাম, উনি আমার আগে থেকে চায়ের দোকানে বসলেও চা খেতেন না! দূর থেকে দেখেছিলাম আমার চা খাওয়া শেষে উনি চা খেতেন। বন্দি জীবন চলছে আজ কিছুদিন হলো! জনবহুল রাস্তা হয়ে উঠেছে সুনসান।এক দুজন যা দেখছি হ্যান্ড গ্লোবস,মাস্ক মুখে তারাহুড়োয় মাত। যেন অশরিরী তেড়ে আসছে তাদের দিকে। চিন্তা, স্বপ্ন, ইচ্ছেগুলোও কাঁথামুড়ে লুকিয়ে আছে।ওদেরও যেন সাম্প্রতিক করোনা নামক অশরিরী ছুঁয়ে বসবে! মেঘেদের জ্বর,পৃথিবীর উত্তাপে। জানালার কাঁচ ছুঁয়ে ভয় মুক্ত পৃথিবী আঁকছি, একটি মুখ ও দু মুঠো স্বপ্নের রুমুন্থন।আজ অনেকদিন পর সন্ধ্যে বেলায় চায়ের দোকানের ২৫ ওয়াটের বাল্বটা জ্বলতে দেখছি! আমি ঘর ছাড়লাম! চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ভয় নেই প্রাণের? প্রশাসনের আইন জানা নেই! সেনাবাহিনী এলো বুঝি! ঘরে চাউল নাই আপামুণি! আংগোর মত গরীবের জইন্যে সরকার যে চাউল দেন,তা আমাগোর হাতে আসার আগেই শ্যাষ হয়া যায়।চা দিমু আপামুণি? না। এই সমায় বাইরে আইছেন ক্যা? — জানি না, কেন যেন তোমার দোকানের ২৫ ওয়াটের লাল আলোটা আমাকে টেনে আনলো! _ আপামুণি? হু,বলো? চাউল আছে আপনেগোর ঘরে? হ্যাঁ, চলছে ভর্তা ছানায়। সামনে কি হবে জানিনা! _ আমারে কয়ডা চাউল….! আচ্ছা, ঠিক আছে। _ আপামুণি বউ আর ছোট মিয়াডা আপনেরে দেখতে চায়ছে । ম্যলাদিন দ্যাহে না। জানেন, বড় বাড়ি ট্যাহা পামু। চেইবার গেছিলাম, দাড়োয়ান গেট খুল্লোইনা, ভেত্রে যেইবারি দিলনা, ফুঁডা দিয়া কতা কইলো। চোইলা যেইত্যাছেন? হ্যাঁ, পৃথিবীর থমথমে ভাব আমার ভালো লাগছে না। আপনের হেই ভাইসাবডা কেবা আছে? কোন ভাইসাব?আমারতো কোন ভাই নেই! হেই ভাইসাব, চীনে যহন করোনা শুরু হইলো, ম্যলা মানুষ মইরলো, হেই সমায় আংগোর পাড়ায় নতুন ভাইসাব আইলেন যে! বুঝতে পারছিনা, কার কথা বলছো? ঐ যে, চা খাইতো আপনের মতন, ভিয়ান বেলা, আর সন্ধ্যা বেলা। — ও………!!!!! ওনিতো কইছিলেন, ওনি আপনের আপনজন হয়া গ্যাছেন। আপনে চা খাওনের পর কাপ ধূইতেও দিত্যান না। কাপের তলানিত পইরা থাকা চা শুদ্ধাই চা খয়তেন। ওনার আর আপনের জন্যেই কাপখান বরাদ্দ আছিলো। শ্যাষবার দ্যাশ লক ডাউনের আগের দিন এইসা কাপখান কিনা নিয়ে গ্যালো। এর মদ্যে আর আছিলো কিনা জানি না।আমার দোহানিতো বন্দ থাকে। আসেন নি উনি! আপনেরে কইছেন ওনি? না, আমার জানালা থেকে তোমার দোকান খুব ভালো দেখা যায়। ভালা আছেন ওনি? জানি নাতো! সেনাবিহীনির গাড়ি হুইসেল দিয়ে ওঠে! লোকজন এক দুজন যা ছিলো ঘুপচি ঘাপচিতে লুকিয়ে পরে।চায়ের দোকানের আলো নিভে , ধাপার বন্ধ হলো।আমি হাঁটছি দ্রুত পায়ে ঘরের পথে…. আমার সামনে গাড়ি এসে থামলো! আমাকে নিরীক্ষার জন্য কপাল বরাবর পিস্তলের মত ছোট্ট মেশিন ধরা হলো! কেউ আমায় চরম ভাবে শাসাচ্ছিলেন! যখন আমার হাতে জীবানু নাশক স্প্রে করে, মাস্ক ধরিয়ে দেওয়া হলো তখন পেরে উঠলাম না চোখের জলের সাথে। প্রচণ্ড কাঁদছিলাম।আমার সামনে আরেকজন ব্যক্তি এসে দাঁড়ালেন। আমি ঝাপসা চোখ জলশূন্য করতে চেষ্টা করছি। তিনি বল্লেন আপনাকে তো খারাপ কিছু বলা হয়নি,আপনি কাঁদছেন কেন? বিনা প্রয়োজনে প্রটেকশন ছাড়া রাস্তায় বের হবেন না। প্রটেকশনে কি হবে? কদিন পরেইতো ভাতের অভাবে না খেয়ে, প্রিয়জনের অভাবে হৃদয় শুকিয়ে মরতে হবে। কত দিন? কতজনকে প্রটেকশন দিয়ে বাঁচাতে পারবেন? আমাদের শেষ নিঃশ্বাস থাকা অব্দি, যতদিন, যতজন কে পারি। উনার কথাগুলো বলার পর উনার হৃদপিন্ডের পুরুত্ব মাপতে চোখ তুলে তাকাচ্ছিলাম।উনার দিকে চোখ যাবার আগেই বুকের উপর থেকে নেমপ্লেট খুলে ফেল্লেন। মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে জোর করে মৃদু হাসলেন।গাড়ির হুইসেল বেজে উঠলো।নিমিষেই উনার কপালের রগ ফুলে উঠে চোখ দুটো রক্ত বর্ণ হয়ে গেল।”ভালো থাকবেন” বলেই ছুটে গাড়িতে উঠে পরলেন।গাড়ির পেছনের লাল আলো ও উনি অন্ধকারে বিলিন হলেন। আমার মন বাঁশিতে করুণ সুরে বেজে উঠলো মুজিব পরদেশীর গানের সুর…. আমি কেমন করে…… পত্রলিখিরে…. বন্ধু….. গ্রাম পোষ্ট অফিস নাই জানা, তোমায় আমি হলেম অচেনা!
লেখক: গল্পকার