নাজনীন তৌহিদ
নানা বাড়ি কাকে বলে তখনও আমার তা জানা হয়নি। কে আমার নানা, কোথায় নানা বাড়ি তাও তখন জানি না। কেননা আমার কৈশোরে দোল খাওয়া চৌদ্দ বছর বয়সে কোনো দিন মাকে নাইওর যেতে দেখিনি।
বাপের বাড়ি যাবার আকাঙ্খা, সাধ-আহ্লাদ আমার মায়ের কোনো দিনই বোধকরি ছিল না, তাই আমাদেরও যাওয়া হয়নি নানা বাড়ি! আমার ছোট চাচি বেশ ঘটা করে বছরে দুতিন বার তার বাপের বাড়ি যেত। যেদিন সে বেড়াতে যেত তার এক সপ্তাহ আগে থেকেই তার প্রস্তুতি চলত। চাচাতো ভাই বোনদের সেকি আনন্দ! বড় নৌকা ভাড়া করা হতো। রান্না বান্না করে সাথে তো নিতই এছাড়াও মাটির চুলা, কাঠখড়ি রান্নার হাঁড়িকুঁড়ি ও আসবাবপত্রও সাথে নিত। তার বাপের বাড়ি যেতে নাকি নদী পথে দুতিন দিন লেগে যেত। তাই এত যোগাড় আয়োজন চলত। যাবার পথে নদীর বাঁকে বসা হাট থেকে বড় ইলিশ মাছ কিনে নৌকায় ভাজা- রান্না করে খেতে খেতে যেত। চাচাত ভাই বোনদের মুখে এসব গল্প শুনে কেবল অতৃপ্তের ঢেকুর তুলে সে সাধ নিতাম। শুধু তাই নয়, চাচির বাপের বাড়ির লোকজনও মাঝে মধ্যে আসত। টিনে ভরা চিড়া, মুড়ি, খৈ, পাকা কলা কত কী আনত! চাচিদের ঘর থেকে ঘিভাত রান্না, ডিমের কোরমা আর বড় মোরগের ঝাল রান্নার গন্ধে বাড়ি যেন তলিয়ে যেত।
নতুন কুটুমেরা এলে আমরা চাচার বাড়িতে যাবার জন্য ফাঁক ফোকর খুঁজতাম কিন্তু আমার মা হাত চেপে ধরত, সেদিকে পা বাড়াতে দিত না। তখনও বুঝতাম না মায়ের কিসের এত কষ্ট, কী আড়াল করে চলে নিত্যদিন! সেই মা, আমাদের মা আজ বাপের বাড়ি যাবে! কথাটা আমার বিশ্বাস হলো না।
সেদিনের রাত গড়িয়ে তখন মাঝ রাত, মা তখনো ঘরে ফেরেনি। অজানা আশঙ্কায় আমার বুকের মধ্যে ধুক ধুক কাঁপনি শুরু হয়েছে। দিপু বলল, আপা এই বাড়ি, ওই বাড়ি কইরাতো সব জাগা খোঁজা হইল। আমি কোনো উত্তর দিচ্ছি না দেখে কী মনে করে হঠাৎ করেই আবার বলে বসল, আপা আম্মা মনে হয় নানা বাড়ি গেছে!
আমি কথাটা গা করলাম না তবু মনের গভীরে কী একটা খটকা লাগল তাই ঘরের দিকে পা না বাড়িয়ে বললাম, চল! নানা বাড়ি যাইয়া আম্মারে খুঁইজা আনি। হারিকেনটা কানের কাছে নিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে দেখে নিলাম যতটা কেরোসিন আছে তাতে মাইল ছয়েকের পথ যাওয়া আসা যাবে কিনা। মনে হলো আর খানিকটা তেল ভরা দরকার, কিন্তু ঘরে ঢোকা যাবে না, মনে হচ্ছিল আব্বা ঘুমায়নি।
মিতু ক্ষুধার জ্বালায় কিংবা আম্মার জন্য বিড়াল ছানার মতো একটানা কেঁদেই যাচ্ছিল, আব্বা এমন জোরে ধমক দিল যে তিন বছরের মিতু প্যান্ট ভরে প্রস্রাব করে ঘরের মেঝে ভাসিয়ে দিল। সেই প্রস্রাব ঘরের দাওয়ায় এসে গড়িয়ে আমার পা দুটো ভিজিয়ে নিল। আমি তবু ঠায় দাঁড়িয়ে।
সন্ধ্যার আগে আব্বা তালগাছ কাটা ছুরিটাকে ঘরের সিঁড়ির পাকা শানে বার কয়েক ধার দিয়েছে। আর বিড়বিড় করে আম্মাকে বিশ্রি ভাষায় গালাগাল করেছে। সেই দৃশ্য দেখে ভয়ে সব ভাই বোন চুপ হয়ে আছে তবে মিতু এখনো আম্মার বুকের দুধ খায় বলে ও আম্মাকে খুঁজছিল আর কাঁদছিল। আব্বার ধমকে সেই ছোট্ট মেয়েটাও এবার চুপ হয়ে গেল।
আব্বার অগ্নিমূর্তি ধারণ করা সেইবারই প্রথম নয়। তবে এমন দাও ছুরি নিয়ে মাথাগরম সেই প্রথম দেখলাম। শুনেছি আব্বার মাথায় নাকি গণ্ডগোল ছিল। ছেলেবেলায় দূরের কোনো এক মাদ্রাসায় পড়ত তখন সেই মাদ্রাসাওয়ালা বাড়িতে জায়গির থাকত। সাত বছর বয়সে তাদের মসজিদে ফজরের আজানও দিত। একদিন রাতের অন্ধকার মাখা ফজর লগ্নে ঘুম জড়ানো চোখে পুকুরের ঘাটে পড়ে গিয়েছিল আর সে থেকে নাকি জ্বিন ভর করেছে বলে মাথা খারাপের ব্যামো হয়েছে। ওতটুকো বয়সে গাঁওগেরামের সেই বিশ্বাস খণ্ডানোর মতো জ্ঞান আমার ছিল না তবে আব্বাকে সবাই ভয় করে চলত তাই আমরাও ভয় পেতাম। কিন্তু আব্বা পাগল এ কথা বিশ্বাস করতাম না।
ঘরের পাশে এসে দাওয়ার কোনে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি দেখে আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দিপু ফিস ফিসিয়ে বলল, হারিকেনে কেরোসিন ভরার দরকার নাই। ঘরের ভিতর ঢুকলে আর বাইর হইতে পারব না, শেষে আম্মারে না পাইয়া তোর আর আমার কল্লা নেবে আব্বা!
দিপুর কথা বলার ভঙ্গি শুনে এই ঘোরতরো বিপদের সময়ও আমার ভীষণ হাসি পেল কিন্তু গম্ভীর হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতর আব্বা কী করে তা বোঝার জন্য কান খাড়া করে রাখলাম। রাতের বেলা আমাদের কারো খাবার খাওয়া হয়নি অথচ ঘটনাটা ঘটেছে সেই দুপুর বেলা। তখন মাত্র আম্মার দুপুরের রান্না শেষ হয়েছিল। কাঠের তেপায়া আল্টার উপর ভাতের মাড় ঝরতে দেওয়া পাতিলের দিকে তাকিয়ে আমাকে বলেছিল, ভাতের ফ্যান ঝারা হইলে পাতিলটা চুলায় আরেকটু স্যাকা দিয়ে নিস। সালুন-তরকারি কড়াইতে আছে, ভাইবোনদের নিয়া খাইতে যা, আমি নাইতে যাইতেছি এই বলে আম্মা সুপারি গাছের সাথে বাঁধা রশিতে ঝুলানো কাপড়, পেটিকোট নিয়ে গোসলের জন্য যখন পুকুরের দিকে পা বাড়ালো ঠিক তখনই আমার দাদির আগমন।
আমার দাদির সাথে আমার মায়ের সম্পর্কটা ঠিক কেমন তা আমি নিজেও জানি না। সাপে নেওলে কিংবা আদায় কাঁচকলা না হলেও গলায় গলায়ও না। আমার দাদি প্রায় একডজন সন্তানের গর্বিত জননী! আমার বাবা সবার বড়। মেজ, সেজ চাচা ছাড়া বাকি চাচা ফুফুদের নিয়ে তার বেশ বড় সংসার। তিনি পুরান বাড়ির মূল ঘরেই থাকেন আর আমরা এবং দুই চাচারা পুরান বাড়ির খানিকটা দূরে দূরে নিজ নিজ বাড়িতে থাকি।
আমার দাদি তার ছেলেদেরকে ভালোবাসলেও ছেলের বউ এবং নাতিরা যেন তার চোখের বিষ! নাতিদেরকে তিনি তার ছোট ছেলেমেয়েদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন। আর ছেলের বউয়েরা যেন তার প্রতিপক্ষ ছিল। তাই আমাদেরকে আপন ভাবতে পারেননি কখনওই। নিজের বাড়ির সম্পদ এমনকি গাছের আম, জাম, কলাটা পর্যন্ত তিনি এমনভাবে আগলে রাখেন যে নাতিরা তো দূরে কথা ভুল করে কোনো কাক পক্ষীও যেন ঠোকর বসাতে সাহস পায় না!
ঝড়ের দিনেও যদি বা নাতিরা বুড়ির গাছের দুটা আম কুঁড়িয়ে পায় বুড়ি তা নাতিদের পেট চিরে হলেও বের করে আনে আর বাড়ি শুদ্ধ লোককে চিৎকার চেঁচামেচিতে জাগিয়ে তোলে। এ নিয়ে বাড়ির ময়মুরব্বি পড়শিরাও বুড়িকে কটু কথা শুনিয়ে বলে যে এসব জিনিসে নাতিপুতিদেরও হক আছে কিন্তু তিনি কোনো হকের কথা শুনতে রাজি নন। তার মতে তার সব সম্পদের ভাগিদার একমাত্র তার ছোট ছেলেমেয়েরা। বড় তিন ছেলের যেহেতু আলাদা সংসার তাই এসবে তাদের কোনো অংশিদারিত্ব নেই। তবে তার বড় ছেলেরা মায়ের এই একচোখা ভালোবাসা নিয়ে মোটেও মাথা ব্যাথা করে না বরং মায়ের যেন কোনো অভাব অভিযোগ না থাকে সে ব্যাপারে তারা বেশ তৎপর থাকে বিশেষ করে তার বড় ছেলে মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে ষোল আনার জায়গা আঠারো আনা করেন কেননা তার ধারণা বাবা ছাড়া মা একা যে তার সংসারটা চালিয়ে নিচ্ছেন এই অনেক বেশি। আর তাই আমার মায়ের প্রতি বাবার কড়া নির্দেশ ছিল যে, আমরা খেয়ে থাকি কিংবা না খেয়ে থাকি তার মা যখন চা চাইবে তা পুরোন করতে হবে। যদিও আমার অন্য দুই চাচিরা ফাঁক পেলে দাদিকে ছেড়ে কথা বলত না কিন্তু আমার মায়ের সে উপায় ছিল না। একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালেও বাবা কড়া ভাবে মাকে শাসন করত। তবু নিত্যদিন বাবা চাচাদের ঘরে এই বউ শাশুড়ি নিয়ে অর্ন্তদ্বন্দ্ব চলতেই থাকে।
দুদিন আগে আমার ছোট দুভাই দিপু আর বিপু দাদির পুকুর ঘাটের গাছ থেকে দুটা কচিকাচা পেয়ারা পেড়েছিল বলে দাদি এ অভিযোগ বাবার কান পর্যন্ত তুলেছিল। বাবা শাসন করে দুটো ঘাইগুতো দিয়েছিলো। ছোট বাচ্চারা তা ভুলে গেলেও তাদের মা অর্থাৎ আম্মা তা ভোলেনি। দিনে দিনে শাশুড়ির প্রতি তার রাগের মাত্রাটা এমনিতেই বাড়ছিল তাই আজ তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই মা সবটুকো বিরক্তি নিয়ে ভ্রু আর মুখ কুঁচকে নিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, ঝোলার বুড়ি! এই দুফাইর কালে কোনডা বাজাইতে আইছে আল্লাহই জানে!
দাদি পেছনের দিকে এসে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে এক নজরে পুরোটা গিলে নিয়ে খাবার ঘরের দিকে নতুন কেনা মাটির কলশিটার দিকে বেশ তির্যক ভাবে তাকালো। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসের এই তপ্ত গরমে একটু ঠাণ্ডা পানি খাবার জন্য মা কালই কেবল কলশিটা কিনেছে। খালে নাও ভাসিয়ে মাটির বাসন কাসন ভরা কুমার বাড়ির মাঝি যখন হাঁক ডাক ছাড়ছিল তখন মাটির ব্যাংকে জমানো পয়সা দিয়ে মা একটি পানির কলশি আর একটি চিতই পিঠার খোলা কিনেছিল। খোলাটা চটে পেচিয়ে রান্না ঘরের উপর চালের তাকে রাখা হয়েছে তাই দাদি তা দেখতে পায়নি নইলে তার শকুনের দৃষ্টিতে তা এড়াবার জো ছিল না।
দাদি এবার একটু আমতা আমতা ভাবে বলল যে ওই কলশিটার মতো একটা কলশি তারও বেশ দরকার। যদিও দাদির এমন একটা নয় বেশ কয়েকটাই কলশি আছে আর তাছাড়া তার বেশি প্রয়োজন পড়লে তিনি হাট থেকে ছেলেদেরকে দিয়ে কিনে আনতেই পারতেন। অন্যদিকে আবার মাত্র দু পয়সার একটা মাটির পাত্র শাশুড়ি চেয়েছে বলে আমার মা দিয়ে দিতেই পারে কিন্তু আম্মা তা না করে মুখটি খেঁচিয়ে দুনিয়ার সবটুকো বিরক্তি টেনে না খোশ প্রকাশ করে বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলল, না! এইডা দেওয়া যাবে না। ক্যান? আপনার পুত্রধনেরা আছে না? তাগো দিয়া হাট দিয়া কিন্না নিতে পারেন না? আমর যা দ্যাখেন আপনার তাই লাগে…..।
আব্বাা তখন গোসল সেরে খেতে আসছিল। খালে গোসল করার সময়ই তিনি দাদিকে দেখে খুশি মনে ঘরে যেতে বলেছেন যে একসাথে খাবেন। কিন্তু গোসল সেরে ঘরে এসে দেখছেন মা দাদির সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলছে, তাও সামান্য দু পয়সার মাটির জিনিসের জন্য! এমনিতেই দুপুরের রোদে আব্বার মাথা বুঝি টগবগিয়ে ফুটছিল তাই এক কথা দু কথায় আব্বা আর আম্মার মধ্যে তুমুল লেগে গেল। গলার স্বর আর বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। ওঠা নামা করতে করতে তা বাড়ির সীমানা পার হয়ে দূরের মুল্লকে পৌঁছালো। বাড়ির আবহাওয়া যখন চরম উত্তপ্ত আমার দাদি তখন চুপিসারে কেটে পড়লেন।
আমার মায়েরও যে সেদিন কী হলো! সামান্য জিনিস নিয়ে বেঁকে বসল। এই সমাজে পুরুষ যত খুশি চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারে, প্রয়োজনে বউয়ের গায়ে হাত তুলতেও পারে কিন্তু বউয়ের প্রতিবাদের কোনো ভাষা দূরে থাক অনুচ্চ স্বরের উহ! আহ ও থাকবে না! চারপাশের পরিবেশ জুরে কেবল তাই দেখে এসেছি, তাই শুনে এসেছি। কিন্তু আমার মা বুঝি তার এতদিনের পুঞ্জীভূত রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ঢেলে দিয়ে আজ তার ব্যতিক্রম ঘটাল । কিছুটা প্রতিবাদী হয়ে বাবার কথার পিঠে কথা বলল। ফলাফলে উত্তপ্ত তেলের কড়াইয়ে দুফোটা পানি পড়ে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠল। বাবা তার ঔদ্ধত্য স্ত্রীকে বাগে আনার জন্য রান্না ঘরের বেড়ায় গুজে রাখা গাছি ছুরি-দাও টি পেয়ে একটানে তুলে নিল। আমি ভয়ে আব্বার পা জড়িয়ে ধরলাম আর আম্মা নিমিষের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে পড়ল।
এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা নামলো। চারিদিক অন্ধকারে ডুবে এলে আমরা ভাইবোনরা যখন মাকে খোঁজার জন্য ঘরের এদিক ওদিক উঁকি ঝুকি করছি তখন আব্বা ধমক দিয়ে ঘরে গিয়ে যে যার কাজ করতে বলল। আমি ঘরে আলো জ্বালানোর অজুহাতে ল্যাম্প, হারিকেন জ্বালিয়ে ঘরে বাইরে, উঠানে, পুকুর পাড়ে গুটি গুটি পায়ে ফিস ফিসিয়ে আম্মাকে ডাকছি কিন্তু আম্মার কোনো সাড়া শব্দ নেই। এই অন্ধকারে আম্মা কোথায় লুকিয়ে থাকবে চিন্তা করে কান্না পেল কিন্তু আব্বার ধমকে আবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। দিপুও আমার মতো আম্মাকে খুঁজতে বারবার ঘরের বাইরে বের হচ্ছে দেখে আব্বা বেশ কঠর ভাবে নির্দেশ দিল খবরদার এক পাও কেউ আর ঘরের বাইর হবি না। দিপুকে বিনা কারণে কষে গালে এক চড় লাগিয়ে বলল, যা পড়তে বয় । আইজ আমি তোর পড়া ধরব। আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, এক পাও কেউ ঘরের বাইরে রাখলে তার খবর আছে!
আমি, দিপু,বিপু টুলু,নিতু, মিতু এই ছয়ভাইবোন । ভাইবোনেরা সবাই পিঠেপিঠি এক দুই বছরের ছোট বড়। দিপু আর বিপু খাটের উপর বই নিয়ে আব্বার ভয়ে কেবল এ্যা-ও আওয়াজ করে পড়ার চেষ্টা করছে আর ফাঁকে ফাঁকে পুরোনো যে পড়া ভালো পারে তাই একটু আওড়াচ্ছে। আমার কিছুতেই বই ছুঁতে ইচ্ছে করছে না মায়ের চিন্তায় জোরে জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। প্রথমে ভেবেছিলাম মা বাড়ির পেছনে কোথাও লুকিয়ে আছে সন্ধ্যা হলে সুবিধা মতো সময়ে ঘরে ঢুকবে। ঘরের পিছনের বারান্দার দরজাটা আলগা করে ভিড়িয়ে রেখেছি যাতে মা ঘরে ঢুকতে পারে। বারবার সেদিকে তাকাচ্ছি কিন্তু না, মায়ের কোনো শব্দই নেই। ছোট ভাই বোনগুলোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। ভয়ে আর ক্ষুধায় মুখটা কেমন শুকিয়ে আমচুর হয়ে আছে তাই ওদেরকে খেতে দিলাম আর বাবার জন্য খাবার বেড়ে মনে মনে ফান্দি আঁটলাম যে, আব্বা যদি খেয়ে দেয়ে দুতলায় তার শোবার বিছানায় যায় তখন আমরা আম্মাকে ঘরে আনতে পারব। কিন্তু না! আব্বা বাইরের দরজাটা খোলা রেখেই সামনের বারান্দায় ঠায় বসে রইল, কাছে গিয়ে খেতে ডাকলেও খেতে আসল না।
আমাদের কাঠের তৈরি দুতলা ঘর। দিনের বেলা সবাই ঘরের ভিতর থাকলেও রাতের বেলা দুতলায় গিয়ে ঘুমাতাম। কিন্তু আজ সবাই নিচের ঘরেই চুপচাপ বসা। বেশ কিছুক্ষণ পর আব্বা কাঠের সিঁড়িটাতে বেশ শব্দ করে পা ফেলে উপরে উঠলো। তৎক্ষণাত আমি ছোট ভাই বোনদেরকে ঘরের ভেতরের খাটে ঘুম পাড়িয়ে বিপুকে ঘরের পাহারায় রেখে দিপুকে নিয়ে মাকে খুঁজতে বেরুলাম।
পুরান বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি খানিকটা দূরে। আমাদের বাড়ির চারিধারে কেবল গাছপালা ঘেরা জঙ্গল, আশে পাশে কোনো জনবসতি নেই। কয়েকটা বাগান পার হবার পর অন্য চাচাদের বাড়ি এবং প্রতিবেশি জ্ঞাতিদের ঘরবাড়ি দেখা যায়। সন্ধ্যের পর বাড়ির বাইরের জঙ্গলা বাগানে যেতে ভয়ে শিউরে উঠতাম । তবু আজ মায়ের জন্য সব বাগানেই ঘুরলাম।
দাদিকে নিয়ে রাগারাগি তাই পুরান বাড়ির দাদির ঘরে মা যাবে না ভেবেই অন্য চাচাদের বাড়ি, জ্ঞাতিদের ঘর বাড়ি সব জায়গাতেই মাকে খুঁজলাম। কিন্তু না! মাকে কোথাও পেলাম না। অজানা আশঙ্কায় বুক আমার কাঁপছিল। রাগের মাথায় মা অন্য কোনো কিছু করে বসেনিতো! দূর এ আমি কী ভাবছি? মায়ের কিছু হয়নি। মা নিশ্চয়ই আশে পাশে কোথাও আছে এই ভেবে খুঁজে চলছিলাম। কিন্তু দিপু যখন হঠাৎ করেই নানা বাড়ির কথা বলল তখন আমার মনে মৃদু আশা জেগে উঠল যে মা হয়ত সেখানেই গেছে! কিন্তু আমরা নানা বাড়ি ভালো করে চিনি না। মাকে কোনোদিন যেতে দেখিনি।
ওখানে মায়ের আপন বলে কেউ নেই। কিশোরী বেলা মাকে তার বাবা মেয়ের স্বীকৃতি দিয়ে একবার এনেছিল কিন্তু সৎমায়ের অত্যাচারে মা চিরদিনের জন্য বাবার মায়া ত্যাগ করে আবার তার মামা বাড়িতেই ফিরে গিয়েছিল। এরপর মা বড় হলে ভাগ্যক্রমে তারই বাবার দেশে আবার আসা হলো অর্থাৎ আমার বাবার সাথে মায়ের বিয়ে হলো। ছেলে মেয়ে সংসার নিয়ে এতগুলো বছর পার করল, তবু মায়ের কাছে কোনো দিন নানা বাড়ির কথা শুনিনি। কিংবা তাদের কাউকে কোনো দিন আসতেও দেখিনি। কিন্তু আমাদেরও যে নানা বাড়ি আছে কদিন আগেই তা জানলাম।
প্রাথমিক শেষ করে যে হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, আমাদের গ্রাম থেকে দুটা গ্রাম পরেই সেই হাইস্কুলটির অবস্থান। সেই স্কুলে আমার ক্লাসে এবং উপরের ক্লাসে দুএকজন ছাত্র ছাত্রীর সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে পরিচয়ের সূত্রে জানলাম তারা আমার মামা, খালা। আরো পরে জানলাম স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আমার নানা এবং আমাদের ক্লাসের ইংরেজি শিক্ষক আমার বড় মামা।
একদিন বাড়ি ফেরার পথে সহপাঠিদের কেউ একজন হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই বড় বিল্ডিং বাড়িটা হেড স্যারের বাড়ি! মনে মনে বললাম, এই তবে আমার নানা বাড়ি! একদিন পিছনের বাগানের দিক থেকে উঁকি ঝুকি মেরে কৌতুহলী চোখে দেখেছিলাম ঘাট বাঁধানো বিরাট দিঘি, পুরানো জমিদার আমলের মতো বিশাল বড় বিল্ডিং। বিল্ডিংটা ক্যামন শেওলা আঁটা, কোথাও কোথাও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। কিন্তু ওই বিল্ডিংয়ে কতজন লোকের বসবাস, আমার নানাজান দেখতে কেমন। কতজন ছেলেমেয়ে তার কিছুই জানা হয়নি। কাউকে তেমন চিনিনা জানিনা তাই ভেতর বাড়িতে না ঢুকেই স্কুলে চলে গেলাম। নানা বাড়ির গল্পটা কেবল দিপুর কাছেই করেছিলাম। দিপুও কদিন আগে হাইস্কুলে উঠেছে তাই ও একদিন বাড়িটি দেখতে যাবে বলেছিল।
ক্লাসে পড়ালেখায় ভালোছিলাম এবং পরীক্ষায় ভালো করেছিলাম বলে একদিন ইংরেজি স্যার কাছে ডেকে পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই পুতুলের মেয়ে! আমার মায়ের যে একটি আদুরে ডাক নাম আছে আমার তাও জানা ছিল না! বাড়িতে এসে মাকে ইংরেজি স্যারের কথা বলেছিলাম কিন্তু আমার মা কোনো কথা বলেনি। এমনকি তার বাবা, ভাই বোন কে কেমন আছে তাও জানতে চায়নি। তবে আমি জানি মা সেদিন একা একা গভীর রাত পর্যন্ত খুব কেঁদেছিল। সেদিনই বুঝলাম আমার মা ভীষণ দুঃখী! মায়ের আদর, বাবার ভালোবাসা, ভাইবোনদের ¯েœহ মমতা কোনো কিছুই আমার দুঃখীনি মায়ের কপালে জোটেনি। পরগাছার মতো মামা বাড়িতে বড় হয়েছে কেবল। এরপর আমার বাবার সাথে বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি এসে ভেবেছে না পাওয়াগুলো সব পেয়েছে কিন্তু কিছুই পাওয়া হয়নি মায়ের! জন্ম থেকেই যে সলতে জ্বলতে থাকে পুড়ে পুড়ে সে কেবল জ্বলতেই থাকে।
হঠাৎ আমার মন বলল, না মা আজ নানা বাড়িতে যায়নি। যে মা কোনো দিনই যায়নি, যে বাবা তার সন্তানকে জন্মের আগেই ত্যাগ করেছে, জীবনে সন্তানের কোনো দায়িত্বই পালন করেনি, সেই বাবার কাছে আমার মা নিশ্চয়ই যাবে না! কিন্তু মাকে যে আজ আমাদের খুঁজে পেতেই হবে। হারিকেনের আলোও যেন ফুরিয়ে আসছিল তবু আমাদের পথ ফুরাচ্ছিল না। কষ্টের পথ বুঝি এভাবেই বাড়তে থাকে। মাঠ ঘাট, ধান খেতের আলপথ ধরে কেবল যেন হেঁটেই চলছিলাম। কালি মন্দির শশ্বান ঘাট, মৃধা বাড়ির বড় গোরস্থান, ধুপ খোলার ভূতুরে পথ সব একে একে পেরিয়ে এলাম। সেদিন কোনো ভয়ই আমাদের পথ রুখতে পারল না। একসময় হারিকেনও নিভে গেল তবু আমরা থেমে গেলাম না। দূর থেকে নানা বাড়ির বড় ডরের ভেতর মৃদু আলো দেখতে পেয়ে দিপু বলল, আপা আর ভয় নাই, আমরা আইসা পরছি। ওই দ্যাখ ঘোপের টং ঘরে কুপি জ্বলতেছে, কামলাদের কেউ বুঝি জাইগা আছে।
আমি বরাবরই একটু ভীতু, বিছানার কিনারায় দিপুকে শুতে দিয়ে আমি মাঝখানে শুতাম।চোকির কিনারায় ঘুমালেই আমার মনে হতো আমাকে কেউ বুঝি এসে এখনি গলা চেপে ধরবে! দিপু জানে আমার এই ভয়ের কথা তাই ছোট ভাই হয়েও অন্ধকার রাতে আমার হাত চেপে ধরে হাটছিল আর অভয় দিয়ে বড়দের মতো দূরের আলো দেখিয়ে মনে সাহস জাগাচ্ছিল।
অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ যেন আকাশটাকে একটু পরিস্কার মনে হলো, চারিদিকের গাছপালাও যেন স্পষ্ট হতে লাগল। মনে মনে ভাবলাম সকাল হতে শুরু করেছে । মাঝে মাঝে দিপুটার যে কি হয়! এতটা পথ এলাম অথচ, যেই না নানা বাড়ির দিঘি পার হয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলাম ওমনি ও আমার হাত চেপে ধরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী মনে করে আবার বলে উঠল, আপা এত রাতে সবাই ঘুম! কেউ আমাদের তেমন চেনে না তাই যদি দরজা না খোলে?
দিপুর দিকে তাকিয়ে মৃদু ধমক দিয়ে বললাম, দূর পাগল! সবাই ঘুম তো কী হইছে? আম্মা আছে না? আম্মা কি ঘুমাবে বল? সে জানে তুই আর আমি তাকে নিতে আসব। দেখবি দরজা টোকা দেবার আগেই আম্মা দরজা খুইলা আমাদের সাথে তাড়াতাড়ি চইলা আসবে।
দিপু বলল, কিন্তু আম্মা যদি নানা বাড়ি না আসে? আমি ওর কথায় ভীষণ চমকে গেলাম! এতক্ষণ মনে মনে যাও মৃদু আশা জাগিয়ে এত দূর এলাম হঠাৎ তা উবে গেল। তাই তো! একদিন আমি যখন আম্মাকে বলেছিলাম, আম্মা আপনার কি কখনো বাপের বাড়ি যাইতে ইচ্ছা করে না? আম্মা আনমনে বলেছিল, যে ঘরে মা নাই, সেই ঘরে বাবা তাওই, সেইখানে থাকার কোনো জায়গা থাকে না।
একা একা বললাম, এতদূর আমরা কেন আসলাম? মা নিশ্চয় এখানে আসেনি? তবে কি মাকে না নিয়েই আমরা ফিরে যাব! ভাবতে ভাবতে আমাদের ক্লান্ত ছোট চারখানি পা কখন যেন বাড়ির ভেতর পৌঁছে গেল। রাতের গভীরে বিশাল বাড়িটা দেখে যেন ভয়ংকর কোনো মৃত্যু পুরী মনে হলো! উঠানের কোনের বুড়ো ছফেদা গাছ থেকে কেমন মড়াৎ করে একটা শব্দ এল ওমনি শপাং করে একটা বাঁদুর উড়ে গেল। আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। আমাদের বাড়ির পিছনের জঙ্গলা বাগানের বুড়ো আম গাছটার এক ভয়ংকর দৃশ্য যেন চোখে ভেসে উঠল! আম্মা যেন সেই গােেছর সাথে … ! না- না ,এ হতে পারে না ! দিপুর হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে বললাম, দিপু চল ! শিগগির বাড়ি ফিরে চল!
লেখক: গল্পকার ও উপ সম্পাদক, বিজয় প্রতিদিন