পানগুছি নদীর তীরের ফেলে আসা দিন

স্মৃতিকথা

0
909

সাইফুল ইসলাম তানভীর

আমার  শিশু কিশোর বয়সের সময়টা কেটেছে বাগেরহাট, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরে। তখন বাবা বিদেশী একটা  সংস্থার মহাসচিব ছিলেন। এজন্য বারবার এখান থেকে সেখানে ! জন্মস্থান বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে দাদার বাড়িতে। নানাবাড়িও একই উপজেলায়। মজার ব্যাপার আমাদের মোরেলগঞ্জের মধ্য দিয়ে যে বিশাল পানগুছি নদী বয়ে গেছে-এই নদীর তীরেই অতি নিকটে  আমার দাদার বাড়ি এবং নানার বাড়ির অবস্থান। দাদার বাড়ী বদনিভাঙ্গা গ্রামে। এই গ্রামের পাশ দিয়ে পানগুছি নদী বয়ে গেছে। নানার বাড়ী পশুরবুনিয়া গ্রামে। এটার পাশ দিয়েও পানগুছি নদী বয়ে গেছে। তবে দাদার বাড়ির তুলনায় নানার বাড়ি নদী থেকে সামান্য ভিতরে ছিল। এখন আর সেই ভিতরে নেই ! নদী ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাড়ির অতি নিকটে এসে গেছে। শৈশবের ওই সময়টায় খুব দুরন্ত ছিলাম ! শহর থেকে গ্রামে গেলেই চরম দুরন্তপনায় মেতে উঠতাম ! আর এই দুরন্তপনা খাটাবার ভেন্যুটা বা স্পটটা ছিল পানগুছি নদীর তীর ! ২০০৩ সালে পানগুছি নদী নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম। যেটা ঢাকার মাসিক ব্যতিক্রম পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। ওই সময় মানুষজন এতটা কৃত্রিম কালচারের ছিল না। গ্রামে অনেক লোক বাস করতেন। উঠতি বয়সী অনেক তরুন নদীর তীরে তখন আড্ডা মারত। এখন সেটা লক্ষ্য করা যায় না। মাঝে মাঝে গ্রামে যাই। সেরকমটা দেখতে পাইনা। ১৯৯৩ সালে আমরা চট্টগ্রাম পোর্ট এলাকা থেকে সাঁতার কাটার বয়া কিনে বাড়িতে নিয়েছিলাম। সেই বয়া গায়ে বেঁধে নদীতে প্রচুর সাঁতার জেতেছি। ১৯৯৪ সালে একদিন আমার বড় ভাই এলাকার সিনিয়র কয়েকজন যুবককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ছিলেন ! আমার বড় ভাই বলেছিলেন এই নদী আমি সাঁতার কেটে ওপারে যাব ! এলাকার সিনিয়ররা এতে অট্টহাসি দিয়েছিল ! ভর দুপুর। নদীতে জোয়ার এবং প্রচণ্ড স্রোত। আমার বড় ভাই এবং তার বয়সী আমার আপন চাচাত ভাই যে নিয়মিত গ্রামেই  থাকত। এই দু জন বদনিভাঙ্গা গ্রামের কাটাখাল থেকে সাঁতার শুরু করে নদী পার হয়ে নদীর ওপারের কাঁঠালতলা গ্রামে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল। নদীর এ পার থেকে ওপার ভালো ভাবে দেখা যায় না। অথচ এত বড় সাহসী কাজ। পরবর্তীতে ওরা নৌকায় ফিরে এসেছিল। আমাদের দেশে ক্রিকেট খেলা মিয়ে বেশী অর্থ ব্যয় করে। সাঁতারের জন্য ভালো কোন প্রতিযোগিতা দেখি না। অথচ আমাদের  দেশে সাঁতার না জানার কারণে প্রতি বছর অনেক মানুষ প্রাণ হারায়। আমি নদীর মাঝে যেতে ভয় পেতাম ! কলা গাছ কেটে সেটা দিয়ে ভেলা তৈরি করতাম। সেই ভেলায় পানগুছি নদীতে  ভেসেছি ! পানগুছি নদীতে ভেলায় ভেসে খাল দিয়ে নানা বাড়ির বাগানে গিয়েও  নোঙর করেছি। একবার ভেলার মধ্যেই চড়ুইভাতির আয়োজন করতে চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হয়েছিলাম। ভেলা তৈরি করা আমার অন্যতম শখ ছিল ! নিয়মিত গ্রামে বসবাস করা তরুণরা আমার সাথে এই দুরন্তপনায় পেরে উঠত না ! আমি শৈশবে অনেক ভেলা তৈরি করেছি। ভেলা তৈরি করতে গিয়ে  কলার বাগান থেকে ভাল ভালো  কলা গাছও কেটে ফেলেছি ! বাঁশ বাগানে গিয়ে বাঁশের কঞ্চিও কেটেছি। যেটা ভেলা তৈরিতে লাগত। শীতকালে রোদ উঠলে দুপুরে পানগুছিতে  গোসল করতে যেতাম। বাড়িতে বড় বড় পুকুর ছিল। তা বাদ দিয়ে নদীতে যেতাম আনন্দ ফুর্তি করতে। তখন অনেক কাজিন ছিল। দাদা বাড়িতে চাচাত ভাইয়েরা। নানা বাড়িতে মামাত, খালাত ভাইয়েরা ছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ আমরা এক সাথে হতাম। তখন ওরা সোজা ভাষায় কথা বলত ! এখন ওরা গ্রামে থাকে না। এখন ওরা বেশির অধিকাংশজনই বাংরেজি ভাষায় কথা বলে ! অল্প ক বছরেই কি পরিবর্তন হয়ে গেল !  অবশ্যই এই সময়টা অনেকের কাছে কম সময় নয়। প্রবীন যারা জীবিত আছেন তাদের কাছে তো এই সময় টা খুব অল্প। পানগুছি নদীর সেই নদীর পাড় এখন আর নেই। নদী ভেঙে আরো অনেক বড় হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের ঘর বাড়ী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক এলাকার বিলুপ্তি ঘটেছে। অনেক গ্রামের আংশিক অংশ কোন মতে টিকে আছে। হারিয়ে যাওয়া অনেক মানব বসতির কথা আমারও মনে আছে। যে মানব বসতি এখন নেই। যে স্থান নদীতে গিলে খেয়ে ফেলেছে। বহু মানুষের কান্নার সাক্ষী এই পানগুছি। ওর যেন দয়া নেই ! চিৎকার দিয়ে আলাতুন্নিসা কেঁদেছেন। তারপরও পানগুছি রেহাই দেয়নি। আলাতুন্নিসার পুরো এলাকা সহ পানগুছি গিলে খেয়ে ফেলেছে। নিরবে পানগুছির স্মৃতি মনে পড়লে চোখে পানি আসে। ওই পানগুছিতে আমার, আমাদের পরিবারের বহু সুখ দুঃখের স্মৃতি রয়েছে। মাঝে মাঝে গ্রামে দাদা বাড়ী নানা বাড়িতে গিয়ে নদীর পাশে নীরবে তাকিয়ে থাকি। এই নদী মহান আল্লাহর দেয়া বিশাল নেয়ামত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here