করোনারে চাবাইয়া খাইমু

ছোটগল্প

0
592

আনোয়ারা খাতুন

রোদেলা আকাশটা হঠাৎ কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগলো । সুহেনা কোলের শিশুকে আঁচলে ঢেকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।টানা ঝড় বৃষ্টি তবুও কোথায় আশ্রয় নিতে দেখা যায়নি।সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসছে, বারান্দা দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সারা শহর লকডাউন মানুষ করোনার ভয়ে গৃহবন্দী আর তুমি ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছো বাচ্চাটা কাঁদছে বাড়ি যাও না কেন? সুহেনা মলিন মুখে বললো, আপনেরা এই লকডাউন পগডাউন করছইন দেইখাইতো আমরার এই দসা।আপনেরারে করোনা খাইতে খুঁজে আর আমরা করোনা রে খাইতাম খুঁজি ।”করোনা রে চাবাইয়া খাইমু আমি “।এই হারামজাদা না আইলে আমার বাচ্চাডি উপাস থাকতো না ।বললাম কি হয়েছে? করোনা সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? সে কেঁদে বলল, কিচ্ছু জানার দরকার নাই আমার ,পেটের জ্বালা বাঁচি না, অত জাইন্না কাম কি? তিন বছর ধইরা এক বাসাত কাম করি।নিজের সংসারে মতন মনে করি ।তারাও আমারে ছাড়া চৌখ্খে দেহে না ।একদিন না গেলে বেদিশা অইয়্যা বাড়িত থাইকা ধইরা আনে ।কত মধুর মধুর কথা ,আমারে ছাড়া বাঁচেই না।আইজ যখন দেশে মহামারী লাগছে আমারে কাম ছাড়াইয়া বিদায় দিছে।কয় তোর শরীর থাইকা জীবাণু আইবো ।এই চশমখোর বিবেক ছাড়া মানুষেরা ভুইলা গেছে যে, ওদের অসুখ অইলে আমিই তাদের সেবা করতাম, কলেরা আমেশায় যাই অউক। অতো দিন ধইরা রাইন্দা খাওয়াই আমারে ঘেন্না করে না, আইজ ঘেন্না করে ।একটা ভালা কথাও ওদের মুহে পাইলাম না । সারা রাইত বাচ্চাডা খিদা কানছে।ভাবছি খালার কাছ থাইকা কয়ডা টেহা লইয়া দুধ আনমু।মাইগো মাই দরজা খুইলা আমারে দেইখা বাঘ দেহনের মতো ডরাইছে।মনে অয় আমি তারে খাইতাম আইছি ।টেহা দিবো দূরের কথা মুহের উপরে দরজা লাগাইয়া দিছে ।আমি দুঃখে মইরা যাইতাম মন চাইতাছে।এই অমানুষগুলো র ঘরে অতদিন আমি কারণে অকারণে খাইটা মরছি?আরে তোরা চাইর বেলা নানা রঙের খাওন খাস মনের সুখে , আমারা রে বাঁচনের লাইগা কিছু দেয়না! সবইতো আল্লাহ্‌র দান । বললাম সরকারি রিলিফ পাওনি? সে বলল, হেইনোতো আরো নাটক, রইদের মাঝে সারাদিন বয়াইয়া রাইখা পুতলি একটা ধরাইয়া এক পাল দানবীরদের ফটো তুলতেই দিন যায় । একদিন পাঁচ কেজি চাউল দিলেই নেতার দ্বায়িত্ব শেষ । ছয় সাত জনের সংসার পাঁচ সাত কেজি চাউল কয় বেলায় খাওয়া চলে? তাছাড়া বড়রা কিছু খাইলেও ছোডু মাইনষের খাওন তো কেউ দেয় না ।বাচ্চাডা দুধের লাইগা কানতাছে , দুধের দাম পাঁচশ টেহা, অত টেহা কই পাইতাম? অত দিন কাম করছি চিন্তা করন লাগছে না কিন্তু অহন————! ঘরে বাকি বাচ্চারা আশায় অইয়া বইয়া রইছে, আমি কিছু লইয়া গেলে খাইবো।তার বাপ সহালে বাইর অইছে অহনো কোন খবর নাই ।বোধ হয় কোন কাম কাজ পাইছে না ।আমি খালি আতে পোলাপাইন এর সামনে ঘরে কেমনে যাইতাম? বাচ্চাডার গলা দিয়া আর আওয়াজ বাইর অয় না, সারাদিন খিদা কানছে, আইজ রাইত টা পার করমু কেমনে আপা? সুহেনার এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিলো না।তার আজকের সমস্যা হয়তো আমি মিটিয়ে দেবো কিন্তু কাল কি করবে, পরশু কি করবে?এদেশে এমন হাজারো সুহেনা রয়েছে কাকে রেখে কার পাশে দাঁড়াবো আমি ।আমরা যারা সারা বছর সুহেনা দের উপর নির্ভর করে থাকি এই দুর্দিনে সেই সুহেনা রা আমাদের উপর কতটুকু ভরসা করতে পারছে? আমাদের বাচ্চা গুলো যাদের উপর নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়ে অফিস আদালত সামলাই , তাদের বাচ্চা গুলো যখন এক ফোটাদুধের অভাবে মরতে বসে ,তখন আমাদের মনুষ্যত্ব কতটুকু জেগে উঠে? কাজ নাই বলে ওদের সন্তান যখন না খেয়ে থাকে, তখন আমাদের সন্তানদের কি না খাইয়ে রাখি? এই প্রশ্ন রইলো সবার বিবেকের কাছে ।

লেখক: ছোটগল্পকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here