কলকাতা থেকে
তৃষা সরকার
আজ দু বছর হয়ে গেছে রাহুল আর নীলিমার বিয়ে হয়েছে। বেশ ভালোই কেটেছে তাদের বিবাহিত জীবন কিন্তু আজ এক টুকরো কাগজ যেন কিভাবে বদলে দিল তাদের সম্পর্ক। নীলিমা একজন লেখিকা। আজ এক পাবলিশিং হাউস এ তাকে যেতে হয়েছে তার নতুন বইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। ঘরে আছে রাহুল একা। তার আজ ছুটি। রাহুল যে একা একা ঘরে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। অনেকবার তার ইচ্ছে করছিল নীলিমার গল্পের বইয়ের সংগ্রহ থেকে ব্যোমকেশ কিংবা কাকাবাবু তুলে নিতে কিন্তু ওখানেও যে বাধা। নীলিমার বইয়ের তাকে কেউ হাত দিলে মেয়েটা বড্ড রেগে যায়। এগিয়ে যায় সেই বইয়ের তাকের দিকে। হঠাৎ তার যে বই অন্ত প্রাণ তা রাহুল জানে। এমনকি বই গুলো একটু দেখে রেখে দিলেও তা নীলিমার চোখে ধরা পড়বেই। তাই এই দুঃসাহসী কাজে রাহুল হাত দেবে কিনা ভাবতে ভাবতেই রাহুল এগিয়ে যায় সেই বইয়ের তাকের দিকে। হঠাৎ তার চোখ পরে একটা ছেঁড়া পাতার উপরে। যা ফেলুদা সংগ্রহের মাঝখান থেকে উঁকি মারছে। খুব ভালো করে সে দেখে নিলো বইটার আশেপাশে কোন বই রাখা আছে যাতে বইটা থেকে কাগজটা দেখে বইটা যেন ঠিক জায়গায় রেখে দিতে পারে। এবং তা সে করলো ও তাই। কাগজটা কোন ডায়রীর ছেঁড়া পাতা। হাতের লেখা যে নীলিমার তা বুঝতে রাহুলের অসুবিধা হয়নি। লেখা পড়ে সে অবাক হয়ে গেল। একটা লাইনে এসে চোখ আটকে গেল রাহুলের। নীলিমা বলেছে যে সে অজিতকে কতটা ভালোবাসে।” বিয়ে টা জোর করে দেয়া হচ্ছে, আমার এতে মত নেই অজিত”- পাতা এ লেখা এ কথাগুলো যেন বারবার ঘুরতে থাকে রাহুলের মাথায়। নীলিমা এক জায়গায় লেখে যে সে কোনদিন অজিতকে ভুলতে পারবে না আর এই বিয়েটা সে কখনো মন থেকে মেনে নেবে না। রাহুল বড্ড নরম স্বভাবের ছেলে, কারোর সাথে বেশি কথা বলে না সে । নীলিমাকে বিয়ের আগে সে বারবার জিজ্ঞাসা করেছিল তার এই বিয়েতে মত আছে কিনা, নীলিমা লাজুক হেসে জানিয়েছিল আছে। আজ সেই সাক্ষাৎকারের স্মৃতি ও কেমন পাগল করে দিচ্ছে তাকে। তাহলে কি সেদিন নীলিমা তাকে মিথ্যা কথা বলেছিল। নীলিমাকে সে বড্ড ভালোবাসে তাই যেন এই ছেঁড়াপাতা টা আরো কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। বাইরের দরজা খোলার আওয়াজ হলো, মনে হয় নীলিমা ফিরেছে। সন্ধ্যের শেষে অন্ধকার নেমেছে তবু ঘরে কোন লাইট জ্বালায় নি রাহুল। বড়ো আশ্চর্য লাগলো নীলিমার। ঘরে গিয়ে দেখে রাহুল শুয়ে আছে বিছানায়। অন্ধকারের কারণে হয়তো তার ভেজা চোখ দেখতে পাইনি নীলিমা। নীলিমা ঘরে ঢুকতেই রাহুল বলে উঠলো লাইট জ্বালিয়ো না, ভালো লাগছে না, একটু একা থাকতে চাই। নীলিমা হয়তো অন্য সময় হলে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করত কি হয়েছে রাহুলের। কিন্তু আজ তার গলার স্বর তাকে আটকে দেয়। ঠান্ডা বরফের মতন সেই স্বরকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। রাতে খাবার টেবিলে আলগা হাসি দিয়ে পরিস্থিতি সামলে রাহুল নীলিমাকে জিজ্ঞেস করে সে অজিতকে চেনে কিনা, নীলিমা রাহুলের চোখে চোখ রেখে না বলে দেয়। নীলিমার এই বেহায়ার মত মিথ্যা বলাটা রাহুলকে যেনো হতভম্ব করে দিয়েছিল। সে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে। আজ দুদিন হল তাদের মধ্যে প্রায় কথা বন্ধ। আজ রবিবার স্বভাব মতো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রাহুল কাগজে দেওয়া ছোট গল্পের দিকে নজর রাখল। ” আমি তোমায় ভুলতে পারবোনা অজিত আমি এই বিয়ে মানি না”- গল্পের প্রথমে এই লাইনটা দেখে অবাক হয়ে গেল রাহুল। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে খবরের কাগজটা একদম চোখের কাছে নিয়ে পড়তে শুরু করলো রাহুল। লেখিকা চেনা- নীলিমা দস্তিদার।দু পাতার গল্পটা রাহুল এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে বড্ড খারাপ লাগছে তার। সে ছুটে যায় রান্নাঘরে নীলিমাকে সব বলার জন্য। ওখানে গিয়ে দেখে নিলীমা তেলে লুচি ভাজছে। রাহুল রান্না ঘরে ঢুকতেই একগাল হাসি হেসে নীলিমা বললে, “আর দু মিনিট লাগবে টেবিলে বসো তোমার প্রিয় লুচি আর সাদা আলুর তরকারি নিয়ে যাচ্ছি”। রাহুল সব বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল সে ভাবলো সব বলে ফেললে হয়তো তাদের সম্পর্কটা আর আগের মতন থাকবে না তাই সে এক গাল হেসে শুধু বলল” আজকের কাগজে তোমার গল্পটা কিন্তু খাসা”, নীলিমার মুখে ফুটে উঠলো লাজুক হাসি। রাহুল রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নীলিমা দীপা কে এসএমএস করে বলে -“বুদ্ধিটা কাজে দিয়েছে ধন্যবাদ রে।”দীপা তার প্রিয় বন্ধু, সে নীলিমা আর অজিত এর সম্পর্ক নিয়ে জানতো। রাহুল কে দেখেই সেদিন নীলিমা বুঝে গেছিলো সে ডাইরী র পাতা টা পেয়ে গেছে কারণ সেটা তার বইয়ের মধ্যে ছিলো না। সব কথা দীপা কে জানাতে দীপা এই বুদ্ধি দেয়। নীলিমা জানে সে হয়তো যেটা করলো সেটা ঠিক না কিন্তু সে কোনভাবেই রাহুলের চোখে ছোট হতে চায় না। সেই রাহুলের বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চায় না। সে অজিতকে ভালোবাসতো ঠিকই কিন্তু রাহুল তার বর্তমান। রাহুলের নরম স্বভাব তার ছেলেমানুষি খুব অল্পদিনেই তাকে বদলে দিয়েছে। সে কোনভাবেই রাহুলকে দুঃখ দিতে চাই নি । সে জানে রাহুল সত্যিটা জানলে আর কোনদিন তাকে বিশ্বাস করতে পারবে না তাই তার এই ছোট্ট ছলনা।
লেখক: গল্পকার