সাজ্জাদুল আলম শাহিন
ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অকৃত্রিম। একটা রাষ্ট্র বা একজন বন্ধু আরেকটা রাষ্ট্রের জন্য বা আরেকজন বন্ধুর জন্য সারা জীবন শুধু উপকার করবে আর তার বিনিময়ে তাকে মনে রাখতে হবে বিষয়টা এরকম না। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছেন শুধুমাত্র তার জন্য সারা জীবন মনে রাখা উচিত। বিশেষ করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা ছিল রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন প্রহসনমূলক গোপন বিচারের মাধ্যমে হত্যার যড়যন্ত্র চলছে ঠিক তখন, ১১ আগস্ট ১৯৭১ সালে বিশ্বের ২৪ টি রাষ্ট্রের প্রধানের কাছে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠান এবং যাতে বিশেষ ভাবে উল্ল্যেখ ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি হলো বাংলাদেশ সংকট সমাধানের অন্যতম প্রধান শর্ত। তখন পাকিস্তানকে জোড়ালো ভাবে শতর্ক করেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব, ফ্রান্স এবং বৃটেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ৪ ঠা নভেম্বর ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী হোয়াইট হাউজে ততকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সাথে মিটিং এ বসেন যার এজেন্ডা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। নিক্সন এবং কিসিঞ্জার সেই মিটিং থেকে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন ইন্দিরা গান্ধি কখনো চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে তা মেনে নিবেন না এবং ইন্দিরা গান্ধীকে তাদের পক্ষে টানা যাবেনা। পরবর্তীতে দেখা যায় ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তি, দৃড়তা, প্রত্যয়, সহমর্মিতা, বিস্ময়কর আন্তর্জাতিক জনসংযোগ বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে আসে। একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান পন্থি কৌশল গুলো অকার্যকর হয়ে পরে।
এদিকে মুক্তিবাহিনীর ধারাবাহিক আক্রমণে অক্টোবর-নভেম্বর থেকে পাকিস্তান বাহিনী ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত হতে থাকে। ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিম অংশে পাকিস্তান আকস্মিক আক্রমণ চালালে যুদ্ধ পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। গঠিত হয় “বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড” বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চুড়ান্ত ভাবে শক্তিশালী রুপ নেই। একইদিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালিতে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী বৈঠক বসে। সে বৈঠকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার প্রস্তাব আনা হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই বার “ভেটো” প্রদান করে প্রস্তাবটিকে অকার্যকর করে দেয়। এর ফলে যৌথ বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ পাকিস্তান বাহিনী দ্রুত পরাজয়বরণ করতে থাকে এবং আত্মসমর্পণের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশ শত্রুমক্ত হয়। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য সহ আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানিরা। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বকে মিথ্যা এবং ভুল প্রমান করে দিয়ে বাংলাদেশিরা পাকিস্তানিদের অহংকারের পতন ঘটান। এরপর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার সদস্যরা কোলকাতা থেকে ২২ ডিসেম্বার ঢাকায় ফিরেন। শত্রুমুক্ত ঢাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা এসে পৌঁছলে হাজার হাজার মানুষ তাদের বীরোচিত সংবর্ধনা জানায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু সেই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। বেঈমান এবং অহংকারী পাকিস্তান এ ব্যাপারে প্রচণ্ড নীরবতা অবলম্বন করে। উৎকন্ঠা বাড়তে থাকে বাংলাদেশিদের।
বাংলাদেশের জনগন যখন স্বাধীনতার উচ্ছাস নিয়ে ব্যস্ত আবার পাশাপাশি জাতির জনক কারমুক্ত না হওয়ার কারনে উদবিগ্ন এবং বাংলাদেশের নেতৃত্ব স্থানীয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিরা ব্যাপক ভাবে উৎকন্ঠার মধ্যে সময় কাটাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। কারন কি হবে জাতির পিতার। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী তখন শুধু ভাবছিলেন কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে কারামুক্ত করা যায়। কারন ইন্দিরা গান্ধী খুব ভালো ভাবে জানতেন বঙ্গবন্ধু ছাড়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যে পিতা ছাড়া এতিম সন্তান এটা বুঝতে খুব একটা জ্ঞানের দরকার নেই। এই বিপদ্গ্রস্থ দেশটির শেষ আশ্রয়স্থল বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবের ফাসী হলে তা হবে ভারতের জন্য চুরান্ত পরাজয়, ভারত যে হৃদয় দিয়ে বাংলাদেশ ও তাঁর অত্যাচারিত জনগনকে সহযোগিতা করেছিলো তার সবকিছুই ভেঙ্গে যাবে যদি ফাসী কার্যকর হয়, বাংলাদেশ হয়ে পড়বে বিশ্ব হায়েনাদের বিচরনস্থল। ভারত প্রতিজ্ঞা করেছিলো শেখ মুজিবর রহমানকে বাচিয়ে রাখতে হবে যে কোনো মুল্যে, বাংলাদেশের স্বার্থে, তাঁর পরিবারের স্বার্থে এবং সত্য ও ন্যায়ের স্বার্থে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে না ফিরলে ভারতের জন্যও ছিল বিপদ কারন ঐ মূহুর্তে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বের বিকল্প বাংলাদেশে ছিলনা। ১৬ই ডিসেম্বর ছিলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারতের সামরিক ও কুটনীতির ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক। এক জটিল ভু-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিশ্ব শাসন ও অর্থনৈতিক দেনা-পাওনার চাপে পিষ্ট প্রায় ১০০ কোটি মানুষের এই ভুখন্ডে তখন বিভিন্ন দেশের সামরিক নেতাদের প্রক্সি যুদ্ধের আড়ালে চলেছে সব হিসেব বুঝে নেবার কৌশল। কিন্তু বাংলার মানুষ এত কিছু চায় নি, তারা চেয়েছিলো স্বাধীনতা, তারা ফেরত চেয়েছিলো স্বাধীনতার সপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে। অন্যদিকে বিজয়ের সেইক্ষনে ইন্দিরা গান্ধী ভাবছিলেন অন্যকিছু, অন্য কোনো নিরব যুদ্ধে মগ্ন ইন্দিরা নজর রাখছিলেন বঙ্গবন্ধুর উপর, কেননা বাঙালী জাতির পিতার মুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপুর্ন থেকে যাবে। ভারতে অবস্থান নেয়া প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী শরনার্থী খরচে দরিদ্র ভারতের তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, সাথে নকশালবাড়ির আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে আইন শৃঙ্খলা। এত বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দীর জন্য কোনো বাজেটই ছিলোনা ভারত সরকারের। তবুও পাকিস্তানী বন্দিরা যাতে জেনেভা কনভেশনের চেয়েও ভালো থাকে সেজন্য ভারত সরকার চেষ্টার ত্রুটি করেনি। এর মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছিলেন যে কোনো মুল্যে শেখ মুজিবের মুক্তি হউক।
তখন ইন্ডিয়ার RAW(Research and Analysis Wing) এর প্রধান ছিলেন রাম নাথ কাও। সেই রাম নাথ কাওকে সুস্পষ্ট ভাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলে যেকোন উপায়ে উনি শেখ মুজিব রহমানের মুক্তি চান। ঠিক এরকম এক সময়ে পাকিস্তানের দাম্ভিক সেনাবাহিনী তার ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক পরাজয়ের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত, চরম বিতর্কিত হয়ে চাপ সামলাতে না পেরে জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ওয়াশিংটন থেকে ডেকে পাঠান জুলফিকার আলি ভুট্রোকে। ভুট্রো তখন জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণা বলে নতুন সিএমএলএ CMLA(Chief Martial Law Administrator.)করে দ্বায়িত্ব বুঝে নিতে বলেন ভুট্রোকে। ভুট্রো ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশে দ্রুত রওনা দেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, তবে আসার আগে ফোন করেন পাকিস্তানের অভিভাবক আমেরিকার রাস্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে। ওয়াশিংটন থেকে ভুট্রোর ফ্লাইট রাওয়ালপিন্ডি যাবার পথে লন্ডনের হিথরোতে রিফুয়েলিং করতে বিরতি নেবে, গোপন সূত্রে এই খবরটি জেনে যান শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং যেনে তিমি আর দেরী করেননি। ইন্দিরা গান্ধী তখনি ওয়ার কেভিনেটের জরুরী মিটিং এ বসেন। “ওয়ার কেবিনেটে” এর জরুরী মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন এক্সটারনার এফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের চিফ দুর্গা প্রসাদ ধর, RAW এর প্রধান রাম নাথ কাও, প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ সহকারী পি এন হাকসার এবং বৈদেশিক সচিব টি এন কাউল। কাকতালীয় ভাবে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর ও তাঁর আগের সময়টুকুতে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সরকারী কর্মচারী হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন প্রধান সচিব মুজাফফর হুসেইন, তিনি তখন শ্রীমতি গান্ধীর নির্দেশে দিল্লিতে ভিআইপি যুদ্ধবন্দী হিসেবে দুর্গা প্রসাদ ধরের সরকারী বাসভবনে অবস্থান করছিলেন। মুজাফফর হুসেইনের স্ত্রী লায়লা লন্ডন সফরকালে সেখানে আটকা পড়ে যান এবং ৩রা ডিসেম্বরে দুই দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াতে দেশে ফিরতে পারছিলেন না । অবশ্য স্বামী-স্ত্রী দুইজনে দুই দেশে থাকলেও তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ নিয়মিত হচ্ছিলো। এই মুজাফফর হুসেইনের স্ত্রী লায়লা ছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্রোর Ex-Girl Friend, দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে।
ইন্দিরা গান্ধী জানতেন তাদের সাথে এখনও সেই পুরনো আবেগ অনুভূতির সম্পর্ক রয়েছে এবং ২ জনি তা টিকিয়ে রেখেছেন। ইন্দিরা গান্ধী এই সুযোগটা নেওয়ার চেষ্টা করলেন। লন্ডনে তার সরকারের কর্মরত ছিলেন ডিপ্লোমেট শশাঙ্ক ব্যানার্জি। তখন শশাঙ্ক ব্যানার্জিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় লায়লা এবং ভুট্রোর সাথে বসিয়ে দেওয়ার জন্য। লায়লার স্বামীকে ছাড়িয়ে নিতে লায়লাকে এই একবার মাত্র কূটনৈতিক মিটিং এ ভুট্রোর সাথে বসিয়ে দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সব চেষ্টা করলেন। ভুট্রোর লন্ডনে আসার দুই দিন আগে শশাঙ্ক ব্যানার্জি “গো এহেড” পান এক্সটারনার এফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের চিফ দুর্গা প্রসাদ ধর (ডিপি ধর) এর কাছ থেকে। ডিপি ধর তাঁকে লায়লার সাথে কথা বলতে বলেন এবং বলেন, লায়লা যেন ভুট্রোর সাথে কথা বলে পুরনো সম্পর্কের জের টেনে অনুরোধ করে তার স্বামীকে ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। দিল্লী নিশ্চিত ছিলো ভুট্রো লায়লার অনুরোধ ফেলতে পারবেন না। আর পাকিস্তানের নবনিযুক্ত সিএমএলএ (CMLA) হিসেবে ভুট্রো দিল্লীর কাছে এই অনুরোধ করতেই পারেন। শশাঙ্ক ব্যানার্জিও তাঁদের দু’জনের গোপন সম্পর্কের কথা জানতেন, কিন্তু সেদিকে তাঁর আগ্রহ ছিলো না, দিল্লী শুধু জানতে চাচ্ছে একটাই ব্যাপার, শেখ মুজিবুরের ফাসির রায়ে ভুট্রো কি করবেন? শশাঙ্ক ব্যানার্জি হিথ্রোর ভিআইপি কক্ষে এই মিটিং বসাতে সক্ষম হলেন। খুবই আন্তরিক ছিলো তাঁদের পুনর্মিলন, যতটা হওয়া যায়। পিছনের দরজার কুটনীতির খুব গুরুত্বপুর্ন এই মিটিংটি যে ইতিহাস নির্মান করবে উপমাহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে, কে জানতো! এত বড় যুদ্ধে হেরেও জুলফিকার আলি ভুট্রো উচ্ছসিত ছিলেন, লায়লার কান্নাজড়িত অনুরোধে ভুট্রো ব্যাপারটি নিয়ে দিল্লীর সাথে কথা বলার অঙ্গীকার করলেন। অনুযোগ করলেন, যদিও তাঁর অনুরোধ দিল্লীকে খানিকটা সুযোগ দেবে।
চোখ টিপে ভুট্রো বিষয় পরিবর্তন করলেন, তিনি লায়লাকে হাত ধরে তাঁর খুব কাছে বসালেন, লায়লার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললেন, ‘‘লায়লা, আমি জানি তুমি কি জানতে এসেছো? বুঝতে পারছি তোমাকে শ্রীমতি ইন্দিরা পাঠিয়েছেন। তাঁকে এই মেসেজটা দিও, আমি দায়িত্ব বুঝে নেবার পরপরই মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করবো, উনাকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দেবো। বিনিময়ে আমি যা চাই, তা আমি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীজীকে অন্য একটি চ্যানেলে জানাবো। তুমি এখন যেতে পারো।’’
লায়লা মিটিং থেকে বের হয়ে মেসেজ দেবার সাথে সাথে শশাঙ্ক ব্যানার্জি তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেন। ইন্দিরা গান্ধী এই মেসেজে খুব খুশি হলেন, যদিও আনঅফিসিয়াল একটি প্রতিজ্ঞা। ভুট্রোকে কে কবে বিশ্বাস করতে পেরেছে, তবুও তো একটা আশ্বাস পাওয়া গেলো, এইটাও কম কিসে? কিংবা ভুট্রো কি তাঁকে ভুল পথে চালিত করবে? জুলফিকার আলী ভুট্রোর মনে কি অন্য কোনো ফন্দি আছে? ইন্দিরা গান্ধী রিস্ক নিতে চাইলেন না, আশ্বাস সে যত ইনফর্মাল হউক না কেনো, সেটা তো দিয়েছেন একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। এই আশ্বাসের অফিসিয়াল কনফার্মেশনের জন্য তিনি পাকিস্তানে অবস্থিত ভারতীয় দুতাবাসকে নির্দেশ দিলেন। দুতাবাস তার ফিরতি রিপোর্টে এই আশ্বাসকে নিশ্চিত করলেন। নিশ্চয়তা পাওয়া মাত্র বিচক্ষন এবং বুদ্ধিমতি ইন্দিরা গান্ধী এই ডিপ্লোম্যাটিক বার্তাকে নিজের হাতে নিয়ে এটিকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে দিলেন।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পান। একটি পাকিস্তান সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ বিমানে আরও ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তার পরিবার। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি এর ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। প্লেনটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর নেমে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে আসলে তাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের উপস্থিত কিছু কর্মকর্তা স্বাগত জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন “গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট”।
বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালী হোটেল ঘিরে “জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেন, ঠিক যেন হোটেলটি হয়ে উঠেছিল এক টুকরো বাংলাদেশ। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন “এক মুহূর্তের জন্য আামি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি, আমি জানতাম ওরা আমাকে হত্যা করবে আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাব না, কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে”। বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ তাকে নজীরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষী ঐদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন।
এর পর ৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে ঢাকার পথে যাত্রা করেন তিনি। ১০ জানুয়ারি তিনি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য ও শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা বাংলাদেশের জাতির পিতাকে ঐতিহাসিক অভ্যর্থনা জানান। একুশবার গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হয়, ওড়ানো হয় বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা। বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত।
বঙ্গবন্ধুকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন, The emergence of independent Bangladesh is itself a unique event in the annals of democratic movements in world history. You have truly been acclaimed the Father of the nwe nation , Bangladesh. উত্তরে বঙ্গবন্ধু ভারতের জনগণ, সরকার, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। প্রায় সব আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে পরদিন প্রায় একই ধরনের শিরোনাম হয় A WELCOME DELHI WILL REMEMBER.
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকায় পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। তখন ঢাকার বিমানবন্দর ছিল তেজগাঁও। ছোট বিমানবন্দর যারা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন দিল্লি জাতির জনককে আনতে এবং আরো যারা সংগী ছিলেন কেউ রাজী হচ্ছিলেন না আলাদা বিমানে আসতে, সবাই জাতির পিতার সাথে একসাথে আসবেন। তাই সেদিন তেজগাও বিমানবন্দরের রানওয়ে মেপে দেখা হয় বড় বিমান ল্যানাদ করার জন্য যতটুকো রানওয়ে দরকার তার চেয়ে মাত্র ২ ফিট বড় রান ওয়ে তাই বড় বিমানে উঠা সম্ভব তবে রিস্কি। তাই সেই রিস্ক নিয়ে সবাই জাতির জনকের সাথে একটি বড় বিমানে উঠে এক সাথে দিল্লি থেকে ঢাকায় আসলেন। পাকিস্তানের কারাগারে থেকেও যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রতি, সেই প্রাণপ্রিয় নেতাকে মুক্ত স্বদেশে স্বাগত জানায় লাখো উদ্বেলিত মানুষ। সব রকমের নিরাপত্তা বেষ্টনী উপেক্ষা করে লাখো মানুষ ঢুকে পড়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে। রয়াল এয়ার ফোর্সের বিমানটি থামার পর তাকে ঘিরে রাখে উদ্বেলিত জনতা। মাটিতে অবতরণ করার আগে বঙ্গবন্ধু বিমানের জানালা দিয়ে তার প্রাণপ্রিয় “সোনার বাংলা” দেখেন, যাকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গোটা মুজিবনগর মন্ত্রিসভা, মুক্তিযুদ্ধের বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্ব, শীর্ষ ছাত্র নেতাবৃন্দসহ লাখো মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্বদেশের মাটিতে আবেগময় অভ্যর্থনা জানান। এরপর মোটর শোভাযাত্রায় তিনি রমনা রেসকোর্সে পৌঁছেন, যেখানে ৭ মার্চ ১৯৭১ ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি, দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যাদের প্রাণের ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরু করেছিলেন। যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালী ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত মন্ত্রমুগ্ধ জনতা দুহাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। আজো সেই ১৭ মিনিটের দিক নির্দেশনাকে জাতির মূল মন্ত্র হিসাবে নিয়ে জাতির জনকের কন্যা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন সফলতার সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন প্রতিটা মানুষকে শিক্ষা, শান্তি, দারিদ্র্য মুক্ত, সুচিকিৎসা এবং উন্নত জীবন দেওয়ার জন্য।
লেখক : কলামিস্ট ও তরুণ উদ্যোক্তা