ব্রাকসহ অন্যান্য এনজিওতে পুরুষের পরিবর্তে নারীকে কেন ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহক হিসাবে নির্বাচন করা হয় এমন প্রশ্ন যদি সাধারণ কোন মানুষকে করা হয় তাহলে হয়তো অনেকেই হেসে উত্তর দিবেন; নারী সহজ সরল তাকে সহজেই পটাতে পারে এনজিও কর্মকর্তারা । আবার হয়তো কোন কোন রক্ষণশীল মানুষ বলতে পারেন-ব্রাক এবং অন্যান্য এনজিও বিদেশি সহায়তা পায় । বিদেশী সহায়তায় কাজ করছে তাই তারা নারীকে ঋণ দেয় । তাদের দৃষ্টিতে এর প্রধান কারণ হচ্ছে নারীদেরকে বাড়ির বাইরে বের করে এনে ধর্মবিমুখ করা । সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা । নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করে পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধনে ফাঁটল ধরানো । কিন্তু আমার মনে হয় সাধারণ মানুষের এই ধারণা সঠিক নয় । এর পিছনে অন্তর্নিহিত বিশেষ কিছু কারণ আছে যার কারণে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব ধরণের ক্ষুদ্রঋণের আওতায় নারীদেরকে গ্রাহক হিসাবে টার্গেট করা হচ্ছে ।
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ বাংলাদেশ প্রতিদিনে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদ এর প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন –
“১৯৭৪ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল । উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করাতে আমরা রংপুরের রৌমারিতে (রৌমারি বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেলার অধীনে) খাদ্য বিতরণ কর্মসূচী শুরু করেছিলাম । রৌমারিতে আমরা কাজ করেছিলাম মাত্র চার মাস । কিন্তু সেখানে কাজ করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতায় এমন কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছিল, যা আমার অন্তরদৃষ্টিকে খুলে দিয়েছিল । সেখানে দুর্ভিক্ষ পীড়িত অনেক শিশুকে আমি দেখেছি, যাদের বাবা দায়িত্ব ফেলে পালিয়েছেন । অনেকেই নিরুদ্দেশ হয়েছেন । কিন্তু মা তার সন্তানকে ফেলে কোথাও যান নি । আমি সেদিন গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম, আমাদের নারীদের দায়িত্ববোধ এবং কর্তব্য নিষ্ঠার ব্যাপারটাই আলাদা । স্বাভাবিক অবস্থায় ঘরে চাল বাড়ন্ত হলে তখন যদি আত্মীয় এসে হাজির হয়, ঘরে কিছু না থাকলেও নারীরা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধারকার্জ করে আপ্যায়নের কাজ চালিয়ে যায় । আমি নিশ্চিত রূপেই দেখেছি, নারীরা নিজের পরিবারের প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল । এ জন্যই আমি নারীদের সংগঠিত করে তাদের আয় রোজগারের ব্যবস্থা করতে চেয়েছি এবং তাদেরকেই উন্নয়নের মুল কর্মকাণ্ডের চালিকা শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছি । ”
আমিও উত্তরবঙ্গের একজন মেয়ে । দিনাজপুরে আমার জন্ম । ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আমি দেখিনি । কিন্তু আমি আমার ছোট বেলায় নব্বইয়ের দশকেও উত্তর বঙ্গে বেশ অভাব অনটন দেখেছি । এখন সেখানে অভাব খুব একটা নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদের প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের এই উক্তিটি-
“কিন্তু মা তার সন্তানকে ফেলে কোথাও যান নি । আমি সেদিন গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম, আমাদের নারীদের দায়িত্ববোধ এবং কর্তব্য নিষ্ঠার ব্যাপারটাই আলাদা ।” যখন আমি পড়ছিলাম আমার চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে গিয়েছিল । এমনকি এখন এই লাইনটুকু লেখার মুহূর্তেও আমি খুব কাঁদছি । আমার খুব মনে পড়ছে হাজার অভাব অনটনের মাঝেও আমাদের বাঁচিয়ে রাখার, আমাদের চার ভাই বোনের সবাইকে পড়াশুনা করিয়ে মানুষ করার জন্য আমার মায়ের আক্লান্ত শ্রম, কষ্ট, কৌশল এবং আত্মত্যাগের কথা ।
আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি আমার বাবা একজন বর্গা চাষী ছিল । অন্যের জমিতে ফসল ফলিয়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতো । কিন্তু আমরা যখন বড় হতে থাকলাম, আমাদের সবার পড়াশুনার জন্য সংসারের খরচ বাড়তে লাগলো; তখন সেই বর্গা চাষের ফসলের আয় দিয়ে আমাদের সংসার আর চলতো না । সারাক্ষণ অভাব অনটন লেগেই থাকতো । আস্তে আস্তে বাবা বর্গা চাষ বাদ দিয়ে সংসারের প্রয়োজনে যখন যেমন পারে ছোট খাট ব্যবসা করতে লাগলো । এই ব্যবসার প্রয়োজনে বাবাকে কখনও ঢাকায়, কখনও অন্য জেলায় যেত হত । মাঝে মাঝে এক সপ্তাহ বা পনের দিনও হত বাবা বাসায় ফিরতো না । ফিরলেও এতো কম লাভ যা দিয়ে ভাল ভাবে সংসার চলতো না । তখন অভাবের তাড়নায় আমাদের যে কি কষ্ট হত । কখনও এমন হতো আমাদের দুই বেলা ভাত রান্নার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল নেই, দুই বেলা চুলোই রান্না করার মতো পর্যাপ্ত খড় বা খড়ি নেই । কারণ বাবা সেই সময় কোন ধান চাষ করতো না । চাল কিনে আনতো । গ্রামের রান্না করার প্রধান জ্বালানীই হচ্ছে নিজের ধান চাষের খড় । তখন মা সারাদিনে একবার ভাত রান্না করতো, সেখান থেকে রাতের জন্য খাবার আলাদা করে গামলায় নিয়ে গামছায় বেঁধে লেপের মধ্যে রেখে দিত । অবশ্য শীতের সময় এই কাজটা বেশি করতো । সেই ভাত রাতের বেলা পিয়াজ তেলে দিয়ে ভেজে খেতাম আমরা; মাছ, মাংস দূরে থাক কোন সবজি ছাড়াই । কোন কোন জায়গায় একে ভাত ভাজাও বলা হয় । আর গরমের সময় মা রাতের ভাত রাখতেন অন্য কৌশলে । রাতের বেলার ভাতে পানি ঢেলে পান্তা করে রাখতেন; কখনও সেই পান্তার পরিমাণ কম হলে তাতে চুলোয় চেপে জাল দিতেন এতে হাফ পাতিল পান্তা ফুলে এক পাতিল হয়ে যেত । আর এতে লবণ, ঝাল ও সরিষার তেলে আমরা প্লেট ভর্তি পান্তা ভোজন সারতাম রাতের বেলা । আবার কখনও এমন হত সামনে কয়েক মাস পর আমাদের পরীক্ষা; অথচ গাইড বা নোট কেনা হয় নি; তখন মা আমাদের সারা মাসের ভাতের জন্য যে চাল থাকতো সে চাল থেকে চাল বিক্রি করে আমাদের নোট বা গাইড কেনার ব্যবস্থা করতেন ।
“আমি আমার শৈশবে দেখেছি আমার বাবার যখন আয় ভাল থাকতো তখন তিনি সংসারের কর্তা । মায়ের পরামর্শ একদম শুনতো না ।তার আয় বাড়লেই মাছ, মাংস কিনে বা সংসারের অন্য কোন কাজে যা আমাদের পড়াশুনার চেয়ে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় সেই কাজে নষ্ট করে ফেলতো । অবশ্য এর জন্য বাবাকে মার কাছে অনেক বকা শুনতে হতো । আর যখন কোন আয় নেই, একটা টাকা হাতে নেই তখন মা সংসারের কর্ত্রী ।চরম দারিদ্রের সময় আমারা মাকেই দেখেছি সংসারের হাল ধরতে ।”
আমরা যখন আর একটু বড় হলাম আমাদের পড়াশুনার খরচ আরও বেড়ে গেল; সম্ভবত ১৯৯৬-১৯৯৭ সালের দিকে মা ব্র্যাকের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সদস্য হয়েছিল । সেখান থেকে খুদ্র ঋণ নিয়ে কখনও বাবার ব্যবসার পুঁজি বাড়িয়ে দিতো, কখনও আমাদের পরীক্ষার ফরম ফিল আপের টাকা যোগান দিতো ।
আমি ক্ষুদ্র ঋণের উপর বেশ কয়েকটা বিদেশী গবেষণা প্রবন্ধ পড়েছিলাম যাতে বেশ সুন্দরভাবে উল্লেখ আছে পুরুষের পরিবর্তে কেন নারীদেরকে ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহক হিসাবে নির্বাচন করছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিও সমূহ ? আমি নিচে সেই কারণগুলো উল্লেখ করছি-
১) পুরুষের তুলনায় নারীর ঋণ পরিশোধের প্রবণতা বেশি
ব্রাক সহ অন্যান্য এনজিও পুরুষের পরিবর্তে নারীকে ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহক হিসাবে নির্বাচন করার প্রথম ও প্রধান কারণ হচ্ছে পুরুষের তুলনায় নারীর ঋণ পরিশোধের প্রবণতা বেশি । জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে যে পুরুষের তুলনায় নারীর ঋণ পরিশোধের প্রবণতা অনেক বেশি ।
সংসার জীবনে কি ছাত্র জীবনেই দেখা যায় অনেক ছাত্র তার অন্য কোন ছেলে বন্ধু্কে নিজের মাসের খরচের টাকা থেকে হয়তো এক সপ্তাহর জন্য ধার দিয়েছে ।কিন্তু এক সপ্তাহে কি মসের পর মাস, বছরের পর বছর তার পিছনে ঘুরেও সেই টাকা উদ্ধার করতে পারেনি । এমন অনেকে আছে যারা বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা দাহ্র নিয়ে হয়তো একেবারে মেরে দিয়েছে । সারা জীবনে সেই ঋণ পরিশোধের চিন্তা এক বারও মাথায় আনে নাই । কিন্তু এমন কোন ছাত্রী হয়তো পাওয়া যাবে যে তার বন্ধুর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সে ঋণ পরিশোধ করে নি । দেরিতে হলে হাজার কষ্ট হলেও সে ঋণ কিন্তু সে পরিশোধ করেছেই ।
২) নারীর ক্ষমতায়ন
ব্রাক সহ প্রায় সকল এনজিও এর মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন । ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের আওতায় নারীদের এনে তাদের কুটির শিল্প, হাস-মুরগি, গরু-ছাগল প্রতিপালন বা সবজী চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে পরিবার ও সমাজে তাদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সমাজকে সমৃদ্ধ করা । ফজলে হাসান আবেদ তার স্কখাতকারে বলেছেন- “আমি নারীদের অংশ গ্রহণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি । আমাদের সমাজে নারীরা জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য পুরুষের পাশাপাশি কাজ করবে- এই ধারনাটা গ্রহণযোগ্য ছিল না ।…আমি বলি বাংলাদেশের নারীরা সব কাজ পারে । নারীরা শক্ত কাজ করতে পারে না এটা ঠিক নয় । আপনারা নদী থেকে নারীদের পানি আনা দেখেছেন । এক কাঁখে ভরা পানির কলস, অন্য কাঁখে বাচ্চা নিয়ে খাড়া নদীর পাড় বেয়ে নারীরা তরতর করে উঠে আসছেন- এই দৃশ্য আমি দেখেছি । নারীরা সব কাজ পারে না- এটা আমাদের পুরুষদের মনোজগতের সীমাবদ্ধতা । আমি এই ধারনাটা ভেঙ্গে দিতে চেয়েছি । ব্র্যাকের শুরু থেকে এই পর্যন্ত এই দৃষ্টি ভঙ্গি অব্যাহত আছে ।নারীর ক্ষমতায়নের পথে আমরা অনেকটাই অগ্রগতি অর্জন করেছি ।”
৩) সন্তান ও সংসারের প্রতি নারী বেশি দায়িত্বশীলতা
পুরুষের তুলনায় সন্তান এবং সংসারের প্রতি নারীর দায়িত্ব বোধ বেশি । আমরা সামজে এমন হাজার হাজার নারী দেখেছি স্বামীর মৃত্যুর পর শুধু মাত্র সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে নিজের জীবন যৌবন সব বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে বুকে আগলে জীবন অতিবাহিত করেছেন বা করছেন ।
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ বলেছেন-
“উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষ পীড়িত অনেক শিশুকে আমি দেখেছি, যাদের বাবা দায়িত্ব ফেলে পালিয়েছেন । অনেকেই নিরুদ্দেশ হয়েছেন । কিন্তু মা তার সন্তানকে ফেলে কোথাও যান নি । আমি সেদিন গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম, আমাদের নারীদের দায়িত্ববোধ এবং কর্তব্য নিষ্ঠার ব্যাপারটাই আলাদা ।”
এছাড়া নারী যদি স্বাবলম্বী হয় তাহলে একজন পুরুষের চেয়ে সে অধিক মানুষ সেই নারী কর্তৃক উপকৃত হয় । যেমন পুরুষ স্বাবলম্বী হলে সে শুধু নিজের স্ত্রী আর সন্তানের জন্য ব্যয় করতে আগ্রহী । কিন্তু একজন নারী স্বামী- সন্তান ছাড়াও বাবা-মা, শশুর, শাশুড়ি এবং নিজের ভাই-বোনসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের দুর্দিনে পাশে থাকে ।
UNCDF এর Microfinance বিষয়ক একটি বিশেষ ইউনিট একটি সার্ভে করে ফলাফল প্রকাশ করে যে “Women’s success benefits more than one improved .Several institutions confirmed the well-documented fact that women are more likely than men to spend their profits on household and family person. Assisting women therefore generates a multiplier effect that enlarge the impact of the institutions’ activities.”
৪) নারীর অর্থ অপচয় না করে সঞ্চয়ের প্রবণতা
দুই একজন বিত্তশালী পরিবারের নারী ছাড়া অধিকাংশ নারীর মাঝে পুরুষের তুলনায় অর্থ সঞ্চয় করার প্রবণতা বেশি থাকে । হাতে যেটুকু টাকা আসুক হোক সেটা বাসার গরুর দুধ, মুরগীর ডিম বিক্রি করে বা গাছের ফল যেমন পেয়ারা, আম, কলা বিক্রি করে বা বাড়ির আঙ্গিনার চালার লাউ, কুমড়া, শিম বিক্রি করে নারীরা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখে । এগুলো বিক্রয়ের মাধ্যমেও তারা ক্ষুদ্র ঋণের সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তি প্রদান করে থাকে । এমনকি আমি ছোট বেলায় আমার মা দাদি সহ অনেক নারীকে দেখেছি ভাত রান্নার জন্য যে চাল টুকু পাতিলে তুলেছে সেখান থেকে এক মুষ্টি চাল তুলে রাখতে । এটা দিয়ে হয় ফকিরকে ভিক্ষা দিবে বা সন্তান দোকানের খাবার যেমন বিস্কুট, চানাচুর বা বাদাম খেতে চাইলে ঐ মুষ্টির চাল বিক্রি করে কিনে দিত খাবার ।
৫)নারীর সমাজে অপদস্ত হবার অধিক ভীতি
ব্রাক সহ অন্যান্য এনজিও গুলো যেমন খুব সহজেই ক্ষুদ্র ঋণ দেয় তেমনি সেই ঋণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করলে নানা কৌশলে তা আদায়ের চেষ্টা চালায় । কখনও গ্রামের গণ্য মান্য লোক ডেকে মজলিস বসায়। আবার কখনও ঘরের চালার টিন খুলে নিয়ে যায় বা বাড়ির গরু বা ছাগল ধরে নিয়ে গিয়ে ঋণের টাকা উদ্ধার করে । সমাজে অপমান, অপদস্ত হবার ভয়ে নারীরা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং সর্বস্ব দিয়ে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা চালায় । কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে এ ধরণের প্রবণতা খুব কম থাকে । তারা সমাজে ক্ষুদ্র ঋণ খেলাফি হবার দায়ে অপদস্ত হবার ভয় তাদের খুব কম থাকে ।
৬) ওয়াদা রক্ষা করার প্রবণতা
পুরুষের তুলনায় নারীরা ওয়াদা রক্ষা করার ব্যাপারে বেশি সচেতন । ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে একটা পুরুষ তার ওয়াদা রক্ষা করতে যতটা সচেষ্ট তাকে নারী তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে সচেষ্ট থাকে ।
7) নারীরা দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম
নারীরা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্রতম জাতি । পৃথিবীর সব দেশে বিশেষ করে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি দরিদ্র । প্রায় এক যুগ আগেই বাংলাদেশের গ্রামীণ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে দেখা যেত পুরুষের হাতে টাকা থাকলেও নারীর হাতে কোন টাকা থাকতো না । সন্তান বাদাম, আইস্ক্রিম বা চানাচুর খাবার জন্য মায়ের কাছে এক টাকা চাইলেও মা দিতে পারতো না; এই এক টাকার জন্য বাবার কাছে ধরনা দিতে হতো বা মা বাসার চাল থেকে সন্তানকে একটু চাল দিত সেটা বিক্রি করে বাদাম বা চানাচুর বা আইস্ক্রিম খাবার জন্য । ১৯৯৫ সালে ইউএনডিপি এর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুসারে জানা যায় যে সেই সময় পৃথিবীতে ১.৩ বিলিয়ন লোকের মধ্যে ৭০% লোকে পার ডে আয় ছিল ১ ডালরের নিচে । আর এই দরিদ্রতম গোষ্ঠীর প্রায় সবটাই নারী । বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে জানা যায় যে প্রায় সব দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর কর্মসংস্থানের হার অনেক কম। আর যদি নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে নারীদেরকে পুরুষের তুলনায় কম বেতন দেয়া হতো ।
বর্তমান সময়ে উচ্চ থেকে নিম্ন সব শ্রেণির নারীর দারিদ্র আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে । সমাজের উচ্চ শ্রেণির নারীরা শিক্ষিত হয়ে চাকুরী গ্রহনে মনযোগী হয়েছে। আর নিম্ন বা মধ্যম শ্রেণির নারীরা ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে এবং কিছু কিছু নারী গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করার মাধ্যমে নিজেদের দরিদ্রতম অবস্থার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে । বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে দরিদ্রতম জাতির সংখ্যা কালের পরিক্রমায় আস্তে আস্তে কম যাচ্ছে ।
আমরা জানি যে সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী হচ্ছে নারী । সেই নারীকে চরম দুর্দশা এবং দরিদ্রতম অবস্থার মধ্যে রেখে কখনই কোন জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয় । বেগম রোকেয়া তার অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে বলেছেন “ যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে ঘুরিতে থাকিবে । তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না ।” ব্র্যাকসহ অন্যান্য এনজিও সমূহ নারীর অধিক সততা এবং পরিবারের প্রতি নারীর অধিক দায়িত্বশীলতার কারণে তাদেরকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রাদানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সৃষ্টির করে পরিবার ও সমাজকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে ।
শারমিন আকতার,বাংলাদেশ