একটা গল্প বলি। একটা নয়, একাধিক। আর গল্প বললে ভুল হবে, কারণ এতো ঘটে যাওয়া বাস্তব। ২৫শে জুলাই ২০১৯। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র্যাব) অফিস। টোলারবাগ, মিরপুর ঢাকা। র্যাব-৪-এর অফিস বললেই চেনেন স্থানীয়রা। সেখানে এক ভদ্রলোক এলেন, অভিযোগ করতে। বারে বারে প্রশ্ন করে তার অভিযোগ শোনার চেষ্টা। তিনি যতটুকু বললেন তা হলো, তার শিশুকে তুলে নিয়ে গলা কাটার হুমকি দেয়া হয়েছে। এ থেকে বাঁচতে তিনি যেন চাহিদা মতো টাকা (চাঁদা) দেন। টাকা দিলে মিলবে সমস্যার সমাধান।
‘পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের কল্লা লাগবে’- এমন খবর যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মানুষের মুখে মুখে, ঠিক তখনকার ঘটনা এটা। আরও ভেঙে বললে, মানুষের জবানে জবানে গুজব। এমন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে সমাজে বেড়ে যায় অপরাধ। আর সেই অপরাধের কারণেই মানুষ ভীত। অপরাধ বেড়েছে বলেই র্যাব-৪-এর কার্যালয়ে ভীতসন্ত্রস্ত বাবা আসেন অভিযোগ করতে। তার কথার ভিত্তি আছে (অপহরণ করে গলা কাটতেও পারে), কিন্তু পদ্মা সেতুকে জড়িয়ে এমন মনগড়া কথার ভিত্তি ছিল না। তবুও গ্রামের অনেক স্কুলে নিয়মিত উপস্থিতি কমে। শহরের মায়েরাও সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। তাদের এই উদ্বেগ আরও বাড়ে; যখন বাসায় এসে ছিনতাইকারী সব ছিনিয়ে নিয়ে যায়, আর ভয় দেখিয়ে বলে, কোনো টু শব্দ করলে গলা কেটে ফেলা হবে! ছিনতাইয়ের ঘটনাটি মিরপুর-৬০ ফিট এলাকার। এমন চিত্র শুধু বৃহত্তর মিরপুরের ছিল না, পুরো ঢাকার। এমনকি বাংলাদেশের।
প্রতিনিয়তই গুজব ছড়িয়ে স্বার্থ হাসিল করছে কোনো কোনো পক্ষ। তাই গুজবে নয়, বিশ্বাস করতে হবে গুজব ছড়িয়ে যারা ক্ষতি করতে চায় তাদের প্রতিহত করায়। তাই বলে গণপিটুনি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরিচিত লোক দেখলেই ‘ছেলেধরা’ ভেবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছে নিরপরাধ মানুষ। গত ২০শে জুলাই ২০১৯। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে রাজধানীর বাড্ডায় দুই সন্তানের জননী তসলিমা বেগম রেনুকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করে উচ্ছৃংখল কয়েকজন। পরে জানা যায়, নিহত রেনু ছেলে ধরা ছিলেন না। মেয়ের স্কুলে ভর্তির বিষয়ে খবর নিতে গিয়েছিলেন তিনি। এমনই পরিণতি হয়েছে প্রতিবন্ধী বাবারও। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির মাত্রা বেড়েছে। এমন ভয়াবহতা বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতেও পৌঁছায়। অভিভাবক কেন, যেকোন ব্যক্তিকে পিটুনি দেয়া মারাত্মক অপরাধ। এর নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে গণমাধ্যম হতে পারে মুখ্য মাধ্যম। এমনকি সরকার চাইলেই প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে- এতে করে মানুষ সচেতন হবে।
পদ্মা সেতুর জন্য মাথার বিষয়টাই ধরি। কিছু মানুষ ধরেই নিয়েছিল সত্যি এটা। এমন খবর পত্রপত্রিকা বা গণমাধ্যমে প্রথমে আসেনি। ভুয়া খবর পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এ নিয়ে শোরগোল হয়। তাই গণমাধ্যমের ওপর ওই শ্রেণীর (গুজবে বিশ্বাসী শ্রেণীর, এমনকি তারা গণমাধ্যম ফলোও করে কম) মানুষের আস্থা কম। আবার অনেক গণমাধ্যম তথা ভুঁইফোড় অনলাইন, ব্লগ, তথাকথিত ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ ইউটিউব চ্যানেল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এসব খবরকে এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে যেন মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। ফলে মূলধারার সংবাদপত্র বাদ দিয়ে কিছু মানুষ এসব ভূইফোঁড় সংবাদমাধ্যমের খবর বিশ্বাস করেছে। সেই সঙ্গে বিশ্বাস করেছে মাথার প্রয়োজনীয়তাও। মূলত সচেতনতার অভাবে এমনটা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেট সুবিধা বিস্তৃত হয়েছে। এতে অনেক ‘অযোগ্য’, ‘স্বল্প শিক্ষিত’, ‘প্রপাগান্ডায় বিশ্বাসী’ লোকজনের কাছেও ইন্টারনেট সুবিধা চলে গেছে। তারা যেকোনো বিষয় যাচাই-বাছাই না করেই বিশ্বাস করেন। এ জন্য বাড়ছে বিপত্তি। গুজব ছড়াচ্ছে দ্রুত।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার শুরু করলো, তার পেছনে ছিল তাদের দীর্ঘদিনের গুজব ছড়ানোর কলাকৌশল। রোহিঙ্গারা ‘খারাপ’, তারা সবাই ‘সন্ত্রাসী’ ‘দেশদ্রোহী’ ‘মুর্খ মুসলিম’, ‘বাঙালি’ ‘তারা রাখাইন সমাজের নয়’, ‘তারা কেবল সন্তান জন্ম দেয়’- এসব বলে প্রপাগান্ডা চালাতে শুরু করলো। সৃষ্টি হলো দেশব্যাপী রোহিঙ্গা বিদ্বেষ। যার ফলাফল তারা পেলো, ২০১৭ সালের আগস্টে। মিয়ানমার সেনারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করলেও, রোহিঙ্গা বলে তাদের বেশিরভাগ জনগণ তাতে সমর্থন দিয়েছে। কোন বার্মিজ নাগরিক প্রতিবাদ করেনি। সেনারা যা করছে ভালোর জন্য করছে- এটাই বিশ্বাস করেছে।
আরেকটা দেশীয় সত্য ঘটনা বলা যাক: বাসার কাজের বুয়ার কাছেও এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে। তার আছে ফেসবুক অ্যাকাউন্টও। সে ফেসবুকে দেখেছে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে বলে পোস্ট দেয়া হয়েছে। এ জন্য ছেলেধরা চক্র সক্রিয় হয়েছে। সুতরাং সে পূর্ণরূপে বিশ্বাস করেছে যে, ঘটনা সত্য। কিন্তু তার কথাটা আংশিক সত্য। ছেলেধরা চক্র সক্রিয় হয়েছে ঠিকই কিন্তু পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে তা বেঠিক। অতএব, মাথার গুজব ছড়িয়ে স্বার্থ হাসিল করাই এক শ্রেণীর অসাধু চক্রের কাজ। দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটা চক্র এটা করেছে। যেমনটা তারা ইতোপূর্বেও করেছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেও মাথার বিষয়টি অসত্য।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী। মাথার কথা সত্য হলে তার এ বাণীও ভুল! মানুষকে হেও করা হয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে। যার ফায়দা দিয়েছে অসাধু চক্র। ঠিক তেমনি ২০১৩ সালের মার্চে চাঁদে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেহারা দেখা গেছে বলে গুজব ছড়ানো হয় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। যার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল। এছাড়া কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে হামলা কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে তাণ্ডব চালানোর পেছনেও ছিল পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো গুজব। এমনকি রাজধানী ঢাকার সড়কে ২০১৮ সালে কিশোরদের আন্দোলনের সময় ধর্ষণ ও খুনের গুজবও ছড়ানো হয়। সেসময় আটক হয়েছিলেন এক অভিনেত্রী।
কয়েক জেলায় দুই-তিনদিন বিদ্যুৎ থাকবে না বলেও একই সময় গুজব ছড়ানো হয়। ২০১৯ সালে ব্যাপক আকারে ডেঙ্গু ছড়ালে তা নিয়েও প্রথম দিকে গুজব ছড়িয়েছেন কেউ কেউ। যা মানুষকে তার স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকে অন্যমনস্ক করেছে, বিভ্রান্ত করেছে। কারণ, ভুয়া খবর- খবর নয়, গুজবও খবর নয়। এ অবস্থায় বেড়ে যাওয়া উচিত সাংবাদিকতার কদর। কারণ চারদিকে সব ভুয়া তথ্য, সঠিক তথ্যের জন্য সংবাদমাধ্যমেরই মূল ভূমিকা নেয়ার কথা। অথচ বাস্তবে তা হচ্ছে না। এ জন্য গণমানুষের সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করতে হবে।
যেকোনো একটা ঘটনা ঘটলেই ফেসবুকে তার ঝড় বয়ে যায়। দুদিন, চারদিন সে ঝড় চলতে থাকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে। তখন যেন সবাই ‘অতি পণ্ডিত’। ক্লাস টেনের শিশু থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাস না দিলেও আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, আমি যে মতামত প্রকাশ করলাম না, জাতি কি আমাকে মেনে নেবে! শত শত স্ট্যাটাসের ভিড়ে সত্য তখন হালকা হতে থাকে। চিলে কান নিয়েছে বলে যে গুজব আছে, ঠিক সে রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি কাজ করছে, সংবাদমাধ্যম কি ছাপছে, কী বলছে, তার দিকে নজর নেই, চিলের পেছনে কান উদ্ধারের চেষ্টা চলে। সুতরাং এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিছু একটা ঘটলেই ফেসবুকে লিখে, মতামত দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার কিছু নেই। অক্ষরজ্ঞান আছে বলেই লিখতে হবে তা নয়। নিরবে পর্যবেক্ষণ করাও জ্ঞানীর পরিচয়। মানুষ চুপ থাকছে না বলেই আস্থা রাখতে পারছে না মূল ধারার গণমাধ্যমের ওপর।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক ভালো দিক রয়েছে। তেমনি খারাপ দিকও গুণে গুণে কম নয়। ২০১৯ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। রাত তিনটার দিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝ থেকে আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই রাতেই হলটির ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পেটান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানান, তার মরদেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। আবরার বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭ তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী ছিলেন। ভারত-বাংলাদেশের অসম চুক্ত নিয়ে ফেসবুকে লেখার বলি হন তিনি। ফেসবুক স্ট্যাটাস এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তা কেড়ে নিয়েছে পরমতসহিষ্ণুতাও।
অক্টোবরের মাঝামাঝি ফেসবুকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে হেয় করে স্ট্যাটাস দেয়ার ঘটনায় ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় উত্তেজিত মুসল্লি রাস্তায় নামেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটে। নিহত হন বেশ কয়েকজন মুসল্লি। একই সময়ে জেলায় হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মন্দির এবং বাড়িঘরে হামলা চালায় অজ্ঞাত পরিচয় বিক্ষুব্ধ জনতা। পরে জানা যায়, যে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এমন মন্দ স্ট্যাটাস ছড়ানো হয়েছিল, সেই অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়। এই হ্যাক করার অভিযোগে আবার আটক হন দুই মুসলিম ব্যক্তি।
ভোলার ঘটনায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় খুলনার একজন সাংবাদিক, নাম মনির উদ্দিন আহমেদ শান্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। মামলায় উল্লেখ করা হয়, সাংবাদিক মুনির উদ্দিন ভোলার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। তার বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করা, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা, হিন্দু-মুসলমানদের সম্প্রীতি বিনষ্ট করা এবং পুলিশ বাহিনীর মনোবল নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়। সুতরাং সাবধানতা অবলম্বন করাই এক্ষেত্রে জরুরি। হয়ত ভবিষ্যতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা এমন সংকট আরও সৃষ্টি হবে, তবে এর রাশ টেনে ধরাই কমাতে পরে সংকট।
প্রচীন কথা। রাজা পঞ্চদশ লুইসের সময় ফ্রান্সের প্যারিসের রাস্তা থেকে একের পর এক শিশু গুম হয়ে যায়। রাস্তায় বেরিয়ে এক বাবা প্রতিবাদ শুরু করেন। এরই মধ্যে খবর আসে, রাজা লুইসের নাকি কুষ্ঠ রোগ হয়েছে। শিশুদের তিনিই অপহরণ করছেন, যাতে তিনি শিশুদের রক্তে গোসল করতে পারেন। ১৭৫০-এর দিকে এ গুজবটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কুষ্ঠ রোগের সঙ্গে মানুষ শিশুর রক্তের বিষয়টি মেলায়। ঠিক যেমন পদ্মা সেতুর সঙ্গে শিশুর মাথা। সৌভাগ্যক্রমে প্যারিসের ঘটনাটিও গুজব ছিল, শিশুরা আবার তাদের পরিবারে ফিরে আসে। সুতরাং মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখাই সমাধান একমাত্র।
১৭৬১ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পরপর দু’বার ভূমিকম্প হয়। তখন মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। ১৭৬১ সালের ৫ই এপ্রিল বড় একটি ভূমিকম্পের শিকার হবে লন্ডন, ধ্বংস হয়ে যাবে সবকিছু- এই বলে প্রচারণা চালাতে থাকে একজন সৈনিক। সাধারণ মানুষ দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে সময় নেয়নি। অস্থির হয়ে পড়ে জনতা। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। কয়েক মাস পর সৈনিকটির জায়গা হয় একটি মানসিক হাসপাতালে।
তবে এ কথাও সত্য যে সবার আগে ‘নিউজ ব্রেক’ করার প্রতিযোগিতায় নেমে সঠিক নয় এমন সংবাদ পরিবেশনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। পত্রিকাগুলোর অনলাইন জনপ্রিয় করতে চটকদার, জাঁকালো শিরোনাম দেয়া হচ্ছে। সংবাদকে অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে। অবশ্য ওই একই খবরের শিরোনাম পরদিন কাগজের পত্রিকায় এমন হয় না। কিন্তু ততক্ষণে অনলাইনে অনেক পাঠক সেই চটকদার শিরোনাম পড়ে সংবাদটির বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন। আবার অনেকে বিশ্বাসও করেন।
এটাও সত্য যে, অনেক সাংবাদিক জানেন না কীভাবে তথ্য যাচাই করতে হয়, অনেকের জানা নেই যে একটি ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখতে হলে ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত সব পক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে হয়। তাদের বক্তব্য প্রতিবেদনে রাখতে হয়। এমনকি, অনেক সাংবাদিকের জানা নেই, খবরের বা তথ্যের সূত্র উল্লেখ করতে হয়। প্রতিবেদনকে আকর্ষণীয় করতে অনেকে ‘হলুদ সাংবাদিকতার’ আশ্রয় নেন। এর মাধ্যমে মানুষের মনে বিভ্রান্তি দানা বাঁধে। অনেকের রয়েছে পড়াশোনার ঘাটতি- এটাও সত্যি। সাংবাদিকতা মানে পড়াশোনার মধ্যে থাকা, যা থেকে আজকাল অনেকেই বিচ্যুত। অন্য বিষয়ে, অনুষদে পড়লেও সাংবাদিকতা করা যায়, কিন্তু এ পেশায় যুক্ত হওয়ার আগে সাংবাদিকতার বেসিক পড়াগুলো পড়ে নেয়া উচিত। এতে নীতি-নৈতিকতা সম্বন্ধে জানা যাবে। সাংবাদিকরা সবাই অন্য পেশার দুর্নীতি নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন আপনার পেশার দুর্নীতিগুলো কী? আপনি সৎ না হলে আপনার লিখাও সৎ হবে না। আপনি পক্ষপাতদুষ্ট রয়ে যাবেন, আর যার খেসারত দিতে হবে সাধারণ পাঠককে; তা হতে পারে না। এছাড়া দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা পড়াশোনায় রিউমার নিয়ে কোর্স বাধ্যতামূলক করা উচিত। যতদূর জানি, সবখানে এই কোর্স নেই, এটি চালু করা সময়ের দাবি। ফলে যারা সাংবাদিকতার ছাত্র-ছাত্রী তারা শুরু থেকেই সচেতন হতে পারবেন। প্রয়োজনে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও এই কোর্স যেন নিতে পারেন, সে বন্দোবস্ত করতে হবে।
তারপরও বলবো, পাঠকের সচেতনতা এ যুগে এসে জরুরি। পাঠক এখন শিক্ষিত। তার জ্ঞানের পরিধি বেড়েছে। সব দোষ সংবাদকর্মীর নয়। যারা ভুয়া খবর ছড়ায় তাদের প্রতিহত করতে হবে, সেই সংবাদমাধ্যমকে বর্জন করে। ‘আমি তোমায় ভুলতে পারি না’ ধরনের তৃতীয়-দ্বিতীয় শ্রেণীর অনলাইন সম্পর্কে পাঠককে সচেতন হতে হবে। ইউটিউবে উমুক নিউজ, তুমুক খবর নামের চ্যানেলগুলো ঘরে বসে টাকা কামাতে তৈরি। তারা চায় শুধু সাবস্ক্রাইব আর ভিউ। এগুলো মনগড়া, বানানো খবর ছড়ায়। এমন মন মতো খবর তৈরির প্রতিযোগিতায় ছড়িয়ে পড়ে ভুয়া, ভিত্তিহীন আর গুজব তথ্য। যা কিনা এই ইন্টারনেটের যুগে ‘ভাইরাল’ হয়ে ছড়িয়ে সৃষ্টি করছে বিপত্তি। তাই মেইন স্ট্রিম মিডিয়াকেই (Mainstream Media বা মূল ধারার সংবাদমাধ্যম) গুরুত্ব দিতে হবে পাঠককে।
মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের সংজ্ঞা কী? এমন প্রশ্নের উত্তর অনেক লম্বা। স্বল্প কথায় যারা পেশাদার, সংবাদকর্মী মাঠে কাজ করে, দায়িত্বশীল, ভুয়া খবর ছাপে না, সংবাদের বিনিময়ে অর্থ আদায় করে না, প্রকৃত সংবাদ প্রচার করে, দেশব্যাপী জনপ্রিয় তাদের মূল ধারার বলা যায়। এ জন্য সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কাজ করতে পারে। তারা মূল ধারার জনপ্রিয় টেলিভিশন, পত্রিকা ও অনলাইনের একটা তালিকা করতে পারে। পাঠক শ্রেণি-বিভাগের মাধ্যমে এ তাকিলার ক্রম হতে পারে। এতে করে মানুষও বুঝলো যে মূল ধারা কী। অন্তত দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে তাদের ধারণা হলো। এতে করে ভুঁইফোড় অনলাইনকে বিশ্বাস করা কমে আসবে। আস্তে আস্তে মানুষও সচেতন হবে। শিক্ষা, সুুশিক্ষায় রূপ নেবে।
সত্য ঘটনা যখন মানুষকে জানানো হয়, তখন সেটা ‘প্রচার’। অসত্য যখন সত্য হিসেবে মানুষকে জানানো বা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করা হয়, তখন সেটা ‘প্রপাগান্ডা’। একটা সময় চলচ্চিত্র ছিল প্রপাগান্ডার মাধ্যম। বর্তমান যুগে এসে সাংবাদিকতার নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে হাতিয়ার করে চলছে প্রপাগান্ডা।
বর্তমান যুগ নিউ মিডিয়ার। পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক ছাপা সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে আছে শুধু অনলাইন ভার্সন। এ অবস্থায় সাংবাদিকতার সংকট নয়, মৃত্যু ঘটতে চলেছে, এমনটাই মনে করেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন, সংবাদমাধ্যম যুগের অবসান ঘটছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগের জগৎ ও মাধ্যমটা এখন আর সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে নেই, অসংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। অসংবাদমাধ্যম বলতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই বোঝানো হচ্ছে (গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, আমাজনসহ আরও কিছু মাধ্যম)। এই অসংবাদমাধ্যম আরও শক্তি অর্জন করেছে যখন এ থেকে মানুষ আয়ের উৎস খুঁজে পেয়েছে তখন। অসংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দাতারাও ছুটছেন। এতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপন। কমতি পড়ছে গণমাধ্যমের আয়ে। তবুও সাংবাদিকতাতেই শুদ্ধ সংবাদ মেলে। তবে তা হতে হবে মূল ধারার। ভুঁইফোড় সংবাদমাধ্যম (ওয়েব সাইট), ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করলেই হবে না। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাও করতে হবে বন্ধ। মানুষকে ভুঁইফোড় সংবাদমাধ্যমের খবর বিশ্বাস না করায় উৎসাহ দিতে হবে। ফলে তৈরি করতে হবে সরকারি সচেতনতা (মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের তালিকা প্রকাশ)।
দায়িত্বশীল জায়গা সাংবাদিকতাই। তাই পাঠককে সত্য জানতে সংবাদমাধ্যমের কাছেই আসতে হবে। তার জ্ঞানকে শাণিত করার জন্য প্রয়োজন সংবাদমাধ্যমের। কোনো অসংবাদমাধ্যম এ জায়গা নিতে পারে না। নেয়ার চেষ্টা করলেই ছড়াবে গুজব। সামাজিক মাধ্যম দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জ করলে ভবিষ্যতে সংকট আরও পোক্ত হবে- এই ধ্রুব সত্য সাধারণ মানুষকে বোঝতে হবে। সামাজিক মাধ্যমকে তার নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই রাখা উত্তম। তখন গুজব আর মিথ্য কথা দ্রুত ছড়াবে না। গুজব ছড়ালে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমেরও উচিত দ্রুত এটা নিয়ে কাজ করা। গোড়ায় এর বিনাশ ঘটনাতে প্রকৃত সত্য জনতার কাছে তুলে ধরা। গুজবে ফায়দা নেয় সুযোগ সন্ধানী মানুষেরা। তাই জীবনে চলার পথে হতে হবে সার্বিক সচেতনও।
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক ও সাংবাদিক