কান্না

ছোট গল্প

0
816

কলকাতা থেকে

তৃষা সরকার

বাসনগুলো মাজা শেষ করে রিয়া সবে কলতলা থেকে উঠতে যাবে ঠিক সেই সময় অনুভব করলো একটা শক্ত হাতের ছোঁয়া তার কাঁধ বেয়ে অযাচিতভাবে নেমে আসছিল তার পিঠে। রিয়ার ঝাঁজালো দুটি চোখের তেজ নাকি কে জানে লোকটি আমতা আমতা করে বলল- “বাবু ডাকছে, গিয়ে দেখা করে আয়।” বুবাই বহুদিন ধরে তার সাথে এরম করছে, ব্যাপারটা ঠিক ঠেকছে না রিয়ার। তবে পেটের দায়ে করা এই কাজ টি ও যদি না করে তবে হয়তো না খেয়ে মরে যাবে।

বাবুর কাছ থেকে রিয়া তিন মাসের মাইনে নিয়ে একটু তাড়াহুড়োতেই বেরিয়ে গেল নদীর পাড়ে। সে রাজকে ভালোবাসে- তবে সে জানে যে এ গ্রাম তাদেরকে একসাথে থাকতে দেবে না। হয়তো জানতে পারলে দুজনকে একসাথে পুড়িয়ে মারবে। কারণ রাম উচ্চ বংশের ছেলে আর রিয়া র কোনো সঠিক পরিচয় নেই। তাই আজই তারা পালিয়ে যাবে। পালাতে তার যে ভয় লাগছে না তা বলা ভুল কিন্তু সে ভয়ের সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছে। বুবাইয়ের শক্ত হাতের অযাচিত স্পর্শ আর কোমর হয়ে উপরে বেয়ে ওঠা বাবুর নজর- এসবেও তো তার বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে- তাই ভয় তার জীবনে নূতন কিছু না।

পুকুর ধারে অপেক্ষা করছে রিয়া। তার হঠাৎ মনে পড়লো ছোট্ট বেলায় চিড়িয়াখানায় যাওয়ায় কথা। মামার সাথে পাঁচ বছরের ছোট্ট রিয়া চিড়িয়াখানায় এসে থ হয়ে গেছে। বাঘ সিংহ যে তার দিদার বলা গল্পের পরী বা রাক্ষ্মসের মতো কোন আজগুবি চরিত্র না- এটা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। হাতির খাঁচার সামনে এসে সে মামা কে জিজ্ঞেস করেছিল- “আচ্ছা এত বড় হাতির পায়ে ঐ সরু চেন কেন মামা ? হাতিটা তো সহজেই নিজেকে খুলে নিতে পারে ঐ চেন থেকে ” মামা মুচকি হেঁসে বলেছিল – “হাতিটা হয়তো যখন ছোট ছিল তখন তাকে বাঁধা হয়েছিল – ছোট বেলায় সে খুব চেষ্টা করেছিল হয়তো কিন্তু সে বাঁধন ভাঙতে পারেনি তাই সে ভেবে নিয়েছে এ বাঁধন ভাঙা অসম্ভব। আজ তার কাছে বল থাকলেও হয়তো সে বিশ্বাস নেই। কোথায় দূরে যেন অজানা পাখি ডেকে ওঠায় রিয়ার খেয়াল ফিরলো।তার মনে হলো ওই হাতি টার মত তার বিশ্বাস ও হারিয়ে গেছিল। সে যে ভালো করে বাঁচতে পারে সে বিশ্বাস ভেঙে গেছে সেই ছোট্ট বেলায়। কিন্তু রাজ যেন তাকে সে বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। তার নজর তার বুকের খাজ বা তর কোমরে থাকে না, তার নজর শুধু খোঁজে তার দুটি চোখ।

রিয়া সেই ছোট্ট পাঁচ বছর বয়সে বুঝে গেছিল তার জীবনে ভয় বা কান্না কোনটার জন্যই মুখ ভার করে বসে থাকার বিলাসিতা নেই। সেই ছোট্টবেলায় তার বাবা মোটা আঙুলের বাঁধন হালকা করে রিয়া কে ছেড়ে পালিয়েছে গ্রাম থেকে দূর এক মেলায়। মেলার লোকের ভিড়, লাউড স্পিকারের আওয়াজ, লোকের চেঁচামেচি তার মাঝে গলা ফাঁটিয়ে কেঁদে যাওয়া মেয়েটাকে কেউ লক্ষ করেছিলো কিনা কে জানে। তার বাবা তাকে কোনদিন ভালোবাসেনি। তার ঠাম্মা বলেছিল যে তার জন্মানোর পর তার বাবা তাকে কতবার মারতে চেয়েছিল কিন্তু সে নির্লজ্জের মতো বেঁচে গেছে। সেদিন একটানা চার ঘন্টা কাঁদার পর তার গলা দিয়ে স্বরই বেরচ্ছিল না। চোখের জল ও যেন মেলার আলো ও উত্তেজনার মতো ফুরিয়ে গেল। অজান্তেই সে ভুলে গেল কাঁদতে, হাঁসতে ও ভাবতে। চায়ের দোকানে বা কারো বাড়িতে বাসন মেজেই ছোট্ট রিয়া কবে বড় হয়ে গেল। তার শরীরে ও লাগলো যৌবনের ধার। সে যেন সব পুরুষের চোখেই দেখতে পেতো শরীরের লোভ। তাদের চোখ যেন তার শরীরের বাঁকের সাথেই কথা বলে। এই একঘেয়ে জীবনে রাজ ছিল তার ব্যতিক্রম। নদীর পাড়ে অপেক্ষা করতে করতে সব স্মৃতি যেন জড়ো হচ্ছে তার সামনে।

“রাজকে ওরা ধরে ফেলেছে, তারা সব জেনে গেছে রিয়া “- রমার কাঁপা স্বর এক ধাক্কায় মুছে দিল সেই স্মৃতির জগৎ। রিয়া ছুটে গেল পঞ্চায়েত সভার বুড়ো বটটার কাছে। ঝোপের আড়ালে রমা তার হাত টেনে বসিয়ে দিল। তার বুকের ধুকধুকানি কয়েক গুন বেড়ে গেল। রাজকে তারা ইতিমধ্যেই অনেক মেরেছে। রাজের কাকা নিজে তার গায়ে পেট্রল ঢেলে দিল তারপর শোনা গেল রাজের চিৎকার। কিন্তু রিয়া যেন কিছু শুনতে পাচ্ছে না- সব যেন এক দূস্বপ্ন। এরপর তারা বুঝি তাকে ও পুড়িয়ে দেবে, সে যেন কেমন স্বপ্নের ঘোরে বাড়ি র পথে পা বাড়ালো। দৃষ্টি তার ঘোলাটে ।সে তার ছোট্ট ঘরে শিকল ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল। ইতিমধ্যেই লোক জমতে শুরু করেছে তার বাড়ির চারপাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেও হয়তো ছাই হয়ে যাবে। মাথার ভিতরে রাগ ও প্রশ্ন একই সাথে ফুলিয়ে দিচ্ছে তার শিরা উপশিরা, কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। তার লাল চোখ গোধূলির লাল সূর্যের চেয়েও গাড়, কোথা থেকে যেন কে বলে উঠলো “আরে এত ভাবনা কিসের, দে আগুন লাগিয়ে দে,” আগুনের তেজ নাকি তার অন্তরের কে জানে তাকে পোড়াতে থাকে। তার শুধু ইচ্ছা করে একটু কাঁদতে, জমে থাকা সব কথা বলে ফেলতে- সেই পাঁচ বছরের রিয়া যেরম কেঁদেছিল – ঠিক সেরকম। কিন্তু তার কাছে আর সময় কোথায় ? হয়ত সত্যি বাবুর চোখের নোংরা দৃষ্টি, বুবাইয়ের শক্ত হিংস্র ছোঁয়া বা তার বাবার তাকে মারার ইচ্ছা – কোনটাই দোষের ছিল না। হয়তো দোষের ছিল শুধু তার ভালোবাসা ও মৃত্যুর কাছে একটু কাঁদার সময় চাওয়া ।

লেখক: শিক্ষার্থী – কলকাতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here