আমেরিকা থেকে
শামসুল আরেফিন খান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ‘জয় বাংলার’ ঢেউ লেগে উদ্বাস্তু বাঙালিদের মনে বেশ একটু রঙ ধরেছিল। বঙ্গবন্ধু ভোরের পূজার অর্ঘ্য পেতে শুরু করেছিলেন। তখন কম্যুনিস্ট নেতা সর্বভারতীয় ব্যক্তিত্ব শ্রী জ্যোতিবসু ‘হিন্দি ভাষা ভিত্তিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের’ পক্ষে শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সেই ‘বাঙালি আবেগের’ ফুলকিতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। সেসময় একভক্ত তাকে প্রশ্ন করেছিল, কমরেড আপনার ললাটে উত্যুঙ্গ বৃহষ্পতির পরশ লক্ষ্য করছি। আপনি কী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চান? জ্যোতিবাবু নাকি উত্তরে বলেছিলেন, “স্বপ্নদেখা অন্যায় না। কিন্তু আমি এখনও পাগল হইনি”। সেভাবেই অবশ্য তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে শ্রমতি ইন্দিরা গান্ধীকে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি তখন নিজগুনে ভারতীয় বাঙালিদের অবিসম্বাদিত নেতা হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু সেই আবেগী চত্বরে একটু অন্যরকম অবস্থান করে নিয়েছিলেন। সেটা তাঁর মনে কোন আঁচড় কেটেছিল কিনা সেটা জানি না। তবে ভারতে পুনর্বাসিত হওয়া পূর্ব বঙ্গীয় বাস্তত্যাগীদের মনে যে বাষ্প জমেছিল তাতে বেশ খানিকটা উষ্ণতা ছিল। আমি তার একটু নিবিড় পরশ পেয়েছিলাম একাত্তরে তুমুল বর্ষার সময়। অবিশ্রান্ত বর্ষণে সমগ্র বিহারতখন জলমগ্ন ছিল। আসামের করিমগঞ্জ থেকে কলকাতা যেতে প্রায় আটদিন লেগে গেলো। বন্যায় ডোবা রেলপথে রোমাঞ্চকর একটানা মন্থর যাত্রায় এক বস্ত্রে থাকতে তেমন কোন কষ্টই বোধ করলাম না। দীর্ঘ রেলভ্রমণে কোন ক্লান্তি আসলো না। কারণ ছিল এক অবিশ্বাস্য হার্দ্য ও সখ্যের অনবদ্য অভিব্যক্তি। আন্তরিক আপ্যায়ন সারা পথ জুড়ে। প্রথম শ্রেণিতে চড়ে বসেছিলাম দুরু দুরু বুকে। টিকিট ছিলনা। বেসরকারি “ত্রান কমিটির” একটা পরিচিতি চিরকুট আর রণাঙ্গনের একটা পরিচয়পত্র সম্বল। পকেট বলতে গেলে গড়ের মাঠ। কিন্তু বুফে কার থেকে তিন বেলা চর্বচোষ্যের সরবরাহ কীভাবে বিনা পয়সায় পেলাম তা বুঝতেই ই পারলাম না। সেই সাথে সহযাত্রীদের কাছ থেকে চপ কাটলেট- চা কফি নিরন্তর। টিকিট চেকাররা ছিলেন প্রায় সবাই পূর্ববাংলায় মা-মাটি ফেলে আসা আবেগপ্রবণ মানুষ। প্রতি ঘাটে কেউ না কেউ এসে আর এক স্টেশন না আসা পর্যান্ত আদর আপ্যায়নে ডুবিয়ে রেখেছেন আমাকে। কত না তাদের সুখ দুঃখের স্মৃতিচারণ। মনোবেদনার বিস্ফোরণ। কী যে উচ্চতা তাঁদের স্বপ্ন-বাসনার!
স্বদেশে ভিনদেশী
মনে আছে ! ইতিহাসের আর এক অধ্যায়ে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এমনি আদর অপ্যায়ন পেয়েছিলাম রেল ভ্রমনে। সেটা ছিল ১৯৬৩ সাল। আমি আর প্রিয় ব্যক্তিত্ব অগ্রজ সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরি লাহোর থেকে রাওয়াল পিন্ডি যাচ্ছিলাম। সে আবেগের মর্ম ছিল একটু ভিন্ন। তাদের কাছে ছিলাম স্বদেশে ভিনদেশী। আর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে একাত্তরে যাদের সান্নিধ্য পেলাম তাঁরা আমার কাছে ভিন দেশে স্বদেশী। পার্থক্য সেটাই। একাত্তরে কলকাতায় সেটাই আমার প্রথম ও শেষ সফর। পকেটের করুণদশা। উঠলাম গিয়ে শিয়ালদার অদূরে শ্রীনিকেতন হোটেলে। তিনবেলার আহারসহ ১০ টাকায় পরিচ্ছন্ন আবাসন। মাথার উপর বিজলী পাখা। কমন বাথই যা বারোয়ারি ব্যবস্থা। সব মিলে সুন্দর রুচিশীল পরিবেশ। ভাবলাম গোবরায় মাকে দেখতে যাব। ২৫ জানুয়ারি, ১৯৪৪ থেকে স্বজন হারা নিঃসঙ্গ আমার মা সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত। কিন্তু প্রয়াত লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে ঠিকানাহীন তাঁকে খুঁজে পেলাম না। অবাধ্য অশ্রুজলে তাঁকে খুঁজলাম হৃদয় গভীরে যেখানে তাঁর উপস্থিতি নিরন্তর ও নিরবধি থিয়েটার রোডের কাজ সেরে তিনদিনে পরে যখন চেক আউট করলাম তখন হোটেলের ভাড়া মিটিয়ে শিয়ালদায় যাওয়ার রিকশা ভাড়াও থাকলো না। মাল সামানা বলতে একটা হালকা ব্যাকপ্যাক। তাই নিয়ে স্টেশেনের পথে পা বাড়ালাম। হাওড়া ব্রিজে উঠে দেখলাম থমথমে পরিবেশ। মানুষের চোখে আতঙ্ক।
শিয়ালদায় এসে ‘সি-আর-পির’ নক্শাল নিধনযজ্ঞের ভয়ঙ্কর ও মর্মস্পর্ষী কিছু লাইভ দৃশ্য দেখতে পেলাম ফিরতি যাত্রাশুরু হওয়ার একটু আগে। একটা হুইসেল বাজলো। সঙ্গেসঙ্গে চারিদিকে তার প্রতিধ্বনি ঘটলো। শিয়ালদা স্টেশনে বিচরণরত হাজার হাজার মানুষ হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে গেলো। ঠুস ঠাস কিছু শব্দ। বুটের দ্রুত বিচরণ ও নিষ্ক্রমণ। প্যান্টের ওপর বাংলা পাঞ্জাবি পরা টগবগে চক চকে কিছু যুবকের দৃশ্যপটে প্রবেশ। তাদের একহাতে চকচকে পিস্তল। অন্য হাতে লাশটানা রশি। দমকলের হোসপাইপে রক্ত ধুয়ে গেলো। রক্তের হোলিখেলা কুশিলবরা নিষ্ক্রান্ত হ’ল বিদ্যুৎবেগে, এসেছিল যেমন হুটহাট ত্বরিৎ বেগে। আবার লোকে লোকারণ্য। ট্রেনের ফার্স্টক্লাস কমপার্টমেন্টের দরজার হাতল ধরে হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পাশের যাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা কী ব্যাপার? কিসের এত হুলুস্থুল? ভীত সন্ত্রস্তভাবে সহযাত্রী অস্ফুটে বললেন, সিআরপি..যুব..কংগ্রেস ! হওড়া ব্রিজে আরও ৬টা লাশ পড়েছে। ট্রেন ঝিকঝিক করে চলা শুরু করলো বিহার অভিমুখে। আমি ফিরে যাবো গোহাটি হয়ে শিলচর। সেখান থেকে করিমগঞ্জ। আবার অন্ততঃ ৭ দিনের ধাক্কা। বন্যা পরিস্থিতি তখনও বলতে গেলে অপরিবর্তিতই ছিল।
নক্শালবাড়ির ঢেউ
নক্শাল বাড়ির রক্তজলের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল গাঙ্গের অববাহিকায় পদ্মা যমুনার বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঠিকানায়। তা গড়িয়েছিল ৭২ সালে সর্বহারা নেতা সিরাজ শিকদারের এনকাউণ্টার ও তৎপরবর্তী রক্ষীবাহিনী অপারেশনে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম দূরদর্শী জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু কেন তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের পতাকায় ৫৪ হাজার বর্গমাইল ভূখন্ডের মানচিত্র জুড়ে দিয়েছিলেন? কেন অর্বাচীণ এক ছাত্রকর্মীর হাতে তুলেদিয়ে ১ মার্চ একাত্তর সেই অসাধারণ পতাকা জন লোকে ভবন শীর্ষে উত্তোলন করতে বলেছিলেন? কেন অপর এক তরুণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ইশতেহার? আসামসহ সপ্তকন্যার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতার প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশীর জন্যে সেটা ছিল নিরাপত্তা ও বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার। আমাদের জন্যে নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর হুশিযারি। মনের আবেগ এমন উচ্চতায় উথলে উঠতে পারবে না, যাতে ক‚ল ছেপে কোন বিপত্তি ঘটে। এটার খুব প্রয়োজন ছিল। তা না হলে বায়ান্নোর মহান একুশের সেক্যুলার আবেগ এপার বাংলা ওপার বাংলার কূল ভাসিয়ে সব স্রোতধারায় বাঙালি আবেগের ঢল নামিয়ে চরম বিপত্তি ঘটাতে পারতো। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের সীমানা দেগে দিয়েছিলেন। সম্ভাব্য ‘কাটাতারের বেড়ায়’ ঝাঁকি দিয়ে সেটা কতটা মজবুত তা পরখ করে তবেই যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন শ্রীমতি গান্ধী। দুজনের দূর দর্শিতায় নিবিড় ছিল গভীর প্রজ্ঞা। তাতেই বাঙালি জাতি ৫২-র ভাষা বিপ্লবের সেক্যুলার ভেলায় ভেসে ৭১ এ ভালোবাসার নিসর্গ রচনা করতে পেরেছিল।
ধন্য সে মহাপ্রাণ
আমি ভাগ্যবান, তাই মাত্র ১২ বছর বয়সে ভারতবর্ষের সেই সর্ববৃহৎ সেক্যুলার বিপ্লবের সূচনাকালে বাত্যাতাড়িত হয়ে যুধিষ্ঠিরের ক্ষণিক নরক দর্শনের মত একচিলতে কারাবাসের স্বাদ নিতে পেরেছিলাম। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সকালে স্কুলের সহপাঠীদের সাথে এসেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাস্থলে। ১৪৪ ধারা ভাঙার ঘোষণা, মিছিল, লাঠিচারয, টিয়ারগ্যাস ; সবই মনে আছে। দুপুরে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভিতরে উপরে ওঠার সিড়িতে একা দাঁড়িয়েছিলাম। পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত রক্তাপ্লুত বরকতকে বহন করে আনলো তার সহযোদ্ধারা। মোজাইক ফ্লোরে রক্তের বড় বড় ফোঁটা রক্ত জবা হয়ে ফুটেছিল। তা মনে আছে। কিন্তু কখন আমি বাইরে যেয়ে মিছিলে মিশে গেলাম; গ্রেফতার হলাম; সে কথা মনে করতে পারি না। সন্ধ্যায় সেই ঘোর কাটলো। তেজগাঁও থানা হাজত থেকে পুলিশের গাড়িতে গাদাগাদি করে তুলে নিয়ে কুর্মিটোলায় অন্ধকার রাস্তায় ছেড়ে দিলো। তারপর অনেকটা রাত হলে স্বজনদের আহাজারির মধ্যে বাড়ি ফিরলাম শহরের আর এক প্রান্তে। স্মৃতির মনিকোঠায় জমে থাকা সে অসামান্য মুহূর্তগুলো আমার সেরা সম্পদ। মহামূল্য দরিয়ায়ে নূর রত্ন। আমার নগণ্য অকৃতি অধম জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি এবং শীর্ষ অহঙ্কার সেটাই।
তারই ধারাবাহিকতায় এসেছিল আমার কৈশোরে ১৯৫৫ সালের কারাজীবন, যা আমার সামনে পৃথিবীর দুয়ার খুলে দিয়েছিল। ১৫ বছর বয়সে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন তথা ’ইপসুর’ কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্যপদ পেয়ে স্কুল জীবনেই জাতীয় ছাত্র রাজনীতিতে আমার অভিষেক ঘটলো। তার আগে বা পরেও আর কোন স্কুল ছাত্র তেমন সৌভাগ্যের অধিকারী হয়নি কথনও। আমাকে হারিয়ে দিয়েছিল কেবল মাত্র ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ নবকুমার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান। ধন্য সে মহাপ্রাণ।
আরব ভাষিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন
আরবী ভাষা আরব ভূখন্ড ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা। প্রেমের ভাষা। গানের ভাষা। শিক্ষার ভাষা ও শাসন শোষনের ভাষা। ধর্মের দিক দিয়ে সর্বকালের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীছিল ইসলাম অনুসারী। সুন্নী ও শিয়া সম্প্রদায় এবং নানা ফেতনায় বিভক্ত ছিল তারা। তাছাড়া ছিল খ্রীষ্টান এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বীরাও। কিন্তু তাদের সবার মুখের ভাষা ও জীবনের ভাষা ছিল অভিন্ন। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ধ্যানেও চিত্বে ধারণ করেছিলেন, দার্শনিক মাইকেল আফলাক ও তাঁর সমদর্শী সালাউদ্দীন বিতার। তাঁরা ১৯৪০ সালে “আরব সোস্যালিস্ট বাথ পার্টি” প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে তার নাম ছিল ‘আরব ইহইয়া মুভমেন্ট’। ১৯৪৩ সালে নাম পরিবর্তন করা হ’ল। সে দলের প্রতিষ্ঠাতা আফলাক ও বিতার দুজনই ছিলেন সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের দর্শনে উদ্বুদ্ধ। তাঁরা সমস্ত আরব ভূখণ্ড জুড়ে আরবী ভাষাভাষী মানুষের একটা ফেডারেল যুক্তরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মিশরের কর্ণেল নাসেরও সেই স্বপ্নের ভেলায় ভেসেছিলেন।
প্রতিষ্ঠা লাভের অল্পকাল পর ‘আরব ইহইয়া মুভমেন্ট’ উপনিবেশ বিরোধী আরব জাতীয়তাবাদী সামরিক কর্মকান্ড জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪১ সালে আফলাক ইরাককে সাহায্য করার জন্য সিরিয়ান কমিটি গঠন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ইঙ্গ-ইরাকি যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিরোধী ও ইরাকের অক্ষপন্থী সরকারকে সমর্থন করা। যুদ্ধে ইরাকি সেনাদের পাশে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইকে বলীয়ান করতে ‘আরব ইহইয়া মুভমেন্ট ’এর সিরিয়ান কমিটি অস্ত্র ও স্বেচ্ছাসেবক পাঠাল। ১৯৪৩ সালে মাইকেল আফলাক সিরীয় সংসদের সদস্যপদের জন্য প্রার্থী হলেন। তবে তাঁর বাসনা সফল হ’লনা। সংসদ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আফলাক অন্যান্য দল যেমন, আকরাম আল হাউরানির ‘আরব সোশ্যালিস্ট মুভমেন্ট’ নামক দলের সাথে সহযোগিতা করে সেক্যুলার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হন। সেই সংহতি নিয়ে ১৯৪৭ সালে তার দল আরব বাথ পার্টিতে পরিণত হ’ল। আল হাউরানির আরব সোশ্যালিস্ট মুভমেন্ট পরবর্তীকালে ১৯৫০ এর দশকে আরব বাথ পার্টির সাথে একীভূত হয়ে আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি গঠন করলো। বাথ পার্টির একটি শাখা ইরাকে ক্রিয়াশীল ছিল সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে।
১৪ জুলাই ১৯৫৮ বাথ পার্টি সমর্থিত করিম কাশেম এবং কম্যুনিস্ট পার্টি সমর্থক কর্ণেল আরিফ অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করলেন। হাশেমী রাজবংশ উৎখাত হ’ল। রাজা, রাজপুত্র এবং ব্রিটিশ আশীর্বাদপুষ্ট প্রধানমন্ত্রী নূরী আস সাঈদ বিপ্লবী নিধনকান্ডের শিকার হলেন। কিন্তু সেই সাথে জর্ডান ও ইরাকের আরব ফেডারেশনও বিলুপ্ত হল। ইরাকের বাথ পার্টি এবং কম্যুনিস্ট পার্টির প্রবল দ্বন্দ্ব মিশর সিরিয়ার সংযুক্ত আরব ফেডারেশন গঠনের স্বপ্নটাও চাপা পড়লো। সমস্ত আরব ভূখন্ড জুড়ে একটি ভাষিক রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্নটাও ভূলুন্ঠিত হ’ল।
আরব মরুতে সেক্যুলার ঝড়
১৯১৭ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের ঝড়ো হাওয়ায় পালে বাতাস পেয়ে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলশেভিকদের হাত ধরে কুলে ভিড়তে পেরেছিল মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে। তারপরেই আরবের পাশে মুসলিম ঘরানায় প্রথম সেক্যুলার বিপ্লব সফল করলেন জাতীয়তাবাদী সেনাপতি মোস্তফা কামাল পাশা। ইঙ্গ-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ ও জার শাসিত স¤প্রসারণবাদী রাশিয়া এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ১ম মহাযুদ্ধে ইসলামের ধ্বজাধারী তুর্কী অটোমেন সাম্রাজ্যকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। তারা খলিফার লেবাজধারী মুসলিম রাজার ভূস্বর্গকে মালে গণিমাত বিবেচনায় লুটেপুটে নিতে ব্যস্ত ছিল। সে সময় জেনারেল মুস্তফা কামাল পাশা প্রতিবেশী সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রাণপুরুষ ভি আই লেনিনের প্রণোদনায় তুরষ্কের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করে তুললেন। লেনিন অর্থ দিলেন। অস্ত্র দিলেন। প্রশিক্ষন দিলেন। গোলাবারুদ দিলেন। সেই শক্তিতে বলবান কামাল পাশা দেশের গণমানুষকে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধায় রূপান্তরিত করলেন। নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে তুর্কী মুক্তিযোদ্ধারা তিন বছর যুদ্ধ করলেন। বহিঃশত্রু হটিয়ে তুরষ্ক পুরোপুরি স্বাধীন হ’ল। সশস্ত্র তুর্কী জনগণ ধর্মান্ধতার খোলস ছেড়ে কামাল পাশার সেক্যুলার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত হ’ল। মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলো ২০-২১ সালে। পরের ধাপে ১৯২৪ সালে তিনি ইসলামী শরিয়া শাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফতের বিলুপ্তি ঘটাতে সক্ষম হলেন অনেকটা নির্বিঘ্নে। লেনিন তাকে কম্যুনিস্ট পার্টি করার জন্য সবরকম সহায়তা দিতে চাইলেন। কিন্তু বাস্তবদর্শী কামাল পাশা সেই অগ্নিপথ পরিহার করলেন। তিনি সেক্যুলার বিপ্লবের সীমানার মধ্যে অনড় রইলেন। ভূমি সংস্কার করে ভুমিহীন কৃষককে ভূমিবান করলেন। উৎপাদন বেগবান হ’ল। মাদ্রাসা বন্ধ হ’ল না। কিন্তু হাজার হাজার স্কুল প্রতিষ্ঠিত হ’ল। নারী মুক্তি পেলো অন্তঃপুরের বন্দীশালা থেকে। শিক্ষায় দীক্ষায় বলীয়ান হ’ল তারা। বিদূষী ২৩ নারী সংসদ সদস্যপদ অর্জন করলো। কামাল পাশা ধর্মীয় কুসংস্কারের কাদাজলে ডুবে থাকা রক্ষণশীল পশ্চাদপদ তুর্কী জাতিকে অন্ধকার থেকে তুলে এনে আলোর মিছিলে সামিল করলেন। অগ্রসরমান ইউরোপীয় ভাবধারায় একটি আধুনিক তুর্কী জাতি গড়ে উঠলো। কৃতজ্ঞ দেশবাসী সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেই তাঁকে জাতির পিতার স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করলো। তিনি ‘তুর্কী পিতা’ তথা “ কামাল আতাতুর্ক “ অভিধায় উদ্ভাসিত হলেন।
ফেরাউন যুগের অবসান
আতাতুর্কের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মিশরের জাতীয়তাবাদী নেতা কর্ণেল নাসের আরবের বুকে জেগে ওঠা সেক্যুলার ঝড়কে উত্তাল করে তুললেন্। ১৯৫২ সালে ‘ফ্রি ইজিপ্ট আর্মী’র নেতা কর্ণেল নাসের ও সমদর্শী আনোয়ার সাদাত গং এর নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটলো। রাজা ফারুক সিংহাসনচ্যুত হলেন। এক জাহাজ সম্পদ দিয়ে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হ’ল। কর্ণেল নাসের কৌশলগত কারণে উগ্র মৌলবাদী মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থন নিলেন। তাদের পছন্দের লোক জেনারেল নাগীবকে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে প্রথম মিশরীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। পাঁচ হাজার বছরের ফেরাউন যুগ ও নির্মম সামন্তবাদী শোষণের অবসান হ’ল। মুসলিম ব্রাদারহুড শরীয়া শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানালো। মৌলবাদীদের চাপের মুখে জেনারেল নগীব ইসলামী শরীয়া শাসন কায়েম করে খেলাফত প্রতিষ্ঠার গোপন উদ্যোগ নিলেন। নাসের তাকে বরখাস্ত করলেন। নাসেরের নেতৃত্বে গড়ে উঠলো প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্য। সেই সেক্যুলার ঝড়ে ধূলিস্যাৎ হ’ল মেীলবাদী ষড়যন্ত্র। নাসেরের ২য় বিপ্লব সফল হ’ল। বিশাল এক জনসভা চলাকালে মৌলবাদীরা বক্তৃতারত প্রেসিডেন্ট নাসেরকে লক্ষ্য করে উপর্যু পরি গুলি নিক্ষেপ করলো। কিন্তু নাসের প্রাণে বেঁচে গেলেন। প্রেসিডেন্ট নাসেরকে হত্যা প্রচেষ্টার দায়ে সাঈদ কুতুবসহ মুসলিম ব্রাদারহুডের শীর্ষ ৭ নেতার ফাঁসি হ’ল। মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শক্তি মুখ থুবড়ে পড়লো। মাইকেল আফলাখের তত্ব লুফে নিয়ে নাসের সিরিয়া এবং ইয়েমেনকে মিলিয়ে সেক্যুলার আরব প্রজাতন্ত্র গড়লেন। কিন্তু তার দ্রূত বিলোপ ঘটলো ইরাকী কম্যুনিস্ট পার্টির সদম্ভ প্রত্যাখ্যান ও সাম্রাজ্যবাদী অভিঘাতে।
ইরাকে কম্যুনিস্ট সরকার
কম্যুনিস্ট পার্টি সমর্থনে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কর্ণেল আরিফ সে সময় ইরাকের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিলেন। কিন্তু মাইকেল আফলাক ও সালাউদ্দীন বিতারের সেক্যুলার তত্বে গড়ে ওঠা সংযুক্ত আরব ফেডারেশনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিলো ইরাকের কম্যুনিস্ট পার্টি। উত্তর ইরাকের মসুল নগরীতে তারা নিখিল আরব সেক্যুলার বিপ্লবের পথিকৃৎ সাদ্দাম হোসেনের বিপুল গণশক্তির বিপরীতে জন সমর্থনের শোডাউন করে সমাধানহীন দ্বন্দ্বে লিপ্ত হ’ল। জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে কম্যুনিস্ট দের ঐক্যভেঙে গেলো। সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে কর্ণেল আরিফ ক্ষমতাচ্যুত হলেন। ইরাকী কম্যুনিস্ট পার্টি নিজেদের ভুলের খেসারত দিতে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলো। কোনদিনই আর তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলো না।
পূর্ব বাংলায় সেক্যুলার ঐক্য
সাম্প্রদায়িকভাবে দ্বিখন্ডিত ভারতবর্ষের পূর্ব বাংলা ভূখন্ড হিন্দু -মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান জনগোষ্ঠী সহিংস সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ভেদাভেদ ভুলে মাতৃভাষা বাংলার জাতীয় অভিষেক ঘটাবার জন্য দুলি কসম অটুট দুর্ভেদ্য সেক্যুলার ঐক্য গড়ে তুললো। ১১ মার্চ ১৯৪৮ শুরুহ’ল ভাষাসংগ্রাম। ২৩ জুন ১৯৪৯ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিতহ’ল দেশের প্রথম শক্তিশালী বিরোধীদল আওয়ামী মুসলিমলীগ। ১৯৫০ সালে মুসলিমলীগের ভাড়াটিয়া গুন্দারা ৫০ হাজার বাঙালিকে হত্যাকরলো। কয়েক লক্ষ মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হ’ল। এই প্রেক্ষাটে কৃষকের তেভাগা আন্দোলনও সাওতাল বিদ্রোহ দুর্বার হ’ল। লড়াকু কৃষক-জনতা ও সংগ্রামী ছাত্রসমাজ বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দূর্জয় সংহতি গড়ে তুললো। বৗর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের সেই পাষাণ ভূমিতে সবার অলক্ষে উদ্গত হ’ল ভারতবর্ষের প্রথম সফল সশস্ত্র বিপ্লবের অঙ্কূর। তারই দুর্বিনীত ফলগ্রূতি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
ভারতবর্ষে সেক্যুলার বিপ্লব
১৭৫৭ সালে লর্ডক্লাইভের কূটচালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ দখল করলো। তার ঠিক একশত বছর পর ১৮৫৭ সালে বাকিমহাম প্যালেসের রাজ সিংহাসন কেঁপে উঠেছিল ভারতবর্ষের ঝড়ে। ব্রিটিশের অনুগত পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা তার নাম দিয়েছিলেন সিপাই বিদ্রোহ। কালজয়ী দার্শনিক কার্ল মার্কস এর বিশ্লেষণে তা মূর্ত হয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের উপনিবেশবাদ বিরোধী সবচেয়ে বড় যুদ্ধ এবং পরাধীন ভারতের সর্ব প্রথম সর্বব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে। ১৮৫৭ সালের মহান সেক্যুলার বিপ্লবকে স্বাধীন ভারত সরকার ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপ হিসাবে স্মরণ করে থাকে। সেই গণবিপ্লব সেনা ছাউনি থেকে উৎসারিত হয়ে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহী সৈনিকদের সাথে নিম্নবিত্ত শহুরে সমাজ, শ্রমিক কৃষক গরীব দুঃখীদের সংহতি ধর্মপ্রাণ সেনা সদস্যেদের বিদ্রোহকে গণবিপ্লবের দাবাগ্নিতে রূপান্তরিত করেছিল। ঝাঁসির রানী লক্ষী বাঈসহ ব্রিটিশ কোম্পানির দুঃশাসনে অতিষ্ঠ রাজন্যবর্গ ও ক্ষুদ্র -বৃহৎ মাঝারি সামন্তরাও সেই ঐক্যে সামিল হওয়ায় তাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। সর্বভারতীয় সে অনন্য দ্রোহ, সে সংঘবদ্ধগণ সংগ্রাম, সে সর্বাত্মক সাহসী সমরকে পদপিষ্ট করলো ইংরেজ তার পাশবিক প্রতাপ ও দানবীয় শক্তি দিয়ে। কোম্পানি শাসন তুলে নিয়ে রাজকীয় শাসন প্রবর্তন করলো। ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্ভ্রাজ্যের সাথে যুক্ত হ’ল। ইংলেন্ডের রানী হলেন সম্রাজ্ঞী। ভারতের পরাধীনতার ইতিহাসে নির্মম দুঃশাসনের একটা নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটলো। সাম্প্রদায়িকতার ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে পররাজ্য গ্রাসী ইংরেজ ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান সংহতির শিরোচ্ছেদ করে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখলো। তৈরি করলো একটা নির্লজ্জ দালাল শ্রেণি। পর্যায়ক্রমে একটি সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের স্থায়ী প্রেক্ষিত রচিতহ’ল। গণমানুষকে ভাগ করে ভারত শাসনের এমন কৌশল নির্ধারণ করলো চতুর ব্রিটিশ যাতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ঝড়ে ইংরেজ শাসন আর কখনও টালমাটাল না হয়। ইংলেন্ডের প্রথম উপনিবেশিক মন্ত্রী লর্ড স্ট্যানলে বললেন, “আগামী সাত শত বছর ভারতবর্ষ আর মাথা করে কথা বলবে না”। তার কথা অব্যর্থ করতে জাস্টিস রাওলাট কমিটি (১৯১৮) এর রিপোর্টের ভিত্তিতে রাওলাট এ্যাক্টের মত বন্য আইন রচিত হ’ল। ১৯১৯ সালে তার প্রয়োগ ঘটলো অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে। রক্তাক্ত বধ্যভূমি জালিয়ান ওয়ালাবাগের নৃশংসতায় বিধূর হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বিদ্রোহী হয়ে ওঠলেন। তিনি ব্রিটিশের দেওয়া ‘নাইট’ বা ‘স্যার’ উপাধি বিসর্জন দিলেন। সহস্রাধিক নরনারীর সেই নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিতে তখনকার প্রত্যক্ষদর্শী কিশোর ঊধাম সিং, একুশ বছর পর মার্চ ১৯৪০ খোদ ইংল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে গণখুনের হুকুমদাতা জেনারেল স্যার মাইকেল ও’ ডায়ারকে পিস্তলের গুলিতে হত্যা করেন। এপ্রিল ‘৪০ তিনি ফাঁসিতে জীবন বিসর্জন দেন।
ভগৎসিং -শুকদেব -রাজগুরুর আত্মোৎসর্গ
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরু মূলতঃ ভাইসেরয়ের বিশেষ ক্ষমতাবলে ১.পাবলিক সেফটি বিল ও ২. ট্রেড ডিসপিউট এ্যাকট পাশের প্রতিবাদে দিল্লী সংসদ ভবনে ৮ এপ্রিল ১৯২৯, অধিবেশন চলাকালে ২টি দেশী বোমার বিষ্ফোরণ ঘটান। ধূর্মজালের মধ্যে ভগৎসিং পালাবার সুযোগ না নিয়ে “ইনক্লাব জিন্দাবাদ “ স্লোগান সহকারে লিফলেট ছড়িয়ে গ্রেফতার হন। মার্চ ১৯৩১ ভগৎসিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি হ’ল। ব্রিটিশের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়লো। ভেবেছিল যা, তা হ’ল না। রাওলাট এ্যাক্টের স্টিমরোলার দিয়ে দমন পীড়ন করায় ভারতবর্ষ দ্রোহে আরও উত্তাল হয়ে উঠলো। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি ধোপে টিকলো না। ব্রিটিশ ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানালো ১৯৩৯ সালে। তাদের সূদূরপ্রসারি ষড়যন্ত্রে জন্ম নিল দ্বিজাতি তত্ব। জিন্নাহ হলেন তার কান্ডারি।
ভারতবর্ষের মানুষ প্রাকৃতিক ধর্ম পালন করতো অনাদি কাল থেকে। বিস্মৃত অতীতের কোন একসময় বেদ ঊপনিষদ হাতে আর্য ব্রাহ্মণরা এসেছিল ক্ষত্রিয় দোসরদের বাহুবল নির্ভর করে। ভারতের আদিবাসীকে বৈশ্য ও শূদ্র নামে সেবাদাশ বানিয়ে বৈদিক ধর্ম প্রবর্তন করেছিল কত হাজার বছর আগে সে কথা ইতিহাসে কোথাও লেখা নেই। প্রাচ্য প্রতীচ্যের ইসলামের ধ্বজাধারী লুটেরা হানাদাররা “হিন্দুস্তানের” সব মানুষকে ‘হিন্দু’ এবং তাদের লালিত ধর্মকে ‘হিন্দুধর্ম’ নাম দেয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের অধীনে যুগযুগ ধরে বর্ণবাদী নির্যাতনের শিকার হয়েছিল বিপুল সংখ্যক “অস্পৃষ্য অশুচি” আদিবাসী। তারাই বর্ণবৈষম্যহীন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই ধর্মান্তিকরণে সামাজিক সখ্য কথনও ব্যাহত হয়নি। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশরাজ নিজের স্বার্থেই সেই সম্প্রীতি ও সখ্য ভেঙ্গে দিয়ে বিভক্ত উঠোনে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপন করলো।
মাস্টারদার সশস্ত্র বিপ্লব
মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত সূর্য কুমার সেন। ডাক নাম কালু। ১৮ এপ্রিল ১৯৩০, ব্রিটিশের হাড় কাপিয়ে দিলেন। বিপ্লবী কান্ড ‘ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’ এর নায়ক সূর্যসেনের নেতৃত্বে স্বল্প বলের বিপ্লবী বাহিনী কয়েকদিনের জন্যে হলেও ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরেছিল। বাংলা মায়ের বীর সন্তান সূর্য সেন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী মর্যাদা নিয়ে বেঁচে আছেন শতকোটি মানুষের আপোষ ফর্মূলায় ভারত ছাড়ার আগে ব্রিটিশ তাদের বশীভুতদের দিয়ে সা¤প্রদায়িক হিংসার দাবানলে বাঙালির বিপ্লবী ঐতিহ্যকে ভষ্ম করে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছিল। তাদের সেবা দাশ জিন্নাহ -লিয়াকত আলী-নাজিমুদ্দিন গং বাঙালির মায়ের ভাষার আবেগের টুটি চেপে ধরেছিল ১৯৪৮ সালে।
ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী এবং উপমহাদেশে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের একমাত্র সফল নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির আসা¤প্রদায়িক আবেগে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলেন। জীবন বাজি রেখে সফল করলেন উপমহাদেশের সেরা সেক্যুলার বিপ্লব। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, সাঁওতাল ও নানা নৃ-গোষ্ঠী র ৩০ লক্ষ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিলো। ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে প্রায় পাঁচ লক্ষ নারী সম্ভ্রম হারালো। জীবন বাজি রেখে লড়াই করলো দুলক্ষ অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধা- হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান। বাঙালি পেলো স্বাধীনতা।
বাঙালির মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম
১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান গণপরিষদে একটি ছোট সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। মূল সরকারি প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও পাকিস্তান গণপরিষদের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। ধীরেন্দ্রনাথের সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, “৫৬ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাও সরকারি ভাষারূপে গণ্য হবে”। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে। ১১ মার্চ ৪৮ বাঙালি গর্জে উঠেছিল মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে। বাংলার স্বধীনতা-মহাকাব্যের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন তরুণ নেতা। তিনি সেই উত্তাল বাত্যার কর্তমূলে স্বাধীনতার বার্তা সঞ্চালন করলেন। শহীদের রক্তে সিক্ত মহান একুশ তথা ৮ ফাল্গুন ২৩ বছর দূরন্ত পথ চলে মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে পৌঁছে দিল অনিবার্য স্বাধীনতার বানী। বাংলার রক্তস্নাত স্বাধীনতা ভারতবর্ষের সেই শীর্ষ সেক্যুলার সংগ্রামেরই ফলশ্রুতি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক