মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা (১ম পর্ব)

স্মৃতিচারণ

0
652

বরেণ্য রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সংসদ সদস্য বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার এই সাক্ষাতটি প্রচার করেছেন।

ফিরে দেখা : মার্চের ২৫ থেকে গ্রামের বাড়িতে সঙ্গরোধে।গ্রামের মানুষের মাঝে উৎকন্ঠা। কিভাবে দেশ চলবে।কেমন করে মানুষ বাঁচবে। আমারও সময় কাটেনা।মনে অজস্র কথা ভীড় করছে। বাঙ্গালির জীবনে গর্বের দুটা ঘটনা একটা ভাষার সংগ্রামও আর একট স্বাধীনতার সংগ্রাম।একটার গর্ভে আর একটার জন্ম। ভাষা সংগ্রাম দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ আমার জীবনে সোনালী দিন।৭১ সালে মার্চে আমি * SSC পরীক্ষা প্রার্থী ছিলাম কিন্তু একদিনও বইনিয়ে বসা হয়নি। ৭০সালের সাধারণ নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের স্রোতে আমিও ভাসছি। প্রতিদিন পঞ্চগড় যাই জানতে চাই (কি করিতে হইবে)।এই অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে আমাদের বাড়িতে ক্রমাগত আত্মীয় সজন এবং পঞ্চগড়ের TEO কাদের সাহেবের সুবাদে পঞ্চগড় থানার সব কর্মকর্তা ( সিও ডেভ /সিও রেভ এবং ঠাকুরগাও মহকুমাশাসক তছলিম সাহেব পরিবার সহ আমাদের অতিথি হলেন।বাড়িতে যায়গা সংকুলান না হওয়ায় স্কুলে থাকার ব্যবস্থা হলো এস ডি ও সাহেবের। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন।জাতি উওাল যেন খাপ খোলা তড়োয়াল।তারিখ ঠিক মনে নেই ৯/১০ মার্চ হবে ছাএলীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা এসেছিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্বপন কুমার চৌধুরী অন্যজন মার্শাল মনি।উনারা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার নির্দেশনা দিয়েছেন। স্বপন কুমার চৌধুরী ছাএলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব করেছিলেন। আমি সেই নির্দেশনামুলক মিটিংয়ে থাকতে পারিনি। বর্তমানে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি /সম্পাদক বাবুল ও সাওার ছিলেন। কেন্দ্রীয় ছাএলীগের নির্দেশ মোতাবেক জয়বাংলা বাহিনী এবং আনসার কমান্ডার হেলালমিয়ার অধীনে থানারমাঠে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ট্রেনিং শুরু। আমার বাড়ি দুরে হওয়ায় আমার সেই সময় অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি।এরমধ্যেই পঞ্চগড়ে একদিন সিরাজ ভাই (এম পি)কোথাও থেকে এসে হুঙ্কার দিয়ে বললেন কি! নাজিম ইন্ডিয়া গেছে ‘ ও কি দেশটা কে ইন্ডিয়ার কাছে দিয়ে দিবে? আমাদের মাঝে মধ্যে ফিসফাস এবং প্রথম ছাএলীগে শাজাহান সিরাজ ও নুরে আলম সিদ্দিকী গ্রুপের অস্তিত্ব অনুভব করলাম।মার্চের মাঝামাঝি আমার বড় ভগ্নিপতি জয়বাংলার পতাকা জীপ গাড়িতে লাগিয়ে দিনাজপুর থেকে এক অচেনা বয়স্কা ধবধবে ফর্সা মহিলা সহ আমাদের বাড়িতে হাজির হলেন। এই ভদ্র মহিলা ভাংগা ভাংগা বাংলায় কথা।আমার বড়বোন বললেন কাস্মীর সাহেবের বউ।কাস্মীরী লোক কাস্মীর সাহেব।সেই সময় বাংলাদেশের অন্য এলাকার মতো পঞ্চগড়েও বাঙালি অবাঙ্গালী সংঘাত।

আমার ভগ্নিপতি মতি মিয়া যাওয়ার সময় ভদ্র মহিলার পরিচয় গোপন করার কথা বললেন। এবং জানালেন দিনাজপুরে যে কোন সময়ে বাঙ্গালি অবাঙ্গালি সংঘাত হতে পারে।আমি প্রতি দিন সকালের নাস্তা সেরে এসডিও সাহেবের অস্থায়ী বাংলো স্কুলে যেতাম উনার সাথে কথা বলতে।উনারা মুর্শিদাবাদের ছিলেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ করেছেন। পাকিস্তানে এসে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন। ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে পঞ্চগরের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো কেরাম খেলা জানি কি না।হ্যা বলতেই তাঁর একছেলে দুমেয়ে খেলার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।ছেলেটা আমার এক বছরের সিনিয়র আর মেয়ে একটাআমার বয়সী আর একটা জুনিয়র।কেরাম খেলার মধ্যেই আমাদের জন্য ওভালটিন এবং ভালো বিস্কুট। আমার একটা অটো রুটিন হয়ে গেল উনাকে সকালে খোঁজ খবর দেয়া আর উনার ছেলেমেয়দের সঙ্গে কেরাম খেলা আর ওভালটি খাওয়া ইত্যাদি। আর দুপুরের খাবারের পর পঞ্চগর যাওয়া।পঞ্চগড় সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশ ছাএলীগ যতন পুখরীর আব্বাসের (ফুটবল খেলোয়ার) নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন এবং অবাঙালীদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পাহারার ব্যবস্থা করা।এসব ঠিকই চলছিল এরমধ্যে ঠাকুরগাঁও রাইফেল বাহিনী ( EPR) উইং ওদের কাছে নিশ্চয়ই কোন মেসেজ ছিল অনেক বিও পি তে পাকিস্তানী সুবেদার ছিলেন। এরকম তিনজনকে বিওপিতে ই বাঙালী রাইফেলস এর লোকেরা হত্যা করে।আমার বাড়ির প্রায় চার কিলোমিটার দুরত্বে অমরখানা বিওপি সেখানে পান্জাবী কামরুদ্দিন সুবেদারকে রাইফেলেসের বাঙ্গালী জাোয়ানরা তেতুলিয়ায় শাহজী পান্জাবীকে বাঙ্গালী যুবক সিভিলিয়ান হত্যা করে। অনুরুপ ঘটনা ডানাকাটা বিওপিতেও হয়।পঞ্চগড়ে অবাঙ্গালী যারা ছিলেন তারা ভারতের বিহার থেকে দারভাঙ্গা /ছাপরা জেলা থেকে ১৯৫০এর দাঙ্গায় এদেশে আসেন।পঞ্চগরে সেই সময় ঢাকা ও পাবনা থেকেও কিছু ব্যবসায়ী থিতু হন।অবাঙ্গালীদের মধ্যে সালাউদ্দিন ও মাহমুদ দুই ভাই এ বং মনসুর বিহারি বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।আইয়ুব শাহীর সময় ষাটের দশকে পঞ্চগরের অদুরেই ভাবরঙ্গী নামক স্থানে অনেক স্বল্প আয়ের অবাঙালি বসতি গড়ে তোলেন।রাইফেলসের পান্জাবীদের হত্যা সংবাদে এসডিও সাহেবকে বিচলিত মনে হয়ছিল।উনি যথারীতি সকালে স্কুলের পতাকা বাঁশে জয় বাংলার পতাকা তুলতেন এবং সন্ধ্যায় নামিয়ে নিতেন। পাকিস্তান আমলে এসডিও ফলে উনার সাথে বডিগার্ড / চাপরাশি ছিল। অসহযোগ আন্দোলন শেষ না হতেই শুরু হয় প্রতিরোধ। মার্চের ২৭/২৮তারিখে ভারতের জলপাইগুড়ির অসংখ্য লোক সাইকেলে পঞ্চগরে আসছে /যাচ্ছে এবং টটুটাক কেনাকাটাও চলছে।আমরা জানতে পারলাম নাজিম ভাই কে খবর পাঠিয়ে জলপাইগুড়ির ডি এম( ডি সি) সাক্ষাত শেষে আস্বস্ত করেছেন যে তারা প্রতিরোধে মুক্তিকামী জনতাকে সহায়তা করবে এবং প্রয়োজন হলে অস্ত্রও দিবে। যে কারনে নাজিম ভাইয়ের উপর সিরাজ ভাই (এম পি) খুব্ধ হয়েছিল। এই সময়েই আবার সিরাজ ভাই তিনজন ছাএকে যথাক্রম সাইখুল/ওয়ায়েসুল এবং লিয়াকতকে জলপাইগুড়ি পাঠিয়েছে চাঁদ ঘোষের কাছে অস্ত্র সহায়তার জন্য। আমি এম পি হবার পর সাইখুল দা সহ জলপাইগুড়ি গিয়েছিলাম। মৃত্যুপথ যাএী চাদঁ ঘোষের দেখা করে ছিলাম আমার বন্ধু এ্যডভোকেট প্রদীপ বাগচীর সহায়তায়।চাঁদ ঘোষ ওই সময়ই জলপাইগুড়ি রাইফেল কাল্ব থেকে কস্ট করে একহাজার বন্দুকের গুলি যোগাড় করে দিয়েছিলেন।এপ্রিল মাসের দুই তারিখ আমিও চার পাঁচ জন মিলে পায়ে হেঁটে জলপাইগুড়ি যাচ্ছি। জলপাইগুড়ি শহরের কাছাকাছি দেবনগরে স্থানীয় মাঝবয়েসী ধুতি পরিহিত এক ভদ্রলোক (এ বাহে দেশটা ছেড়ে কেনে আইসেচেন আইস হামার বাড়িত বইস মুড়ি খাও)রাস্তার পাশে তাই তাঁর বাড়িতে বসতেই সে বঙ্গবন্ধুর একটা ছেঁড়া ছবি দেখিয়ে বলছে নেতাজীর পুনরাবির্ভাব হয়েছে বাঙলা স্বাধীন হবে।আমরা জলপাইগুড়িতে সুকুমার বাবুর দোকানে উনার দেখা করলাম। আমার দাদা দেশভাগের সময়ে রাজগন্জে প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন সুকুমার বাবু রাজগন্জ থানার ও সি ছিলেন। আমাদের সাহেব পাড়ার বাড়িতে পুলিশ প্রহড়া থাকতো। দাদারা দুই ভাই। তাঁদের পিতার অসিহত অনুযায়ী দাদা ভারতেই থাকবেন। ছোট ভাই বর্তমান এম মি মজাহারুল পিতা পাকিস্তানি হবেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ জয়া চ্যটার্জীর বাংলা ভাগ হলো এবং বাংলা ভাগের অর্জন দুটি বইয়ে দেশ ভাগের বয়ান এক কথায় অসাধারণ। ১৯৫০ এর নোয়াখালী এবং জলপাইগুড়ি দাঙ্গার সময়ে দাদাকে ও সি সুকুমার বাবু বলছেন প্রেসিডেন্ট সাহেব জলপাইগুড়ির মাস্তানরা আপনাদের বাসায় আসতে চাচ্ছে কি করবেন? দাদা তখনই ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বাবাকে ছোট দাদার কাছে পাঠিয়ে দাদার বন্ধু খগেন্দ্র নাথ বসুনিয়ার সঙ্গে বিনিময় চুড়ান্ত করেন।১৯৭১ সালে প্রথম জলপাইগুড়ি গিয়ে তাই গিয়েছিলাম আমাদের বাড়ি দেখতে। খুবই সুন্দর বাড়ি। বসুনিয়া সাহেব চা খাওয়ার ফাঁকে বলছেন নাতি কি দেশ ভাগ হলো তোমরাও শেষ হলে আমিও শেষ হলাম!

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো মাইগ্রেশন ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ।সাত পুরুষের ভিটামাটি ত্যাগ করে মানুষ দেশত্যাগ করেছে শুধু মাএ ধর্মের কারনে।পাকিস্তান নামক রাস্ট্রে হিন্দুরা আবার হিন্দুস্থান নামক রাস্ট্র মুসলিমরা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। যে দুঃখজ্বালা এখনও বহন করতে হচ্ছে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতে।আমাদের সাহেব পাড়ার বাড়ি দর্শন শেষে দেশে এসে দেখি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক উওেজনা। মনসুর বিহারীর নেতৃত্বে বিহারীরা মিছিল করেছে পাকিস্তানের পক্ষে।। আবার বিহারী অধ্যুষিত সৈয়দপুরে বাঙ্গালীদের উপর চড়াও হয়েছে বিহারীরা।এই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ যুদ্ধের সময়কালে ৭১ সালে এপ্রিলে ১/২তারিখের মধ্যেই পঞ্চগর এবং ভাবরঙ্গির বিহারীদের শিশু কিশোর সহ নির্মুল করা হয়।মুক্তি যুদ্ধে কতো বিহারী নিধন হয়েছে তা নিয়ে কোন কাজ হয়নি! এদের অধীকাংশ সাধারণ মানুষ। এরা ১৯৫০এ বিহারের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় রিফুজি হয়ে পুর্ব পাকিস্তানের পন্চগড়ে বসতি গড়েছিলেন।নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায় এরকম অবস্থায় সাধারণ মানুষেররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।যেমন ১৯৪৪ সালে ঢাকায় হিন্দু এলাকায় মুসলমানরা আবার মুসলমানদের এলাকায় হিন্দুরা নিগৃহীত হতো।ওয়ারী এলাকায় তাদের বাড়িতে কাজ করতেো কাদের নামে এক ছেলে। একদিন সকালে কাদেরকে পাশের বাড়ির হিন্দুরা ছুরিকাঘাত করে যমালয়ে পাঠিয়ে দেয়।অথচ কাদের ছিল গরীব সাধারণ মানুষ। থিতি থাকলে কাজে আসতো না।এরকমই গোধরা হত্যাকান্ড( সাউথ ইন্ডিয়া) । সাম্প্রতিক কালে দিল্লি। ২০০১সালে বাংলাদেশ বি এন পি জামাত জোট ক্ষমতায়নের পর সাধারণ হিন্দুদের উপর নির্যাতন।এই সময়ে পঞ্চগড়ে অল্পগুটি কয়েক বিহারী পালিয়ে বেঁচেছিল তারা দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশের স্রোতধারায় মিশে গেছে।এরকম রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সব সময় সাধারণ মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।ভারতে যেমন ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার পর শিখ ধর্মাবলম্বীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।পঞ্চগড়ে তখন প্রতিরোধের আগুন।নব্য ট্রেনিং প্রাপ্ত মুজাহিদ ই পি আর ছাএ যুবক মিলে প্রতিরোধের করতোয়া নদীকে ধরে শক্ত ডিফেন্স। আমার বন্ধু খয়েরউদ্দীন ৭০সালে মুজাহিদ ট্রেনিং কালে পাকিস্তানি সুবেদার ওস্তাদ বলেছিল (।বাচ্চুলোক আচ্ছাসে শিখলো তুমারা কামমে আয়েগা।খয়েরউদ্দীন জিজ্ঞেস করছিল কিয়া কাম – উওরে সুবেদার ইয়ে মুলক তুমারা হোগা হামলোক আপনা মুলক চলা যায়েগা)।বন্ধু খয়েরউদ্দীন এর ৭০এর নির্বাচনে এই কথা আমদের অনুপ্রাণিত করছিল চলবে

লেখক: সাবেক সংসদ সদস্য

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাসদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here