কলতাতা থেকে
দিলীপ রায়
সতীনাথ কপালীর ডাক নাম সত্য । কেউ আবার পদবী কপালী ধরেও ডাকে । অনেকে আবার সত্য কপালী নামেও ডাকে । কেউ ডাকলেই সত্য কপালীর চিরাচরিত সাড়া দেওয়ার অভ্যাস, “আজ্ঞে” । আজ্ঞে শব্দটা শুনলেই তাঁর বৌ, পদ্মাবতীর ভীষণ গোঁসা ! মুখের উপর সত্যকে শুনিয়ে দেয়, “আজ্ঞে বলাটা বন্ধ করো । আজ্ঞে শব্দটা শুনলেই মনে হয় ভিখিরির বাচ্চা ! এমনিতেই সংসারের করুণ অবস্থা । কোনোরকমে মোটা কাপড় মোটা ভাতে দিন গুজরান ।“ যদিও আগেই পদ্ম (পদ্মাবতীর ডাক নাম, পদ্ম) সত্যকে বার কয়েক স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, আজ্ঞে কথাটা বন্ধ করতে । কিন্তু বেচারা কপালী পরেছে মহা ফাঁপরে । গিন্নির কথার অবাধ্য হলে তাঁর চোখ রাঙানী অবশ্যম্ভাবী । অথচ বহুদিনের পুরানো অভ্যাস, ত্যাগ করাটাও দুঃসাধ্য !
পদ্মকে সত্য কপালী ভীষণ ভালবাসে । যদিও পদ্ম ও সত্যর বিয়ে ভাব-ভালবাসা করে । ভাব-ভালবাসার বিষয়টিও সত্যর জীবনে একটা ইতিহাস । সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আকাশ জুড়ে কালো মেঘ । একেই সন্ধ্যার অন্ধকার, তার উপর কালো মেঘের গাঢ় অন্ধকার । তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচন্ড ঝড় । ঝড়ের মাত্রা লাগামছাড়া । জ্যেষ্ঠের শেষদিক । ঝড়ের গতিবিধি লক্ষ্য করে সত্য ভাবলো, গ্রামের পুন্ডরীকাক্ষ’র আম বাগানে ঝড়ের তান্ডবে অনেক আম গাছ থেকে মাটিতে পড়ার কথা । সন্ধ্যার পরে পুন্ডরীকাক্ষ’র বাগানে কোনো রক্ষী থাকে না । সত্তর বছরের ঘাটের মরা গার্ড চৈতন্য বাহাদুর সেই সময় বাড়ি ফিরে যায় । ভোরবেলা থেকে তার ডিউটি শুরু আর সূর্যাস্তের সাথে সাথে তার ছুটি । এটাই মোক্ষম সময় । সন্ধ্যার ঘোর অন্ধকার । বাইরে তুমুল ঝড় । বৃষ্টি তখনও শুরু হয় নি । সত্য পাটের বস্তা মাথায় দিয়ে সোজা পুন্ডরীকাক্ষ’র আম বাগানে । আসলে পুন্ডরীকাক্ষ হাড় কিপটে । আম চাইলেও কাউকে দেয় না । অথচ তাঁর গাছের আম বড় বড় । খেতে ভীষণ সুস্বাদু । আমের গুণগত মান সম্বন্ধে এই তল্লাটের সকলেই অবগত । তাই চেয়েও আম না পাওয়ার জন্য গাঁয়ের ছেলেপুলেদের ভীষণ রাগ হাড় কিপটে পুন্ডরীকাক্ষ’র উপর । তার উপর চৈতন্য বাহাদুরের খবরদারীর জন্য আম কারও কপালে জোটে না । তাই সত্য ভাবছে, ঝড়ের মধ্যে সে আম কুঁড়িয়ে আবার সোজা বাড়ি ফিরে আসবে । তাহলে কাক-পক্ষীও টের পাবে না । অথচ আম বাগানে গিয়ে দেখে তার আগে গাঁয়ের গোটা কয়েক বড় বড় ছেলে-মেয়ে আম কুঁড়াচ্ছে । সত্য প্রায় পচিশটা আম কুঁড়িয়ে বস্তায় ঢোকালো । তারপর ভারী বস্তাটা পাশে রেখে আবার ছুটলো আরও আম কুঁড়াতে । ততক্ষণে প্রচন্ড বৃষ্টির তান্ডব শুরু হয়ে গেছে । বৃষ্টির জলে সত্য ভিজে একশা । হঠাৎ সত্য দেখতে পেলো তার বস্তা থেকে সাদা কাপড় জড়ানো কেউ একজন আম সরাচ্ছে । সত্য তৎক্ষণাত ঐ মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে হৈ হৈ রবে ছূটে গিয়ে তাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরলো । আর সত্যর কী হুমকী । আমার কুঁড়ানো আম নিয়ে পালানোর মজা তোকে দেখাচ্ছি । সাদা কাপড় সরিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে সত্য দেখতে পেলো পদ্মকে । তারপর তার গর্জন, তুই আমার আম নিয়ে পালাচ্ছিস ?
“তোমার অতো আম কিসের দরকার ?” তারপর আবার পদ্ম বললো, তুমি নিজে একজন আম চোর হয়ে আবার আমাকে চোখ রাঙাচ্ছো ।
তারপর দুজনের মধ্যে অনেক তর্কাতর্কি । আবোল-তাবোল কথা কাটাকাটি । শেষে রাগে দুঃখে সবগুলি আম পদ্মকে দিয়ে সত্য বাড়ি ফিরলো ।
তারপর থেকেই মারকুটে পদ্মর মনের মধ্যে সত্যর প্রতি সদয় ভাব জন্মায় । দেখা হলে দুজনে চারদন্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে । হাসি মস্করা করে । এইভাবে দুজনের মধ্যে ভাবভালবাসার সম্পর্কের বীজ ক্রমশঃ অঙ্কুর থেকে গাছে রুপান্তরিত হয় । বেঁকে বসে উভয় বাড়ির লোক । পদ্ম লেখাপড়া জানা মেয়ে, অথচ সত্য একটা গন্ডমূর্খ । এই নিয়েই মূলত দুই বাড়ির মধ্যে অশান্তি । “বিয়ে না দেওয়ার বাড়ির সিদ্ধান্ত” নাছোড়বান্দা অবলোকন করে, শেষে একরকম বাধ্য হয়ে দুজনে অন্ধকার রাত্রিতে বাড়ি থেকে পালায় । গিয়ে উঠে ফরাক্কায় । অনন্যেপায় না দেখে সত্য সেখানে প্রথমে মুড়ি তেলে ভাজার দোকান খোলে । তারপর চায়ের দোকান । ফরাক্কা ব্যারেজ কোয়ার্টারের বাজারের পাশে বাসস্ট্যান্ড এবং বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া বট গাছ তলায় টিনের ছাউনির চায়ের দোকান । ঐ চত্বরে যতোগুলি চায়ের দোকান তার মধ্যে সত্যর চায়ের একমাত্র ভীষণ চালু ।
পদ্মর কথা সত্য যতো ভাবে ততোই পুরানো স্মৃতি তাঁর মনে উস্কে উঠে । পদ্ম যেমন সাহসী তেমনি মানসিকভাবে ভীষণ শক্ত । সত্যর একবার সাংঘাতিক জ্বর । জ্বরের কাঁপুনিতে সত্য দিশেহারা । টাইফয়েডের সাথে নিমোনিয়া । ডাক্তার ঝুঁকি নিতে পারছেন না । সেই অসুখের চিকিৎসা টানা তিন মাস চললো । কিছুদিন তাঁর পক্ষে বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল না । সেই সময় পদ্ম নিজের কাঁধে তাঁর চায়ের দোকান ও চিকিৎসার ভার তুলে নিয়েছিল । ভোর সাড়ে চারটায় বহরমপুরের প্রথম বাস । সুতরাং ভোর চারটের সময় পদ্মকে গিয়ে চায়ের দোকান খুলতে হোতো । কেননা কয়েকজন সবজি ও মাছ ব্যবসায়ী প্রত্যেকদিন ঐ বাসে গিয়ে ধূলিয়ান থেকে সবজি ও মাছ কিনে ফেরত এসে ফরাক্কা বাজারে বাজার ধরে । তাঁদের ভোর বেলায় চা খাওয়া চাই । এছাড়া কিছু মানুষের ধূলিয়ানের আশেপাশে কৃষিজমিতে কাজের উদ্দেশ্যে ঐ বাসটাতেই যাতায়াত । তারাও সত্যর চায়ের দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার । কয়লার উনুন ধরিয়ে চা বানিয়ে খরিদ্দার ধরে রাখার স্বার্থে পদ্মকে ঐ ভোরে বট গাছ তলায় বসতে হোতো । তারপর সারাদিন চায়ের দোকানদারি । মাঝখানে বাড়ি এসে রান্না এবং সত্যর ঔষধ খাওয়ার তদারকি । সত্যকে খাইয়ে এবং নিজে স্নান খাওয়া সেরে পুনরায় রাত্রি দশটা পর্য্যন্ত চায়ের দোকানদারি । তারপর আবার সত্যর ডাক্তার দেখানোর থাকলে ডাক্তারের কাছে তাঁকে নিয়ে যাওয়া বা অন্যান্য যেমন বিভিন্ন প্যাথোলজিক্যাল টেষ্টের জন্য রক্ত দেওয়া, ইত্যাদি কাজগুলি তাকেই সারতে হোতো । সেই সময় পদ্ম ছিল পোয়াতী । তার মধ্যেও তাঁর কাজের নিষ্ঠা অবর্ণ্নীয় ।
মেয়েকে নিয়ে তাঁদের সংসার । পদ্মর যতো অশান্তি তার মেয়ে পিয়াশাকে নিয়ে । মেয়েটা ভীষণ জেদি । পড়াশুনার চেয়ে দৌড়ঝাঁপ, ঘোরাঘুরি, উল্টোপাল্টা খেলাধূলায় বেশী উৎসাহী । পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে মারামারি অহরহ । কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। একটু এদিক-ওদিক বেতাল দেখলেই, সে ছেলে-বুড়ো বাছবিচার নেই সঙ্গে সঙ্গে তার রণমূর্তি ধারন । তার জন্য পদ্মর অশান্তি । মেয়ের নেশা খেলাধূলা । প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই ছুটলো মাঠে । নাওয়া নেই খাওয়া নেই শুধু দৌড়ঝাঁপ । পদ্ম নিজেও জানে না মেয়েটা মাঠে কী খেলছে ? ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা বড় বড় মেডেল বাড়িতে এনেছে । জিজ্ঞাসা করলে পিয়াশার উত্তর, খেলে পেয়েছি । কিন্তু পদ্ম পিয়াশাকে সর্বক্ষণ বলে যাচ্ছে ঐসব মেডেলে আমাদের পেট ভরবে না । লেখা পড়া শিখে মানুষ হতে হবে । নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । নিজের পায়ে দাঁড়ালে তবেই বিয়ে । পদ্ম আবার আত্ননির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী । খেলাধূলা করে পেটে ভাত জুটবে না । অন্যদিকে সত্যর আবার মেয়ের প্রতি বেশীমাত্রায় দরদ । সত্যর মতে, পিয়াশা খেলাধূলায় ভাল, সুতরাং তাকে খেলাধূলায় উৎসাহ দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয় । কিন্তু পদ্ম সত্যর সওয়ালের একেবারেই মার্ক দেয় না । বরং উল্টে বলে, চায়ের দোকান নিয়ে বেশ তো রয়েছো । মিছে কেন মেয়েটাকে খেলাধূলার দিকে উস্কিয়ে গোল্লায় পাঠাচ্ছো !
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কলেজে ভর্তির যখন তোড়জোড়, জেলার স্পোটর্স আধিকারিক ফোন করে জানালেন পিয়াশা এবছর জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগীতায় চারশ মিটার রানে এবং লং জাম্পে ডাক পেয়েছে । এবছর জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগীতা হচ্ছে জয়পুরে । বিশদ বিবরণের জন্য পিয়াশাকে নিয়ে সত্যকে সত্বর বহরমপুরে যেতে বললেন ।
সংসারের উপায়ের জায়গা ঐ চায়ের দোকান । চায়ের দোকান বন্ধ রাখা খুব মুস্কিল । তাতে সংসারে টান পড়ে । তাই পদ্ম মেয়েকে নিয়ে বহরমপুরে গিয়ে জেলা স্পোটর্স আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করলো । সেখানে মেয়ের কোচ ফরাক্কার জনার্দন মাস্টারের সাথে জয়পুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা হোলো । এই প্রথম পিয়াশা মা-বাবা ছেড়ে ভিন্ রাজ্যে পারি দিচ্ছে । জনার্দন আগাগোড়া পিয়াশাকে খেলা শেখায় । জনার্দন মাস্টার নিষ্ঠার সাথে পিয়াশাকে কোচ দিয়ে আসছে । অথচ এদিকে মেয়ে খেলাধুলায় এতোটা উন্নতি করেছে পদ্ম ঘূণাক্ষরেও টের পায় নি । তাই পদ্ম মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললো, “তোকে আরও বড় হোতে হবে ।“
স্পোটর্স অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার কলকাতা থেকে দুদিনের ট্রেনিং ব্যবস্থা হোলো পিয়াশার জন্য । পরর দিন ভোরের ট্রেনে কোচ জনার্দন মাস্টারের সাথে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা । হঠাৎ আগেরদিন সকাল বেলায় মাঠে পিয়াশের অনুশীলনের সময় কোচ জনার্দন বাবুর মোবাইলে একটি টেলিফোন, “আগামীকাল ট্রেনিং পিয়াশের হচ্ছে না । পিয়াশের নমিনেশন বাতিল হয়ে গেছে । তার জায়গায় হাওড়া জেলা থেকে তমাশার নাম নথিভূক্ত হয়েছে । সুতরাং পিয়াশা জয়পুরে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারছে না ।“
জনার্দন বাবুর মাথায় হাত ! তাঁর তৎক্ষণাত প্রশ্ন, “পিয়াশার অপরাধ ?”
এটা উপর মহলের অর্ডার ।
ভেঙ্গে পড়লো পিয়াশা । তার অনেকদিনের স্বপ্ন, জাতীয় স্তরে খেলে বাবা-মাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার । তার লুক্কায়িত প্রতিভার সাফল্যে ঘটানোর । কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো পিয়াশা । সে এখনও ধন্দের মধ্যে, তাকে বাদ দেওয়ার হেতু কী ?
পদ্ম শোনা মাত্রই ক্ষেপে লাফিয়ে উঠলো ! নিশ্চয়ই পেছনে বড় হাত রয়েছে । যার অঙ্গুলি হেলনে তার মেয়ের নাম তালিকা থেকে বাদ গেছে । অথচ কদিন আগেই জনার্দন বাবুর ই-মেলে পিয়াশার অফিসিয়াল নমিনেশনের চিঠি এসেছে । তারপর ট্রেনিং-এর জন্য সাই, কলকাতা থেকে আবার ই-মেল । সুতরাং অফিসিয়ালি পিয়াশা জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে খেলার জন্য নির্বাচিত । পদ্ম হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয় । সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো বহরমপুরে । সেখানে গিয়ে জানতে পারলো, পিয়াশা রাজনৈতিক যাঁতাকলের শিকার ।
পদ্ম গর্জে উঠলো ! “এটা অন্যায় । আমি ছাড়বো না । মেয়ের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি লড়বো !”
কিন্তু সত্য নরম মনের মানুষ । সে ঝুটঝামেলায় যেতে নারাজ । তাই পদ্মকে বললো, “থেমে যাও । মেয়ের কপালে যা হবার তাই হবে । অহেতুক বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের বিরাগভাজন হলে আখেরে আমাদের পরিবারের বিপদ হতে পারে !”
“আমরা দয়াকে ঘৃণা করি, কিন্তু যোগ্যতার যথাযথ মর্যাদা চাই । মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে আমি এর শেষ দেখতে চাই । পিয়াশার মনস্কামনা পূর্ণ করাই আমার লক্ষ্য ।“ চোখ লাল করে স্পষ্ট জবাব পদ্মর ।
পরের দিন ভোরের ট্রেনে সোজা সল্ট লেকে সাই ট্রেনিং সেন্টারে । সেখানে তমাশাকে দেখতে পেয়ে পদ্ম তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো তার বাবা একজন দুঁদে আমলা । আর তাছাড়া তমাশার বাবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের খুব কাছের মানুষ ।
জনার্দন মাস্টার পদ্মর সাথে রয়েছেন । সংশ্লিষ্ট সাই অধিকর্তা অভদ্র ভাষায় ভীষণ রূঢ়ভাবে জানালেন, চায়ের দোকানদারের মেয়ে কী করে জাতীয় স্তরে খেলার আশা করে ? উত্তরে পদ্ম একটা কথাই বলেছিল, “তার মেয়ে পিয়াশা নিজের পারফর্মেন্সের যোগ্যতায় খেলছে ।“ তখন জনার্দন মাস্টার বললেন, সাই অর্থাৎ স্পোটর্স অথরিটি অফ ইন্ডিয়া নমিনেশনের ব্যাপারে কিছু করবেন না । সুতরাং এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার অর্থ “অরণ্যের রোদনের ন্যায়” ।
পদ্ম জানতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাজ্যের মাননীয় রাজ্যপাল । তাই পদ্ম ভাবলো বিষয়টি রাজ্যপালের গোচরে আনা দরকার । তখন বিকাল তিনটে । ছূটলো রাজভবন । উত্তর গেটে গিয়ে সোজা রাজ্যপালের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিকে ফোন করে মাননীয় রাজ্যপালের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলো । মাননীয় রাজ্যপাল ঠিক পাঁচটায় সময় দিলেন । হাতে সময় কম । ট্যাক্সিতে গিয়ে নিউ মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া সংগ্রহ করে রাজ্যপালের চেম্বারে পদ্ম জনার্দন মাস্টারের সঙ্গে প্রবেশ করলো । পদ্ম কোনো কথা না বলে সরাসরি রাজ্যপালের পা জড়িয়ে ধরে বললো, আমার মেয়েটার সম্মান ফিরিয়ে দিন ।
তারপর রাতের ট্রেনে ভোর বেলায় দুজনে ফরাক্কা গিয়ে পৌঁছালো ।
ততক্ষণে পিয়াশার খবরটা প্রচারের আলোতে প্রকাশ পেয়ে গেছে । নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন । মাননীয় রাজ্যপাল সমস্ত কাগজপত্র ঘেটে যেটা বুঝলেন, সরকারিভাবে পিয়াশাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগীতায় নির্বাচিত, কিন্তু তাকে বাদ দেওয়ার কোনো সরকারি যোগাযোগ নেই । তার অর্থ পিয়াশার নমিনেশন তখনও বৈধ । অথচ অন্যায়ভাবে একটা ফোনের মাধ্যমে যোগ্য মেয়েকে জাতীয় স্তরে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে ?
জয়পুরে খেলার একদিন আগে পিয়াশার কোচ জনার্দন বাবুকে জানিয়ে দিলো, পিয়াশা জয়পুরে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারবে ।
অনেক টাকা ধার করে ফ্লাইটের টিকিট কেটে পিয়াশা জনার্দন মাস্টারের সাথে জয়পুরে খেলার স্টেডিয়ামে হাজির হোলো ।
পরেরদিন টান টান উত্তেজনা । প্রতিটা রাজ্য থেকে বাছাই বাছাই অ্যাথলেটরা এসেছে । জনার্দন মাস্টার পিয়াশাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে, “যেভাবে হোক তাকে তার মায়ের মান রাখতে হবে । খেলায় জিতে ফরাক্কার মানুষের আবেগকে মর্যাদা দিতে হবে ।“
পিয়াশা জনার্দন মাস্টারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মাঠে প্রতিযোগীদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো । মোট কুড়িজন প্রতিযোগী । প্রথমেই রানের প্রতিযোগীতা । সকলেই প্রস্তুত । তারপর ………?
চারশ মিটার রানে ফার্স্ট । আর লং জাম্পে তৃতীয় স্থান ।
ফরাক্কায় নামার সাথে সাথে পিয়াশাকে কাঁধে নিয়ে সতীর্থদের হৈ হুল্লোর । আনন্দে উন্মাদনার চূড়ান্ত । দূরে পদ্ম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে ।
(বি-দ্র : উল্লেখ থাকে যে গল্পটির সমস্ত চরিত্র, অথরিটি, প্রতিষ্ঠান, সবটাই কাল্পনিক । কারও সঙ্গে বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে গেলে সেটা নিছকই কাকতালীয় ও আকস্মিক্ ।)
লেখক: কবি ও গল্পকার
কলকাতা, ভারত