সালাউদ্দিন আহমেদ
হুট করে কোথায় যাই এমন চিন্তা পেয়ে বসল। কোভিড হাসপাতাল হিসেবে সরকারি কর্মচারি হাসপাতালের কথা মাথায় এলো। কারণ কিছুদিন আগে কোভিড টেস্ট করাতে এসে স্বস্তি পাই। তাছাড়া এ হাসপাতালটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন। এখানে আছে একঝাক মহাপ্রাণ। উপসচিব কামাল আর উপসচিব দিদার স্যার প্রমূখ সাদা প্রাণের আবেগে আমার মন আমাকে ৪ তারিখ রাত নয়টায় এ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে এলো। শরীর বেশ দুর্বল, মাথা ঘুরাচ্ছে, অক্সিজেন সেচুরেশন ৯২. অপেক্ষার টেবিলেই শুয়ে পড়লাম। স্ত্রী শুরু থেকেই আমার সাথে রোগের একচাদরে আবৃত যেন। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। ওর সাহচর্য সব সহজ করে দিল। আত্মীয়রাও চলে আসল।মূলত জুনের ২৪ তারিখ থেকে শরীরে হাল্কা জ্বর। আগের দুইদিন থেকেই একটানা জরুরি সভা আর জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। কিন্তু সারাটা দিনবিকাল প্রায় সাতটা পর্যন্ত মিটিং শেষ করে বাসায় গিয়ে অবস্থা বেশ খারাপ। পরদিন শুক্র শনিবার হওয়ায় একটু রক্ষা। কিন্তু না জ্বর বেড়েই চলল ১০২ পর্যন্ত। এর মাঝে একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম রান্না ঘরে। পরে ডাক্তারের পরামর্শে কোভিড টেস্ট করাই ১ তারিখ কর্মচারী হাসপাতালে। এইদিনও রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। পাশে বন্ধু উপসচিব কাওসার থাকায় রক্ষা। সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে কিছুক্ষণ থেকে বাড়ি ফিরে যাই। এর মাঝে আমার মন্ত্রণালয়ের সচিব স্যার, অতিরিক্ত সচিব, উন্নয়ন স্যার আর যুগ্মপ্রধান স্যারের নিরবচ্ছিন্ন সাহস, উৎসাহ, সমর্থন পাই, যা আমাকে এগিয়ে নিয়ে যায় ৩ তারিখ পর্যন্ত। বাসায় থাকা পর্যন্ত পিএস মাহমুদ আমার স্বাস্থ্যের বিষয়টি মনিটর করতে থাকে। আমি অনলাইন চিকিতসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এত অল্প সময়ে আমার মন্ত্রণালয়ের সকলের ভালোবাসায় নিমগ্ন হবো, কখনো ভাবি নাই। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।জুলাই ০৩ তারিখ করোনা পজিটিভ আসার পর কাশি মাত্রাতিরিক্ত আকার ধারণ করে, শরীর তার কাঁধ ছেড়ে দেয়। ঝুলে পড়ে বিশাল দেহ। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হই। এর মাঝে নারায়নগঞ্জের ডিসি জসীমউদ্দিন ফোন করে নারায়নগঞ্জে চিকিতসার ব্যবস্থা নিতে বলে। আমি কৃতজ্ঞ এই মানুষগুলির জন্য। যাহোক ইতোমধ্যে যুগ্মপ্রধান স্যার, অতিরিক্ত সচিব, উন্নয়ন স্যার আর উপসচিব মনিরুজ্জামান এর মাধ্যমে সচিব মহোদয় এমন এক আবেশ তৈরি করেন যে আমি আর অভিভাবকশূণ্য বোধ করি নাই। সচিব স্যার নিজে কোথায় কোথায় যেন ফোন করে আমার ভিআইপি ক্যাবিনে ভর্তির পথ সহজ করে দেন। আমার সাথেও কথা বলেন কিন্তু আমি কাশির তীব্রতায় কথা বলতে পারিনি, বাকিটা আমার স্ত্রী কথা বলে শুনে নিয়েছে। এমন এক ভীষণ অবস্থায় আমার মন্ত্রনালয়ের স্যারদের বদান্যতা আর আন্তরিকতা আমি কোনদিন ভুলব না। মাঝে যুগ্মসচিব উন্নয়ন স্যারও সাহস যুগিয়েছেন। ফোন করেছিলেন সহকর্মী, বন্ধুসহ এই হাসপাতালের পরিচালক স্যারও। অনেকেই হোয়াটসঅ্যাপ আর মেসেঞ্জারে সহানুভুতি জানিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন। আজ প্রায় ১৪ দিন হাসপাতালে কাটালাম। আজ কোভিড টেস্ট এ নেগেটিভ রেজাল্ট পেলাম। কাল মনে হয় ছুটি। আলহামদুলিল্লাহ। আমার মেরিন কমিউনিটি আমাকে দ্রুত সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন যেমনটি পেয়েছি আত্মীয় স্বজন থেকে। ঢালি স্যার, জামাল, মোশতাক, ব্যাচমেটসহ দেশ বিদেশ থেকে জানানো ভালোবাসা আর ক্যাডেট কলেজের বন্ধু বা বড়ভাই, ছোটভাইদের অকুন্ঠ সমর্থন আমাকে সাহসী করে তুলেছে। খাদ্য অধিদপ্তরের প্রাক্তণ সহকর্মীদের কথা নাই বা বললাম। এ সমুদ্রসম ভালোবাসার বাইরে যে আর কোন কিছুর মূল্য নেই তা আবিষ্কার করলাম। আমি সত্যি ভাগ্যবান। আমার এক বন্ধু যখন বলে তোর জন্য রক্ত, অর্থ, জীবন সব বাজি, তখন জীবনকে খুব বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। যখন কোন স্যার বলেন আমার একভাই চলে গিয়েছে, অন্য ভাই ফিরে এসেছে, তখন কান্নায় ভালোবাসা লুকাই। যখন স্বজনের চোখে দেখি নির্ভরতার স্বপ্ন, রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করা খাবার ক্যারিয়ার, হাসপাতালের রিপোর্ট নিয়ে স্বজনের চারদিকে তোলপার করা উতকন্ঠা, সতর্ক চোখে ভালবাসায় গোপন প্রকাশ বা স্ত্রীর উদাস চোখে ভালোবাসার অবলম্বন, সন্তানের মমত্ববোধ তখন আমি এই কল্পিত মুখটি লুকিয়ে রাখি মায়ের আঁচলের ভেতর, যেখানে সব প্রতিকার, সুখ। জীবনকে এক প্ল্যাটফরমে দাড়িয়ে এভাবে জীবনের বিচার কখনো করিনি। আলহামদুলিল্লাহ।বক্ষব্যাধি ডাক্তার অনেক পড়ে আমাকে বলেছেন,আমার লাং এর ইনফেকশন প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ খারাপ ছিল। একবার সিটি স্ক্যান আর তিনবার এক্স রে’তে লাংস এর ইনফেকশন বেশ ভালোই ছিল, যাকে বলে বাইলেটারাল নিউমোনিয়া। তাছাড়া হাই ব্লাড ফেরিটিন, মাত্রাতিরিক্ত ডব্লিউবিসি ও প্রেশার বেশি ছিল. ধীরে ধীরে ইনফেকশন কমে এলেও অন্য সমস্যা কাটতে সময় লাগবে জানালেন তিনি। এখন কাশি নেই, শরীরের দুর্বলতা কম। তবে ধকল আছে। আলহামদুলিল্লাহ। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।করোনাকালে জীবনযুদ্ধের এই সময়ে আমি আমার সকল আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মী, ব্যাচমেট, সুহৃদ, সিনিয়র, জুনিয়রসহ মন্ত্রণালয়ের স্যারদের উপর আস্থা রেখেছি আর বিশ্বাস রেখেছি সরকারি কর্মচারি হাসপাতালের উপর। এ হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সাপোর্ট, খাদ্য সরবরাহ, নিরাপত্তা সবই আমার দৃষ্টিতে আন্তরিক ও অতিরিক্ত পাওয়া। এখানকার ব্যবস্থাপনা আর চিকিতসা আমার ধারণা পাল্টে দিয়েছে। ধন্যবাদ পরিচালক স্যারকে। আর অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই এ হাসপাতালের চিকিতসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের। এ হাসপাতালকে সিএমএইচ এর মতো কল্পনা করাও আমার কাছে বাতুলতা নয়। আমার এই আস্থা আর বিশ্বাসই হোক আগামির পথ চলা। সবশেষে সচিব স্যারের বদান্যতা আর আন্তরিকতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে সালাম জানাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন। প্রায় ২৩ দিনের মানসিক আর শারিরীক ধকল ছেড়ে বাসায় যাব, এ অপেক্ষায় আছি। ডাক্তার যদিও বলেছেন করোনা তার লেজ নাড়িয়ে কোথায় কখন কি করে তা এখনো জানা যায়নি, সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। আহা! যেন নতুন জীবন লাভ করেছি। সব কিছুই মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা। মানুষের ভালোবাসার আর দোয়ার চেয়ে আর কিছু নাই। আল্লাহ সকলের উত্তম প্রতিদান দান করুন, আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুন, ভালো রাখুন। আমিন