শেখ একেএম জাকারিয়া
রমজানের আগমন, মানব জাতির জন্য আলোকিত জীবনের দীপ্ত আহ্বান । একমাস রোজা পালনের মধ্য দিয়ে নিজেকে খাদ্য-পানীয় ,আরাম-আয়েশ ও সকল প্রকার লোভ-লালসার হাতছানি থেকে বঞ্চিত রেখে বিশ্বনিয়ন্তা মহান রাব্বুল আলামিন ‘র নৈকট্য লাভের সাধনা এবং নিজেকে পরিপূর্ণ রুপে গড়ে তোলার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ অংশ সিয়াম সাধনা। মুসলিম বিশ্ব প্রতিবছর এ রমজান মাসে সিয়াম সাধনায় ব্রত হয় । সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহাপুরুষ নবী করিম (সা:) -এর মুখের বাণী ‘ছুমু তাছিহহু’ অর্থাৎ রোজা রেখো সুস্থ থাকবে। রাসুল (সা:)’র এ বাণী আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তাই তো চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা রোজার রোগ নিরাময় ক্ষমতা নিয়ে যুগযুগ ধরে গবেষণা করে আসছেন। এ পৃথিবীতে কোনও কিছুই কারণ ছাড়া সংঘটিত হয় না। বিপদ-আপদ , সুখ-দুঃখ ,রোগ-বালাই সবকিছুর পেছনেই রয়েছে একটি নির্দিষ্ট কারণ। আমাদের এ পৃথিবীতে জীবানুবাহিত রোগগুলোর মধ্যে সাধারণত ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস গঠিত রোগই প্রধান। সম্প্রতি এক গবেষনায় দেখা গেছে, উপবাসের ফলে অনেক জীবানু মারা যায় । এ বিষয়ে ডা. ডিউই বলেছেন, জীর্ণক্লিষ্ট , রুগ্ন মানুষটি উপোস থাকছে না , সত্যিকার অর্থে উপোস থাকছে রোগটি। Father of Medical Science হিসেবে খ্যাত Hippo Crates বলেছেন, The more you nourish and diseased body, the more the worse you make it. অর্থাৎ অসুস্থ দেহ যতই খাবার পায় ততই রোগ বাড়তে থাকে। গ্রাহাম বার্থলো জেনিংস গবেষকরা এ বিষয়টি সত্য বলে প্রমাণ করেন । ডা. জুয়েল এমডি এ বিষয়ে বলেছেন , যখন একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকবে তখনই দেহ সে মুহুর্ত হতে রোগ মুক্তির সাধনায় নিয়োজিত থাকে। ডা. স্যামুয়েল আলেক্সজান্ডার বলেন, রোজা হচ্ছে বিভিন্ন রকম মানসিক রোগের উত্তম ওষুধ, চমৎকার ও ফলপ্রসূ প্রতিষেধক। এটা যেমন আত্মাকে নির্মল করে, ঠিক তেমনি পবিত্রও করে । সেভিয়েত রাশিয়ার প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী Natikan বলেছেন , তিনটি কাজ করলে শরীরে সারা বছর যে জৈব বিষ জমা হয় তা দূরীভূত হয়, তন্মধ্যে রোজা অন্যতম । চিকিৎসা বিজ্ঞানী Alexheing বলেন ,রোজায় সর্দিজনিত বধিরতা ,অস্থি ফোলা ও দাঁতের রোগ নিরাময় হয় এবং খাদ্যের অরুচি ও অনিহা দূর করে। ডা. ম্যাক ভাডন বলেছেন ,রোজার কারণে বাত ও শরীরের বিভিন্ন জোড়ার সংক্রমক রোগেরও আরোগ্য হয় । সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা.গোলাম মোয়াজ্জিম ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর Effect of Ramadan fasting on Health শীর্ষক গবেষণা পরিচালনা করেন। এতে দেখা যায় ১৭ থেকে ৬৯ বছরের রোগীদের রোজা রাখার ফলে তাদের দেহের ওজন , তাপ , হৃৎস্পন্দন , রক্তচাপ,মেটাবলিক বিট, শরীরে পানির ভারসাম্য , রক্তের শর্করা , ইউরিয়া,কোলেস্টেরল, প্রোটিন, লিভার ফাংশন , গ্লুকোজ, টলারেন্ট টেস্ট, ও রক্তের শ্বেতরক্ত কণিকা কোনও কিছুই অস্বাভাবিক পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের শরীরের জন্য রোজা কখনই ক্ষতিকারক নয় বরঞ্চ রোজা না রাখলে বিভিন্ন রোগ-বালাই শরীরে এসে বাসা বাঁধে।
আজকের বিষয় শিরোনাম রমজানে বহুমূত্র /ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয় কী? এ বিষয় সর্ম্পকে জানার আগে ডায়াবেটিস /বহুমূত্র রোগ সর্ম্পকে জেনে নিলে কেমন হয়। ডা. এস, এন পাণ্ডে তাঁর Practice of Medicine বইয়ে ৪৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ডায়াবেটিস অতি প্রাচীন রোগ, তা বোঝা যায় এই থেকে যে, আয়ুর্বেদ পণ্ডিত সুশ্রুত’র প্রভৃতি গ্রন্থে অবিকল এ রোগের লক্ষণযুক্ত রোগীর কথা বলা হয়েছে। সুশ্রুত একে বলেছেন বহুমূত্র রোগ। চরক তাঁর গ্রন্থে একে মধুমেহ রোগ বলে বর্ণনা করে গেছেন । ঘন ঘন বা বারবার প্রস্রাব এবং প্রস্রাবের সঙ্গে চিনি বের হয় বলে এর নাম দেওয়া হয়েছিল বহুমূত্র। প্রাচীন ইউনানি ও হেকিমি গ্রন্থে এ রোগের কথা বর্ণনা করে বলা হয়েছে এ রোগ বিলাসী লোকদের কর্মবিমুখতার ফল । এ গ্রন্থে লিখিত হাকিম কবিরাজেরা প্রাচীনকালে বাদশা-বেগম সকলকেই রোজ হালকা ব্যায়াম করার পরামর্শ দিতেন।
ডা. এ,এন,এ হোসেন তাঁর আধুৃনিক এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বইয়ে উল্লেখ করেছেন , ” ডায়বেটিস বংশগত রোগ না হলেও সন্তানদের মধ্যে এ রোগ দেখা দেওয়ার প্রবণতা থাকে। ৪০ -৪৫ বছর পর যারা এ রোগে আক্রান্ত হয় তাদের অনেকেই অতিপুষ্টিজনিত স্থুলকায় ব্যক্তি। পরিশ্রমী মানুষের তুলনায় বসে থাকা মানুষদের এবং গ্রাম অপেক্ষা শহরের মানুষদের ডায়াবেটিক হওয়ার সম্বাবনা বেশি।”
আমাদের দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে।দেশে প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন ।এ ডায়বেটিস রোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী আবার ডায়বেটিসের বিভিন্ন জটিলতায় আক্রান্ত। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সাত থেকে দশ বছর পর শতকারা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগী কিডনী জটিলতায় আক্রান্ত হন। তাই নির্ধিধায় বলা চলে, বহুমূত্র আমাদের শরীরে এক জটিল ব্যাধি । এ রোগ সব বয়সের মানুষের মাঝে কম বেশি দেখা যায় । আমাদের দেহে অগ্ন্যাশয়(Pancreas) নামে একটি ছোটখাটো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে যার কাজ হলো এন্ডোক্রাইন গ্রন্থি হতে প্রতিদিন ইনসুলিন নামে এক জাতীয় হরমোন তৈরি করা। এ হরমোন প্রতিদিন খাবার হিসেবে খাওয়া, শর্করা (কার্বোহাইড্রেট) বা চিনি জাতীয় দ্রব্যগুলোকে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যাবহার করে অতিরিক্ত সুগারকে দেহের ভেতরেই সঞ্চিত রাখে । যদি কোনও কারণে এ হরমোনটি Pancreas থেকে ঠিকভাবে তৈরি না হয় বা তৈরি হলেও ঠিকমত কাজ করতে না পারলে শর্করা জাতীয় খাবারগুলো ব্যাবহৃত না হওয়ার দরুণ রক্তে সুগারের পরিমান বাড়তে থাকে । আর এভাবে বাড়তে বাড়তে যখন স্বাভাবিক মান অতিক্রম করে তখনই আমরা থাকে ডায়বেটিস বা বহূমূত্র বলে অভিহিত করি। অর্থাৎ শরীরে কোন কারণে ইনসুলিনের পরিমান কমে গিয়ে অথবা সম্পূর্ণ অভাবের দরুন সুগার বেড়ে গেলে বা কমে গেলে যে অবস্থার বা রোগের সৃষ্টি হয় তাকেই ডায়বেটিক বা বহুমূত্র রোগ বলে। এ ডায়াবেটিস রোগ সাধারণত দু’ ধরণেরঃ এক. ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস। দুই. ডায়াবেটিস মিলিটাস। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী , এ পৃথিবীতে প্রায় ১৫৭ কোটি মুসলিম উম্মার মাঝে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি ডায়াবেটিস রোগী রমজান মাসে রোজা পালন করে থাকেন। ১৩ টি মুসলিম প্রধান দেশের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে বিশ্বে প্রায় ৮০% টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগী রোজা পালন করে থাকেন। সুস্থ- স্বাভাবিক ডায়াবেটিস রোগী /লোকের জন্য রোজা পালন করতে কোনও বাধা নেই, যদি তাদের রক্তে সুগারের পরিমান স্বাভাবিক থাকে । কিন্তু রমজান মাসে পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস ডায়বেটিসের ওষুধ/ ইনসুলিনের পরিবর্তিত মাত্রা একটু সমস্যার সৃষ্টি হয় যা ডায়বেটিস রোগীর জন্য ক্ষতিকারক । তবে সঠিক নিয়ম জেনে নিলে ডায়াবেটিস রোগীর রোজা পালনে তেমন কোনও সমস্যা বা অসুবিধার সৃষ্টি হয় না । বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ/ নির্দেশক্রমে পরিকল্পিত ও সঠিক পন্থা অবলম্বন করে সিয়াম সাধনা করলে রমজান মাসে ডায়াবেটিস লোকের/রোগীর জন্য কোনও রকমের অসুস্থ হওয়ার কথা নয় বরঞ্চ এর উল্টোটা ঘটলে সময় বিশেষে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। অবশ্য যাদের বারবার হাইপোগ্লইসেমিয়া অর্থাৎ রক্তে গ্লুকোজের পরিমান কমে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে, যাদের রক্তে গ্লুকোজ অনিয়ন্ত্রিত , যারা লিভার, কিডনী, হার্ট ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত , কিডনী ডায়ালাইসিস করেছেন , খুব বেশি বয়স্ক বহুমূত্র রোগী এবং গর্ভবতী ডায়াবেটিস রোগীর সিয়াম পালনে বিরত থাকাই ভালো । এসব রোগীদের নিজের সম্পর্কে ঠিক ধারণা পেতে হলে রমজান আসার দু’থেকে তিন মাস পূর্বে একটি কমপ্লিট মেডিক্যাল চেকআপ করিয়ে নেয়া খুব জরুরী। এসময় রক্তের গ্লুকোজ , এইচবিএওয়ানসি, কিডনী ফাংশন (ইউরিয়া , ক্রিয়েটিনিন, ক্রয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্সরেইট), লিভার ফাংশন(এসজিপিটি, এসজিওটি, এলকালিন ফসফেটেজ )এবং হার্টের জন্য শরীরে কী পরিমান চর্বি আছে তা জানার জন্য লিপিডপ্রোপাইল ও ইসিজি পরীক্ষা করিয়ে নেয়া উচিত । আর এসব রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসক নির্দেশ দিবেন রোজা রাখা যাবে কী-না । হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ তানজিনা হোসেন দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার স্বাস্থ্যকুশল বিভাগে তাঁর লেখা রমজান ও ডায়াবেটিস নিবন্ধে বলেছেন, রমজান আসার পূর্বে সঠিক সময় সঠিক প্রস্তুতি না নিলে অন্তত পক্ষে এ মাসে চার রকমের বিপদ ঘটতে পারে। এক. হঠাৎ করে রক্তে সুগারের পরিমান অনেক কমে গিয়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন । অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। দুই. রক্তে সুগার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। তিন. ডায়বেটিস কিটোএসিডোসিস বা কোমা হয়ে যেতে পারেন । চার. পানি শূন্যতা ও থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন। অতএব, রমজান মাসে ডায়াবেটিস রোগীর খাবারের ব্যাপারে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। একজন ডায়বেটিস রোগী এ মাস আসার পূর্বে যে পরিমান ক্যালরি গ্রহণ করেন রমজান মাসে তাকে সে পরিমান ক্যালরিই গ্রহণ করতে হবে। কম বা বেশি গ্রহণ করলে চলবে না। এসময় শুধুমাত্র সময়সূচি ও খাদ্যের উপাদান পরিবর্তিত হতে পারে । এক জন বহুমূত্র রোগী এ মাসে ইফতারি ও অন্যান্য সময়ে অতিরিক্ত কোনও খাবারই গ্রহন করতে পারবেন না । বিশেষ করে ভাজাপোড়া ও মিষ্টি জাতীয় খাবার থেকে তাকে বিরত থাকতে হবে । সুস্থ থাকতে হলে প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগীকে পুষ্টিকর ও মানসম্পন্ন খাবার গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে । রক্তে গ্লুকোজের পরিমান নিয়ন্ত্রনে রাখতে হলে লাল আটা, লাল চালের ভাত ,গোটা শস্য, শস্যবীজ ইত্যাদি খাবার গ্রহণ করতে হবে । এসব খাবারকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় লো গ্লাইসেমিক ফুড বলা হয় । ডা. জহিরুদ্দিন আকন্দ রতন তার principles & practice of Medicine বইয়ে উল্লেখ করেছেন ১ কাপ শিম বা মটরশুটির খোসার চা ১ ইউনিট ইসুলিনের সমান এবং শসার মধ্যে এমন হরমোন রয়েছে যা অগ্ন্যাশয়ের কোষে ইনসুলিন উৎপাদনে বিশেষ সহায়ক। সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক গবেষনায় দেখা গেছে, বহুমূত্র রোগ নিরাময়ে করলা বিশেষ উপকারী। করলায় রয়েছে প্রচুর ইনসুলিন যা রক্ত ও প্রস্রাবে সুগারের পরিমান কমাতে বিশেষভাবে সহায়তা করে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন করলা রাখা উচিত। এছাড়াও পেয়াজ, রসুন ও টমেটো রক্তের গ্লুকোজ কমাতে বিশেষ উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে। বহুমূত্র রোগ সম্পর্কে ডা. এস, এন পাণ্ডে তার practice of Mmedicine বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘‘ডায়াবেটিস রোগীদের পিপাসা বেশি হলে আমলকির রস , আমলকি চুষে খেতে হবে এবং লেবুর রস পানিতে মিশিয়ে খেলেও পিপাসা কম হয়। ” হাই ক্যালরি, হাই গ্লাইসেমিক ফুড যত সুস্বাদু ও মুখরোচকই হোক না কেন এসব খাবার থেকে বিরত থাকাই উত্তম। কেননা এসব খাবার যে কোন মুহুর্তে একজন ডায়বেটিস রোগীর জীবন বিপন্ন করতে পারে। বেশি পরিমানে তেল আছে এমন খাবার যেমন – বেগুনি, বড়া/পেঁয়াজু , চানা/ছোলা, জিলাপী ও বাখরখানি এসব ভাজা-পোড়ায় শুধু দেহের ওজনই বাড়ে না রক্তে Cholesterol এর মাত্রা বাড়ানোসহ পেটে বদহজম ও গ্যাস সৃষ্টি হয়ে নানা ধরণের জটিলতা দেখা দেয়। ইফতারির সময় হালকা ও সুষমও পুষ্টিকর আহার করত: রাত দশটা সাড়ে দশটার দিকে রুটি/ডিনার সেরে এবং শেষ রাতে সেহেরির জন্য ভাত /রুটি সহযোগে আমিষ ও তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে । সেহেরি না খেয়ে কোনও অবস্থায়ই রোজা রাখা উচিত হবে না । রোজা পালন করে দিনের বেলা মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম/ব্যায়াম করা যাবে না । এতে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান কমে গিয়ে রোগী শারিরীক ভাবে দুর্বল ও অতিরিক্ত ঘাম বের হওয়ার কারণে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে। অবশ্য ইফতারের পর হালকা ব্যায়াম বা আধা ঘন্টা হাঁটাচলা করলে অসুবিধা নেই। আর যারা নিয়মিত তারাবির নামাজ পড়েন তাদের জন্য আলাদা করে ব্যায়াম/হাঁটার প্রয়োজন পড়ে না । বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বহু পূর্বেই মতামত দিয়েছেন রোজা রেখে জরুরি প্রয়োজনে রক্ত পরীক্ষা করলে রোজা নষ্ট হয় না । অন্তত সপ্তাহে এক বা দু’ দিন সেহেরির দু’ ঘন্টা পর, না পারলে ইফতারের আধা ঘন্টা পর যে কোনও ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রক্তের গ্লুকোজ মাপাতে হবে । ফাস্টিং সুগার মাপতে হলে মাগরিবের আযান হওয়ার সাথে সাথে এক গ্লাস পানি খেয়ে রোজা ভেঙ্গে এরপর রক্ত দিতে পারেন অথবা ইফতারির আধঘন্টা পূর্বে রক্তের সুগার মেপে নিতে পারেন। আর যাদের বাড়িতে গ্লুকোমিটার রয়েছে তাদের তো কোনও সমস্যাই নেই। ঘরে বসে নিজে নিজেই রক্তের গ্লুকোজ মেপে নিতে পারেন । খেয়াল রাখতে হবে সেহেরির পর রক্তে গ্লুকোজের পরিমান ৮ মিলিমোল বা এর কম এবং ইফতারির পূর্বে অর্থাৎ ফাস্টিং ৬ মিলিমোল বা এর কম রয়েছে কী না । যদি এর ব্যাতিক্রম ঘটে অতিসত্ত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দিনের বেলা যে কোনও সময় খারাপ লাগলে , মাথা চক্কর দিয়ে উঠলে, শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলে , অতিরিক্ত ঘেমে উঠলে, বুক ধড়ফড় করলে ,বেশি ক্ষুধা লাগলে, মাথা ফাঁকা লাগলে কিংবা চোখে ঝাঁপসা দেখলে অবশ্যই সুগার মাপতে হবে । দিনের বেলা কোনও সময়ে রক্তের গ্লুকোজ ৩.৩ মিলিমোল বা তার কম অথবা ১৬ মিলিমোল’র বেশি এবং দিনের পূর্বাহ্ণে ৩.৯ মিলিমোল বা তার কম হয়ে গেলে সেদিন রোজা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। রমজান মাসে ডায়াবেটিসের ওষুধ এবং ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সূচি পরিবর্তন করতে হবে। সহজ নিয়মে সকাল বেলার ডোজ/ ওষুধ ইফতারির সময় এবং রাতের ডোজ/ওষুধ অর্ধেক করে সেহেরির সময় খেতে হবে। অবশ্য এ পরিবর্তন চিকিৎসকের নির্দেশক্রমে করা উচিত । নইলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। ইনসুলিন ব্যাবহরের পর অনেক সময় রক্তে সুগার হঠাৎ করে খুব বেশি পরিমানে কমে যেতে পারে। এ অবস্থার নাম হাইপোগ্লাইসেমিয়া । এটি একটি বিপজ্জনক অবস্থা। তাৎক্ষনিকভাবে চিকিৎসা না দিলে রোগী মারা ও যেতে পারে। কোন্ রোগীর জন্য কী পরিমান ওষুধ/ইনসুলিন প্রয়োজন ও পরিবর্তন এবং ঠিক কোন্ রোগীর জন্য প্রযোজ্য তা চিকিৎসকই সঠিকভাবে বলতে পারেন। কাজেই এ মাসে অবশ্যই ওষুধের মাত্রা ও সময় পরিবর্তনের পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং ইনসুলিন /ওষুধ সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে ।
লেখক:
কবি ও প্রাবন্ধিক
মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট
সদর হাসপাতাল,
সুনামগঞ্জ,বাংলাদেশ।