মোস্তাক আহমেদ
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল কাদের তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের পাবনার জেলা প্রশাসক। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পরপরই জেলা প্রশাসকের পদে থেকেও পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সক্রিয় যুদ্ধে অংশ নেয়া বেসামরিক প্রশাসনের দেশের প্রথম সর্বোচ্চ ব্যক্তি তিনি। তাঁর নেতৃত্বে পাবনার গণ-মানুষকে সংগঠিত করে দেশের প্রথম জেলা হিসেবে পাবনাকে পাক দখলমুক্ত করেন তিনি। তিনিই প্রথম পাবনায় বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন।
শুধু তাই নয়। দেশকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে পাবনার ঐ সময়ের মুক্তি সংগ্রামের কিংবদন্তি আব্দুর রব বগা মিয়া, রফিকুল ইসলাম বকুল, ওয়াজিউদ্দিন খান, আমিনুল ইসলাম বাদশা, গোলাম আলী কাদরী, আমজাদ হোসেন, রণেশ মৈত্র, সিভিল সার্ভিসের পাবনার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই কেবল সংগঠিত করেননি, তিনি দেশের বিশেষ করে রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলের ডিসি, এসডিও, ডিআইজি, এসপি, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বিভাগের বাঙালি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ও জনগনকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণে দুঃসাহসিক ভুমিকা পালম করেছিলেন। মুজিবনগর সরকার গঠন প্রক্রিয়ায়ও তিনি সক্রিয় ভুমিকা রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রথম সচিব। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও স্বাধীনতার অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকেও একদিকে যেমন মুজিবনগর সরকারকে সবধরনের সাচিবিক সহায়তা করছেন, অতিরিক্ত হিসেবে দেশের ভেতরের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতে অবস্থানরত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যুব ক্যাম্পের সার্বিক মনিটরিং এর দায়িত্বও পালন করেছেন অত্যন্ত সফলভাবে। তাঁর সার্বিক কার্যক্রমে শুধু সরকার নয়, মুক্তিযোদ্ধারাও সন্তুষ্ট ছিলেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে বিদেশের সাথে যৌথ উদ্যোগে আমদানি নির্ভর শতভাগ রফতানিমূখী তৈরি পোশাক শিল্প ‘দেশ গার্মেন্টস লি.’ স্থাপন করেন এবং পোশাক শিল্প খাতকে দেশের সর্বাধিক কর্মসংস্থানকারী খাতে পরিণত করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের দুর্বল অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করেন। যার ব্যাখ্যা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। সুখের খবর, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএ তাঁকে পথিকৃৎ অবদানের জন্য বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পের ‘জনক’ হিসেবে স্বীকার করে এবং তাঁকে তাঁর মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত রেখেছে।
কিন্তু এই অকুতোভয় দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরী হয়ে পাবনায় দীর্ঘদিন চাকরি করেও কোন অনুষ্ঠান এমনকি স্বাধীনতা বা বিজয়দিবসে আলোচনা অনুষ্ঠানে তাঁর উপর কোন আলোচনা শুনেছি বলে মনে নেই। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা হিসেবে আমার কাছে স্থানীয় কেউ কেউ বড়জোর বলতেন ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার পাবনার ডিসি ছিলেন মোহাম্মদ নুরুল কাদের খান এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি খান সেনাদের অবজ্ঞা ও ঘৃণা প্রদর্শন স্বরূপ নিজের নামের শেষের ‘খান’ উপাধিও কেটে দেন’- ইত্যাদি নানা গল্প। কিন্তু তাঁর লেখা ‘একাত্তর আমার’ বইটি পড়ে তাঁর ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন করে জেনে এই মহানায়কের প্রতি আমার শ্রদ্ধা সহস্র গুণ বেড়ে গেলো। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে অসমসাহসী এই মুক্তিযোদ্ধার কপালে মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বা স্বাধীনতা পদক জুটেনি তা জেনে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি মনে করি, মহান এই মুক্তিযোদ্ধার অসামান্য অবদানের বিষয়টি অন্য অনেকের মতোই চাপা পরে গেছে। না হয় তাঁর সহযোদ্ধারা অনেকে যেখানে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব খেতাব বীর উত্তম বা বীর বিক্রম বা স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন, সেখানে প্রাপ্তির তালিকায় তিনি অগ্রগণ্য থাকারই কথা ছিল। আমি এবিষয়ে পাবনা অনেক বিশিষ্টজন, পাবনার সাবেক ও বর্তমান জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলেছি। তাঁরা বিষয়টি অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন এবং তাঁকে উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করা জাতীয় দায়িত্ব হিসেবেই সবাই মত প্রকাশ করেন। পাবনার বর্তমান জেলা প্রশাসক জনাব কবির মাহমুদ জানান, গত বছর মোহাম্মদ নুরুল কাদেরকে স্বাধীনতা পদক প্রদানের প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু গৃহীত হয়নি। এবারও তিনি প্রস্তাব পাঠাবেন বলে আমাকে অভিহিত করেন। আশা করি মোহাম্মদ নুরুল কাদেরের নামে স্বাধীনতা পদকের প্রস্তাব সদাশয় সরকার এবারে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন। আমি আরও আশা করি, সদাশয় সরকার মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় ও দুঃসাহসিক অনন্য অবদানের জন্য বীরত্বপূর্ণ বীর উত্তম খেতাব তাঁকে মরণোত্তর প্রদান করবেন। একইসাথে, পাবনায় তাঁর নামে কোন একটা স্থাপনা গড়ে উঠুক, তার-ও জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক: কবি, ছোট গল্পকার ও উপ সচিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার