পরোপকারী বন্ধু

ছোট গল্প

0
1101

এস বি এ নিলয়

তখন ২০১৯  সাল। ফটোগ্রাফির নেশায় কুমিল্লার এক গ্রামে গিয়েছিলাম। এর আগেও অনেকবারই কুমিল্লা গিয়েছি। তবে সব বারই অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে। এবার শুধুমাত্র বেড়ানোর উদ্দেশ্যে নিজের ইচ্ছামত বেরিয়ে পড়লাম সেই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ীর টানে। সেখানে রাজ রাজাদের যে সমস্ত প্রাসাদ ছিল সেগুলোর কিছু ছবি তুলে আনার জন্য। সেখানে আমার ছোট্ট বেলার এক বন্ধু বসবাস করত। বৈশাখ মাস, ঝড়-বৃষ্টি আসাটাই স্বাভাবিক। তারপরেও ছাতা না নেওয়াটা নিতান্তই বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। যাই হোক, নেশার টানে একবার যখন বেরিয়ে পড়েছি  যত কষ্টই হোক না কেন উদ্দেশ্য সাধন করা এখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুর বাড়ি যেতে নৌকায় যেমন যাওয়া যায় তেমনি গাড়ির রাস্তাও আছে। তথাপি নৌকায় যাওয়াটা অনেকটা সহজসাধ্য বলে নৌকা ঘাটের দিকে রওনা হই।

হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি। সঙ্গে ছাতা ও নেই, এদিকে গলায় ঝুলানো দামি জাপানি ক্যামেরা। জল পড়লে নষ্ট হওয়ার চান্স ১০০ ভাগ। তাই কোন কিছু না ভেবে কাছাকাছি অবস্থিত একটি বাস স্টপে দাঁড়াই। এমনিতে এই সময়ে এই রাস্তায় বাস আসার কোন চান্সই নেই। অগত্যা নৌকাই ভরসা। কিন্তু অবাক করে দিয়ে এই সময়ে একটি প্রাইভেট কার এই রাস্তা দিয়েই আসছিল। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। আমি বাসস্টপের ছাদের তলায়। হঠাৎ মনে হল গাড়িটিকে থামাবার চেষ্টা করি। সিগন্যাল দিতেই গাড়িটি এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। গাড়ির ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক জানলার কাঁচটা কে সামান্য নামিয়ে মুখ বের করে জিজ্ঞেস করলেন,” কোথায় যাবেন?” আমি সামনের দিকে যাব বলাতে উনি গাড়ির দরজাটা খুলে দিলেন।’চলুন আমিও এই দিকেই যাচ্ছি’বলে আমাকে গাড়িতে তুলে নিলেন। আমিও বৃষ্টির কথা ভেবে আর সাত পাঁচ ভাবি নি। তৎক্ষণাৎ গাড়িতে উঠে পড়ি।

গাড়ি চলা শুরু করলো। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে তো কোনদিন এই গ্রামে দেখিনি, কি ভেবে এখানে আসা?” আমি বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি-কোন কিছু না ভেবে আমিও তৎক্ষণাৎ জবাব দেই। “বন্ধুর নাম কি?” আরিফিন। “ও, আপনি আরিফিনের বাড়ি যাবেন?” আমি বললাম, হ্যা। এবার আমার আশ্চর্য হওয়ার পালা। ‘আপনি কি করে চিনলেন আরিফিন কে?’ ‘ও আমার বাড়িতে কাজ করে, বাড়ির দেখাশোনা করে।’ আমার উৎসুক আরো বেড়ে গেল। আমি জানতে চাইলাম,’আপনি কে? নাম কি আপনার?’ আমার কৌতুহল দেখে উনি বললেন, ‘আমার নাম প্রেম। এখানে এক জমিদার বাড়ি আছে, সেই জমিদার বাড়ির আমি হলাম সপ্তম বংশধর।’ আমি চমকে উঠলাম। তবুও বুঝতে না দিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হয়েই বললাম, ও, এর আগে আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি আপনার বাড়ি গিয়ে কিছু ছবি তুলব। কিন্তু দুর্ভাগ্য দেখুন, প্রতিবারই অনুমতি না থাকার দরুন বিফল হয়ে ফিরতে হয়েছে।

তিনি আমার উৎসুক্য দেখে বললেন, বেশ, তাহলে আগামীকাল আরিফিন এর সঙ্গে চলে আসুন আমার বাড়ি। এ যেন মেঘ না চাইতে পানি পেয়ে গেলাম। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এমন ভাবে কথা বলতে বলতে আমরা কখন যেন আরিফিনের বাড়ির গেইটে চলে আসি। উনি আমাকে নামিয়ে দিয়ে উনার নিজের কাজে চলে গেলেন।আমি আরিফিনদের বাড়ির গেটে কড়া নাড়তেই সে আমাকে দেখে চমকে উঠলো।’আরে দোস্ত, তুই এখানে? ‘আমি কোন কিছু না বলে শুধু বললাম, কেমন দিলাম বল? আশ্চর্য হলি তো? সে বলল, এসেছিস, বেশ করেছিস। কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছি, বাইরে এত বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু তোর কাপড় তো ভিজে না। তাহলে আসলি কি করে? আমি আর কোন কিছু রাখঢাক না রেখেই বলি, তোদের জমিদারবাবু গাড়ি করে আমাকে দিয়ে গেছেন। সাথে আমাকে আগামীকাল তোর সাথে যাওয়ার জন্য উনার বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। সে বলল, ভিতর আয়, বাকি কথা খেতে খেতে বলিস।

পরদিন সকালে আরিফিনের সাথে আমিও জমিদার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাই। অনেক বড় বাড়ি। ভিতরে যেতেই দেখি জমিদার বাবু পুরনো এক সোফায় বসে আছেন। আমাকে দেখেই,’আসুন, আসুন, এখানে বসুন।’ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম উনি একটু চিন্তিত। আরিফিনও বোধহয় বুঝতে পেরেছিল। তাই সে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে বাবু? আপনাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন? বিমর্ষ জমিদার বাবু বললেন, কাল রাতে ৩০ ভরি গয়না আর বাগানবাড়ির দলিল চুরি হয়ে গেছে। এ শুনে আরিফিন অবাক হয়ে বলল, কি বলেন বাবু? কিভাবে হল? জমিদার বাবু বললেন, কাজের লোক কে জিজ্ঞেস করতে বলে সে নাকি নতুন কাজের লোকটিকে সেই সিন্দুকের আশেপাশে যাতায়াত করতে দেখেছে। সুজয় এ কাজ করতে পারে-আরিফিন কিছুটা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল। তা শুনে জমিদারবাবু কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, কে কি করতে পারে তা তো আমার জানা নেই, সেটা সময়ই বলবে। যাই হোক, বাদ দাও। জমিদারবাবু আমাকে বললেন, নিলয়, আজকে সারাদিন আমার বাড়িতে থাকবে। তোমার অনেক দিনের ইচ্ছে তুমি আজ পুষিয়ে নাও। যা যা ছবি তোমার তুলতে হয়, তুলে নাও। আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। খুশিতে ডগমগ হয়ে রাজি হয়ে গেলাম। তিনি আরিফিন কে বললেন, তোমার  বন্ধুকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাও। তিনি তার কাজে বেরিয়ে পড়লেন। আমরাও সারাদিন ঘুরে ঘুরে মনের ইচ্ছে মতো ছবি তুললাম। শেষে খেয়েদেয়ে বিকেলবেলা জমিদার বাবু কে বিদায় জানালাম। পরদিন বন্ধুর কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে এ যাত্রায় গ্রাম ছেড়ে চলে আসি। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। কাজের চাপে আরিফিনের সাথেও খুব একটা কথা বলা হয়ে ওঠেনা।

ঈদের কিছুদিন আগে আবার ওই গ্রামের উদ্দেশ্যে ‌ রওনা হই। নৌকায় চড়তে গিয়ে কিছুটা অবাক হই। চারিদিক ফাঁকা। যেন জনশূন্য একটা গ্রাম। ব্যাপারটা কিছুতেই মাথায় আসছিল না। মাঝি কে জিজ্ঞেস করলাম,’কি ব্যাপার, চারিদিকে এত ফাঁকা জনশূন্য লাগছে কেন?’ সামনে ঈদ, অথচ গ্রামে কোন হৈ-হুল্লোড় নেই কেন? মাঝি বলল, ‘আপনি জানেন না বাবু? সারা গ্রামে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। কোন এক অজানা অসুখে সারা গ্রামের মানুষ অসুস্থ। অনেকে মারাও যাচ্ছে। গ্রামের অবস্থা খুব খারাপ।’এই কথা শুনে মনটা কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল।মনে মনে একটা আশঙ্কা তৈরি হলো তবে কি এই মহামারিতে আরিফিনের কিছু হল? গত তিন মাস ধরে ওর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আশঙ্কার মেঘ নিয়ে গ্রামে ঢুকতেই দেখি চারিদিকে শুধু হাহাকার। প্রতি ঘরেই কান্নার রোল। কত লোক দেহ দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আরিফিনদের বাড়ির কাছে আসতেই দেখি দরজায় তালা। আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে একজন লোক জিজ্ঞেস করল, কাকে খুজছেন? আরিফিন এর কথা বলতেই লোকটি মাথা নিচু করে বলল, ও তো নেই ‌। কিছুদিন আগেই মারা গেছে। কথাটা শুনেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। হৃদপিণ্ডটা খালি হয়ে গেল। তবুও আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই মহামারিতেই ও মারা গেছে? লোকটি বলল, না বাবু, ওই জমিদার বাবু আরিফিন কে খুন করেছে। ‘এটা কি করে সম্ভব? ওতো জমিদার বাবুর বাড়ি দেখাশোনা করতো’-আমি জানতে চাইলাম। সে বলল, ওই জমিদার প্রতিবছর একজন করে লোক কাজে রাখতো এবং কিছুদিন পর মিথ্যে চুরির দায়ে তাকে খুন করতো। তাদের ভয় দেখাতো, জমিজমা হাতিয়ে নিতো। আর যারা দিতে রাজি থাকতো না তাদেরকে মেরে ফেলা হতো। এমনই এক ঘটনা হতে দেখে আরিফিন তার প্রতিবাদ করেছিল। তাই তাকেও মরতে হলো। একথা শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। আমি আজই এর একটা হেস্তনেস্ত করব। শুনে লোকটি বলল, তা আর দরকার হবে না। আরিফিনের মৃত্যুর একমাস পরে নদীতে গোসল করতে গিয়ে জমিদারবাবুও মারা গেছেন। আর বর্তমানে গ্রামের যা অবস্থা আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্রাম ছেড়ে চলে যান। দুঃখিত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানতে চাইলাম এখন ফিরতে হলে নৌকা পাওয়া যাবে তো? ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে হয়তো পেয়েও যেতে পারেন।

লোকটিকে বিদায় জানিয়ে আমি ঘাটের কাছে চলে আসি। একটি নৌকা ও নেই। আকাশে থোকা থোকা কালো মেঘ, ঠিক যেমন আমার মনের অবস্থা। ছোটবেলা থেকে যে বন্ধুকে চিনতাম সে আজ নেই। বিধাতা কি করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন? বারবার ওর নিষ্পাপ মুখ খানা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, যদি আগে বুঝতে পারতাম জমিদারের হাত থেকে বন্ধুকে বাঁচাতে পারতাম। ভাবতে ভাবতেই একটা গাছের নিচে এসে বসলাম। এখন কি করবো, কোথায় যাব আমি? হঠাৎ আমার কাধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করি। চোখ তোলতেই দেখি বন্ধু আরিফিন দাঁড়িয়ে। ‘দোস্ত, আমি কি তোকে ছুঁতে পারি?’ ‘না দোস্ত, আমিতো ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। আমি এখন তোদের মতো না। আমার এই দেহ প্রাণহীন। অথচ দেখো আমি কোনদিন কোন অন্যায় কাজ করিনি। এমনকি প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপার্জিত টাকাও গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তা বলে কোনদিন কোন অন্যায় কে প্রশ্রয় দিতে পারিনি। ওই জমিদার আমার চোখের সামনে এক নিরপরাধ কাজের লোককে গুলি করে মেরে ফেলে। আগেও নাকি সে এমন করেছে। কিন্তু আমি এর কিছুই জানতাম না। সেদিন বাগান বাড়ি তালা দিয়ে ভুলবশত চাবি বাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। সেটাই ফেরত দিতে গিয়ে দেখি জমিদারবাবু কাজের লোককে খুব করে মারছে। জমি হাতিয়ে নিতে চাইছিল। সে দিতে রাজি না হওয়ায় জোর করে তার টিপসই নিয়ে তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। আমি চিৎকার করে উঠলাম। জমিদারবাবু আঁতকে উঠলেন। এই সময়ে আমার উপস্থিতি জমিদার বাবু কে বিচলিত করে ফেলে। আমি এসব কথা গ্রামের লোককে বলে দেবো বলে দৌড় দিতেই পেছন থেকে সে আমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এই অবস্থায়ও আমি গ্রামের লোককে সবকিছু জানিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ি। আমি জানতে চাই তারপর কি হলো? কথায় বলে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমি  মারা যাওয়ার মাস খানেক পরেই নদীতে গোসল করতে গিয়ে জমিদারবাবু পানিতে তলিয়ে যায়।

কিন্তু মরেও সে তার শয়তানি বন্ধ করেনি। পানিতে বিষাক্ত বিষ মিশিয়ে দেয়। আর এর ফলেই আজ গ্রামের মানুষের এই অবস্থা। আমি বললাম এখন উপায়? সে বলল, উপায় আছে বন্ধু। তুই পারবি এই মহামারী থামাতে। কি পারবি না? কেন পারব না? তুই শুধু বল, আমাকে কি করতে হবে? তুই একটা কাগজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কিছু নিয়মাবলী লিখে হ্যান্ডওয়াশ এর সাথে প্রত্যেক বাড়ির দরজার সামনে রেখে আসবি। লিখে দিবি প্রত্যেককে পরিষ্কার পানি পান করতে হবে, ঘনঘন হাত ধুতে হবে,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখিয়ে সময় মতো ওষুধ খেতে হবে। এই কথা বলে সে যেভাবে এসেছিল সে ভাবে বাতাসের সাথে মিশে গেল। আমার চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরল। সে রাতে আমি তার কথামতো প্রত্যেক বাড়ির দরজার সামনে এসব কিছু লিখে রেখে আসি।

এভাবেই চলতে থাকে। কিছুদিন পর শুনি ধীরে ধীরে মহামারী স্তিমিত হয়ে এসেছে। আমার কাগজে লেখা নিয়মগুলি পড়ে সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেয়। আর এর ফলে সবাই সুস্থ হয়ে উঠে। শয়তানের শয়তানিও শেষ হয়। পরিশেষে বলি, বর্তমানে নোবেল করোনা ভাইরাসে মৃত্যুহার রুখতে আমাদেরকেও সেই সমস্ত নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে। তবে একদিন এই মহামারীও খতম হয়ে যাবে। আপাময় মানুষ মুক্তি পাবে এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে।

লেখক: শিক্ষার্থী ৮ম শ্রেণি।

ন্যাশনাল আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়

ঢাকা  বাংলাদেশ।

৩০, সেপ্টেম্বর ২০২০.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here