মৃগয়া

ছোট গল্প

0
1246

মাসউদুল হক

সেনাপতি ভীরসিংয়ের অগ্রযাত্রার কথা এই মুলুকের কারওই আর অজানা নেই। গান্ধার রাজ্য জয়ের মধ্য দিয়ে যে জয়যাত্রা শুরু করেছিলেন তা এখন সমাপ্তির পথে। কাপালিকা রাজ্য জয় করলেই ভীরসিংয়ের জয়যাত্রা পূর্ণতা পাবে। কুণ্ডাকপুরের নৃপতি বলবীর জীবদ্দশায় সমগ্র হিন্দুস্তানের অধিপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন। তার সেই ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানিয়ে কুণ্ডাকপুর রাজ্য থেকে চারজন সেনাপতি নির্বাচন করে চারদিকে প্রেরণ করা হয়েছে। উত্তরে রওয়ানা দিয়েছেন উসমার পাঠান। দক্ষিণে ভানু প্রতাপ। পূর্বে রাজ্য বিস্তারের দায়িত্ব পেয়েছে শ্রীরাম। আর পশ্চিমের বিপদসংকুল পাঁচ রাজ্য জয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নবীনতম সেনাপতি ভীরসিংয়ের ওপর।

সভাসদগণের প্রায় সবাই এই তরুণের নিয়োগে বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল, সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পক্ষে ভীরের বয়স যথেষ্ট নয়। আবেগ নিয়ন্ত্রণের মতো যথেষ্ট বর্ষীয়ান সে এখনও হয়ে ওঠেনি। কিন্তু নৃপতি বলবীর তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। সভাসদরা নৃপতির এহেন আচরণকে খামখেয়ালিপনা বলেই ধরে নিয়েছিলেন। রাজার সামনে প্রতিবাদ করতে সাহস হয়নি কারও। তবে রাজার আড়ালে পরস্পরের সাথে কথা বলে বুঝতে চেয়েছেন, ভীরের কী এমন গুণাবলি আছে যা নৃপতির নজরে পড়ে, কিন্তু তাদের চোখ এড়িয়ে যায়?

অমাত্যবর্গ মনে মনে প্রার্থনা করেছিল- আর কেউ না শুধু ভীরসিং যেন পরাস্ত হয়। ভীরসিং পরাজিত হলে বলবীরের আত্ম বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। আর নৃপতির আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি মানে সভাসদগণের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিস্তার। কিন্তু ভীর যেন সভাসদগণকে ভুল প্রমাণের পণ করেছে। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব থেকে উলে­খযোগ্য সাফল্যের সংবাদ না এলেও পশ্চিম থেকে সাফল্যের খবর আসছে প্রতিনিয়ত। সভাসদগণ ইতোমধ্যে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেছেন। এখন তারা কেউ কেউ নৃপতির চেয়ে ভীরসিংয়ের মধ্যে অধিক গুণাবলির সন্ধান লাভে সক্ষম হচ্ছেন।

নৃপতির আস্থার প্রতিদান প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন ভীরসিং। ইতোমধ্যে গান্ধার, জাহানাবাদ, বুলকপুর জয় করে নিয়েছেন তিনি। প্রবল পরাক্রমশালী যশোধর রাজ্যের রাজা রায় চন্দ্র তার রণকৌশল দেখে এতই ভয় পেয়েছে যে, সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। যশোধর বিজয়ের পর উত্তরের শেষপ্রান্তের রাজ্য কাপালিকা জয় করে অন্য তিন সেনাপতির আগেই ভীরসিং ফিরে আসবেন বলে নৃপতি বলবীর বিশ্বাস করেন। কী পুরস্কার দিয়ে ভীরসিংকে পুরস্কৃত করা হবে তা নিয়ে অমার্ত্যবর্গের চিন্তার শেষ নেই। নানা রকম পুরস্কারের প্রস্তাব প্রতিনিয়ত নৃপতির কাছে আসে। কিন্তু নৃপতি বলবীর ঐসব পুরস্কারের কথা শুনে দুই পাশে মাথা নাড়েন। এবং স্মিত একটা হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে বলেন, ভীরের জন্য এইসব পুরস্কার যথেষ্ট উপযুক্ত নয়। রাজার অতৃপ্তি দেখে সবাই বিস্মিত হয়। আর অন্দরমহলে শুরু হয় গুঞ্জন। সবাই ফিসফাস করে বলছে, নৃপতির নাকি ইচ্ছে কন্যা গায়ত্রীকে ভীরসিংয়ের হাতে তুলে দেবেন। এই সম্ভাবনার কথা শুনে রাজকন্যা গায়ত্রী লজ্জায় আরক্তিম হয়ে ওঠে। ভীরের সাথে কোনোদিন দেখা না হলেও তার বীরত্বগাথা রাজকন্যাকে মুগ্ধ করেছে। পিতা বীরবল ইচ্ছে পোষণ করলে তাতে সম্মতি দেওয়ার গোপন অভিলাসের কথা ইতোমধ্যে সখীদের কাছে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি গায়ত্রী।

রাজদরবারের এইসব খবর হাজার মাইল দূরে যুদ্ধরত ভীরসিংয়েরও অজানা নয়। কী করে যেন সেই সব খবর বাতাসে উড়তে উড়তে তাঁর তাঁবুতেও পৌঁছায়। কিন্তু ভীরসিংকে কোনো পুরস্কার কিংবা গায়ত্রীর স্বামী হওয়ার লোভ মোহিত করে না। সে বর্তমানে শুধু কর্তব্যের প্রতিই নিষ্ঠ। নৃপতি বলবীর যে গুরুদায়িত্ব তাকে দিয়েছেন তা যত দ্রুত পারা যায় শেষ করে লম্বা সময়ের জন্য বিশ্রামে যাওয়ার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে আছেন। আর সেই বড় বিশ্রামের লোভে ছোট ছোট বিশ্রাম পরিত্যাগ করেছেন ভীর। যশোধর রাজ্যের রাজা রায় চন্দ্রকে নৃপতি বলবীরের বশ্যতা স্বীকার করানোর পর সৈন্যরা খানিকটা বিশ্রাম প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু ভীর সেই প্রস্তাব পুরোপুরি উপেক্ষা করে কাপালিকা রাজ্য অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছেন।

ভীরসিং যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে জানত কাপালিকাই তার চূড়ান্ত গন্তব্য। তবে সেই গন্তব্যে পৌঁছার জন্য যে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে সেই পথের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর ভয়। আছে বন্দি হয়ে দাসত্ববরণের সম্ভাবনা। যুদ্ধের ময়দানে থাকা সবচেয়ে অকুতোভয় যোদ্ধার মতো ভীরসিংও সেই সম্ভাবনাগুলোকে একবারের জন্য ভুলে যায়নি। ফলে প্রতিটি রাজ্য জয়ের জন্য পৃথক পৃথক পরিকল্পনা নিয়েছেন। গান্ধার রাজ্য আক্রমণ করতে গিয়ে যশোধরের কথা মনে রাখেননি। কিংবা জাহানাবাদের আগে বুলকপুর। তেমনই যশোধর রাজ্য আক্রমণের আগে কাপালিকা নিয়েও ভাবেননি তিনি। তবে যশোধর রাজ্য জয়ের পর পরই কাপালিকা রাজ্যের খবরাখবর সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু যত খবর সংগ্রহ করছেন ততই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন ভীরসিং। কোনো বিষয়েই সুনিশ্চিত হতে পারছেন না। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে,পশ্চিমের রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে কাপালিকা রাজ্যই সবচেয়ে সুরক্ষিত ও দুর্গম। কিন্তু কেন প্রকৃতিগতভাবে সুরক্ষিত- সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর যশোধরের রাজা রায় চন্দ্র ছাড়া আর কেউ দিতে পারেনি।

তবে বিগত দিনের যুদ্ধের ইতিহাস ঘেঁটে ভীরসিং অনুমান করতে পেরেছেন, কাপালিকা রাজ্যের রাজা হরিহরণ কোনো দুর্বল শাসক নন। বিগত পাঁচ বছরে সাতটি ছোট-বড় যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। এবং সবগুলোতেই প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেছেন। তাদের রাজবংশের বয়স দ্বিশতবর্ষ অতিক্রম করেছে। তামাম হিন্দুস্তানে একই বংশের রাজাদের এত দীর্ঘ সময় রাজ্য শাসনের ইতিহাস আর আছে কি-না তা ভীরসিংয়ের জানা নাই। তার হাতিশালায় যথেষ্ট হাতি আছে। ঘোড়াশালায় আছে ঘোড়া। সমুদ্র যাত্রার জন্য আছে বিশাল আকারের যুদ্ধজাহাজ। যুদ্ধবাজ সৈনিকের অভাব নেই তার। শোনা যায়, সমগ্র হিন্দুস্তানে কাপালিকাই একমাত্র রাজ্য যেখানে কৃষক, দাস, কামার, কুমার- সবাই যোদ্ধা। নিয়মিত যোদ্ধার বাইরে এরাও সময়ের প্রয়োজনে অস্ত্র ধরতে জানে। সবচেয়ে ভয়ংকর হরিহরণের অমাত্যবর্গ। যুদ্ধের নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবনে তাদের জুড়ি মেলা ভার।

নৃপতি বলবীরের মতো একশত বছর আগে মাধুশাঙ্ক নামের এক নৃপতিরও সমগ্র হিন্দুস্তানের অধিপতি হওয়ার বাসনা জেগেছিল। একে একে সব রাজ্য জয় করে কাপালিকা রাজ্যে এসে আটকে গিয়েছিলেন তিনি। লক্ষ লক্ষ সৈন্য নিয়েও তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল মাত্র কয়েক হাজার সৈন্যের বাহিনীর কাছে। যুদ্ধে অস্ত্র, গোলাবারুদ আর সৈন্য সংখ্যা অধিক হলেই হয় না। সাথে কার্যকর রণকৌশল আর দৃঢ়চেতা যোদ্ধাও লাগে-এই সত্য রাজা মাধুশাঙ্ক যখন অনুভব করেছিলেন তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সীমিত সৈন্যবাহিনী নিয়ে কী করে বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে হয় তা শেখার জন্য কাপালিকা রাজ্যে নিজ পুত্রদের পাঠাতে উদগ্রীব থাকেন আশেপাশের অনেক রাজ্যের রাজাই। কিন্তু রাজা হরিহরণ কিংবা তার পূর্বসূরিরা কেউই শিক্ষানবিশ হিসেবে রাজপুত্রদের গ্রহণ করেন না। বার্তাবাহক মারফত জানিয়ে দেন, ‘প্রজার মনোরঞ্জনই শাসকের পক্ষে সবচেয়ে বড় রণকৌশল।’ যদিও কোনো রাজাই কোনোদিন এইসব দার্শনিক কথা বিশ্বাস করেনি। দ্বিতীয় কাউকে সেই পত্রের বক্তব্যের বিষয়ে অবগত না করে সকল রাজাই নিজ হাতে প্রেরিত পত্রটি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলেন। এবং অমার্ত্যবর্গের নিকট কাপালিকার রাজাদের ধূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।

যশোধরের রাজা পরাজিত হওয়ার পর সন্ধির শর্ত মোতাবেক তার সৈন্য-সামন্তদের ভীরসিংয়ের সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি। উপযাচক হয়ে নানা রকম তথ্যও সরবরাহ করেছেন। নিজের পতনের পর কাপালিকা রাজ্যের পতন দেখার জন্য রাজা যশোধরের রাজা রায়চন্দ্র অস্থির হয়ে উঠেছেন। তার বর্ণনা থেকেই ভীরসিং নিশ্চিত হয়েছেন, কেন কাপালিকা রাজ্য প্রকৃতিগতভাবেই সুরক্ষিত। কাপালিকা রাজ্যের উত্তর এবং পশ্চিম প্রান্ত ঘিরে রেখেছে বিস্তীর্ণ সাগর। সেই সাগর পাড়ি দিয়ে কাপালিকা রাজ্য আক্রমণ করা দুরূহ কাজ। বছর দুয়েক আগে কাপালিকা রাজ্যের ধন-সম্পদের লোভে উচ্চাভিলাষী রাজা মীন বিন বিশাল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে নৌপথে আক্রমণ করেছিল। তবে তার ফলাফল সুখকর হয়নি। পরাজিত হয়েই ফিরে যেতে হয়েছিল মীন বিনকে। সমুদ্র যেখানে শেষ সেখানে শুরু হয়েছে বিস্তীর্ণ পর্বতরাজি। দক্ষিণের পুরো সীমানা জুড়ে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই উঁচু পর্বতরাজি। পূর্বে রয়েছে তুরঙ্গমী নদী। দক্ষিণের পর্বতরাজির হিমবাহ আর ঝর্নাধারা একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করেছে এই তুরঙ্গমী নদী। রাজ্যের সমগ্র পূর্বপাশটিকে বেষ্টন করে উত্তরের সাগরে পড়েছে তুরঙ্গমী। সাগর আর পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে কাপালিকা রাজ্য আক্রমণ করা প্রায় অসম্ভব। যশোধরের রাজা প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্য এবং মানচিত্র পাঠ করে ভীরসিং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, কাপালিকা রাজ্য আক্রমণ করতে হলে এই তুরঙ্গমী নদী পার হয়েই করতে হবে। এবং এই অভিযান বর্ষা আগমনের পূর্বেই শেষ করতে হবে। কারণ ভরা বর্ষায় তুরঙ্গমী সাগরের আকার ধারণ করে। নৌকা দিয়ে ভাসমান সেতু তৈরি করে যুদ্ধের রসদ সরবারহ করার কৌশলটি তখন কার্যকর করা কঠিন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, বর্ষা আসার পূর্বেই কাপালিকা রাজ্য জয় শেষ করে নৃপতি বীরবলের পদতলে নিজের তলোয়ার সোপর্দ করতে চান ভীরসিং।

সেই ভাবনা থেকে যশোধর রাজ্য জয়ের পর পরই একটি অগ্রবর্তী সেনাদল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কাপালিকা রাজ্য অভিমুখে। ভীরসিং তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কাপালিকা রাজ্যের নিকটবর্তী একটি সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করে বিশ্রামের আয়োজন করতে। মুখে বিশ্রামের কথা বললেও ভীরসিং বিদায় দেওয়ার সময় প্রত্যেক সৈন্যকে ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিলেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, অগ্রবর্তী দলটি কাপালিকা রাজ্যের নিকটবর্র্তী হওয়ার পূর্বেই রাজা হরিহরণের সেনারা তাদের আক্রমণ করে বসবে। ঐ আক্রমণে অগ্রবর্তী সৈন্যদের অল্প কিছু পালিয়ে যেতে সক্ষম হবে, কিছু মৃত্যুবরণ করবে এবং বড় একটি অংশই বন্দি হয়ে দাসের জীবন বেছে নেবে। কিন্তু ভীরসিংয়ের লাভ হবে দুটি। প্রথমত কাপালিকা রাজ্যের রণকৌশল এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যাবে এবং দ্বিতীয়ত সামান্য ক্ষতির বিনিময়ে কাপালিকা রাজ্য আক্রমণের একটা অজুহাত দাঁড় করাতে পারবেন। সাধারণত রাজ্য বিস্তারে কোনো অজুহাত লাগে না। কারণ ইতিহাস বলে, আধিপত্যকামিতা মানুষের প্রকৃতি প্রদত্ত প্রবণতা। কিন্তু ভীরসিং তার প্রজ্ঞার বলে জেনেছে, অজুহাতবিহীন আক্রমণে তেজ থাকে না। একমাত্র গান্ধার রাজ্য কোনো কারণ ছাড়াই আক্রমণ করেছিল ভীরসিং। সেই আক্রমণে সাফল্য পেয়েছে ঠিকই, তবে তাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ সৈন্যরা উদ্দীপ্ত ছিল না। প্রতিপক্ষকে শত্র“পক্ষ ভাবতে না পারলে নিষ্ঠুর হওয়া কঠিন। গান্ধার রাজ্য আক্রমণের সময় নিজ সৈন্যদলের মধ্যে নিষ্ঠুরতার অভাব দেখেছিলেন ভীরসিং। এই কারণে আক্রমণের উদ্দেশ্য যাই হোক, একটা অজুহাত খাড়া না করে প্রতিআক্রমণে যান না ভীরসিং। অগ্রবর্তী সেনাদল সেই অর্থে আক্রমণ করার জন্য একটি টোপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

ভীরসিং নিশ্চিত ছিল এই টোপ হরিহরণ গিলবে এবং কাপালিকা রাজ্য আক্রমণের সুযোগ করে দেবে।

কিন্তু ভীরসিংয়ের সূক্ষ্ন পরিকল্পনাগুলো ইতঃপূর্বে কার্যকর হলেও কাপালিকা রাজ্যের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। যা অনুমান করেছিল তার কিছুই বাস্তবে ঘটেনি বা ঘটছে না। মাত্র মাস সাতেক আগে যে রণকৌশলে যশোধরের রাজা রায়চন্দ্রকে মোকাবেলা করেছিল সেই একই কৌশল ভীরসিংয়ের বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে না রাজা হরিহরণ। সেই সময় রাজা হরিহরণ নিজ রাজ্যসীমা অতিক্রম করে তুরঙ্গমীর এই প্রান্তে চলে এসেছিলেন। রায়চন্দ্রের অগ্রবর্তী দলকে নিশ্চিহ্ন করে কেন যেন ফিরে গেলেন না। আচমকা কোনো কালক্ষেপণ না করে যশোধর রাজ্য অভিমুখে তীব্রবেগে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। এই আচমকা অগ্রায়ন দেখে রাজা রায়চন্দ্র বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি পিছু হটে জৌহারবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি রাজা হরিহরণকে। ঘন জঙ্গলের সুবিধা নিয়ে রাজা রায়চন্দ্রকে এক সময় প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছিলেন হরিহরণের সেনাদল। রাজা রায়চন্দ্র সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে দুই পক্ষেরই বিপুল সৈন্য-সামন্ত মৃত্যুবরণ করে। তবে ক্ষতিটা বেশি হয়েছিল রাজা রায়চন্দ্রের।

অনেকেই মনে করে, যশোধরের রাজা রায়চন্দ্র কাপালিকা রাজ্যের সাথে অপ্রয়োজনীয় বিবাদে জড়িয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। সেই সর্বনাশের ফলই হলো, ভীরসিংয়ের কাছে পরাস্ত হয়ে অপমানজনক সন্ধিতে স্বাক্ষর করা। সেই যুদ্ধের পূর্বে যশোধর রাজ্যের যে পরিমাণ সৈন্য, গোলাবারুদ আর সরঞ্জাম ছিল যুদ্ধের পর তার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। নতুন করে অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য জনগণের ওপর বাড়তি খাজনা আরোপ করেছিল রায়চন্দ্র। কিন্তু অল্প সময়ে আদায়কৃত খাজনা দিয়ে যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু ঘন ঘন খাজনা বৃদ্ধির কারণে প্রজারা রাজার ওপর অসন্তুষ্ট ছিল। অনেকে বিরক্ত হয়ে পূর্বপুরুষদের মতো কাপালিকা রাজ্যে আশ্রয় নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছিল। কেউ কেউ চলেও গিয়েছিল।

প্রজাদের সাথে রাজা রায়চন্দ্রের দূরত্বটি টের পেয়েছিলেন ভীরসিং। সৈন্যবাহিনী নিয়ে যশোধর রাজ্যে প্রবেশ করার সময় প্রজাদের বড় নির্লিপ্ত মনে হয়েছিল। বহু দেশে অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে ভীরসিং বুঝে নিয়েছিলেন, প্রজারা মনে করে- এই দেশ রাজার। প্রজার এই দেশে কোনো অধিকার নাই। রাজা রায়চন্দ্র মসনদে থাকল নাকি মসনদচ্যুত হলো তাতে প্রজাদের কিছুই যায়-আসে না। ফলে প্রবল কোন বাঁধা না দিয়েই এক অসম্মানজনক সন্ধির মাধ্যমে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল রায়চন্দ্র।

অন্যদিকে বাধ্য হয়ে যশোধর রাজ্যেও সাথে যুদ্ধে নামা কাপালিকার রাজা হরিহরণ অনেক লোকবল এবং গোলাবারুদ হারানোর পরও প্রজাদের ওপর বাড়তি খাজনা আরোপ করেনি। শিলাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়েছিল আগের বছর। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগে পুনরায় খাজনা বৃদ্ধি করলে প্রজাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে ভেবে নিজেকে সংবরণ করেছিলেন রাজা হরিহরণ। বরং অঞ্চলভেদে অনেকের খাজনা মওকুফও করে দিয়েছিলেন। এইসব খবরে ভীরসিং একটু উৎসাহ পেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, এক যুদ্ধ করতে গিয়ে রাজা যশোধর যেখানে নিঃস্ব সেখানে লাগাতার যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকা কাপালিকা রাজ্যের রাজা হরিহরণের না-জানি কী করুণ দশা!

কিন্তু অনুমান আর বাস্তবতার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক তা ভীরের চোখে ধরা পড়তে থাকে যশোধর রাজ্য ত্যাগ করার পূর্বেই। তার অগ্রবর্তী দল ন্যূনতম কোনো বাধা ছাড়াই তুরঙ্গমী নদীর তীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় সাপের কামড়ে একজন সৈন্যের মৃত্যু ছাড়া আর কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর না পেয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠে ভীরসিং। কাপালিকা রাজ্যের ভেতরে এবং বাইরে গুপ্তচরের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দেয়। চারদিক থেকে যতই তিনি খবর সংগ্রহ করতে থাকেন ততই তাঁর কপালে চিন্তার রেখা ঘন হতে থাকে।

শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদে ভীরসিং তুরঙ্গমী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বড় বিষণ্ন হয়ে পড়েন। তিনি দেখেন তুরঙ্গমীর ঐ-পাড় জনমানবশূন্য। ঘাটে কয়েকটি ছোট ডিঙি বাঁধা আছে বটে তবে তাতে কোনো মানুষ নেই। চলি­শ হাজার সৈন্যের কোলাহল, হাতুড়ি পেটানোরর শব্দ, অস্ত্রের ঝনঝনানি, ঘোড়া এবং খচ্চরের উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে কাপালিকা রাজ্যের মানুষ পালিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল ভীরসিংয়ের। তবে তৃপ্ত হতে পারেনি। নিজের মধ্যকার দ্বিধা দূর করতে শত্র“পক্ষের গতিবিধি নজরে রাখার জন্য অগ্রবর্র্তী দল যে উঁচু মাচান তৈরি করেছিল তার শীর্ষে তিনি  নিজেই আরোহণ করেন। আরও দূরবর্তী স্থানে দৃষ্টি প্রসারিত করে আবিষ্কার করেন, তার অনুমান ভুল। তুরঙ্গমী নদীর পাড় ঘেঁষে যে উঁচু উঁচু সারিবদ্ধ টিলা আছে তার অপর প্রান্তে মাইলের পর মাইল নানা বয়সী যব, ভুট্টা আর ইক্ষুর জমিন। কৃষকের দল আপন মনে জমিনে চাষ করে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিজের জমিন থেকে আগাছা তুলে নিচ্ছে। নদীর ঠিক অপর পাশেই যে ভীরসিং বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে চোখ রাঙাচ্ছে তা নিয়ে তাদের কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। টিলার পিঠে বড় বড় পরিখা খনন করা আছে। ইচ্ছে করলেই সেখানে নানা রকম গোলাবারুদ দিয়ে সৈন্য লুকিয়ে রাখা  সম্ভব ছিল। এবং ঐ উঁচু টিলা থেকে কামান দাগলে অল্প সময়ের মধ্যে ভীরসিংয়ের সৈন্যদলকে পর্যুদস্ত করে ফেলাও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই পরিখাগুলোতে কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। ছোট ছোট কিছু শিশু সেই বিশালাকার পরিখাগুলোতে লুকোচুরি খেলায় মত্ত। অপর প্রান্তের এই সৈন্য সমাবেশ নিয়ে শিশুদেরও কোনো আগ্রহ নেই। হঠাৎ করে ভীরসিং হতাশ হয়ে পড়েন। তার মনে হয়, কাপালিকা রাজ্যের রাজা হরিহরণ যেন তার মনের কথা জানেন। প্রতিপক্ষকে আক্রমণের জন্য যে অজুহাত খুঁজছেন তিনি সেই অজুহাত তৈরির সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছেন তিনি।

রাতে খাদ্যগ্রহণের পর বর্ষীয়ান যোদ্ধাদের নিয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন ভীরসিং। সারা কাপালিকায় ছড়িয়ে থাকা গুপ্তচরদের ডেকে এনে সর্বশেষ তথ্যগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু কাপালিকা রাজ্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে- এমন কোনো প্রমাণ উদঘাটন করতে ব্যর্থ হন। তবে কি রাজা হরিহরণ বিনাযুদ্ধে কাপালিকা ছেড়ে দেবেন? নাকি বড় কোনো ফাঁদ পেতে বসে আছেন? কোনো বিষয়েই সুনিশ্চিত হতে পারেন না ভীরসিংয়ের সেনাবহিনীর প্রবীণ যোদ্ধারাও। অনেকটা নিরুপায় হয়ে দুটি সিদ্ধান্ত নেন ভীরসিং। রাতের আঁধার কেটে গেলে তুরঙ্গমী নদী অতিক্রম করবেন। এবং খুব সকালেই আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠাবেন রাজা হরিহরণের কাছে।

পরদিন খুব সকালে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ভীরসিংয়ের সৈন্যবাহিনী তুরঙ্গমী নদী অতিক্রম করে। বিপুল পরিমাণ গোলা-বারুদ, যুদ্ধের নানা রকম রসদ আর চলি­শ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধবহরটি কাপালিকা রাজ্যের জমিনের ফসল নষ্ট করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে। এতদিন ধরে একটু একটু করে ফলানো ফসল ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে নষ্ট হতে দেখে কৃষকেরা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা বাধা দেয় না, কিন্তু তাদের চোখে ভীরসিং ঘৃণার আগুন দেখেন। যুদ্ধযাত্রাকালে জমির ফসলের ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রেওয়াজ সর্বদা অনুসরণ করেন ভীরসিং। সৈন্যদল জমিন অতিক্রমের পর ভীরসিং প্রত্যেক কৃষকের দিকে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা ছুড়ে দিতে থাকেন। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখেন, তারা কেউ সেই মুদ্রার দিকে ফিরেও তাকায় না। তাদের চোখে দাউ দাউ করে জ¦লছে ঘৃণার আগুন।। যে আগুন গান্ধারে দেখেননি। যে আগুন যশোধরের প্রজাদের চোখে দেখেননি সেই আগুন কাপালিকায় দেখে ভীরসিং একটু চমকে ওঠেন। তার মনে হয়, এই রাজ্য সত্যিই বড় দুর্ভেদ্য। যদি রাজা হরিহরণ আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে সাড়া দেয় তবে বিজয় কেতন উড়িয়ে নিজ রাজ্যে যত দ্রুত সম্ভব প্রস্থান করবেন ভীরসিং। এই রাজ্যে সৈন্য রেখে যাওয়া মানে মৃত্যুক‚পে আশ্রয় নেওয়া।

কিন্তু ভোরে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া দূত সন্ধ্যায় ফিরে এসে যখন জানায়, রাজা হরিহরণ মৃগয়ায় গেছেন। এবং তার অনুপস্থিতিতে আর কারও আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার অধিকার নেই। এই কথা জেনে, ভীরসিং চূড়ান্ত রকমের হতাশ হয়ে পড়েন। রাজ্যের মীমাংসা রাজা ছাড়া হয় না। সুতরাং রাজার কাছে তাকে পৌঁছুতেই হবে।

রাজপ্রাসাদ থেকে একশত ক্রোশ দূরে তাঁবু ফেলে রাজা ঠিক কোনো বনে গেছে সেই বনের সন্ধান করতে থাকেন ভীরসিং। তার ইচ্ছে, মৃগয়ায় থাকা অবস্থায় রাজা হরিহরণের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রেরণ করবেন। কিন্তু প্রাসাদের দ্বাররক্ষীরা সুনির্দিষ্ট কোনো বনের নাম বলতে পারে না। শেষে বিচলিত হয়ে রাজ্যের প্রধান অমাত্য কুলদীপের কাছে দূত পাঠান ভীরসিং। কুলদীপ জানিয়ে দেন, রাজা হরিহরণ যুদ্ধ করতে নারাজ। তিনি মৃগয়ায় যাওয়ার পূর্বে বলে গেছেন, ভীরসিং তুরঙ্গমী নদী পার হওয়ার সাথে সাথেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেশব mv¤ªv‡R¨I  সাম্রাজ্যেও পতন ঘটেছে বলে তিনি গণ্য করবেন। এবং তার উজির, নাজির, সেনাপতি সকলের পদ আপনা-আপনি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে। তাই রাজার সর্বশেষ আদেশবলে বর্তমানে তিনি আর উজির পদে নেই।

যে রাজ্যে উজির নেই, নাজির নেই, কাজি নেই, সেনাপতি নেই সেই রাজ্যের কার কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায় করবেন বুঝতে পারেন না ভীরসিং। কথা বলার জন্য অন্দরমহলের কেউ উপযুক্ত কিনা সেই খবর নিতে গিয়েও নিরাশ হন তিনি। রাজা তার স্ত্রী-পুত্রকে সঙ্গে নিয়েই মৃগয়ায় গেছেন। কবে ফিরবেন কেউ জানে না। তিনি মৃগয়ায় গেছেন নাকি পালিয়ে গেছেন তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হতে পারত, কিন্তু মৃগয়ায় যাওয়ার পূর্বে নিজের সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত করে গেছেন শুনে রাজাকে পলাতক ভাবতে পারেন না ভীরসিং। অনন্যোপায় হয়ে ভীরসিংয়ের যখন উন্মাদ হতে আর বাকি নেই তখন সন্ধ্যা নাগাদ রাজপুরোহিত তাঁবুতে হাজির হন। এই দেখে ভীরসিং খানিকটা আশান্বিত হন।

রাজপুরোহিত যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনপূর্বক ভীরসিংকে অবগত করেন যে, রাজা নিজে যে পদগুলো দিয়েছিলেন তা ফিরিয়ে নিয়েছেন সত্য, তবে রাজপুরোহিতের পদটি বংশানুক্রমিক। সুতরাং এই পদটি বিলুপ্ত করার অধিকার রাজা হরিহরণ রাখেন না। তাই সমগ্র রাজ্যে তিনিই একমাত্র দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মৃগয়ায় যাওয়ার পূর্বে রাজা হরিহরণ পুরোহিতকে বলে গেছেন, তিনি আর রক্তপাত চান না। বিগত পাঁচ বছরে সাতটি যুদ্ধ করে তিনি বড্ড ক্লান্ত। নিজের এবং প্রতিপক্ষের প্রতিটি মানুষের মৃত্যু তাকে প্রতিনিয়ত পীড়িত করে। যদি ক্ষমতা ত্যাগ করে রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হয় তবে তিনি তাই করতে প্রস্তুত। রাজপুরোহিত একথা জানাতেও ভোলেন না, রাজা হরিহরণ যাওয়ার আগে বলে গেছে, রাজ্যের যা সম্পদ আছে তা বর্তমান দখলদার হিসেবে ভীরসিংয়ের প্রাপ্য। কাপালিকার প্রজাদের কল্যাণে কাজ করার জন্য তিনি রাজকোষও ভীরসিং বরাবর হস্তান্তর করেছেন। রাজপ্রাসাদের প্রবেশমুখের প্রাচীন বটবৃক্ষে রাজকোষের চাবি ঝুলানো আছে। তা যেন নির্দ্বিধায় ভীরসিং হস্তগত করেন। এবং রাজকোষ থেকে যা নিতে ইচ্ছে করে তাই যেন তুলে নেন। বিনিময়ে তিনি প্রজাদের নিরাপত্তা কামনা করেন শুধু।

রাজপুরোহিতের কথায় ভীরসিংয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এমন বিজয়ের মুখোমুখি কোনো যোদ্ধা কোনোদিন হয়নি। এমন বিজয় কোনো যোদ্ধা কোনোদিন কামনাও করে না। সবচেয়ে নিকৃষ্ট জয়ের মুখোমুখি হয়ে ভীরসিং হতভম্ব হয়ে পড়েন।

পরদিন প্রত্যুষে খানিকটা সন্দেহ এবং বেশ কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে ভীরসিং প্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করেন। পথে তাকে অতিক্রম করা চাষি, কামার-কুমার, গোয়ালা, নারী-পুরুষ কারও চোখে কোনো বিস্ময় দেখে না ভীরসিং। সবাই নির্বাক। এত নীরবতার মধ্য দিয়ে বিশাল সৈন্যবাহিনী আগে কখনো কোনো জনপদ জয় করেনি। যাত্রাপথে কয়েকটি বেওয়ারিশ কুকুর ক্ষণে ক্ষণে কোথা থেকে যেন দলবদ্ধ হয়ে এসে ধমক দিয়ে যাচ্ছিল। সৈন্যরা হৈ হৈ করে উঠতেই তারা পালিয়ে যাচ্ছিল এবং আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে আসছিল। কুকুর এবং মানুষের এই খেলার মধ্যেই এক সময় প্রাসাদের প্রবেশমুখে এসে দাঁড়ান ভীরসিং। এবং রাজপুরোহিতের বর্ণনা মতে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ দেখতে পান। সেই বটবৃক্ষে একটি বিশাল চাবিও ঝুলতে দেখেন। সেই চাবি দিয়ে বিশ্বস্ত দুজন অনুচরকে রাজকোষের তালা খোলার জন্য প্রেরণ করলে তারা ফিরে এসে জানায়, এই চাবি দিয়ে রাজকোষের তালা খোলা গেছে। সেখানে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পরিমাণে হীরা-জহরত-মণি-মুক্তা মজুদ করা আছে।

অন্য সময় ঐ রাজকোষ দেখতে ছুটে যেত ভীরসিং। কিন্তু সেদিন কেন যেন সব উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন তিনি। খুব ক্লান্ত, অবষণ্ন দেহে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। চারদিকে বাদ্য বেজে ওঠে। কিন্তু তিনি অনুভব করেন, সেই বাদ্যে শব্দ আছে, কিন্তু সুর নেই। সৈন্যরা অন্য সব বিজয়ের মতো কাপালিকা বিজয় উদ্যাপন করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। তারা আবিষ্কার করে কাপালিকা রাজ্য বিজয় তাদের উল্লসিত করতে পারেনি। একদল সৈন্য নিয়ম মোতাবেক নৃপতি বীরবলের পতাকাটি নিয়ে প্রাসাদের চূড়ায় আরোহণ করে। তারা পতাকা উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের কাপালিকা রাজ্য জয়ের বার্তা চারদিকে ছড়িয়ে দিতে চায়।

কিন্তু কেন যেন হঠাৎ করে ভীরসিং ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠেন। হাতের ইশারায় প্রাসাদের চূড়ায় আরোহণ করা সৈন্যদের নেমে আসতে বলেন। তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে যে পথে প্রাসাদে প্রবেশ করেছিল সেই পথে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসেন। রাজকোষের চাবিটি নিয়ে প্রাচীন বটবৃক্ষের ডালে পুনরায় ঝুলিয়ে দেন। সাথের সৈন্যদের আদেশ করেন, কারও কাছে লুণ্ঠনের মালামাল থাকলে তা যেন কালক্ষেপণ না করে ফিরিয়ে দেয়।

সৈন্যদলের প্রবীণতম যোদ্ধা সাহস করে ভীরসিংয়ের কাছে এগিয়ে এসে জানতে চান, তারপর?

চোয়াল শক্ত করে ভীরসিং কিছুক্ষণ প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু কোনো জবাব দেন না। জবাবের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সবাই যখন ক্লান্ত তখন প্রবীণতম যোদ্ধার মুখের দিকে না তাকিয়ে ভীরসিং জানায়, আপনারা কুণ্ডাকপুর ফিরে যান।

বিস্মিত যোদ্ধা জানতে চায়, আপনি?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভীরসিং বলে, আমি মৃগয়ায় যাব।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here