কুমার অরবিন্দ
এক
ভালোবাসা রঙ হারাতে হারাতে যখন বিবর্ণ হয়ে যায় তখন সবচেয়ে কাছের মানুষটাকেও দূরবর্তী দ্বীপ বলে মনে হয়। সেই মানুষটার চারপাশে থাকে অথৈ পানির যন্ত্রণাময় কল্লোল। সেই কল্লোল পাড়ি দিয়ে দ্বীপ-মানুষে পৌঁছাতে হলে কোনো আনন্দময় মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। কন্যা সন্তান জন্মের পর রাফিয়া ভেবেছিল মশিউরের কাছে পোঁছানোর সেই মাধ্যমটা হয়তো সে পেয়েছে। কিন্তু সে ভুল ভেবেছিল।
রাফিয়া এখন আর কিছু বলে না মশিউরকে। হয়তো স্বামীর কাছে এখন সে কিছুই প্রত্যাশা করে না। এই জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এক সময় অভ্যাসই মানুষকে পরিচালিত করে। সে এই অভ্যাসের রেললাইনে নিজের জীবনকে চাপিয়ে দিয়েছে। জীবন চলছে গন্তব্যহীন, উদ্দেশ্যহীন।
একই ডিপার্টমেন্টে পড়লেও তারা সিনিয়র জুনিয়র ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসূত্রে ডিপার্টমেন্টের সব বড় ভাই মনে করে ছোট বোনদের সঙ্গে তাদের প্রেম করার অধিকার আছে। নবীনবরণ অনুষ্ঠানের সময়ই বড় ভাইয়েরা ঠিক করে ফেলে কে কাকে পছন্দ করল বা কে কাকে বুকড করে রাখল। এটা কেউ কেউ করে নিছক মজার ছলে।
হাবিব পছন্দ করেছিল সিন্থিয়াকে। নবীনবরণের দিন সন্ধ্যায়ই হাবিব দেখল সিন্থিয়া অন্য এক ছেলের হাত ধরে ঘুরছে! পরে খোঁজ নিয়ে জানল ছেলেটার সাথে সিন্থিয়ার বছর খানেকের প্রেম। সে মনে মনে একটু দুঃখ পেলেও বুকের পাঁজরভাঙ্গা কষ্ট পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করেও হাবিব সিন্থিয়াকে তার প্রথম দিনের ভালোলাগার কথা বলতে পারেনি। এই সব নবীনবরণ প্রেমের অধিকাংশই দুই তিন মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এক পাক্ষিক প্রেমের মোহ ভাঙতে বেশি সময় লাগে না। মশিউরের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম হলো। যাদের নবীনবরণ ভাগ্য মশিউরের মতো নয় তারা পরের বছর আরেকটা নবীনবরণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
পরিচয়ের শুরু থেকেই রাফিয়ার খুব কেয়ার নিত মশিউর। ছাত্র সংঠন করা এক বড় ভাইকে বলে ভর্তির পরপরই তাকে হলে রুম পেতে সাহায্য করে। প্রথমে কিছুটা নিমরাজি থাকলেও মশিউরের সাংগঠনিক দক্ষতা, মানুষের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা, বড় হওয়ার আকাক্সক্ষা তাকে আকৃষ্ট করত। নিজের সব দায়িত্ব মশিউরের ওপর ছেড়ে দিয়ে রাফিয়া নিশ্চিন্ত হতো। তার কখন কি লাগবে, কোথায় যেতে হবে সব দিকেই খেয়াল রাখত সে। ক্লাস শেষ হলে টিএসসির মাঠে দুজন বসত। বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দানাগুলো চটকে তাতে ভালোবাসার ফুঁ দিত।
মশিউরের অধিকাংশ সময় যেত টিউশনি করিয়ে। রাফিয়া মালিবাগ থেকে এসে ক্লাস করত। যেদিন ক্লাস থাকত না সেদিনও সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরত। ভালোবাসা প্রতীক্ষা করছে জেনে ভালো লাগত তার। ক্যাম্পাসে পা দিয়ে দুজন মিলে বাতাসের গায়ে গায়ে স্বপ্নের কথা লিখে রাখত। আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে হৃদয়ের ¯পর্শ নিত।
অল্প বয়সে বাবা মারা যায় মশিউরের। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। ভাইগুলো বিয়ে করার পর তারা বাবার সংসারটা আলাদা করে ফেলে। পড়াশুনার জন্য নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হয় মশিউরের। ঢাকা শহরে এসে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে তাকে টিউশনি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করতে হয়। এক বন্ধুর সঙ্গে গুলিস্তানে কিছুদিন জুতার ব্যবসাও করেছে। তারপর ধীরে ধীরে ঢাকা শহরের সাথে ধাতস্ত হয়েছে। মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে মানুষকে পড়তে শিখেছে নিজের মতো করে।
মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরি পাবার আশায় বসে থাকেনি মশিউর। বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেয়। বেতন অল্প হলেও চাকরি করছে এটা তাকে আপ্লুত করে।
বাবা মারা যাবার পর চারদিক থেকে অসহযোগিতা পেয়ে আসা মশিউরের অদম্য লক্ষ্য ছিল বড় হওয়া, মানুষকে দেখিয়ে দেবার মতো কিছু করা। বুকের গোপন কুটিরে সেগুলো জমা রেখে স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় আনতে নিরন্তর চেষ্টা করে গেছে। লক্ষ্যকে ছুঁতে মশিউর যখন হাত বাড়িয়েছে সে হাত তাকে খালি ফেরাতে হয়নি।
মশিউরের পাশে কেউ না থাকা সময়ে রাফিয়া ছিল। যখন হতাশায় ভেঙে পড়েছে, জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে আকাশ-পাতাল চিন্তা করেছে তখন রাফিয়া নির্ভরতার প্রতীক হয়ে সঙ্গে থেকেছে। হতাশায় ভেঙ্গে পরা গাছটাকে খুঁটি হয়ে দাঁড় করিয়েছে।
রাফিয়ার বাবা সৌখিন মানুষ। সুযোগ পেলেই তিনি মেয়েকে গহনা বানিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র মেয়েকে বিয়ের সময় তো খালি হাত-পায়ে পাঠাতে পারবেন না!
মা-বাবাকে না জানিয়ে মশিউরকে রাফিয়া চার ভরির মতো সোনার গহনা দিয়েছে। তার কিছু জমানো টাকা ছিল সেগুলোও মশিউরের হাতে তুলে দিয়েছে তাকে দাঁড়ানোর জন্য।
রাফিয়ার পরিবার প্রথমে রাজি না হলেও মেয়ের পছন্দকে তাঁরা শেষমেশ গুরুত্ব না দিয়ে পারেনি। রাফিয়াই তার পরিবারকে মশিউরের ব্যাপারে রাজি করিয়েছে। রাফিয়ার বাবা অবশ্য মেয়েকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মশিউরের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটা অতিমাত্রায় উচ্চাকাক্সক্ষী। এই ধরণের মানুষ অল্পেতে তুষ্ট থাকতে পারে না, অতিরিক্ত আকাক্সক্ষা তাদের তুষ্ট থাকতে দেয় না। রাফিয়া বাবাকে বলেছিল, ছোটবেলা থেকেই নানা দুঃসময়ের পার ভেঙে তাকে চলতে হয়েছে। তাই হয়তো ওর চরিত্রের মধ্যে…।
বাবার দিকে তাকিয়ে রাফিয়া কথা শেষ করতে পারেনি। তিনি বলেছেন, ঠিক আছে, তোর যখন এত পছন্দ তাহলে আমাদের আর কি…।
দূর থেকে একজন মানুষকে যতটা কাছের মনে হয়, কাছে এলে সেই মানুষটাকেই কখনো কখনো দূরের বলে মনে হয়। কাছে থাকলে আগে না দেখা রূপটা না চাইলেও দেখা হয়ে যায়। সেটা ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন।
বিয়ের পর থেকেই রাফিয়া বুঝতে পারে মশিউরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সকালে অফিসে গেলে ফেরার কোনো ঠিক থাকে না। সারাদিন মোবাইলেও তেমন পাওয়া যায় না। কখনো পাওয়া গেলে ব্যস্ততার জন্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কথা শেষ করে দেয়। বাসায় এলেও সারাক্ষণ অফিস অফিস করতে থাকে। কোনো কোনো দিন অফিসটাকেই বাসায় নিয়ে আসে। মশিউরের দিনরাত অবিরাম ছুটতে দেখে রাফিয়া একদিন বলেছিল, এমন করে কি জীবন চলবে, বলো?
কেমন করে? নির্লিপ্ত থেকে মশিউর জবাব দিয়েছিল।
-এই যে তুমি দিনরাত ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছ, তোমার চারপাশের কারোর দিকেই তোমার খেয়াল নেই।
-আমি সবই খেয়াল রাখছি। তোমার পেটে আমার সাত মাসের বেবি আছে। তার জন্য, তোমার জন্যই তো আমাকে দৌড়াতে হচ্ছে।
-তুমি কাছে থাকলে আমি যতটা স্বস্তি পাই, সাহস পাই তা আর অন্য কিছুতেই পাই না। আগের তুমি আর এখনকার তুমির মধ্যে কত পরিবর্তন হয়েছে তুমি বুঝতে পার?
-পারি। আগে না খেয়ে থাকতাম এখন যা ইচ্ছা তাই খেতে পারি। সামনে আরও পরিবর্তন হবে। এখন অন্যের বাসায় ভাড়া আছি পরে নিজের বাসা হবে, এখন অফিসের গাড়িতে চলি পরে নিজের গাড়িতে চলব। পরিবর্তনটাই নিয়ম। এগুলো কি আমি শুধু আমার সুখের জন্য করছি?
রাফিয়া আর কিছু বলে না। মশিউরের নাস্তা করা দেখে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, এই যাহ্, সাড়ে আটটা বাজে! এখই বের হতে হবে।
নাস্তার অর্ধেকটা প্লেটে রেখেই উঠে পড়ে। আগে একটা স্যান্ডউইচ খেতে গেলে বুক কাঁপত মশিউরের আর এখন কত অবহেলায় নির্দ্বিধায় খাবার নষ্ট করতে পারে।
মশিউর অল্প সময়ের মধ্যেই চাকরিতে বেশ উন্নতি করেছে। চাকরির পাশাপাশি নিজের মতো করে একটা ব্যবসাও করছে। চাকরির শুরুতেই রাফিয়ার সহযোগিতায় ব্যবসাটা শুরু করে। কোথায় কিভাবে কাজ করতে হয় শিখে গেছে সে। বন্ধুর সঙ্গে শেয়ারে এক্সপোর্টের ব্যবসাটা ভালোই চলছে।
অত্যন্ত পরিশ্রম করতে পারা তীক্ষè বুদ্ধির মশিউর ব্যবসায় তরতরিয়ে উন্নতি করে। মেয়ে জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। বন্ধুকে পাশ কাটিয়ে নিজের মতো করেই একটা ফার্ম খুলেছে। ছোট ফার্মের মালিক হিসাবে বড় চেয়ারটাতে এখন সেই বসে।
উচ্চাভিলাষী মশিউর রহমান চিরদিনই চেয়েছে আরো বেশি উন্নতি করতে, আরো বেশি টাকা উপার্জন করতে। টাকা উপার্জনের নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। চাকরি ছেড়ে দেবার পর ব্যবসাই মশিউরের ধ্যানজ্ঞান হয়েছে। ব্যবসাটাকে দাঁড় করানোর জন্য নিজে থেকেছে দৌড়ের ওপর।
মেয়ে মারিয়াকে নিয়ে বাসায় বন্দি হয়েছে রাফিয়া। মেয়ে জন্মের আগে বাসায় একা একা লাগত রাফিয়ার। মেয়ে এসে সেই একাকিত্বটাকে তাকে আর বুঝতে দেয় না। তবে বুকের ভেতর চাপা বেদনা তাকে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। সে এমন জীবন তো চায়নি।
দুই
মারিয়ার বয়স এখন পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরেও বাবার সঙ্গে তার তেমন পরিচয় হয়নি। কথা হয়েছে সামান্যই। বাবা তাকে কোনোদিন আদর করেনি, তাকে নিয়ে ঘুরতে যায়নি। বাবার কাছেও তার কোনো আবদার, আহ্লাদ নেই।
মশিউর অফিসে যাবার সময় মেয়েকে ঘুমাতে দেখে, এসেও দেখে মেয়েটা কাদা হয়ে ঘুমোচ্ছে। ছুটির দিনগুলোতেও তার ব্যস্ততার শেষ থাকে না। সে ভাবে মেয়েকে দেখার জন্য ওর মা আছে। রাফিয়ার তো আর কোনো কাজ নেই। কিন্তু সে জানে না মেয়েটার সঙ্গে তার যে আত্মিক স¤পর্ক তৈরি হওয়ার কথা ছিল সেটা এখনো হয়নি।
ফারিয়া লক্ষ্য করেছে মশিউরকে দেখলে মেয়েটা কেমন চুপসে যায়। কিছুটা ভয়ও পায় বোধ হয়। মশিউর বাসায় থাকলে মেয়েটা সবসময় তার আঁচল ধরেই ঘুরঘুর করে। অন্য সময়ের মতো স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিও করে না।
রাফিয়া আজ সকালে মেয়ের স্কুলের বইখাতা গুছিয়ে দিচ্ছিল। মারিয়া তাকে জিজ্ঞেস করে, আম্মু, ওই লোকটা তোমাকে শুধু বকে কেন?
রাফিয়া মেয়ের এমন কথায় অবাক হয় না। সে যা দেখেছে তাই বলেছে। তবু সে কিছুটা অনুযোগের স্বরে বলে, উনি তোমার আব্বু হন মা।
-আব্বু তোমাকে বকে কেন?
-তুমি তাড়াতাড়ি স্কুল ড্রেস পরে নাও। আমরা এখনই বের হব মা।
-আম্মু, আমার এখানে আর থাকতে ভালো লাগে না। চলো আমরা চলে যাই…।
রাফিয়া কিছু না বলে মেয়েকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে দেয়। তারও তো এখানে থাকতে ভালো লাগে না। অনেকেই তাকে বলেছিল সন্তান জন্মের পর স্বামীর খারাপ স্বভাব থাকলেও তা দূর হয়ে যায়। এমন একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্মের পর ফারিয়াও ভেবেছিল মেয়ের টানে হলেও মশিউর স¤পর্কে যা শুনে আসছে তা আর শুনতে হবে না। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে মশিউর তত ব্যস্ততার জালে নিজেকে জড়িয়েছে। কাজের বাইরেও যে আরেকটা জীবন আছে, স্ত্রী-কন্যা আছে সে সেটা ভুলে যায় অথবা ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
কয়েক বছর ধরেই রাফিয়া শুনছে নতুন নতুন সম্পর্কে জড়ানো মশিউরের ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরী মেয়েরা তার ফার্মে ইন্টারভিউ দিতে এলে সবারই চাকরি হয়। সুযোগ পেলে তাদের নিয়ে সে লংড্রাইভে যায়, শপিং-এ যায়। বিদিশা নামের এক মেয়েকে নিয়ে গত সপ্তাহে সে চীনে গিয়েছিল। চারদিন থেকে এসেছে। রাফিয়াকে অবশ্য বলেছিল ব্যবসার একটা ডিল করার জন্য চীনে যেতে হচ্ছে। রাফিয়া খোঁজ নিয়ে দেখেছে ডিলফিল কিছু না বিদিশাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল।
এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। কখনো কখনো সেটা হাতাহাতির পর্যায়ে যায়। মারিয়া বুঝতে পারে লোকটার সঙ্গে ঝগড়া শেষে আম্মুর মন খুব খারাপ থাকে। তখন তার কিচ্ছুই ভালো লাগে না। তাই তার আর ইচ্ছে করে না এখানে থাকতে। সেদিন আব্বু তো আম্মুকে বলেই দিল, তোমার এখানে থাকতে মন না চাইলে যেখানে ইচ্ছা যেতে পার।
স্কুল থেকে বাসায় ফেরার জন্য মারিয়াকে নিয়ে রিক্সায় ওঠে রাফিয়া। যদিও তাদের জন্য এখন একটা প্রাইভেট কার আছে। মেয়েটা কারে চড়তে পারে না। বমি পায়। রিক্সা কিছুদূর এগোলে রিক্সাকে পেছন থেকে একটা মাইক্রো ধাক্কা দেয়। মা মেয়ে দুজনই ছিটকে পরে রাস্তায়।
রিক্সায় উঠে মেয়েকে সবসময় ধরেই রাখে রাফিয়া। আজও ধরে রেখেছিল। তবুও মেয়েটা ছিটকে যায়। মাথায় ও কপালে বেশ আঘাত পেয়েছে। মাথা কেটে রক্ত বের হচ্ছে। রাফিয়ার বাম হাতের কনুই ছিলে গেছে কিছুটা।
রক্তাক্ত মেয়েকে দেখে সে অস্থির হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ মেয়েটা সংজ্ঞাহীন ছিল। আরেকটা রিক্সা নিয়ে কাছের আরোগ্য নিকেতন হাসপাতালে যায়।
রাফিয়া ফোন দেয় মশিউরকে। সে কিছুক্ষণ আগেই একটা বোর্ড মিটিং শেষ করেছে। এখন বিদেশি বায়ারদের নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসেছে। সে জানে বউ এখন বলবে, দুপুরের খাবার খেয়েছে কিনা বা কি দিয়ে ভাত খেলে। এই সব প্যানপ্যানানি ভালো লাগে না মশিউরের। তার বউ এখনো স্মার্ট হতে পারল না!
বারবার ফোন করায় বিরক্ত হয় মশিউর। একবার কল রিসিভ করেই ধমকের সুরে বলে, এখন ব্যস্ত আছি। এত কল করার কি আছে?
রাফিয়া কিছু বলার আগেই রেখে দেয় মশিউর। মেয়ের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রক্ত পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। ওষুধ কেনার জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে, ডাক্তার-নার্সের কাছে দৌড়াতে হচ্ছে। সে বাসা থেকে বের হবার সময় টাকা নিয়েও বের হয়নি। মশিউরও ফোন ধরছে না। উপান্তর না দেখে রাফিয়া বাবাকে ফোন দেয়।
মারিয়ার মাথায় পাঁচটা সেলাই দিতে হয়েছে। রাফিয়ার তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু সে মেয়ের অবস্থা দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়ে। মশিউর এখনো তাকে ফোন করেনি! এতদিন যে সিদ্ধান্ত সে নিতে পারেনি এখন সে সেই সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলে।
রাতে বাসায় এসে মশিউর দেখে মা-মেয়ে কেউ নেই। সারাদিন আজ তার অনেক ধকল গেছে। বিদেশি বায়ারদের বোঝাতে তার অনেক কথা খরচ করতে হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে রাফিয়া মাঝেমধ্যেই বাইরে খেতে যায়। মশিউর ভাবে আজও বোধ হয় মেয়েকে নিয়ে খেতে বের হয়েছে।
একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না মশিউর। ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। সারাদিনের পরিশ্রান্ত দুটি চোখ অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।
সারারাত মেয়ের পাশে জেগে কাটায় রাফিয়া। তার বাবা বাসায় চলে যাবার পর মা আসেন রাতে। তিনিও রাতে থাকেন নাতনির পাশে। রাফিয়া অবাক হয়। একজন মানুষ কেমন করে এমন নিষ্ঠুর হতে পারে! সারারাত মেয়ে আর বউ বাসায় ফেরেনি তবুও লোকটার কোনো হুঁশ নেই। একবারের জন্যও খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করল না! তাহলে কি তারা বাসায় না গেলেই মশিউরের ভালো লাগে? কান্না পায় রাফিয়ার। ভুল মানুষকে সে ভালোবেসেছিল। মেয়েকে নিয়ে সে আর ওই বাসায় ফিরে যাবে না।
সকালে নাস্তা না করেই বের হয় মশিউর। রাফিয়ার বাবার বাসা খুব বেশি দূরে না। মেয়েকে নিয়ে রাফিয়া হয়তো তার বাবার বাসায় বেড়াতে গেছে। এটা ভেবেই সে অফিসের উদ্দেশে বের হয়।
বাবার বাসায় যাবার জন্য মেয়েকে নিয়ে সিএনজিতে ওঠে রাফিয়া। বাবা তার পাশে বসা। কেমন যেন কষ্ট লাগে তার। আগে বাবার বাসায় যাবার সময় যেমন ভালো লাগত এখন তেমন লাগছে না। মেয়েকে ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। তার দুচোখ বেয়ে পানি গড়ায়। মেয়েটার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বাবার মুখের দিকেও তাকায়। সফেদ দাড়িতে মুখভর্তি বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ থাকলেও চোখে-মুখে নির্ভয়তার আশ্বাস। মেয়েটাকে আরও কাছে টেনে মাথায় চুমু দিতে দিতে ভাবে, বিপদের দিনে তার তো পাশে বাবা আছে, শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বাবার বাড়ি আছে। আমার মেয়েটার কখনো এমন হলে তার বাবা, বাবার বাড়ি বলে কিছু থাকবে না!
লেখক: ছোটগল্পকার