নবীরুল ইসলাম বুলবুল
বিশ্বাসের ঘরে জ্বলছে আগুন, লেলিহান।
অবিশ্বাস হুতাশন
জ্বলছে দাউ দাউ, শরীরে, মননে,
মগজের প্রত্যেক তন্ত্রীতে, নিরন্তর।
হস্তিনী বিশ্বাস করেছিলো,
সেই সব শিক্ষিত মানুষদের,
যারা গাদা গাদা পুস্তক পড়ে
স্বীকৃতি আদায় করেছিলো সভ্যতার।
তারা ইতিহাস পড়েছিলো
পড়েছিলো ভূগোল,
প্রাণিবিজ্ঞানের পাশাপাশি পড়েছিলো বনবিদ্যা
হস্তির জীবনচক্র,
কতদীর্ঘ সাধনায় একটি হস্তিনী মা হয়,
তারা জানতো সে কথাও।
তারা সুসভ্য মানুষ ছিলো।
তাদের মগজে তোলা ছিলো বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক
কিংবা কুরআন, নয়তো গ্রন্থ-সাহেব;
ভগবান, ঈশ্বর, গড, কিংবা আল্লাহর নাম
নিতে নিতে, বলতো, অহংকারে,
আমি-ই সৃষ্টির সেরা,
আমি-ই মানুষ!
হায়! সেই মানুষকেই হস্তিনী বিশ্বাস করেছিলো,
তার উদরে তিলতিল বেড়ে ওঠা শিশুকে
বলেছিলো, চল যাই, ওখানে মানুষ আছে,
ওরা আমাদের খাদ্য দেবে,
ওরা মানুষ, ওরা সৃষ্টির সেরা জীব,
আমাদের কোন কষ্ট হবে না,
শিশুটির আফসোস, আমরা কেন মানুষ হইনি, মা!
হস্তিনীর অভয়, সে আমাদের পোড়া-কপাল,
কিন্তু আমরা তো মানুষের কাছেই যাচ্ছি!
চল যাই।
সে বিশ্বাস করেছিলো মানুষকে,
যে মানুষ জানে
তার স্ত্রী সন্তান-সম্ভবা হলে,
খুববেশি খেতে চায়,
অনাগত সন্তানের পুষ্টি যোগাতে
মা-কে খেতে হয় অনবরত, মাছ-মাংস-সব্জি,
খেতে হয় নানা-রঙ ফল,
এমনকি, টক তেঁতুল, মায় কাঠকয়লা ও পোড়ামাটি।
সন্তানের পুষ্টির ক্ষিধে এমন-ই মারমুখী!
মানুষের দেয়া খাবারেই মৃত্যু-লেখা,
হস্তিনী বিশ্বাস করেনি,
মানুষের বদান্যে উৎফুল্ল তার শিশুর মুখে
চালান করেছিলো খাদ্য,
তার পরিপাকতন্ত্রের সুড়ঙ্গ পথে;
দেখ, দেখ, মানুষ কতো মহান, কত সভ্য,
অনাগত শিশুর প্রতি কতো আন্তরিক বোধ;
তার কথা শেষ না হতেই,
শিশুটি চিৎকার করে ওঠে, মা, মরে যাচ্ছি,
আমার ছোট্ট শুঁড় ছিড়ে আলাদা হয়ে
তোমার পেটের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, মা,
আমার নরম পা-গুলো রক্তাক্ত,
আমি চোখে অন্ধকার দেখছি,
আমি মরে যাচ্ছি, মা, মরে যাচ্ছি;
তুমি যদি বেঁচে থাকো, তুমি মানুষকে,
বিশ্বাস কোরো না, মা,
মানুষ মুখোশধারী হন্তারক।
হস্তিনীর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে
গলগলিয়ে,
তার পরিপাকতন্ত্র ছিন্নভিন্ন,
তার জরায়ুতে মৃত শিশুর বারুদ-ছিন্ন-শরীর
মানুষের প্রতি বিশ্বাসের মৃতদেহ!
যে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে,
বাস্তবিক যে বোকা
সে কোথায় যাবে!
মানুষ বড় অবিশ্বস্ত প্রাণি, ইতরতায় কূলশ্রেষ্ঠ,
হস্তিনী লোকালয় ছেড়ে
জলের কাছে আশ্রয় নিয়ে
মৃত্যর অপার যন্ত্রণায় অনন্ত বহতা জলে
বলে গেলো অনাগত কালের কাছেই,
‘মানুষ বড় অবিশ্বস্ত প্রাণি,
মানুষে বিশ্বাস রাখা পাপ’।