মাওলানা ইব্রাহিম খলিল মাহমুদী গাজীপুর
খিদমাতে খালক তথা সৃষ্টির সেবা :- খিদমাত অর্থ সেবা এবং খালক অর্থ সৃষ্টি, খিদমতে খালক অর্থ সৃষ্টির সেবা। কোরআন ও হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহর রহমত বরকত ও সওয়াব অর্জনের সবচেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ হলো আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি বিশেষত মানুষের প্রতি সহযোগিতা বা কল্যাণ উপকারে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এ বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অনেকেই অসচেতন, আমরা জিকির তাহাজ্জুদ অন্যসব ইবাদতের সওয়াব সম্পর্কে যতটুকু সচেতন ,সৃষ্টির সেবার ফজিলত গুরুত্ব ও সওয়াব সম্পর্কে আমরা ততটুকু সচেতন নই। অথচ কোরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে অগণিত নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহকে ভালবাসতে হলে অবশ্যই তার সৃষ্টিকে ভালবাসতে হবে এবং তাদের সেবা ও সাহায্য এগিয়ে আসতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সকল জাগতিক প্রয়োজনে সাহায্য করা, সমাজের কিছু মানুষের মধ্যে পরস্পরে গোলমাল বা অশান্তি হলে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, অসুস্থ কে দেখতে যাওয়া, সেবা করা, বিপদে পড়লে উদ্ধার করা, মজলুম হলে সাহায্য করা, মৃত্যুবরণ করলে কাফন দাফনের শরিক হওয়া ইত্যাদি সকল প্রকার মানব সেবা মূলক কাজের জন্য অকল্পনীয় সাওয়াব ও মর্যাদার কথা অগণিত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন দু’জন মানুষের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা দান বলে গণ্য, কোন মানুষকে তার বাহন নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করতে সাহায্য করা দান বলে গণ্য, কারো বাহনে তার জিনিসপত্র তুলে দেওয়া দান বলে গণ্য, সুন্দর আনন্দদায়ক কথা দান বলে গণ্য, মসজিদে গমনের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ দান বলে গণ্য এবং রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক দ্রব্য সরিয়ে দেওয়া দান বলে গণ্য। ( বুখারী২/৯৬৪,৩/১০৯০ ) আল্লাহ তাআলা বান্দার উপকার করাটা এত পছন্দ করেন যে, বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত তাহার কল্যাণে রত থাকবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “যখন একজন মানুষ অন্য কোনো মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে ততক্ষণ আল্লাহ তার কল্যাণে রত থাকবেন “।(মুসলিম ৪/২০৭৪ ) পরোপকারী ব্যক্তি সকল প্রকার বিপদ আপদ ও অপমৃত্যু থেকে রক্ষা পায় আর দান সদকা আল্লাহতালার ক্রোধ নির্বাপিত করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “মানব কল্যাণমুখী বিপদ আপদ ও অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে গোপন দান আল্লাহ তাআলার ক্রোধ নির্বাপিত করে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা আয়ু বৃদ্ধি করে।(সহীহুত তারগীব ১/২১৬) সমাজের এতিম, অনাথ, বিধবা, হতদরিদ্র, দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সেবার ও স্বার্থ রক্ষা করার জন্য রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতিমের লালনপালনকারী কে তার পাশাপাশি জান্নাতে থাকার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “যে ব্যক্তি এতিম অনাথের রক্ষণাবেক্ষণ লালন পালন করে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে একথা বলে তিনি ও তর্জনীকে পাশাপাশি রেখে দেখান”। (বুখারী ৫/২০৩২,২২৩৭) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন বিধবা ও দরিদ্রদের স্বার্থ সংরক্ষণ বা কল্যাণের জন্য চেষ্টারত মানুষ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে রত, ক্লান্তিহীন বিরামহীন তাহাজ্জুত আদায়কারী এবং অবিরত সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির ন্যায়। (বুখারী ৫/২০৪৭,২২৩৭: মুসলিম ৪/২২৮৬) সৃষ্টির সেবা অন্যতম দিক হচ্ছে অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়া ,বস্তুত সৃষ্টির সেবাতেই আল্লাহর সেবা করা হয়। অসুস্থ ব্যক্তি কে দেখতে যাওয়া তার সেবা করা ক্ষুধার্তের আহারের ব্যবস্থা করা তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির পানির ব্যবস্থা করা এসব কিছুই আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন “কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ বলবেন আদম সন্তান আমি অসুস্থ হয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি! সে বলবে হে রব আপনি তো রাব্বুল আলামিন আমি কিভাবে আপনাকে দেখতে যাব? তিনি বলবেন তুমি তো জেনেছিলে যে আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল তবুও তুমি তাকে দেখতে যাওনি তুমি কি জানতে না যে তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে তবে আমাকে তার কাছে পেতে। হে আদম সন্তান আমি তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাদ্য দাও নি। সে বলবে আপনি তো রাব্বুল আলামিন আমি কিভাবে আপনাকে খাদ্য দিব? তিনি বলবেন তুমি তো জেনেছিলে যে আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে খাদ্য দাওনি তুমি কি জানতে না ,যে তুমি যদি তাকে খাদ্য দিতে তবে আমার নিকট তা পেতে। হে আদম সন্তান আমি তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে পানি দাওনি, সে বলবে হে রব আপনি তো রাব্বুল আলামিন আমি কিভাবে আপনাকে পানি পান করতে দেব? তিনি বলবেন তুমি তো জেনেছিলে যে,আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি।তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে পানি পান করতে দিতে তাহলে তার কাছে আমাকে পেতে। (মুসলিম ৪/১৯৯০)কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহর বান্দার সেবা করার চেয়ে আল্লাহর কাছে প্রিয়তর কর্ম আর কিছুই নেই। নিজের দায়িত্ব ইনসাফের সাথে পালন করাও ইবাদত। চাকুরি কিংবা যে কোন কর্মক্ষেত্রে আগত মানুষটিকে আপনি হাসি মুখে কাছে ডেকে আন্তরিকতার সাথে তার সকল সমস্যা শোনেন এবং তার প্রতি আপনার দায়িত্বটুকু পরিপূর্ণরূপে পালন করেন তাহলে এর জন্য আপনি নফল যিকির, তাহাজ্জুদ ও অনুরূপ ইবাদতের চেয়ে বেশি সাওয়াব ও বরকত লাভ করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন “কিয়ামতের দিন যে সকল বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে আরশের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন তাদের অন্যতম হলো ন্যায়পরায়ন বা ইনসাফের সাথে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তা,প্রশাসক বা শাসক। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সহিহ জ্ঞান দান করুন এবং মানুষের সহ সকল সৃষ্টির সেবা করার তৌফিক দান করুন আমিন।