-শামসুল আরেফিন খান
বুদ্ধিমান ইশারায় বুঝে। রাজনীতির সতরঞ্চে বসে যারা রাজা উজির মারেন ও কিস্তিমাৎ করেন তারা সবাই চিকন বুদ্ধির মানুষ। আমার স্বল্পকালীন জেলজীবনে প্রায় সব বুদ্ধিমান লোককেই তাস পিটিয়ে সময় কাটাতে দেখেছি। ট্রামকার্ড কখন কীভাবে মারলে অন্য সবাই কুপোকাত হবে সেটা জানতে ও বুঝতেই সবার নিরন্তর সাধনা।ব্যারিস্টার ইশতিয়াকের কথা মনে পড়ে। ৮৭ নভেম্বরের বন্দী জীবনে তিনি সবাইকে ট্রাম কার্ড দিয়ে কুপোকাত করে রাখতেন। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন
মুজিব বিরোধী তৎকালীন মোগলটুলি মুসলিম ছাত্র লীগের সভাপতি তুখোড় আইনজীবী টেনু শামসুল হক।
মহাকালের ইতিহাসের সূচিপত্রে আর একজন ধীমান মহানায়কের আর্ভিাব ঘটলো ৬ দফার রকেটে চেপে। স্থান-কাল-পাত্র: লাহোর, 0৫ ফেব্রুয়ারি,১৯৬৬ । চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবন। সম্মিলিত বিরোধীদলের সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ছয় দফা দাবিনামা উত্থাপন করলেন সোহরাওয়ার্দী উত্তর পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।ছয়দফার প্রচ্ছদমোড়কে বাংলার উদীয়মান বাঘ যে বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের পান্ডুলিপি উপস্থাপন করেছেন সে কথা বুঝতেও অতিচতুর শাসকগোষ্ঠীর মোটেও বিলম্ব হয়নি। তারা বুঝলেন মুজিব কী বলেছেন। আর কী বলেননি। তরা একথাও বুঝলেন যে, শেখ মুজিব যা বলেছেন তার চাইতে যা বলেননি তার ওজন অনেক বেশি ভারি।
“ বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান
এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর জনজীবনের একেবারে শুরু থেকে এই বিমূর্ত প্রবচনটি বার বার উচ্চারন করেছেন্। বিরোধীদলীয় সম্মেলনের সভাপতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরি মোহাম্মদ আলী নাকচ করলেন ৬ দফা। সম্মেলনের এজেন্ডাভুক্ত হ’লনা বাঙালির মুক্তি সনদ। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল যখন বাকি সকলের লক্ষ্য তখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা দাবিনামা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হ’ল না।, ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় সম্মেলনে শেরে বাংলা ফজলুল হক যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তার সাথে ৬দফায় দাবিকৃত পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসন দাবির সমন্বয় ঘটাতে তারা বেগ পেলেননা। পৃথক বানিজ্য, পৃথক মূদ্রা স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী প্রভৃতির অর্থ যে বাধন ছিড়ে খোয়াড় ভেঙে কামধেনুর প্রস্থান সেটা বুঝতেও তাদের বিলম্ব হ’ল না। তারা বুঝতে পারলেন যে পূর্ব পাকিস্তান যদি সর্বাত্মক স্বায়ত্ব শাসন পায় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য চারটে নড়বড়ে খুটিও ভেঙে পড়বে। তাদের শোষনের লীলাভুমি প্রচন্ড ভুমিকম্পে অস্তিত্ব হারাবে।
১৪ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিলেন। “সের কুচাল দেঙ্গে “ বলে আহত বাঘের মত হুঙ্কার ছাড়লেন। তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ১৮ মার্চ কনভেনশনে মুসলিম লীগের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান গৃহযুদ্ধের হুমকি দেন।তার মোটা মাথায় গৃহযুদ্ধ মানে কী? কাদের সাথে কাদের যুদ্ধ?পৃথিবীর ইতিহাসে সব চেয়ে বড় গৃহযুদ্ধ ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তার এক পক্ষ্যে ছিল ক্রীতদাশ প্রভুরা অন্যদিকে নব্য পুজিবাদ।কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তখন পুজিবাদ বিকশিত হতে পারেনি।কাজেই গৃহযুদ্ধ মানে ছিল ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের মত হিন্দু দলনের হুমকি।কিন্তু শেখ মুজিবের রূপকল্পে ছিল প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার এক অসাধারণ ব্যাপ্তি। তিনি ১৯৪৬ এর ভোটাভুটিতে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের স্বপ্ন ও ভূমিকার কথা মাথায় রেখেই অগ্নিপথে পা রেখেছিলেন।ভাষা প্রশ্নে প্রতারণার শিকার হয়ে পূর্ব বাংলার মুসলমানের নতুন বোধোদয় ঘটেছিল মহান ভাষা আন্দোলনে । উদীয়মান মহানায়কের নেতৃত্বে বাঙালি গর্জে উঠেছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১ মার্চ ‘৪৮ । ২১ ফেব্রুয়ারি ‘৫২ বুকের রক্ত ঢেলে প্রাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল ৫৬ শতাংশ বাঙালির ভাষার অধিকার। উন্মোচিত হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার নবদিগন্ত । গড়ে উঠেছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার বাঙালি ঐক্যের এক সুদৃঢ় ভিত্তি । উন্মেষ ঘটেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের। সেই নবজাগরণে সংগ্রামী বুদ্ধিজীবীদের বিশাল ভূমিকা ছিল।সেই নবচেতনা এবং উদ্দীপন ছিল মুজিবের সকল প্রেরণার মূল উৎস।
মার্কিন কূটনীতি দ্বারা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে শহশ্রাব্দের মহানায়ক শেখ মুজিবের আবির্ভাব ঘটেছিল ৫ফেব্রুয়ারি ‘৬৬। তিনি উদিত হয়েছিলেন তিন হাজার বছরের চৈনিক রাজতন্ত্রের বুকে বল্লমহানা মহান নেতা সানইয়াতসেন, মিশরের জামাল আব্দুন নাসের ও তুরষ্কের মুস্তফা কামাল পাশার রেখে যাওয়া জাতীয়তাবাদী পোষাকে। কিন্তু সেটাই তার শেষ পরিচয় ছিল না। তাতে মূর্ত এক বিন্দুর মধ্যে সুপ্ত ছিল বিমূর্ত এক মহাসিন্ধু।
তবে ৬দফা আকড়ে তাঁর পূর্ণ ছবি আঁকার মূর্খ প্রচেষ্টায় অন্ধের হস্তি দরশনের একটি খন্ডচিত্র মাত্র উদ্ভাসিত হবে। তাঁকে অসম্পূর্ণভাবে আবিষ্কার করা যাবে ৭ মার্চ ৭১ উন্মোচিত মহাকাব্যের সূচনা বক্তব্যে। তাতে ছিল ২টি কেন্দ্রীয় বাক্য, ১. “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।২. এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম । পরবর্তী ধাপে তাঁকে আরও একটু পরিষ্কার ভাবে চেনা যাবে মৃত্যুর গারদ ভেঙে বেরিয়ে স্বদেশ ফেরা দিবস ১০ জোনুয়ারি দেয়া দিক নির্দেশনামূলক ভাষণের মধ্যে । তাতে ছিল ১০টি দিক নির্দেশনা। আর তাতেও ছিল ২টি কেন্দ্রীয় বক্তব্য, ১. “বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র যার ভিত্ ধর্মভিত্তিক হবে না । ২. বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। খেয়ে পরে সুখে থাকবে।.
” সর্বশেষ, ২৫ জানুয়ারি ৭৫ দেওয়া চূড়ান্ত বক্তব্যে মধাহ্নের অরুণ রবির মত তাঁর পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি তাঁর মহাকাব্যের পিনআপ পাতাগুলো আলোর মুখে পেতে ধরলেন। তাতেই মুজিবের সামগ্রিক পরিচয় উদ্ঘাটিত হ’ল। ১১ বছরের কারাজীবনে উদ্গত তাঁর মহান বিপ্লবী সত্বা দিবালোকে উদ্ভাসিত হ’ল। দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা ঘোষণা করতে গিয়ে জাতির জনক শেখ মুজিব বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে বললেন— “মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমি একদিন এই হাউজে বলেছি, আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড়ো বড়ো অর্থশালী লোক, যারা বিদেশ থেকে ভোট কেনার জন্য পয়সা পায় তাদের গণতন্ত্র নয়— শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের। এবং সে কারণেই আজকে আমাদের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করতে হয়েছে”। এই পষ্ট বক্তব্য দিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজের অজান্তে মহাভারতের মহারণ বিজয়ী ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মত মহাপ্রস্থানের পথে পা রাখলেন।তাঁর আস্তিন থেকে বেরিয়ে বিষধর কালসাপ ফনা তুললো।ঘরের চার কোনায় বাস্তু গোখরাগুলো ফুঁসে উঠলো।
বঙ্গব্ন্ধুর উত্থান ঘটেছিল মহাশূন্যের লক্ষে উৎক্ষিপ্ত চার স্তরের রকেটের মত। প্রথম স্তরের খোলস ৬ দফা পুড়ে খসে পড়লো। ২য় স্তরের ৭০ এর নির্বাচনে বাঙালি তাদের প্রিয় নেতা মুজিবের হাতে অব্যর্থ ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দিলো। ৩য় স্তরে মুক্তিযুদ্ধ এবং ৪র্থ স্তরে আসলো দ্বিতীয় বিপ্লব। সব ঠিক ছিল। কিন্তু কোল্ড ওয়ারের রম রমা সময়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রতিকূলতা সামাল দেয়ার মত সাংগঠনিক শক্তি প্রতুল ছিল না সে সময়।দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা ‘পঞ্চম বাহিনীর’ অন্তর্ঘাত দমনের জন্য স্পেন বিপ্লব খ্যাত শক্তিশালী ‘৬ষ্ট বাহিনী’ গড়ে ওঠেনি। সেই আদলে গড়ে ওঠেনি রাশিয়ার মত রেড আর্মী যার অভ্যুদয় ঘটেছিল ক্ষমতাচ্যূত জার নিকোলাসের ব্রিটিশ মদদপুষ্ট প্রতি বিপ্লবী হাতিয়ার হোআইট আর্মীর বিপরীতে । গড়ে ওঠেনি , চীন বিপ্লবের রক্ষা কবচ যথা পিপলস আর্মী অথবা ইরাণের ইসলামী বিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার রেভ্যুলুশনারী গার্ডের মত দুর্ভেদ্য বিপ্লবী শক্তি। বঙ্গবন্ধু আস্থা রেখেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির উপর। সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন রাজাকার বিরোধী সর্বাত্মক জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সরল লক্ষ্যে। সেই অবকাশে মহাশত্রুর দূরপাল্লার মিজাইল তাঁর মহাকাশ যানকে লক্ষ্যচ্যূত করে ভূপাতিত করলো। কিন্তু তাঁর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেনি। ইতিহাসের উত্তাল তরঙ্গের শীর্ষে বসে তিনি চলমান রয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শক্তিতে বলীয়ান সময়ের কান্ডারি যারা তারাই তাঁকে বাচিয়ে রেখেছেন। তাদের প্রজ্ঞা , বস্তু নিষ্ঠা এবং দূরদর্শিতা প্রতিকূলতা বিধ্যস্ত জাতির জনকের ভুলভ্রান্তি ও সাংগঠনিক শক্তির অপ্রতুলতা দূর করে তাঁর অসমাপ্ত কাজকে পূর্ণ করবে বলে আশা রাখি। সেজন্য সবাইকে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর বুকভরা ছিল মানুষের জন্যে ভালোবাসা। ধৈর্য, সহনশীলতা ,ক্ষমা ও মহানুভবতা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় গুন এবং গরিমা। ৫০ বছর বাঙালি তাঁর সেই ক্ষমার আদর্শকে শিরোধা্র্য করে “মরুভূমিতে সুইমিং পুল” গড়ার অলৌকিক সাধনায় নিবেদিত থেকেছে।
বঙ্গবন্ধু প্রাণ বিসর্জন দিলেন বাংলার মাটিতে আর একবার রক্তের ঢল বইবে না সেই প্রত্যয়ে। তাঁর কাঙ্খিত সেই শান্তির সময়টাকে চিরস্থায়ী করার দূরন্ত প্রয়াস রেখেছে বঙ্গবন্ধুর আরাধণার ঋদ্ধ বাঙালি । কিন্তু আজ সময় এসেছে এ কথা উপলব্ধিতে নেয়ার , ,“Modesty is not a virtue any more” এবং “Have no mercy otherwise you will need mercy.ইতিহাস শিখিয়েছে যুদ্ধের এক পক্ষ্য হিরোশিমার আগুনে নিশ্চিহ্ন না হলে মহারণের দাবানল কখনও থামেনা।
পিছন ফিরে দেখা।।
তরুন রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবের গণতান্ত্রিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছিলেন আসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের লড়াই জেতার সবচেয়ে শাণিত অস্ত্র ‘এক মানুষ এক ভোটের যুক্ত নির্বাচন”। একদা ব্রিটিশ সেটা কেড়ে নিয়েছিল।সেই হাতিয়ার দিয়েই বঙ্গবন্ধু জিতেছিলেন ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচন।নির্ভয়ে অসঙ্কোচে মেনে নিয়েছিলেন এলএফও ।
, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএফ) থেকে বের হয়ে আওয়ামী লীগকে এককভাবে পুনর্গঠিত করতে গিয়ে প্রাজ্ঞ নেতা মুজিব আওয়ামি মুসলিম লীগ ও তারও আগের সোহরাওয়ার্দীভক্ত প্রবীন নেতাদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন । বিশেষকরে পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্ত খুটি নওয়াবজাদা নসরুল্লা খান ও তাঁর সমর্থকরা যখন ৬ দফা প্রত্যাখ্যান করলেন আর সেই সাথে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান ৬ দফার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে বললেন, “মুজিব তুমি ৬ দফা ছিড়ে ফেলো, আমার বাপের অনেক কষ্টে গড়া পাকিস্তান তুমি পুড়িয়ে দিওনা” , তখন মুজিব সতর্কভাবে জটিল এক বাস্তবতার মাটিতে পা রাখলেন।সবাই জানতো পুনর্গঠিত আওয়ামি লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর যাচ্ছেন সরকার বিরোধী সর্বদলীয় সম্মেলনে উপস্থিত থেকে আইয়ুব বিরোধী আর একটি এনডিএফ গঠনের প্রয়াস রাখতে। মানিক মিয়া ও সিনিয়ার নেতাদের তেমনি খায়েশ ছিল।সে জন্যেই হয়ত লাহোর যাওয়ার আগে ছয়দফার ব্যাপারে তিনি কোন আগাম আভাস দেননি। বৈষম্য বিরোধী চিরাচরিত কিছু কথার বাইরে মুখ খোলেননি। আমি ছিলাম বিমান বন্দরে । সাংবাদিকদের সব প্রশ্ন তিনি পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন।
“ লাহোর সম্মেলন শুধু দেশবাসীকেই না , ক্ষমতাসীন সরকারকেও নূতন চিন্তার খোরাক যোগাবে ” শিরোনামে ৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রতিবেদনে দেশের রাজনীতিতে বড় রকমের কিছু একটা ঘটার প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছিল। কিন্তু ৬ দফা মুক্তিসনদ দিয়ে ঝড় তোলার ব্যাপারে কোন আভাস ইঙ্গিত ছিল না তাতে।
“আমারে কিছু না কইয়া মুজিবর মেয়া এমন একটা তুলকালাম কান্ড ঘঠাইলে”বলে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তার গ্যাস্ট্রিক রাগ আবার দপ করে নিভেও গিয়েছিল সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরি ও মিল্লাত সম্পাদত মোতাহার হোসেন সিদ্দিকীর সময়োচিত হস্তক্ষেপে।
মানিক মিয়া বেকায়দায় পড়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী তনয়া বেগম আখতার সোলায়মান আইয়ুবের দূতের ভুমিকায় নামায়। এদিকে তখন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী (সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা) জহীরুদ্দিন ও ‘ভেড়ার ছাল পরা নেকড়ে’, নবাগত ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ আজিজুর রহমান মানিক মিয়ার পাশে দাড়িয়ে আওয়ামি লীগকে প্রগতিশীল ঐক্যে গড়া ন্যাপের বিরুদ্ধে শক্ত দূ্র্গে পরিণত করার প্রয়াস রাখছিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী জেলের তালা খুলে দিয়ে সারা দেশে কারারুদ্ধ ব্রিটিশ যুগের সব কম্যুনিস্টকে বাইরের জগতে বের হতে না দিলে আওয়ামি লীগও ভাঙতো না আর ন্যাপের মত অবাস্তব একটা অবৈজ্ঞানিক বাম ঐক্য হতই না। সে যাই হোক ৬ দফার পক্ষ্যে জনজোয়ার উথলে উঠছে দেখেতারা সবাই মুষড়ে পড়লেন।শাহ্ আজীজ লেজ গুটিয়ে পালালেন। যারা বলছিলেন ৬-দফা শরিষার মধ্যে সি আই এর মামদো ভূত লুকিয়ে আছে। ওতে কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষ নেই। তারা তপস্যায় চোখ বুজলেন, সত্য কী সেটা বুঝার জন্যে।বঙ্গবন্ধুও ভেবেছিলেন,রাজবন্দীরা সবাই মুক্তি পেলে আওয়ামি লীগে বাম উপাদান বাড়বে। আওয়ামি লীগ কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে এক দুর্মর হাতিয়ারে পরিণত হবে । কিন্তু মামদো ভূত ঢুকে পড়েছিল শরিষার মধ্যে। সেটা জাতির দুর্ভাগ্য বই আর কিছু না।
শেখ মুজিব জাতীয়তাবাদী চেতনায় পূর্ববঙ্গবাসীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে পাওয়া নজীরবিহীন শোষণ বঞ্চনা ও পাহাড় প্রমান বৈষম্যের নিখুত চিত্র জনলোকে বার বার উপস্থাপন করে। তিনি তাঁর এই বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রা সফল করার লক্ষ্যে, কর্মযজ্ঞের দ্বিতীয় ধাপে এসে, অতীত ১৯৫৭ সালে অশুভ চক্রান্তে ধ্বসে পড়া প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্য পুনঃনির্মানের জোর প্রয়াস রাখছিলেন্। তারই ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছিল আওয়ামি লীগের নেতৃত্বে বাম প্রগতিশীল শক্তির ১১ দফা ভিত্তিক জাতীয় ঐক্য।
বঙ্গবন্ধুর প্রাজ্ঞ রণণীতি -রণকৌশলের কাছে পরযুদস্ত হয়েছিল ষাটের দশক থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষকবেশে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাপটিমেরে থাকা মার্কিন এজেন্ট ড. নিউম্যানের সব ভেদ নীতি ও মগজধোলাই কৌশল।রবার্ট কুরুক(Robert Kruk) ওরফে নুরুল ইসলাম নামধারী , নওমুসলিম ছাত্রবেশী এক পাশ্চাত্য এজেন্ট ৫৬ সাল থেকে তৎপর ছিল বামপন্থীদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে ক্রমবর্ধমান বামপ্রগতিশীল ঐক্য বানচাল করার লক্ষ্যে। ৬০ সালে দৈনিক পূর্বদেশ তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে ছবিসহ রিপোর্ট ছাপায় সে অন্তরালে লুকিয়ে যেয়ে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।বামদলগুলো প্রথমে মস্কোপন্থী ও পিকিং পন্থী হয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়। পরবর্তীকালে তারা বহুখন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে বলে রাখতে চাই, উচু মার্গের এজেন্ট রবার্ট ক্রূক ১৯৫৬- ৫৭ সেশনে ঢাকা কলেজে সিং ভেঙে বাছুর সেজে আমার ও মহিউদ্দীন খান আলমগীর এবং সিরাজুল আলম খানের সহপাঠী হয়েছিল। সে সময় মওলানা ভাসানীর জেষ্ঠ পুত্র আবু নাসের খান ভাসানী ও ন্যাপ নেতা প্রফেসার মোজাফ্ফর আহমদের ছোট ভাই বাবুল আমাদের সাথে পড়তো। রবার্ট ক্রূক তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেজেছিল।সন্তোষে তার অবিরাম যাতায়াত ছিল। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক বন্ধুবর শফি আহমদেরও ছিল সে হরিহর আত্মা।
স্নায়ু যুদ্ধের সেই মধ্যাহ্নে বিশ্বব্যাপী কারযকরী হওয়া এজেন্ট মারফত সেই অন্তর্ঘাত প্রক্রিয়ায় প্রগতিশীল শক্তি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়।প্রাজ্ঞনেতা শেখ মুজিবুর রহমান এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তিনি ধীর পদক্ষেপে সুপ্ত প্রচেষ্টায় ১১ দফাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তোলেন।উত্তরকালে তাঁর দেয়া ৪ দফা মূলনীতির মৌলিক সূত্র নিহিত ছিল ১১ দফার মধ্যে । তার ভিত্তিতেই ৭০ এর নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল গণম্যান্ডেট।
পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোতেও ৬দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা বলে আখ্যায়িত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ প্রতিধিদল নিয়ে আলোচ্য সর্বদলীয় সম্মেলন থেকে ওয়াক আউট করেন । ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফার ব্যাখ্যা দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তেজগাঁ বিমান বন্দরে সোভিয়েত বার্তা সংস্থা তাস এর জন্যে তাঁর একক সাক্ষাৎকার নেয়ার। মুজিব ভাই তাঁর ব্যাগ থেকে জেরোক্স কপি সহ ৬দফার পান্ডুলিপি বের করে সেটা পাঠ করলেন। সেটাই ছিল তাঁর কথিথ সাংবাদিক সম্মেলন। আমি ছাড়া সেখানে উপস্থিত ছিল সনদ না পাওয়া আর একজন অর্ধেক সাংবাদিক। বিমান বন্দরে ঘোরা ফেরা করা সরকারি বার্তা সংস্থা এপিপির একজন স্ট্রিঙ্গার। তাকেও আমি সাথে জুটিয়ে নিয়েছিলাম। আওয়ামি লীগ ছাত্রলীগৈর কেউ জানতেন না যে লাহোরে সাংবাদিক সম্মেলন করেই মুজিব ভাই নিঃশব্দে ঢাকা ফিরে আসছেন।
তবে আমি ছাড়াও শেখ মুজিবের সেদিনের বিমানবন্দর অভ্যর্থনায় কাকতালীয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন অন্যদলের দুজন শীর্ষ রাজনীতিক। একজন শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহিউদ্দিন আহমদ ,যিনি ৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারির প্রাককালে ফরিদপুর জেলে অনশন ধর্মঘটে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন।আর একজন নিখিল পাকিস্তান ন্যাপের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীণ পাকিস্তান আওয়ামি লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। করাচির জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের অতি ঘনিষ্ঠ মিত্র মাহমুদুল হক ওসমানি। মুজিবের সহযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদ তখন পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা। হেলিকপ্টার ফ্লাইটে করে ফরিদপুরে একটা দলীয় জনসভায় যাওয়ার জন্যে তাঁরা দুজন বিমান বন্দরে অপেক্ষমান ছিলেন।
শেখ মুজিব একটা লম্বা টেবিল দখল করে সবাইকে নিয়ে জেঁকে বসলেন। সবার সামনে ৬ দফার পান্ডুলিপি উন্মোচন করে কথিত সাংবাদিক সম্মেলন সম্পন্ন করলেন।
৬দফার কয়েকটা জেরোক্স কপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, “ইত্তেফাক, সংবাদ, মর্ণিং নিউজ অবজার্ভারে পৌছে দিস।সন্ধ্যার সময় আমি সবার সাথে কথা বলবো “ কোন পত্রিকায় কার হাতে দেবো তাও বলে দিলেন।
১৩ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে প্রথম বিবৃতি দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, আব্দুল্লাহ আল হারুন, এম এ হান্নান, জানে আলম দোভাষ, আবুল কাশেম (সাব-জজ) প্রমুখ। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি বিবৃতির মাধ্যমে ছয় দফার প্রতি সংহতি প্রকাশ করলো।আওয়ামি লীগ সভাপতি মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সহ সিনিয়ার নেতাদের অনেকেই ছয় দফার বিরোধিতা করলেন। কিন্তু ছাত্রলীগ শেখ মুজিবের পক্ষ্যে দৃঢ় অবস্থান গ্রহন নিলো।
এই প্রেক্ষিতে ৬৬-এর ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের যুগান্তকরী কাউন্সিল অধিবেশন। দলের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়ে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন শুরু হয়। কাউন্সিল সভায় আগত ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে দলের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে।আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিলটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন। যা ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এ মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল।জনগনের সার্বভৌমত্বে যাদের বিশ্বাস ছিলনা তেমন গোঁড়া ও রক্ষণশীলরা দল থেকে ঝরে পড়লেন। ছয় দফা আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হিসেবে অনুমোদন লাভ করলো। মিজান চৌধুরির ঈমান নড়বড়ে ছিল। উত্তরকালে তিনি দলছেড়ে স্বনামে উপদল গঠন করেন এবং আর এক দল ছুট নেতা আতাউর রহমান খানের মত স্বৈরাচার এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হন।
১৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা প্রত্যাখ্যান করলো কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে প্রথম জনসভা করে জনমত গঠন শুরু করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৪ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ১৮ মার্চ কনভেনশনে মুসলিম লীগের সম্মেলনে গভর্নর মোনায়েম খান গৃহযুদ্ধের হুমকি দেন।
কনভেনশনে মুসলিম লীগের সম্মেলনে আগত আইয়ুবের মন্ত্রী ভুট্টো ছয় দফা প্রশ্নে প্রকাশ্য বিতর্কের চ্যালেঞ্জ জানালেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাজউদ্দীন আহমদ পত্রিকার মাধ্যমে ভুট্টোকে পল্টন ময়দানে এসে ডিবেটে যোগ দেয়ার জন্যে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন । প্রকাশ্য বিতর্কের এই চ্যালেঞ্জ দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি করলো। কিন্তু ‘সময়ের অভাব’ অজুহাতে বাকপটু ভুট্টো রণে ভঙ্গ দিলেন।
সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রবল বিরোধিতার পাশাপাশি এসময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গণপ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হতে শুরু করে। ১৮ এপ্রিল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বারবার গ্রেপ্তার করে যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠানো হয়। ৯ মে আবার তাঁকেসহ আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর মুক্তিচেয়ে সদ্য পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগ ছয় দফার পক্ষে হরতাল আহ্বান করে ৭ জুন। দলকানা শহুরে বামপন্থীরা সহযোগিতা করেননি। কিন্তু যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্দুর রব সেরনিয়াবত, আব্দুস সামাদ আজাদ, বিশ্ব শান্তি পরিষদের পাকিস্তান চ্যাপটারের নেতা কমরেড আলী আকসাদ , বঙ্গবন্ধুর ইসলামিয়া কলেজের সহপাঠী “ভাসানী যখন ইউরোপ “ গ্রন্থের খ্যাতিমান লেখক সিনিয়ার সাংবাদিক খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ( উত্তর কালে মুজিব বাদ গ্রন্থরচয়িতা) সহ বহু বাম নেতা সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিনের হাত ধরে শেখ মুজিবের পাশে দাড়িয়েছিলেন। তাঁদের সহযোগী হয়েছিলেন প্রগতিশীল শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের দুর্বল শ্রমিক লীগ ছিল ফ্রন্ট লাইন ফাইটার।সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় শেখ মুজিব ও তাঁর অমর কীর্তি ছয় দফার পক্ষে ৭ জুন ঐতিহাসিক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের পাশাপাশি আদমজী পাটকল ও তেজগাঁ শিল্পাঞ্চলের হাজার হাজার সর্ব দলীয় ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকনেতা কর্মীরা ঢাকাকে উত্তাল করে তোলেন ছয় দফার সমর্থনে। পুলিশের গুলিতে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, আদমজীতে মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়।
‘ জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু ’৬৬-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় ‘ছয় দফা’কে ‘নতুন দিগন্তের নতুন মুক্তিসনদ’ উল্লেখ করে চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘একদিন সমগ্র পাক-ভারতের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসন ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলের বীর সন্তানেরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই , ‘পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য দাবি আদায়ের সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন হোক।’
‘
সফলভাবে সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের পর বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় বক্তৃতা করেন। লাগাতার জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় ‘ছয় দফা’র সপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে নির্মম গ্রেফতার-নির্যাতন। প্রত্যেক জেলা থেকে জারিকৃত ওয়ারেন্ট বলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ‘ছয় দফা’ প্রচারকালে মাত্র আড়াই মাসে বঙ্গবন্ধুকে সর্বমোট ৮ বার গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ ‘মে দিবস’ স্মরণে নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক-জনতার মহাসমাবেশে ভাষণদান শেষে ৮ মে রাত ১টায় বাসায় ফিরলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।
উপসংহার
‘ছয় দফা’ দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে এবং দেশরক্ষা আইনে আওয়ামী লীগের উপর গ্রেফতার-নির্যাতন চালায়। প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ‘ছয় দফা’র প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। দলের নব-নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘সাতই জুন’ সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ৭ জুনের হরতালে পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়।তারই ধারাবাহিকতায় ২০ জানুয়ারি ৬৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও শিবপুরের কৃষকআন্দেলনের পুরোধা আসাদুজ্জামান পুলিশের পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জে দাড়িয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেন। ২৪ জানুয়ারি ঢাকা নবকুমার স্কুলের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান মিছিলে যুক্ত থেকে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়।উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সারা দেশ। এই পরযায়ে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান হৃদ রোগে আক্রান্ত হন।ক্ষমতা গ্রহন করেন প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খান।জনরোষে আগরতলা মামলার কেন্দ্রীয় দফতর বর্ধমান হাউজে ( বর্তমান বাংলা একাডেমি ভবন) সংরক্ষিত মামলা সংক্রান্ত সকল নথিপত্র ভষ্মিভূত হয়।মামলার আইও ছিলেন কর্ণেল মুস্তাফিজুর রহমান।তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী সব্যস্ত করে চার্জশীট দাখিলের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন।মামলা চালু থাকলে আগরতলা মামলায় প্রধান আসামী শেখ মুজিবুর রহমান ও ২য় প্রধান আসামী নৌবাহিনী কমান্ডার সহ ৩৫ জন অভিযুক্তকেই ফাসিতে মৃত্যুবরণ করতে হ’ত। উল্লেখ করা যায় যে মামলা চলাকালে অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক কে ক্যান্টনমেন্টের ভিতর হত্যা করা হয়। কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে হত্যা করা হয় ২৫ মার্চ ৭১ মধ্যরাতে।আরও একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার যে আগরতলা মামলার আইও কর্ণেল মুস্তাফিজ উত্তরকালে বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন।
আমার ডায়রিতে লেখা আছে যে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান সহসকল রাজবন্দীর মুক্তি লাভ করেন।২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে ফিনিক্স পাখির মত পুনর্জীবন পাওয়া শেখ মুজিব’ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।
’৬৯-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পালনকালে বাম ছাত্র সংগঠনসহ ৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ছয়-দফাকে এগারো দফায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ১১ দফা ছড়িয়ে দেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে ছয় দফা ধারিত এগারো দফা আন্দোলনের সপক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়। বিভক্ত বাম শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবশেষে ৬দফাকে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বাহন মেনে নিলে দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ১৯৫৭ সালে হাইজ্যাক হয়ে যাওয়া প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্য সেই যুগ সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্যের স্বরূপে ফিরে আসে।
বঙ্গবন্ধু এভাবে ধাপে ধাপে শক্ত মাটির উপর পা রেখে ৭ মার্চ ৭১ সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেন। ফলশ্রুতিতে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে , কমরেড মণিসিং,অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ ও মনোরঞ্জন ধরকে সদস্য করে ভারতের মাটিতে স্বাধীনবাংলা প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।তা না হলে রুশ-ভারত মৈত্রীর কামান দেগে ৭ম নৌবহরের আগ্রাসন ও পাকিস্তানের সপক্ষে চৈনিক সমর্থন ঠেকানো সম্ভব হ’ত না।
ইতিহাস শিক্ষা দেয় জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে বাম প্রগতিশীল শক্তির রাখি বন্ধন না হলে কোন দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সফল হয় না।আর সেই ঐক্যকে চোখের মনির মত লালন না করলেও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লালিত প্রতি বিপ্লবকেও প্রতিহত করা যায়না।কোন দেশে বিপ্লব একদিনে যেমন জন্ম নেয়না তেমনি একদিনে শেষও হয়না। জনতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে হাটি হাটি পাপা করে বিপ্লব সম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে যায়। সেই সাথে পায়ে পায়ে হাটে প্রতি বিপ্লব। নানা বর্ণে তার পল্লব প্রসারিত হয়। তাকে নির্মূল করার জন্যে বিপ্লবকে নির্দয় ও নির্মম হতে হয়।এ পন্থার কোন বিকল্প নেই।
বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির ইতিহাসের টার্ণিং পয়েন্ট ৭ম মার্চ গণঅভ্যুত্থানের ১১ শহীদ, বঙ্গবন্ধুর শহীদ পরিবার ও ৭১ এর মহাযজ্ঞে আত্ম উৎসর্গকারী সকল শহীদ,বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা মুক্তিসেনাদের প্রতি এই নিবেদনে বিশ্ব নন্দিত “অন্যদেশ” এর পক্ষ্য থেকে নত মস্তকে অসীম শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
লেখক: কলাম লেখক ও সাংবাদিক